শিল্প ও সংগ্রামে by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। বি কে জাহাঙ্গীর নামেও সাধারণ্যে পরিচিত। সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার জগতে যুগপৎ সাবলীল পরিভ্রমণে সক্ষম মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রমীদের অন্যতম তিনি। শিল্প-সাহিত্যের নানা পথে মেধাবী পদচারণা ছয় দশকের বেশি সময়জুড়ে।
কবিতার জন্য গল্পের জন্য আলোচিত হতে শুরু করেছিলেন গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই। দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তানের আচ্ছন্নতা মুক্ত থেকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা তথা সমাজ রূপান্তরের বোধসম্পন্ন চিন্তার সংস্পর্শে আসেন বলতে গেলে কিশোর বয়সেই। তারপর থেকে আজ অবধি আমাদের ভূখ-ে মানুষের বাসযোগ্য সমাজ মানুষের বাসযোগ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ও কর্মে নিযুক্ত বি কে জাহাঙ্গীর। তবে তাঁর চিন্তা ও কর্ম নিতান্ত নিজ-ভূগোল প্রীতিতে আচ্ছন্ন না থেকে সম্প্রসারিত-ভুবন দৃষ্টিকে পরম-প্রয়োজনীয়তা হিসাবে মান্য করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দীর্ঘজীবনে তত্ত্বকে ভেঙে দেখানোর দক্ষতা, তত্ত্বকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানোর পারঙ্গমতা আর বৈশ্বিক জ্ঞানকা-ের সর্বশেষ অগ্রগতিগুলোর বিষয়ে অতি সাবলীল পর্যালোচনার সক্ষমতায় ঋদ্ধ করেছেন অগণিত শিক্ষার্থীকে। বিপ্লব, জাতীয়তাবাদ, মৌলবাদ, কৃষক সমাজ, ধনতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা, রাষ্ট্রিক সন্ত্রাস, লড়াই-সংগ্রামে নারীর ভূমিকাসহ প্রাসঙ্গিক নানাবিধ বিষয়ে বি কে জাহাঙ্গীরের প্রজ্ঞাপূর্ণ অবিরাম লেখালেখির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চিত্রকলা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া বোদ্ধার সংখ্যাও অনেক বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করলেও নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বি কে জাহাঙ্গীরের কর্মপরিধি ব্যাপক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ বলতে গেলে তাঁর হাতেই তৈরি। গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে তাৎপর্যবাহী জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিবিড় অবদান রেখে চলেছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র।’ বলা যায় ‘সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র’কে ঘিরে তৈরি হয়েছে জ্ঞানচর্চার সুনির্দিষ্ট একটি ধারা। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত গবেষণা-জার্নাল ‘সমাজ নিরীক্ষণ’ ও ‘জার্নাল অব সোশ্যাল স্টাডিজ’ এ নিয়মিত লেখালেখি করেন দেশ-বিদেশের গবেষক ও প-িতরা।
বি কে জাহাঙ্গীরের তাঁর জীবন ও চিন্তা নিয়ে জুলাই মাসজুড়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে। দৈনিক জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য মাস-দীর্ঘ এই আলোচনাটির প্রথম অংশটি ছাপা হচ্ছে। এই অংশে বি কে জাহাঙ্গীরের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের নানা স্মৃতি, নানা যুক্ততার বিবরণ-বিশ্লেষণ, মানস গঠনে প্রভাব সৃষ্টিকারী ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। বি কে জাহাঙ্গীরের অনবদ্য কথা-শৈলীর বরাতে পাকিস্তানের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তির নয়া-বিন্যাসের উত্থানপর্বেরও হদিস পাওয়া যাবে এখানে।
ঝালকাঠিময় শৈশব স্মৃতি
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জন্ম চাঁদপুরের কচুয়ার গুলবাহার গ্রামে। ১৯৩৬ সালে। গুলবাহারকে ঘিওে শৈশবের কোন স্মৃতি তাঁর নেই । শৈশব স্মৃতির প্রতি পরতে জড়িয়ে আছে ঝালকাঠি। চাঁদপুরের মানুষ ঝালকাঠিতে কী? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “বাবা ছিলেন ঝালকাঠি সরকারী স্কুলের শিক্ষক; আসলে উনি ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ঝালকাঠি স্কুলের ছাত্ররা বেশ একটা ভূমিকা রাখে। আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে পরে ব্রিটিশরা এই স্কুলকে নানান সমীকরণ থেকে সরকারীকরণ কওে ফেলে। কিন্তু সে সময় আবার মুসলিম শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছিল না চাহিদামতো; তখন আমার আব্বার পরিদর্শকের পদ পালটে ঐ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়, যার সুবাদে আমাদের পরিবার ঝালকাঠিতে যায়।” এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা।
বি কে জাহাঙ্গীর এখনো, প্রায় সাত দশক পরেও বিনা আয়াসে স্মরণ করেন ঝালকাঠি। তাঁর মনে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ শাসকদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কথা। আম্মা যেদিন আব্বাকে জানান, ‘ঘরে একটুও চাল নেই’ সেদিন প্রথম দুর্ভিক্ষ ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেন। “মণকে মণ চাল আমরা কিনতাম না কিন্তু যখন যা লাগত কেনা হতো। সেবার অন্যরকম দেখা গেলো; আব্বা চাল যোগাড় করতে পারছেন না।” এর কিছুদিনের মধ্যে দুর্ভিক্ষ একেবারে চাক্ষুষ হয়ে ওঠে। ঝালকাঠি বাজারজুড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ আর মানুষ। হাতপাতা মানুষ। সবখানে ‘কিছু দ্যান’ আওয়াজ। ভাত না হোক ভাতের মাড়। তখন প্রাইমারী যাওয়া জাহাঙ্গীরের মন সাংঘাতিক আলোড়িত হতে থাকে। আব্বার ভূমিকা ছিল দারুণ সে সময় “লঙ্গরখানা, চাউল বিতরণ, অনাহারে মৃতের দাফনে কাটাতেন সারাদিন।”
