চিডুর মিডুর by সুশান্ত মজুমদার
বাসা থেকে বড় রাস্তায় জুয়েল যখন নামে আকাশে তখন তীব্র আগুন। নিষ্করুণ বাতাসেও গরম হলকা। উহ, ইচ্ছা হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরের টলটলে পানিতে ভিজতে, দীর্ঘক্ষণ ভিজে নিস্তেজ শরীর ফের নিজের করে ফিরে পেতে। কেন, কে বলেছিল, অজপাড়াগাঁর কোন এক মুক্তিযোদ্ধার মনোভাব গ্রহণের এ্যাসাইনমেন্ট নিতে? সেই তো রাজি হয়, সানন্দে
তখন শিস্্ দিতে দিতে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। উহু, মন ঘুরিয়ে আনে জুয়েল-বিষয়টা মুক্তিযুদ্ধ, বিরূপ হওয়ার আছে কী!
লাখ লাখ মানুষ একাত্তরে জীবন দিতে পারলে আজ এতদিন পর অতি সামান্য একটা কাজ, উল্টাপাল্টা আবহাওয়ার দোষে অনীহা দেখানো ঘোর অন্যায়। ধুর, এ মৌসুমের শহুরে পাজি গরম গ্রামও দখল করেছে। কোথাও ঠা-া নেই, আকাশ বিধবাÑবজ্রগর্ভ মেঘ পুরোপুরি অদৃশ্য। গা জুড়ানো আরামের বাতাস কী গ্রাম ছেড়ে নিখোঁজ মাঠভাঙ্গা দস্যি হাওয়া, গাছপালার কোলাহল, শুকনো পাতার ঘূর্ণি, দীঘির পানির তিরতির কাঁপন, কিছুই কী দেখা যায় না। গরমে চরাচর সিদ্ধ হতে হতে সবুজও যেন ফ্যাকাশে। বাসের ভিড়ের ভেতর মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে জুয়েল লক্ষ্য করেছে থানা সদর থেকে পুরো রাস্তা যাচ্ছেতাই, কোথাও কোথাও বিটুমিন উঠে গেছে-দু’পাশের সেই বড় বড় গাছগুলো লোপাট। গরম এতে দ্বিগুণ মনে হয়।
এক সপ্তাহের ছুটিতে জুয়েল বাড়ি যাচ্ছে শুনে চিফ রিপোর্টার মফস্বল শহর লাগোয়া গ্রামের কোন এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সাক্ষাতকার নিতে বলেন। জুয়েল এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে গ্রামে আসতে হবে, খুঁজে পেতে মুক্তিযোদ্ধা ডাকতে হবে-অতি সহজ কাজ না। ঢাকা ছেড়ে আসার সময় পদ্মার ফেরিতে দাঁড়িয়ে সে মোবাইল ফোনে গ্রামে মামার সঙ্গে কথা বলে। একদিন একবেলার জন্য হলেও সে আসছে-ছোট্ট একটা কাজ আছে, এসে সব বলবে, মামার সহায়তা দরকার। হঠাৎ ফোন পেয়ে উল্লাসে মামা তখুনি ভাগ্নেকে উড়াল দিয়ে চলে আসতে বলেন, পারলে ফোনের মধ্যে দিয়ে সে এসে পড়ুক। কত কথা তাঁর ভাগ্নেকে সে অনেক অনেকদিন দেখে না, এদিকে মামীর চোখে ছানি পড়ছে, স্নেহের ভাগ্নের জন্য ভাল ভাল কত পদের রান্না স্থগিত রেখে হাত তাঁর অলস হয়ে গেছে, মামাতো ভাই দুটি জুয়েল ভাইয়া জুয়েল ভাইয়া করে গলার স্বর আগেই ভেঙ্গে রেখেছে। শুনে জুয়েলের সারা শরীরে ত্রাস ছড়িয়ে যায়। মামার কথার মানে-জুয়েল বুঝি কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু সময় তাঁর হাতে নেই। একবেলা মামা বাড়ি, পরের বেলা গ্রামের কোন এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ সেরে দিন থাকতে থাকতে সে শহরে ফিরবে। মামা এতেও রাজি; আর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ, এমনকি কঠিন ব্যাপার, তাঁদের গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা অনেক আছে, খুব সাহসের সঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সব তাঁর কাছের লোক।