মনে রয়ে গেছে ঝালকাঠিতে গোরা সৈন্যদের তৎপরতা। বাজাওে যেদিকটায় থানা ছিল সেদিকে আস্তানা নিয়েছিল গোরারা। নদীর নৌকাগুলো ফুটো করে দিচ্ছে গোরারা। এ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বোঝা যায়, জাপানীদের ঢুকে পড়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশদের গৃহীত পোড়ামাটি নীতির আওতা থেকে ঝালকাঠির মতো বলতে গেলে প্রত্যন্ত এক এলাকাও বাদ পড়েনি। ঝালকাঠির সঙ্গে দেশভাগের স্মৃতি ওতপ্রোত হয়ে আছে বি কে জাহাঙ্গীরের মধ্যে। তখন দেশভাগের আগের বছরগুলো। নিতান্ত বালক জাহাঙ্গীর সহসা লক্ষ্য করেন “হিন্দু সহপাঠীদের সঙ্গে কেমন যেন একটা দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা অনবরত হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি যেতাম। হিন্দু সহপাঠীরা একটু কম হলেও আমাদের বাড়ি নিয়মিত আসত।” হঠাৎ যেন এসবে ছেদ পড়তে থাকল। সেই যে স্কুলের স্কাউট শিক্ষক রমেশ বাবু স্যার; দারুণ ফুটবল খেলতেন। অকৃতদার রমেশ স্যার মাঝে-মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যেতেন; বিধবা বোনটির বানানো খাবার খাওয়াতেন। সেই প্রথম বুঝতে পারা যে হিন্দু বাড়ি আর মুসলিম বাড়ির খাবারে কিছু তফাৎ আছে। দেশভাগের হাওয়ায় সেসব যাওয়া-যাওয়িতে কেমন যেন ভাটা লাগে। ঝালকাঠি নিয়ে কথায় বি কে জাহাঙ্গীরের মনে আসে জ্ঞানবাবুকে। ডাক্তার মানুষ। একটা লঞ্চ ছিল। ওটা নিয়ে গ্রামে-গ্রামে রোগী দেখে বেড়াতেন। ছিলেন আব্বার সহকর্মী হেমবাবু স্যার। “সাইকেলটা চালিয়ে আমাদের বাড়ি এসে বলতেন, তোমার আম্মার কাছ থেকে মুরগির ডিম নিয়ে আস। আমি এনে দিতাম। আম্মা মুরগি পালতেন।”
শৈশবের ঝালকাঠির আরো অনেকের কথা মনে আছে, তবে আজিজ ভাইয়ের মতো আর কাউকে নয়। সেই যেদিন আম্মা আব্বাকে জানিয়েছিলেন ঘরে চাল নেই সেদিন আজিজ ভাই বিষখালী নদীর অপর পাড়ে গিয়ে আধা বস্তা চাল যোগাড় করে এনে দিয়েছিলেন। এমনিতেও বাড়ি থেকে আসার সময় দুধ নিয়ে আসতেন প্রতিদিন। সকালে এসে নাস্তা সেরে জাহাঙ্গীর ও অন্য ভাইবোনদের পড়াতে বসতেন। যেদিন আজিজ ভাইকে থানার বারান্দাতে কোমরে দড়ি অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেল সেদিনকার মতো আঘাত এর আগে কখনও পাওয়া হয়নি বালক জাহাঙ্গীরের। করেছেন কী আজিজ ভাই? কী করেছেন আজিজ ভাই? ঘুরে ঘুরে একই প্রশ্ন একে-তাকে। পরে এক কনস্টেবল সাহেব জানান, “আজিজ বড় সাংঘাতিক লোক! সে চুরি-ডাকাতির চেয়েও অধম কাজ করেছে। সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে টেলিগ্রাফের লাইন কেটে দিয়েছে।” কনস্টেবল সাহেবের কথা মাথায় ঢুকে না। পরে আব্বা বলেন, ‘আজিজ রাজনীতি করে। সে সোশ্যালিস্ট পার্টি করে।‘ ততদিনে কংগ্রেসের নাম জানা হয়ে গেছে, মুসলিম লীগের কথাও। এদেরকে দেখা যায় ঝালকাঠিতে। কিন্তু সোশ্যালিস্ট? সেটা কী? জিজ্ঞেস করলে আব্বার উত্তর, ‘বড় হও, তখন বুঝবে।’ শব্দটা মাথায় রয়ে যায় কিন্তু কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যান আজিজ ভাই। জানা যায় আজিজ ভাইয়ের জেল হয়েছে।
কিছুদিন জেল খেটে প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে আবার ঝালকাঠিতে আসেন আজিজ ভাই। তবে তখন থেকে তিনি থাকতেন বরিশালে। ঝালকাঠি আসার সময় জাহাঙ্গীরদের জন্য নিয়ে আসতেন বই। একটা লাইব্রেরিও গড়ে দিয়েছিলেন। পাঠ্যপুস্তকের নয়, ‘আউট বই’ এর লাইব্রেরি। আব্বার সহায়তায় আজিজ ভাইয়ের গড়া লাইব্রেরি নিয়ে বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “সেখানে ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতির মতো অনেক বই ছিল। আজিজ ভাই যখনই আসতেন তখনই আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন আর আমাদের পড়া বইগুলো নিয়ে আলাপ করতেন।” একটা সময় এসে জানা গেল আজিজ ভাই আরএসপি অর্থাৎ রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত।
জিজ্ঞাসা করি, আজিজ ভাই কি আপনাকে বা আপনার সহপাঠীদের কাউকে তাঁর পার্টিতে নিতে চেয়েছিলেন?
“না। তেমন কিছু তিনি করেননি। তবে তিনি আমাদের মাথায় কতগুলো প্রশ্ন আর তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের লোকেরা গরিব কেন? এর জন্য দায়ী কারা। জানিয়েছেন যে এসবের জন্য দায়ী ইংরেজরা। আমাদের মুক্তির পথে অন্তরায় কট্টর হিন্দু আর কট্টর মুসলিমরা। হিন্দু মহাসভা। মুসলিম লীগ। এরকমসব কথা বলতেন আজিজ ভাই।” আলাপে মনে হয় মুক্তমনা পিতার কথা বাদ দিলে, এই গৃহশিক্ষক মোহাম্মদ আজিজ হচ্ছেন বি কে জাহাঙ্গীরের শৈশবে মানসগঠনে বড় ছাপ রেখে যাওয়া প্রথম মানুষ।
ঝালকাঠি নিয়ে কথাগুলো বলার সময় নিজের অজান্তেই কি গলা একটু ধরে আসে বি কে জাহাঙ্গীরের? কে জানে? দক্ষিণবঙ্গের এই জনপদ নিয়ে তাঁর স্মৃতি মনে হয় অফুরান। যেন দেখতে পাচ্ছেন এখনও ঐ যে নদীর পার ধরে চলতে থাকা রাস্তা; হাওয়াতে শনশন দু’পাশে ঝাউগাছ। রাস্তার মাথাতে সরকারী লাশকাটা ঘর। ওটার আশপাশে পৌঁছলেই কি ভয় কি ভয়। নাক-কান বুজে একদৌড়ে জায়গাটা পার হয় জাহাঙ্গীর ও সাথীরা। ভয় লাগে তবু রাস্তাটা টানে।
ঝালকাঠিতে থাকার সময় মধুর স্মৃতিগুলোর দুয়েকটি শুনতে চাওয়া হলো।
“একবার কলকাতা থেকে নাটকের দল এসেছে। বড় হয়ে বুঝেছিলাম ওরা ছিল কমিউনিস্টপন্থী আইপিটিএ।” ‘ছেঁড়াতার’ নাটক হবে হিন্দুদের সঙ্কীর্তনের থানে। জাহাঙ্গীররা ঘুর ঘুর করে। টিকেট কেনার পয়সা নেই। কিন্তু নাটক দেখা চাই যে। শেষে দলের নাটকের দলের এক কর্তা সবাইকে বসিয়ে দেয় মঞ্চের সামনে বসানো শতরঞ্চিতে। “আমরা সবাই, আমার হিন্দু সহপাঠীরা, আমার মুসলিম সহপাঠীরা, আমরা একেবারে অভিভূত হয়ে যাই নাটক দেখে” সে কোন এক সন্ধ্যার নাটক নিয়ে এখনও মুগ্ধতা ঝরে কণ্ঠে। মনে আছে, ঘাটে ভিড়ে থাকা জাহাজের আলোতে ঝলমলানো সন্ধ্যাগুলোর কথা। ঝালকাঠিতে তখনো বিজলী বাতি আসেনি। জাহাজগুলো ডায়নামো চালিয়ে আলো জ্বালাত। ছোটদের সে যে কি আকর্ষণ। দল বেঁধে উঠে পড়া হতো জাহাজে। সারেঙ-সুখানীরা বকা লাগাতেন না; শুধু জাহাজ ছাড়ার ভেঁপু বাজলেই নেমে যাবার কথা মনে করিয়ে দিতেন। বাজারের কাছাকাছি ভূ-কৈলাসের জমিদার বাবুদের বাড়িখানাও ছিল ‘দেখার মতো।’ সে বাড়ির স্থলপদ্মের বাগানখানি! দুর্ভিক্ষ দেখতে এসে গান্ধীজী একবার ছিলেন এই বাড়িতে।
গান্ধী মানুষটা কে? কি তাঁর গুরুত্ব? খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি বুঝতে পারছিলেন তখন। সে আমলে ঝালকাঠি পাঠ-আমোদী মানুষের চাহিদা মেটাত দুটি বইয়ের দোকান। একটি নূর মোহাম্মদ মিয়ার। তাঁর দোকানে আজাদ পত্রিকা পাওয়া যেত। আরেকটি দোকান ছিল কৈলাস বাবু। সে দোকানে থাকত আনন্দবাজার পত্রিকা। দেশ তখন হিন্দু-মুসলিম লাইনে সরে যাচ্ছিল; বোঝাই যাচ্ছে। মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে; এদিকে দেশভাগ চূড়ান্ত হয়ে উঠছে। এমনি সময়ে ঝালকাঠিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে থাকে। জাহাঙ্গীর বুঝতে শেখেন ‘হিন্দু-মুসলমানে ঝগড়া করে। হিন্দু-মুসলমানে কাজিয়া করে।’ চেনা ঝালকাঠি অচেনা হতে থাকে যেন। অবস্থা এমন জায়গায় চলে যায় যে ‘আব্বা বলে দিলেন সন্ধ্যার পর একলা বাজারের দিকে যাওয়া যাবে না।’
১৯৪৬ সাল : কৈশোরে ঢাকাতে
আশেক আলী খান-সুলতানা খানম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান মিসবাহউদ্দীন খান মেট্রিক পাস করলে তাকে ঢাকায় পড়তে পাঠানো হয়। সে ধারাবাহিকতাতে চতুর্থ সন্তান তথা দ্বিতীয় পুত্র বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকেও ঢাকায় ভর্তি করা হয়; মুসলিম হাইস্কুলে। থাকার জায়গা হয় ডাফরিন হোস্টেলে। লর্ড ডাফরিনের নামে হোস্টেলের নাম। ঢাকাতে এসে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে রায়টের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন জাহাঙ্গীর। মুসলিম স্কুল ছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমানের বাহাদুর শাহ পার্ক) পাশে। এর একদিকে ছিল হিন্দু-বসত; অন্যদিকে মুসলিম। দু’পক্ষের মধ্যে যখন-তখন বেধে যেত। এমনকি স্কুলগুলোতেও ভেদাভেদটা ছিল স্পষ্টÑ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা মুসলিম হাইস্কুলে আর হিন্দুরা পগোজে।
বিপদ হতো না? মানে কার কোন এলাকা এটা নিখুঁত করে মনে রাখাটা তো স্থানীয় ছাড়া অন্যদের জন্য মুশকিল।
“কখন যে কোন এলাকায় কে ঢুকে পড়ত। বড় বিপদের দিন ছিল সেগুলো। প্রায়ই দাঙ্গা লাগত। স্কুলের কাছাকাছি একটা চার্চ ছিল। হঠাৎ রাস্তায় দাঙ্গা লেগে গেলে কয়েকবার চার্চে ঢুকে পড়েছিলাম। ফাদার আমাদের অভয় দিতেন। তাঁতীবাজারের মোড়ে ধুতি পরা একজন মানুষ আমাকে একদিন বাঁচিয়েছিলেন। ঐ এলাকাটা মুসলমানদের জন্য নিরাপদ নয় এটা মনেও করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে থেকেছিলেন আর আমি এক দৌড়ে মুসলিম এলাকায় ঢুকে পড়েছিলাম।” অনেক দিন পরে আবার দেখা হলে জানা যায় ভদ্রলোক কমিউনিস্ট পার্টি করেন।
ধর্মের ভিত্তিতে তখন দেশভাগ হবে-হচ্ছে। কিন্তু কিশোর জাহাঙ্গীরের মনোভূমিতে সে ঘটনা প্রধান উপাদান হয়ে উঠেনি। ততদিনে ‘আমি পালটে যাচ্ছি’ এই অনুভূতিটা নিজের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। লেখালেখির শুরুটাও ঠিক এই সময়টাতেই। ততদিনে সখ্য হয়েছে হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরের লেখালেখিতে ব্যাপক উৎসাহ হাসানের। তখন আরো পরিচয় হয়েছে আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীনের সঙ্গে, যিনি কিনা ‘দারুণ কমিউনিস্ট।’ আরো ছিলেন ‘লম্বা টুপি পরা’ জয়নুদ্দীন স্যার যিনি শোনাতেন রুশ বিপ্লবের কাহিনী। একসময় জানা গেল ‘এই দাঁড়ি-টুপির মানুষটা কমিউনিস্ট।’ আরেকজন শিক্ষকও, আবুদল্লাহ উপন্যাসের লেখক কাজি এমদাদুল হকের ছেলে, ছিলেন বামপন্থী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরিব মুসলিম পরিবার থেকে আসা ছাত্রদের পড়ানো মুসলিম হাইস্কুলের অনেক শিক্ষকই গোপনে বামপন্থী ছিলেন। আর ছিলেন হোস্টেল সুপার - মৌলানা আম্বর আলী; ইনি লেখক মনজুরে মাওলার বাবা। এঁর আরেক পরিচিতি হচ্ছে, “ইনি একসময় আব্বার কলিগ ছিলেন। তাঁর সুবাদে নানা সুবিধা পেয়েছি। কি বই পড়ছি না পড়ছি তা কেউ দেখতে আসত না। আমি আসলে কপিবুক মুসলিম ছাত্র ছিলাম না; নামাজ পড়তাম না।” বি কে জাহাঙ্গীরের ধারণা এসব লোকজনের সান্নিধ্য আর অবাধে বই পড়তে পারার সুযোগের মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ব্যাপারটা ঘটে চোখের সামনে। নতুন পতাকা, স্কুলে প্যারেডে ও মিষ্টি বিতরণে নতুন দেশের জন্ম অনুভূত হলো।
কেমন লাগছিল সেদিনগুলোতে? জানতে চাওয়া হলো।
‘আমি দুঃখিত বা আনন্দিত কোনটাই হইনি।’
এটা কি ব্যতিক্রমী নয়?
“আসলে হিন্দু হলেই খারাপ আর মুসলমান হলেই ভালো এরকম মনোভাব আমার মধ্যে গড়ে ওঠেনি। আরেকটা কথা হচ্ছে, ছাত্রদের মধ্যেও তেমন বিপুল কোন উদ্দীপনা দেখিনি। পাকিস্তান হয়েছে ঠিক আছে এরকম একটা ব্যাপার।” ঢাকাতে নবাববাড়ী, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগের মতো কয়েকটি এলাকাতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বেশ একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল; পুরো শহরে নয়। এর একটা কারণ হচ্ছে তখনকার দিনে মুসলিম পরিবারের ছাত্ররা ম্যাট্রিক পাস করলেই কলকাতা চলে যেতেন; ঢাকায় থাকতেন না। ফলে পাকিস্তান নিয়ে ঢাকাতে মাতামাতি সংঘটিত করার লোক খুব একটা ছিল না। এ সময় বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বামপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগও হতে থাকে।
সে সময়টাতে তো সবকিছু পাকিস্তানময়। তাই না?
“ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখবেন সে সময় আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি শক্তি অর্জন করছে; মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। হিন্দু কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। একটা বোধ তৈরি হচ্ছে।”
আলোচনার মধ্যে একফাঁকে ঢুকে পড়ে সেকালের ঢাকা। সেকালের সদরঘাট খুব সুন্দর একটা জায়গা ছিল। লোকে বেড়াতে যেত। বি কে জাহাঙ্গীরদের যাওয়া ছিল নিয়মিত। হোস্টেল থেকে দূওে তো নয়। তখন সিনেমা হল ছিল মুকুল, রূপমহল। কাছাকাছি ছিল হিন্দুদের পরিচালিত এক কেবিন। এতদিনে নাম আর মনে নেই। তবে কেবিনে বানানো কাটলেটের স্বাদ মনে আছে। টানাটানির পকেটে প্রায়ই একটা সমস্যায় পড়তে হতোÑ সিনেমা না কাটলেট? একসঙ্গে দুটো হবার নয়। অত পয়সা আসবে কোত্থেকে? এমনিতে হোস্টেলে বাকি পড়ত মাঝেমধ্যে। হোস্টেল সুপার এজন্য কখনো তাড়া দিতেন না। স্কুলের বন্ধুরা সব হারিয়ে গেছে। স্কুলের বেশিরভাগ ছেলে আশপাশের ব্যবসায়িক পরিবারের। এরা মেট্রিকটা পাস করেই ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকে যেত। বছরখানেক আগে ওয়াসার এক ইঞ্জিনিয়ার রসমালাইয়ের ভা- নিয়ে দেখা করে যান; ইনি মুসলিম হাইস্কুলে সহপাঠী ছিলেন বি কে জাহাঙ্গীরের। অন্যরা কে যে কোথায় আছে জানা নেই।
জাহাঙ্গীরদের স্কুলকালেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দম্ভোক্তি, ‘উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ প্রতিবাদের গরম হাওয়াটা গায়ে লাগতে শুরু করে প্রথম থেকে। এই সময়টা গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনেরও - এটা বি কে জাহাঙ্গীর কখনোই ভুলে যান না। তাই তাঁর সৃষ্টিশীলতা আর মননশীলতার চর্চাতে কৃষক বিদ্রোহ ঘুরে-ফিরে স্থান করে নিয়েছে অবিরত। আলোচনা যত দিন গড়িয়েছে লক্ষ্য করা গেছে একই ব্যাপার। চৈতন্যে কৃষকের লড়াই স্থান করে নেয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন একদিন সদরঘাটে আমাকে ধরলেন। বর্শাধারী এক হাজংয়ের পোস্টার দিলেন। হাজংদের বিদ্রোহ নিয়ে কথা বললেন। আমি যোগ দেব কিনা জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ভেবে দেখি।” পরের দেখা হবার কথা ছিল তা আর হয়নি; পার্টির নির্দেশে মুতি চলে গেছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তবে তাঁর বলা কথাগুলো দেয়া পোস্টারটি গভীর ছাপ ফেলে বি কে জাহাঙ্গীরের মনেÑ ‘হাজং বিদ্রোহ’ বা এমন একটা কিছু শিরোনামে একটা গল্প লেখা হয়ে যায়। সে লেখা হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে। কিন্তু হারায়নি কৃষকের লড়াই আর কৃষকের জীবন জানার আগ্রহ। মনে পড়ে গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পর্যায়ে ‘সমাজ পরিবর্তন’ বিষয়ক কোর্স আর মাস্টার্সে ‘পাবলিক পলিসি’ পড়ানোর সময়েও আমাদের স্যার অধ্যাপক বি কে জাহাঙ্গীর প্রভূত গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সামনে আলোচনা করতেন বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, বিদ্রোহের স্বরূপ। ‘বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ও শ্রেণী সংগ্রাম’ সম্ভবত এপ্রসঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণতম কাজ।
পাকিস্তান তৈরি হয়ে যাওয়াতে কি ধরনের আবেগ-অনুভূতি বোধ করছিলেন এ ব্যাপারটা বার বার কিছুটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কয়েকদিন ধরেই জানতে চাওয়া হচ্ছিল। একদিন তিনি বললেন, “শুনুন, পাকিস্তান আন্দোলনের আগে থেকেই চলছিল কৃষক আন্দোলন। আর সে সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের লোকেরা ব্রাইট মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ফলে আমাদের মতো পড়াশোনাতে আগ্রহী ছেলেরা পাকিস্তান নিয়ে নয় গণআন্দোলন নিয়ে বেশি ভাবিত হতে শিখেছিল।”
ভাষা আন্দোলন সূচনাপর্ব প্রসঙ্গে বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “১৯৪৭ সাল থেকেই একটা বিষয় আমরা টের পেতে থাকি। বাঙালীরা নতুন গঠিত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সরকারী পর্যায়ে বাংলা নেই! কিভাবে মানবো?” জিন্নাহর ঘোষণা আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
১৯৫০ : এবার ঢাকা কলেজে
সময় যায় দেখতে-দেখতে। ১৯৫০ সাল। ঝালকাঠির বালক, মুসলিম স্কুলের কিশোর ততদিনে তরুণ তুর্কি বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। স্কুল পাড়ি দিয়ে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা কলেজে। এবারের থাকবার জায়গা বেগম বাজারের নূরপুর ভিলা। তখন ঢাকা কলেজের হোস্টেল আরো দুটি ছিল মোস্তফা হাউস আর ঢাকা কলেজ হোস্টেল। ঢাকা কলেজে এসে শিক্ষক হিসাবে পাওয়া গেল হেমায়েত উদ্দীন সাহেবকে; ইনি প্রকাশ্য কমিউনিস্ট। অর্থনীতি পড়াতেন ন্যাপের মোজাফফর আহমদ। এ সময় আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির লিফলেট হাতে আসতে শুরু করে। নিয়ে আসতেন পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাতিমান ওয়াহিদুল হক।
তখন কি পার্টিতে যোগ দেয়ার ডাক পেয়েছিলেন?
“ব্যাপারটা এরকমের নয়। তখন পার্টি আহ্বান জানানোর মতো কিছু করত না। পার্টি পর্যবেক্ষণে রাখত। পরে পার্টি সেল থেকে ওকে করে করা হলে তখন যোগদান করানোর প্রশ্ন আসত।”
এ পর্যায়ে এসে কথা বলতে-বলতে মনে হয় আলোচ্য সময়টিতে সরাসরি রাজনীতি নয় বরং গভীরভাবে রাজনীতিক বোধসম্পন্ন থেকে প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার দিক ঝুঁকছিলেন বি কে জাহাঙ্গীর। কলেজ জীবনে তাঁর বন্ধুরা হচ্ছেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ। ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, একটু চুপচাপ টাইপ আর ভাল গল্প লিখতেন। কলেজের বাইরে আমিনুল ইসলাম, মর্তুজা বশীর এই দু’জনও নিয়ে আসত কমিউনিস্ট পার্টির কাগজপত্র। বইপড়ার নেশা ততদিনে তীব্রতর। বই নিয়ে তুমুল আলোচনা মগ্ন থাকে এই তরুণেরা। কিন্তু ভাল বইপত্র কোথায় পূর্ব পাকিস্তানে? তেমন কোন বইয়ের দোকানও তখন নেই ঢাকা শহরে। আরমানীটোলার ওয়ারসি বুক হাউসে পাওয়া যেত কিছু নতুন বইপত্র। কলকাতা থেকে কচ্চিৎ আসা বইগুলো ‘পাগল হয়ে’ কিনতেন জাহাঙ্গীররা। এর বাইরে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি সামান্য কিছু বই আনত। বই পড়ার সুযোগ পাবার জন্য ওয়ারসি বুকের মালিক আবদুল বারী ওয়ারসির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বি কে জাহাঙ্গীর ও তাঁর বন্ধুরা।
আপনার এসময়কার বন্ধু আর কারা? বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা কাদের সঙ্গে?
“বুঝতেই পারছেন আমি তখন মোটামুটি বামের সঙ্গে যুক্ত। একদিন আমার কাছে একটা চিরকুট এলো টক টু জহির। জহির মানে জহির রায়হান। তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ততদিনে বড় নেতা। এঁদের বাবা ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার হোস্টেল সুপার আর এই দুইভাই হচ্ছেন বামপন্থী। গোয়েন্দারা জানত কিন্তু কিছু বলত না। ভাবত মাওলানার ছেলে; এরা তো গবর্মেন্টকে ফেলে দিতে চাইছে না Ñ এরকম একটা ব্যাপার আর কি।”
‘ফর আ লাস্টিং পিস ফর আ পিপলস ডেমোক্র্যাসি’ নামের বুখারেস্ট থেকে প্রকাশিত কমিউনিস্টদের একটি পত্রিকা নিয়মিত আসত শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে। একদিন আলাপে-আলাপে পত্রিকার কপিগুলো দেখতে চাইলে জহির আলুর বাজারে তাঁদের আলিয়া মাদ্রাসার বাসায় নিয়ে যান জাহাঙ্গীরকে। সেখানে দেখা হয় কথা হয় শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে, সদ্য পাস দেয়া ডাক্তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে, এঁদের বাবার সঙ্গে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়। তারপর পত্রিকা দেখতে দেন শহীদুল্লাহ কায়সার। যখন খুশি আসার, বই-পত্রিকা নিয়ে যাবার কথা বললেন তিনি। “আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কেন জহিরের সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছিল বুঝতে পারলাম। আসলে তাঁরা আমাকে এভাবে প্রগতিশীল বইপত্র পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন”, বি কে জাহাঙ্গীর জানান। (চলবে)
বি কে জাহাঙ্গীরের তাঁর জীবন ও চিন্তা নিয়ে জুলাই মাসজুড়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে। দৈনিক জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য মাস-দীর্ঘ এই আলোচনাটির প্রথম অংশটি ছাপা হচ্ছে। এই অংশে বি কে জাহাঙ্গীরের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের নানা স্মৃতি, নানা যুক্ততার বিবরণ-বিশ্লেষণ, মানস গঠনে প্রভাব সৃষ্টিকারী ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। বি কে জাহাঙ্গীরের অনবদ্য কথা-শৈলীর বরাতে পাকিস্তানের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তির নয়া-বিন্যাসের উত্থানপর্বেরও হদিস পাওয়া যাবে এখানে।
ঝালকাঠিময় শৈশব স্মৃতি
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জন্ম চাঁদপুরের কচুয়ার গুলবাহার গ্রামে। ১৯৩৬ সালে। গুলবাহারকে ঘিওে শৈশবের কোন স্মৃতি তাঁর নেই । শৈশব স্মৃতির প্রতি পরতে জড়িয়ে আছে ঝালকাঠি। চাঁদপুরের মানুষ ঝালকাঠিতে কী? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “বাবা ছিলেন ঝালকাঠি সরকারী স্কুলের শিক্ষক; আসলে উনি ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ঝালকাঠি স্কুলের ছাত্ররা বেশ একটা ভূমিকা রাখে। আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে পরে ব্রিটিশরা এই স্কুলকে নানান সমীকরণ থেকে সরকারীকরণ কওে ফেলে। কিন্তু সে সময় আবার মুসলিম শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছিল না চাহিদামতো; তখন আমার আব্বার পরিদর্শকের পদ পালটে ঐ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়, যার সুবাদে আমাদের পরিবার ঝালকাঠিতে যায়।” এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা।
বি কে জাহাঙ্গীর এখনো, প্রায় সাত দশক পরেও বিনা আয়াসে স্মরণ করেন ঝালকাঠি। তাঁর মনে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ শাসকদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কথা। আম্মা যেদিন আব্বাকে জানান, ‘ঘরে একটুও চাল নেই’ সেদিন প্রথম দুর্ভিক্ষ ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেন। “মণকে মণ চাল আমরা কিনতাম না কিন্তু যখন যা লাগত কেনা হতো। সেবার অন্যরকম দেখা গেলো; আব্বা চাল যোগাড় করতে পারছেন না।” এর কিছুদিনের মধ্যে দুর্ভিক্ষ একেবারে চাক্ষুষ হয়ে ওঠে। ঝালকাঠি বাজারজুড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ আর মানুষ। হাতপাতা মানুষ। সবখানে ‘কিছু দ্যান’ আওয়াজ। ভাত না হোক ভাতের মাড়। তখন প্রাইমারী যাওয়া জাহাঙ্গীরের মন সাংঘাতিক আলোড়িত হতে থাকে। আব্বার ভূমিকা ছিল দারুণ সে সময় “লঙ্গরখানা, চাউল বিতরণ, অনাহারে মৃতের দাফনে কাটাতেন সারাদিন।”
মনে রয়ে গেছে ঝালকাঠিতে গোরা সৈন্যদের তৎপরতা। বাজাওে যেদিকটায় থানা ছিল সেদিকে আস্তানা নিয়েছিল গোরারা। নদীর নৌকাগুলো ফুটো করে দিচ্ছে গোরারা। এ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বোঝা যায়, জাপানীদের ঢুকে পড়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশদের গৃহীত পোড়ামাটি নীতির আওতা থেকে ঝালকাঠির মতো বলতে গেলে প্রত্যন্ত এক এলাকাও বাদ পড়েনি। ঝালকাঠির সঙ্গে দেশভাগের স্মৃতি ওতপ্রোত হয়ে আছে বি কে জাহাঙ্গীরের মধ্যে। তখন দেশভাগের আগের বছরগুলো। নিতান্ত বালক জাহাঙ্গীর সহসা লক্ষ্য করেন “হিন্দু সহপাঠীদের সঙ্গে কেমন যেন একটা দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা অনবরত হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি যেতাম। হিন্দু সহপাঠীরা একটু কম হলেও আমাদের বাড়ি নিয়মিত আসত।” হঠাৎ যেন এসবে ছেদ পড়তে থাকল। সেই যে স্কুলের স্কাউট শিক্ষক রমেশ বাবু স্যার; দারুণ ফুটবল খেলতেন। অকৃতদার রমেশ স্যার মাঝে-মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যেতেন; বিধবা বোনটির বানানো খাবার খাওয়াতেন। সেই প্রথম বুঝতে পারা যে হিন্দু বাড়ি আর মুসলিম বাড়ির খাবারে কিছু তফাৎ আছে। দেশভাগের হাওয়ায় সেসব যাওয়া-যাওয়িতে কেমন যেন ভাটা লাগে। ঝালকাঠি নিয়ে কথায় বি কে জাহাঙ্গীরের মনে আসে জ্ঞানবাবুকে। ডাক্তার মানুষ। একটা লঞ্চ ছিল। ওটা নিয়ে গ্রামে-গ্রামে রোগী দেখে বেড়াতেন। ছিলেন আব্বার সহকর্মী হেমবাবু স্যার। “সাইকেলটা চালিয়ে আমাদের বাড়ি এসে বলতেন, তোমার আম্মার কাছ থেকে মুরগির ডিম নিয়ে আস। আমি এনে দিতাম। আম্মা মুরগি পালতেন।”