দেখো কা-, মামা মুক্তিযোদ্ধা আফাজ আলীকে তার সামনে রেখে আসছি বলে হনহন পায়ে সেই যে কোথায় গেল এ পর্যন্ত চেহারা, কিসের চেহারা, তাঁর কোন্দল করা খরখরে স্বরও আশপাশের কোন উঠোন বা গাছপালার আড়ালেও শোনা যাচ্ছে না। এ দিকে দিনের বাকি আলো কুড়িয়ে নিয়ে বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ডালপালা ধরে নেমে ছায়া আয়তন বাড়িয়ে নিচ্ছে। তাহলে দাঁড়াল কী, নির্ঘুম রাত তার মামাবাড়ির ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা বিছানায় কাটবে, শোনা যাবে বাদুরের সাঁই সাঁই ডানার আওয়াজ, ঝিঁঝি আর পোকামাকড়ের কিটির কিটির ক্রমাগত জোগান দিয়ে যাবে কালিবিষ অন্ধকার। ধুর, নিজের উপর নিদারুণ বিরক্ত হয় জুয়েল। কোথায় ভৈরবের পাশঘেঁষা তার নিজস্ব মফস্বলে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে গুলতানি আড্ডায় মশগুল থাকার কথা। কতদিন পর মজার খোসা ছাড়িয়ে ফুর্তি চুষে খাওয়া। সব গুবলেট। আরে গ্রাম বলে নয়। মামাবাড়ি এমনিতেই তার ভাল লাগে না। আগের সেই সেকেলে চলাচল অনুপযোগী কাদা মাটি এলাকায়, সুযোগ-বঞ্চিত এলাকা আর নেই। অনায়াসে শহর ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে মাঠে মাঠে রাস্তায়। পল্লী বিদ্যুতের কল্যাণে টিভি বলো, ভিসিপি বলো, ডিশলাইনÑকত কিসিমের অশেষ বিনোদন দোচালা, চারচালার দরজা- বেড়া ছাউনি ধরে ধেই ধেই নৃত্য করছে। ছেলেমেয়েদের গায়ে পায়ে এখন হালফ্যাশন। কী নেই, খুঁজলে বুঁদ হয়ে যাওয়ার নেশার পুরিয়াও পাওয়া যেতে পারে। জুয়েলের এসবে আগ্রহ নেই, ঢের দেখছে সে তার ছাব্বিশ বছরে। ঘোর জ্বালা অপেক্ষা করছে সামনে, মামা ভাগ্নেকে সামনে বসিয়ে রাতে যখন তাঁর বাচালতা চালু করবেন। কী থাকে না তাঁর কথার মধ্যে। যত অরান্তর প্রসঙ্গ : ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, কোন পেয়ার মোহাম্মদ না ইয়ার মোহাম্মদ। তাঁর দোস্ত হয়, মামার কাছে নারকেলের দশটা চারা চেয়েছে। এ বাড়ির নারকেলের ফলন নাকি বেশি বেশি। কি করা, মামা দশটা না এক ডজন চারা চেয়ারম্যান বাড়িতে ভ্যানগাড়িতে করে পাঠিয়ে দিলেন। এই অনাবশ্যক ফালতু প্যাঁচল শোনার কী! জুয়েলের প্রয়োজন আছে! দেখো, গ-ার সাইজের দুই মামাতো ভাই জুয়েলের ডানে-বামে সেঁটে বাড়তি তাপের জোগান দিয়ে যাবে-সরিয়ে দিলেও নড়বে না। জুয়েল ভাইয়াকে দেখেও নাকি শান্তি। তাদের ইচ্ছা, আব্বা রাজি হলে ঢাকায় গিয়ে সর্বক্ষণ ভাইয়ার সঙ্গে থাকা। কত মজার মানুষ, দিন দুনিয়ার সব খবর ভাইয়া জানে। শুধু শরীরে না, মাথামোটাও মামাতো ভাই দুটির একজন আগেই বই-পুস্তুক ফেলে দিয়েছে, আরেকজন পঁচানব্বই পার্সেন্ট পাস করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এসএসসিতে এবারও ইংরেজী ও অঙ্কে ফেল করেছে। মামার উচিত তাঁর স্নেহের বদল জোড়াকে চাষের কাজে জুড়ে দেয়া। আর মামি; অসুখে ভুগে ভুগে কাহিল মানুষটির জন্য সত্যি জুয়েলের দুঃখ হয়। মামা বাড়ির এই একটি লোক মুখে যার রা নেই, কেবল নিষ্প্রভ নজর জ্বেলে ধরে রাখে। তাঁর অকথিত জমাট বেদনা। জুয়েলের কাছে মামিকে সবসময়ের দুখিনী মনে হয়। কেন, জানার আদৌ চেষ্টা করেনি সে। মায়ের সমান সাদাসিধা এই নারী ছেলের বয়েসী জুয়েলকে দেখে খামখা কেন ঝড় হয়ে থাকে-সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মামা যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন- রহস্য কী! চায়ের ছাপড়ার একপাশে আফাজ আলীকে নিয়ে সে ঠায় বসা, দু’জনেরই মুখ বন্ধ, হঠাৎ হঠাৎ এ ওর মুখ পড়া। নতুন মানুষ জুয়েল তার দ্বিধা কাটাতে পারছে না। কোন্্ কথা থেকে কোন্্ কথা সে শুরু করে।
ক্ষয়াটে ইটের উঁচু নিচু পুরনো পথের বাঁ পাশে বুড়ো নারকেল গাছের গোড়ালাগোয়া তুচ্ছ এই চায়ের ছাপড়া। পাড়াগাঁর ভেতর দারুণ আয়োজন বৈকি। জানা গেল, সিডরের প্রলয়ের পর সাহায্য দিতে আসা সাহেব সুবোদের কণ্ঠের পিপাসা মেটাতে এই ছাপড়াটা রাতারাতি চালু হয়। তখন থেকে এটা চলছে। সকালের রোদ চড়ে যাওয়ার আগে আর বিকাল ফুরিয়ে যাওয়ার পর রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত ছাপড়ার মাটির উনুনটা জ্বলে। ভরদুপুরে ছাপড়া বন্ধÑ গ্রামের খাটুয়ে মনুষ্যিরা থাকে মাঠে ঘাটে, এত শখ কার কে খাবে চা। রোদ মরে এলে প্রাণের গ্রামের জোয়ান ছেলেরা হাজিরÑতুমুল কথা চালাচালি হাসি-তামাশার সঙ্গে হাতে ধরা থাকে কাপ। রাতে হেরিকেন একটা জ্বলে। চিমনির ঘষা কাচের ভেতর থেকে আসা আলো এতটাই মরা যে কারও মুখ পরিষ্কার থাকে না। দেখো কা-, অনুমান করা মাত্র বুঝি আফাজ আলীর চেহারা সাফ সাফ ধরা যাচ্ছে না ওই নীরব গম্ভীর বয়স্ক মুখের আড়ালে এমন অনেক স্মৃতি জমা আছে যা ভেদ করে বাইরে টেনে আনা মুশকিল; অত সহজ কাজ না। জুয়েল জেনেছে, মাইলখানেক দূরে গ্রামের উত্তরডাঙ্গায় সামান্য জায়গার উপর এই মুক্তিযোদ্ধার বাস। হরহামেশা আফাজ আলীকে তাই হাতের কাছে বা আলাপের মধ্যে পাওয়া যায় না। সময় খরচ করা ভেরেন্ডাবাজদের মতো হাটে মাঠে পথে খামখা সে ঘুরঘুরও করে না। রীতিমতো বাড়ির কামলা পাঠিয়ে মামার আফাজ আলীকে ডাকতে হয়েছে। পয়লা সে পাত্তা দেয়নি-আসার ব্যাপারে তাঁর গরজ নেই। আসবে কেন? ঢাকা থেকে কোন মামার কোন্্ ভাগ্নে এসেছে এত বছর পর আলাপ জুড়তে, ধুর, তাঁর আসে কী! গ্রামে উচ্ছন্নে যাওয়া নষ্ট মুক্তিযোদ্ধাও দু’চারটা আছে, তাদের মুখের বানিয়ে তোলা কেচ্ছা শুনে গেলে হয়। মামার কামলাটা নাছোড়বান্দা, আফাজ আলীকে কোলে নিয়ে হলেও সে পথ পাড়ি দেবে। এত পীড়াপীড়ি শেষে মন গলে তাঁর। জানা গেছে, মানুষটা এ বয়সেও মাটির ঢেলায় মুগুর মারে, ক্ষেতের আগাছা সাফ করে আঙুল অচল রাখতে নারাজ সে। বড়ই আফসোস, তাঁর খাটুয়ে শক্তি সোমত্ত ছেলেটা এক রাতের অসুখে হঠাৎ মারা যায়। আফাজ আলী নির্বাক তাঁর মনের অতল জায়গা দুঃখ-কষ্টে খাক হয়ে গেলে ভেতরের জোর আলগা হয়ে যায়। মনে ও শরীরে সে আরও কাবু হয়ে পড়ে। ব্যাপার কী, বসে থেকে থেকে সে ঝিমিয়ে পড়েছে নাকি! না, ওই তো আবার চোখ খুলেছেন। তার জোড়া ঘোলা চোখ অপলকে চেয়ে থাকলে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে যায় জুয়েল। ওই পানসে কমজোরি দৃষ্টির আড়ালে থাকা সম্বল মনের আলো দিয়ে বুঝি জুয়েলকে সে নিড়িয়ে নিচ্ছে। হয়তো বুঝতে চাইছেন, তাঁকে নিয়ে বাইরের এই যুবকের হঠাৎ আগ্রহের কারণ কী হতে পারে! স্থির চাহনির সামনে জুয়েল দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ছাপড়ার বসার পর সম্ভাবপর চোখ চালিয়ে সে আশপাশ দেখে নিয়েছে। পেছনে নলবন, কাঁটা কোপ, হেজিপেজি লতাপাতার দখলে যাওয়া সরু খাল, তার তলের থিকথিকে কাদার মধ্যে পড়ে আছে বাতিল একটা ডিঙ্গি নৌকো। নৌকোর উঁচু একমাথা এখনও দেখা যায় Ñনিচু অংশ কাদার গভীরে ডুবে গেছে। নৌকোটা বাতিল, আদৌ আর কাজে আসবে না। হয়তো এতদিন কাঠ পচে গেছে। পচে যাওয়ার সম্ভাবনাই ষোলোআনা, মন্দ কাদা পানি শুষে নিয়েছে কাঠের শক্তি, আর বাকি কি, চাপ পড়লেই বডি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ছাপড়ার চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা নোনা গন্ধ। আশপাশের কোন বাড়ির উঠোনে জড়ো করা সাতবাসি খড়কুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আজ রোদে দিয়েছিল, বাতাসে তারও দুর্ভোগ ভাসছে। জুয়েল গ্লাসের চা শুষে নিতে নিতে মুরুব্বি আফাজ আলীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেÑ ‘মনে হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা শুনেছেন?
আফাজ আলী টুঁ শব্দটিও করে না যেন জুয়েলের রাখা প্রশ্নের দিকে ফ্যালফ্যাল সে চেয়ে আছে। মনে হয়, চা পানের অভ্যাস তাঁর নেই। কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঝোলটানার মতো করে সে আওয়াজ করছে। সারা মুখময় তাঁর সাদা দাড়িÑভাঁজ পড়া পরিণত গাছ পাথুরে চোয়াল চুপসানো। ওই মুখেও অন্ধকারের সর কমে আছে।