শৈশবের ঝালকাঠির আরো অনেকের কথা মনে আছে, তবে আজিজ ভাইয়ের মতো আর কাউকে নয়। সেই যেদিন আম্মা আব্বাকে জানিয়েছিলেন ঘরে চাল নেই সেদিন আজিজ ভাই বিষখালী নদীর অপর পাড়ে গিয়ে আধা বস্তা চাল যোগাড় করে এনে দিয়েছিলেন। এমনিতেও বাড়ি থেকে আসার সময় দুধ নিয়ে আসতেন প্রতিদিন। সকালে এসে নাস্তা সেরে জাহাঙ্গীর ও অন্য ভাইবোনদের পড়াতে বসতেন। যেদিন আজিজ ভাইকে থানার বারান্দাতে কোমরে দড়ি অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেল সেদিনকার মতো আঘাত এর আগে কখনও পাওয়া হয়নি বালক জাহাঙ্গীরের। করেছেন কী আজিজ ভাই? কী করেছেন আজিজ ভাই? ঘুরে ঘুরে একই প্রশ্ন একে-তাকে। পরে এক কনস্টেবল সাহেব জানান, “আজিজ বড় সাংঘাতিক লোক! সে চুরি-ডাকাতির চেয়েও অধম কাজ করেছে। সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে টেলিগ্রাফের লাইন কেটে দিয়েছে।” কনস্টেবল সাহেবের কথা মাথায় ঢুকে না। পরে আব্বা বলেন, ‘আজিজ রাজনীতি করে। সে সোশ্যালিস্ট পার্টি করে।‘ ততদিনে কংগ্রেসের নাম জানা হয়ে গেছে, মুসলিম লীগের কথাও। এদেরকে দেখা যায় ঝালকাঠিতে। কিন্তু সোশ্যালিস্ট? সেটা কী? জিজ্ঞেস করলে আব্বার উত্তর, ‘বড় হও, তখন বুঝবে।’ শব্দটা মাথায় রয়ে যায় কিন্তু কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যান আজিজ ভাই। জানা যায় আজিজ ভাইয়ের জেল হয়েছে।
কিছুদিন জেল খেটে প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে আবার ঝালকাঠিতে আসেন আজিজ ভাই। তবে তখন থেকে তিনি থাকতেন বরিশালে। ঝালকাঠি আসার সময় জাহাঙ্গীরদের জন্য নিয়ে আসতেন বই। একটা লাইব্রেরিও গড়ে দিয়েছিলেন। পাঠ্যপুস্তকের নয়, ‘আউট বই’ এর লাইব্রেরি। আব্বার সহায়তায় আজিজ ভাইয়ের গড়া লাইব্রেরি নিয়ে বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “সেখানে ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতির মতো অনেক বই ছিল। আজিজ ভাই যখনই আসতেন তখনই আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন আর আমাদের পড়া বইগুলো নিয়ে আলাপ করতেন।” একটা সময় এসে জানা গেল আজিজ ভাই আরএসপি অর্থাৎ রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত।
জিজ্ঞাসা করি, আজিজ ভাই কি আপনাকে বা আপনার সহপাঠীদের কাউকে তাঁর পার্টিতে নিতে চেয়েছিলেন?
“না। তেমন কিছু তিনি করেননি। তবে তিনি আমাদের মাথায় কতগুলো প্রশ্ন আর তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের লোকেরা গরিব কেন? এর জন্য দায়ী কারা। জানিয়েছেন যে এসবের জন্য দায়ী ইংরেজরা। আমাদের মুক্তির পথে অন্তরায় কট্টর হিন্দু আর কট্টর মুসলিমরা। হিন্দু মহাসভা। মুসলিম লীগ। এরকমসব কথা বলতেন আজিজ ভাই।” আলাপে মনে হয় মুক্তমনা পিতার কথা বাদ দিলে, এই গৃহশিক্ষক মোহাম্মদ আজিজ হচ্ছেন বি কে জাহাঙ্গীরের শৈশবে মানসগঠনে বড় ছাপ রেখে যাওয়া প্রথম মানুষ।
ঝালকাঠি নিয়ে কথাগুলো বলার সময় নিজের অজান্তেই কি গলা একটু ধরে আসে বি কে জাহাঙ্গীরের? কে জানে? দক্ষিণবঙ্গের এই জনপদ নিয়ে তাঁর স্মৃতি মনে হয় অফুরান। যেন দেখতে পাচ্ছেন এখনও ঐ যে নদীর পার ধরে চলতে থাকা রাস্তা; হাওয়াতে শনশন দু’পাশে ঝাউগাছ। রাস্তার মাথাতে সরকারী লাশকাটা ঘর। ওটার আশপাশে পৌঁছলেই কি ভয় কি ভয়। নাক-কান বুজে একদৌড়ে জায়গাটা পার হয় জাহাঙ্গীর ও সাথীরা। ভয় লাগে তবু রাস্তাটা টানে।
ঝালকাঠিতে থাকার সময় মধুর স্মৃতিগুলোর দুয়েকটি শুনতে চাওয়া হলো।
“একবার কলকাতা থেকে নাটকের দল এসেছে। বড় হয়ে বুঝেছিলাম ওরা ছিল কমিউনিস্টপন্থী আইপিটিএ।” ‘ছেঁড়াতার’ নাটক হবে হিন্দুদের সঙ্কীর্তনের থানে। জাহাঙ্গীররা ঘুর ঘুর করে। টিকেট কেনার পয়সা নেই। কিন্তু নাটক দেখা চাই যে। শেষে দলের নাটকের দলের এক কর্তা সবাইকে বসিয়ে দেয় মঞ্চের সামনে বসানো শতরঞ্চিতে। “আমরা সবাই, আমার হিন্দু সহপাঠীরা, আমার মুসলিম সহপাঠীরা, আমরা একেবারে অভিভূত হয়ে যাই নাটক দেখে” সে কোন এক সন্ধ্যার নাটক নিয়ে এখনও মুগ্ধতা ঝরে কণ্ঠে। মনে আছে, ঘাটে ভিড়ে থাকা জাহাজের আলোতে ঝলমলানো সন্ধ্যাগুলোর কথা। ঝালকাঠিতে তখনো বিজলী বাতি আসেনি। জাহাজগুলো ডায়নামো চালিয়ে আলো জ্বালাত। ছোটদের সে যে কি আকর্ষণ। দল বেঁধে উঠে পড়া হতো জাহাজে। সারেঙ-সুখানীরা বকা লাগাতেন না; শুধু জাহাজ ছাড়ার ভেঁপু বাজলেই নেমে যাবার কথা মনে করিয়ে দিতেন। বাজারের কাছাকাছি ভূ-কৈলাসের জমিদার বাবুদের বাড়িখানাও ছিল ‘দেখার মতো।’ সে বাড়ির স্থলপদ্মের বাগানখানি! দুর্ভিক্ষ দেখতে এসে গান্ধীজী একবার ছিলেন এই বাড়িতে।