মানুষটা কথা বলতে কি নারাজ? নাকি এতদিন পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বলাবলি তাঁর মহাঅপছন্দের। পরনের ময়লাধরা পুরনো লুঙ্গি, গায়ের রঙজ্বলা জামা দেখে নিশ্চিত বোঝা যায়Ñতাঁর দিনকাল সুবিধার না, কষ্টেসৃষ্টে গোঁজামিল দিয়ে বয়সটা ফুরিয়ে দিচ্ছেন। এমনও হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের একচল্লিশ বছরে অভাবের চরম ছোবলে নীল হয়ে নিজেকে সে আড়ালে সরিয়ে নিয়েছেÑ প্রাণ শুকিয়ে খটখটে, কোন কিছুতেই আর উৎসাহ নেই।
জুয়েল থাকে রাজধানীতে, চাকরি সূত্রে পত্রিকায় প্রয়োজনে দু’চার কথার আলাপ বা সাক্ষাতকার যাই হোক গ্রহণ করবে শুনে আফাজ আলীর ভারিক্কি ভাব হয়তো আরও জমাট হয়েছে। আফাজ আলীর কাঁধ হঠাৎ কেঁপে ওঠে। পিঠে মোচড় রেখে এই কাঁপুনি সে সামাল দিতে চায়। ডানহাতের আঙুল দিয়ে দ্রুত বাঁ বাহু, পরে ওই বাঁ হাত উপরে তুলে ঘাড়ের ওপর অংশ চুলকান। খানিক পর ঠা-া যেন কিছুই হয়নি। তার ঠোঁট বেয়ে আলগোছে অস্পষ্ট আওয়াজ খসে পড়ে-চিডুর মিডুর।
বলে কি মুক্তিযোদ্ধা? এমন শব্দ তার অজানা, আগে শোনেনি-তাহলে অর্থোদ্ধার কেমনে করবে! হতে পরে স্থানীয়ভাবে শব্দটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে, এর অর্থ এরাই জানে। জুয়েলের মুখাবয়বে নির্বোধ ভাব দেখে, এই আছে হৈ চৈ ফেলানোর মতো কইরে আছে, আবার নাই, হঠাৎ হঠাৎ কাড়া মাইরে ওডে, বলে, আফাজ আলী চিডুর মিডুর নিয়ে কথার গিঁট এঁটে দেয়। অল্পভাষী এই মানুষটির ছাড়া ছাড়া বাক্যের মধ্যে এতো রহস্য কেন? ধুর এমন মারফতি গুপ্ত কথার চালাচালি তার ভাল লাগে না। সহসা জুয়েলের মাথার মধ্যে খুব গভীরে চকচকে চিকন তারে টোকা পড়ে-আফাজ আলী কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সাময়িক আলোড়নমাত্র মনে করে চিডুর মিডুর বলে সন্দেহ করছেন? আরে মানুষটি হঠাৎ তন্নতন্ন করে দেখার মতো করে অমন চেয়ে আছে কেন? কি দেখছে? বুঝি ভাবখানা, এই উল্টাপাল্টা জামানার ছেলেপেলে সে ঢের দেখেছে, এরা পোকায় খাওয়াÑ জোয়ানী রক্তে দোষ, এদের লাগাম টানবে কে, এদের বাপ-চাচার দলাদলি, অবৈধ উপার্জন ক্ষমতার দম্ভে দেশেরই স্বার্থ উঠেছে।
ভাবতেই জুয়েলের বোধের থেকে ধাক্কা উঠে আসেÑ এ মানুষটা তার মতো করে ভাবতে নাও পারেন। হতে পারে, পলকশূন্য চাহনি উড়ে গেছে পেছনের অমলিন শ্রেষ্ঠ সারি সারি স্মৃতির ওপর, সেই যুদ্ধ দিনে তাঁর কষ্ট ত্যাগ সাহসী লড়াই, সহযোদ্ধাদের মুখ, ক্যাম্প জীবন এই মুহূর্তে খুব বেশি মনে আসছে। ওই তো আফাজ আলী নিজের থেকে তাঁর চুল কমে আসা শুকনো মাথাটা নাড়ছেন। অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি চায়ের গ্লাসটা ফিরিয়ে দেন। কোন এক বোধের নাগাল পেয়ে ধীরে ধীরে তিনি জেগে উঠছেন। তাঁর অনুচ্চস্বর ঝরে পড়লে জুয়েল কিছুটা ধরতে পারে।
‘কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু না, কেডা বিচার বিচার করবে?’