গান্ধী মানুষটা কে? কি তাঁর গুরুত্ব? খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি বুঝতে পারছিলেন তখন। সে আমলে ঝালকাঠি পাঠ-আমোদী মানুষের চাহিদা মেটাত দুটি বইয়ের দোকান। একটি নূর মোহাম্মদ মিয়ার। তাঁর দোকানে আজাদ পত্রিকা পাওয়া যেত। আরেকটি দোকান ছিল কৈলাস বাবু। সে দোকানে থাকত আনন্দবাজার পত্রিকা। দেশ তখন হিন্দু-মুসলিম লাইনে সরে যাচ্ছিল; বোঝাই যাচ্ছে। মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে; এদিকে দেশভাগ চূড়ান্ত হয়ে উঠছে। এমনি সময়ে ঝালকাঠিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে থাকে। জাহাঙ্গীর বুঝতে শেখেন ‘হিন্দু-মুসলমানে ঝগড়া করে। হিন্দু-মুসলমানে কাজিয়া করে।’ চেনা ঝালকাঠি অচেনা হতে থাকে যেন। অবস্থা এমন জায়গায় চলে যায় যে ‘আব্বা বলে দিলেন সন্ধ্যার পর একলা বাজারের দিকে যাওয়া যাবে না।’
১৯৪৬ সাল : কৈশোরে ঢাকাতে
আশেক আলী খান-সুলতানা খানম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান মিসবাহউদ্দীন খান মেট্রিক পাস করলে তাকে ঢাকায় পড়তে পাঠানো হয়। সে ধারাবাহিকতাতে চতুর্থ সন্তান তথা দ্বিতীয় পুত্র বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকেও ঢাকায় ভর্তি করা হয়; মুসলিম হাইস্কুলে। থাকার জায়গা হয় ডাফরিন হোস্টেলে। লর্ড ডাফরিনের নামে হোস্টেলের নাম। ঢাকাতে এসে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে রায়টের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন জাহাঙ্গীর। মুসলিম স্কুল ছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমানের বাহাদুর শাহ পার্ক) পাশে। এর একদিকে ছিল হিন্দু-বসত; অন্যদিকে মুসলিম। দু’পক্ষের মধ্যে যখন-তখন বেধে যেত। এমনকি স্কুলগুলোতেও ভেদাভেদটা ছিল স্পষ্টÑ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা মুসলিম হাইস্কুলে আর হিন্দুরা পগোজে।
বিপদ হতো না? মানে কার কোন এলাকা এটা নিখুঁত করে মনে রাখাটা তো স্থানীয় ছাড়া অন্যদের জন্য মুশকিল।
“কখন যে কোন এলাকায় কে ঢুকে পড়ত। বড় বিপদের দিন ছিল সেগুলো। প্রায়ই দাঙ্গা লাগত। স্কুলের কাছাকাছি একটা চার্চ ছিল। হঠাৎ রাস্তায় দাঙ্গা লেগে গেলে কয়েকবার চার্চে ঢুকে পড়েছিলাম। ফাদার আমাদের অভয় দিতেন। তাঁতীবাজারের মোড়ে ধুতি পরা একজন মানুষ আমাকে একদিন বাঁচিয়েছিলেন। ঐ এলাকাটা মুসলমানদের জন্য নিরাপদ নয় এটা মনেও করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে থেকেছিলেন আর আমি এক দৌড়ে মুসলিম এলাকায় ঢুকে পড়েছিলাম।” অনেক দিন পরে আবার দেখা হলে জানা যায় ভদ্রলোক কমিউনিস্ট পার্টি করেন।
ধর্মের ভিত্তিতে তখন দেশভাগ হবে-হচ্ছে। কিন্তু কিশোর জাহাঙ্গীরের মনোভূমিতে সে ঘটনা প্রধান উপাদান হয়ে উঠেনি। ততদিনে ‘আমি পালটে যাচ্ছি’ এই অনুভূতিটা নিজের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। লেখালেখির শুরুটাও ঠিক এই সময়টাতেই। ততদিনে সখ্য হয়েছে হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরের লেখালেখিতে ব্যাপক উৎসাহ হাসানের। তখন আরো পরিচয় হয়েছে আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীনের সঙ্গে, যিনি কিনা ‘দারুণ কমিউনিস্ট।’ আরো ছিলেন ‘লম্বা টুপি পরা’ জয়নুদ্দীন স্যার যিনি শোনাতেন রুশ বিপ্লবের কাহিনী। একসময় জানা গেল ‘এই দাঁড়ি-টুপির মানুষটা কমিউনিস্ট।’ আরেকজন শিক্ষকও, আবুদল্লাহ উপন্যাসের লেখক কাজি এমদাদুল হকের ছেলে, ছিলেন বামপন্থী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরিব মুসলিম পরিবার থেকে আসা ছাত্রদের পড়ানো মুসলিম হাইস্কুলের অনেক শিক্ষকই গোপনে বামপন্থী ছিলেন। আর ছিলেন হোস্টেল সুপার - মৌলানা আম্বর আলী; ইনি লেখক মনজুরে মাওলার বাবা। এঁর আরেক পরিচিতি হচ্ছে, “ইনি একসময় আব্বার কলিগ ছিলেন। তাঁর সুবাদে নানা সুবিধা পেয়েছি। কি বই পড়ছি না পড়ছি তা কেউ দেখতে আসত না। আমি আসলে কপিবুক মুসলিম ছাত্র ছিলাম না; নামাজ পড়তাম না।” বি কে জাহাঙ্গীরের ধারণা এসব লোকজনের সান্নিধ্য আর অবাধে বই পড়তে পারার সুযোগের মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ব্যাপারটা ঘটে চোখের সামনে। নতুন পতাকা, স্কুলে প্যারেডে ও মিষ্টি বিতরণে নতুন দেশের জন্ম অনুভূত হলো।
কেমন লাগছিল সেদিনগুলোতে? জানতে চাওয়া হলো।
‘আমি দুঃখিত বা আনন্দিত কোনটাই হইনি।’
এটা কি ব্যতিক্রমী নয়?
“আসলে হিন্দু হলেই খারাপ আর মুসলমান হলেই ভালো এরকম মনোভাব আমার মধ্যে গড়ে ওঠেনি। আরেকটা কথা হচ্ছে, ছাত্রদের মধ্যেও তেমন বিপুল কোন উদ্দীপনা দেখিনি। পাকিস্তান হয়েছে ঠিক আছে এরকম একটা ব্যাপার।” ঢাকাতে নবাববাড়ী, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগের মতো কয়েকটি এলাকাতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বেশ একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল; পুরো শহরে নয়। এর একটা কারণ হচ্ছে তখনকার দিনে মুসলিম পরিবারের ছাত্ররা ম্যাট্রিক পাস করলেই কলকাতা চলে যেতেন; ঢাকায় থাকতেন না। ফলে পাকিস্তান নিয়ে ঢাকাতে মাতামাতি সংঘটিত করার লোক খুব একটা ছিল না। এ সময় বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বামপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগও হতে থাকে।
সে সময়টাতে তো সবকিছু পাকিস্তানময়। তাই না?
“ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখবেন সে সময় আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি শক্তি অর্জন করছে; মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। হিন্দু কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। একটা বোধ তৈরি হচ্ছে।”
আলোচনার মধ্যে একফাঁকে ঢুকে পড়ে সেকালের ঢাকা। সেকালের সদরঘাট খুব সুন্দর একটা জায়গা ছিল। লোকে বেড়াতে যেত। বি কে জাহাঙ্গীরদের যাওয়া ছিল নিয়মিত। হোস্টেল থেকে দূওে তো নয়। তখন সিনেমা হল ছিল মুকুল, রূপমহল। কাছাকাছি ছিল হিন্দুদের পরিচালিত এক কেবিন। এতদিনে নাম আর মনে নেই। তবে কেবিনে বানানো কাটলেটের স্বাদ মনে আছে। টানাটানির পকেটে প্রায়ই একটা সমস্যায় পড়তে হতোÑ সিনেমা না কাটলেট? একসঙ্গে দুটো হবার নয়। অত পয়সা আসবে কোত্থেকে? এমনিতে হোস্টেলে বাকি পড়ত মাঝেমধ্যে। হোস্টেল সুপার এজন্য কখনো তাড়া দিতেন না। স্কুলের বন্ধুরা সব হারিয়ে গেছে। স্কুলের বেশিরভাগ ছেলে আশপাশের ব্যবসায়িক পরিবারের। এরা মেট্রিকটা পাস করেই ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকে যেত। বছরখানেক আগে ওয়াসার এক ইঞ্জিনিয়ার রসমালাইয়ের ভা- নিয়ে দেখা করে যান; ইনি মুসলিম হাইস্কুলে সহপাঠী ছিলেন বি কে জাহাঙ্গীরের। অন্যরা কে যে কোথায় আছে জানা নেই।
জাহাঙ্গীরদের স্কুলকালেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দম্ভোক্তি, ‘উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ প্রতিবাদের গরম হাওয়াটা গায়ে লাগতে শুরু করে প্রথম থেকে। এই সময়টা গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনেরও - এটা বি কে জাহাঙ্গীর কখনোই ভুলে যান না। তাই তাঁর সৃষ্টিশীলতা আর মননশীলতার চর্চাতে কৃষক বিদ্রোহ ঘুরে-ফিরে স্থান করে নিয়েছে অবিরত। আলোচনা যত দিন গড়িয়েছে লক্ষ্য করা গেছে একই ব্যাপার। চৈতন্যে কৃষকের লড়াই স্থান করে নেয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন একদিন সদরঘাটে আমাকে ধরলেন। বর্শাধারী এক হাজংয়ের পোস্টার দিলেন। হাজংদের বিদ্রোহ নিয়ে কথা বললেন। আমি যোগ দেব কিনা জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ভেবে দেখি।” পরের দেখা হবার কথা ছিল তা আর হয়নি; পার্টির নির্দেশে মুতি চলে গেছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তবে তাঁর বলা কথাগুলো দেয়া পোস্টারটি গভীর ছাপ ফেলে বি কে জাহাঙ্গীরের মনেÑ ‘হাজং বিদ্রোহ’ বা এমন একটা কিছু শিরোনামে একটা গল্প লেখা হয়ে যায়। সে লেখা হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে। কিন্তু হারায়নি কৃষকের লড়াই আর কৃষকের জীবন জানার আগ্রহ। মনে পড়ে গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পর্যায়ে ‘সমাজ পরিবর্তন’ বিষয়ক কোর্স আর মাস্টার্সে ‘পাবলিক পলিসি’ পড়ানোর সময়েও আমাদের স্যার অধ্যাপক বি কে জাহাঙ্গীর প্রভূত গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সামনে আলোচনা করতেন বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, বিদ্রোহের স্বরূপ। ‘বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ও শ্রেণী সংগ্রাম’ সম্ভবত এপ্রসঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণতম কাজ।
পাকিস্তান তৈরি হয়ে যাওয়াতে কি ধরনের আবেগ-অনুভূতি বোধ করছিলেন এ ব্যাপারটা বার বার কিছুটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই কয়েকদিন ধরেই জানতে চাওয়া হচ্ছিল। একদিন তিনি বললেন, “শুনুন, পাকিস্তান আন্দোলনের আগে থেকেই চলছিল কৃষক আন্দোলন। আর সে সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের লোকেরা ব্রাইট মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ফলে আমাদের মতো পড়াশোনাতে আগ্রহী ছেলেরা পাকিস্তান নিয়ে নয় গণআন্দোলন নিয়ে বেশি ভাবিত হতে শিখেছিল।”
ভাষা আন্দোলন সূচনাপর্ব প্রসঙ্গে বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “১৯৪৭ সাল থেকেই একটা বিষয় আমরা টের পেতে থাকি। বাঙালীরা নতুন গঠিত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সরকারী পর্যায়ে বাংলা নেই! কিভাবে মানবো?” জিন্নাহর ঘোষণা আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
১৯৫০ : এবার ঢাকা কলেজে
সময় যায় দেখতে-দেখতে। ১৯৫০ সাল। ঝালকাঠির বালক, মুসলিম স্কুলের কিশোর ততদিনে তরুণ তুর্কি বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। স্কুল পাড়ি দিয়ে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা কলেজে। এবারের থাকবার জায়গা বেগম বাজারের নূরপুর ভিলা। তখন ঢাকা কলেজের হোস্টেল আরো দুটি ছিল মোস্তফা হাউস আর ঢাকা কলেজ হোস্টেল। ঢাকা কলেজে এসে শিক্ষক হিসাবে পাওয়া গেল হেমায়েত উদ্দীন সাহেবকে; ইনি প্রকাশ্য কমিউনিস্ট। অর্থনীতি পড়াতেন ন্যাপের মোজাফফর আহমদ। এ সময় আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির লিফলেট হাতে আসতে শুরু করে। নিয়ে আসতেন পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাতিমান ওয়াহিদুল হক।
তখন কি পার্টিতে যোগ দেয়ার ডাক পেয়েছিলেন?
“ব্যাপারটা এরকমের নয়। তখন পার্টি আহ্বান জানানোর মতো কিছু করত না। পার্টি পর্যবেক্ষণে রাখত। পরে পার্টি সেল থেকে ওকে করে করা হলে তখন যোগদান করানোর প্রশ্ন আসত।”
এ পর্যায়ে এসে কথা বলতে-বলতে মনে হয় আলোচ্য সময়টিতে সরাসরি রাজনীতি নয় বরং গভীরভাবে রাজনীতিক বোধসম্পন্ন থেকে প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার দিক ঝুঁকছিলেন বি কে জাহাঙ্গীর। কলেজ জীবনে তাঁর বন্ধুরা হচ্ছেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ। ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, একটু চুপচাপ টাইপ আর ভাল গল্প লিখতেন। কলেজের বাইরে আমিনুল ইসলাম, মর্তুজা বশীর এই দু’জনও নিয়ে আসত কমিউনিস্ট পার্টির কাগজপত্র। বইপড়ার নেশা ততদিনে তীব্রতর। বই নিয়ে তুমুল আলোচনা মগ্ন থাকে এই তরুণেরা। কিন্তু ভাল বইপত্র কোথায় পূর্ব পাকিস্তানে? তেমন কোন বইয়ের দোকানও তখন নেই ঢাকা শহরে। আরমানীটোলার ওয়ারসি বুক হাউসে পাওয়া যেত কিছু নতুন বইপত্র। কলকাতা থেকে কচ্চিৎ আসা বইগুলো ‘পাগল হয়ে’ কিনতেন জাহাঙ্গীররা। এর বাইরে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি সামান্য কিছু বই আনত। বই পড়ার সুযোগ পাবার জন্য ওয়ারসি বুকের মালিক আবদুল বারী ওয়ারসির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বি কে জাহাঙ্গীর ও তাঁর বন্ধুরা।
আপনার এসময়কার বন্ধু আর কারা? বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা কাদের সঙ্গে?
“বুঝতেই পারছেন আমি তখন মোটামুটি বামের সঙ্গে যুক্ত। একদিন আমার কাছে একটা চিরকুট এলো টক টু জহির। জহির মানে জহির রায়হান। তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ততদিনে বড় নেতা। এঁদের বাবা ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার হোস্টেল সুপার আর এই দুইভাই হচ্ছেন বামপন্থী। গোয়েন্দারা জানত কিন্তু কিছু বলত না। ভাবত মাওলানার ছেলে; এরা তো গবর্মেন্টকে ফেলে দিতে চাইছে না Ñ এরকম একটা ব্যাপার আর কি।”
‘ফর আ লাস্টিং পিস ফর আ পিপলস ডেমোক্র্যাসি’ নামের বুখারেস্ট থেকে প্রকাশিত কমিউনিস্টদের একটি পত্রিকা নিয়মিত আসত শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে। একদিন আলাপে-আলাপে পত্রিকার কপিগুলো দেখতে চাইলে জহির আলুর বাজারে তাঁদের আলিয়া মাদ্রাসার বাসায় নিয়ে যান জাহাঙ্গীরকে। সেখানে দেখা হয় কথা হয় শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে, সদ্য পাস দেয়া ডাক্তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে, এঁদের বাবার সঙ্গে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়। তারপর পত্রিকা দেখতে দেন শহীদুল্লাহ কায়সার। যখন খুশি আসার, বই-পত্রিকা নিয়ে যাবার কথা বললেন তিনি। “আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কেন জহিরের সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছিল বুঝতে পারলাম। আসলে তাঁরা আমাকে এভাবে প্রগতিশীল বইপত্র পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন”, বি কে জাহাঙ্গীর জানান। (চলবে)
No comments