জুয়েল জবাব দেখার উৎসাহ নিয়ে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে খানিক এগিয়ে বসে ‘ কেন, সরকার তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
আফাজ আলী ফের চুপ। নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে কি হারিয়ে গেছেন? হয়তো জীবনের তরঙ্গময় সময়ে কথার ভেলায় ভেসে ভেসে ঘাটে মাঠে ঘরে ঘরে মানুষের কাছে গেছেন; এখন ওসব নিরর্থক ভেবে কথার ব্যাপারে তিনি বীতশ্রদ্ধ।
গরমের মধ্যে থাকতে থাকতে গরম সয়ে এসেছে জুয়েলের। মামার এখনও খোঁজ নেই। হোক তার মামা, মানুষটা মানুষ চরাতে ঘাগু, কথার মারপ্যাঁচে ঝানু জুয়েল তো জানে। মামার হামবড়া ভাবের আসন কোনদিনই তার কাছে পোক্ত নয়। আচ্ছা, তার মামার বর্তমান যে বয়স বিয়োগ করলে একাত্তরে হৃষ্টপুষ্ট চোখ কান খোলা যুবকই হওয়ার কথা, ওই চরম সময়ে সে মুক্তিযোদ্ধা কেন হয়নি?
মুক্তিযোদ্ধা হতে তাঁর সমস্যা কি ছিল? এই জিজ্ঞাসা জুয়েলের মধ্যে আজতক কেন ক্রিয়া করেনি? ভাবতেই সামনে বসা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তার মাথা আর আফাজ আলী প্রতিবেশী বটে, একই ইউনিয়নের মনুষ্যি, পরস্পরের নিবিড় চেনাশোনা, জেনে নেয়ার এই তো মোক্ষম সুযোগ। ও মা, আফাজ আলীর কি ঝিমুনি এসেছে চোখ বুজে আছেন? এমনও হতে পারে, বয়সের ভারে কিংবা কৃশ শরীরের কারণে একটানা কথা বলতে তাঁর কষ্ট হয়। ওই কষ্ট লাঘব করার জন্য তিনি দম নিচ্ছেন। তাঁর কণ্ঠ এবার ধীর, আগের চেয়ে অনুচ্চ।
‘ঢাকায় কয়ডা বুইড়া দালালরে ধরলে হবে ডা কী। গোটা দ্যাশটাই তো গেরাম, সবখানে যুদ্ধাপরাধী আছে। একাত্তরের দালাল শয়তান খুনী গেরামেই বেশি। আমাগো এ গেরামের চ্যায়ারম্যানের বাপ ছিল দালাল-একাত্তরে পাক বাহিনীর দালালী করচে। বুইড়া শয়তানটা এহনো বাঁইচা আচে। এর পোলার পোলা মাইনে দালালের নাতি মহব্বত কইরা এলাকার আওয়ামী নেতার মাইয়ারে বিয়া করচে। সে মহাধুমধামের বিয়া ছিল। কও, বিচার আচার কেমনে হয়? ব্যবসা কও, বাণিজ্য কও, ওঠবস, বিয়া-থাহা কও, এহন এওর কুটুম। ক্যামনে হবে বিচার। আচ্চা, শ্যাখ সাহেবের আত্মীয় আওয়ামী লীগের কোন্্ মন্ত্রী, তার মাইয়ার বলে এমুন বিয়া হইবে?’
জুয়েল নিভে যায়। এই প্রশ্নের সত্য-মিথ্যা কোন উত্তর তার জানা নেই। কাদায় পড়ে থাকা নৌকোর মাথাটা অন্ধকারের কারণে আর দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে চোখ ফেললে নজর ফিরে আসে। গাছপালার পাতা কি নড়ছে, না ইশারা করে তাকে ডাকছেÑ বোঝার উপায় নেই। কেবল পাশের নাম না জানা বেটে গাছটাকে মু-ুহীন মনে হচ্ছে।
লাখ লাখ মানুষ একাত্তরে জীবন দিতে পারলে আজ এতদিন পর অতি সামান্য একটা কাজ, উল্টাপাল্টা আবহাওয়ার দোষে অনীহা দেখানো ঘোর অন্যায়। ধুর, এ মৌসুমের শহুরে পাজি গরম গ্রামও দখল করেছে। কোথাও ঠা-া নেই, আকাশ বিধবাÑবজ্রগর্ভ মেঘ পুরোপুরি অদৃশ্য। গা জুড়ানো আরামের বাতাস কী গ্রাম ছেড়ে নিখোঁজ মাঠভাঙ্গা দস্যি হাওয়া, গাছপালার কোলাহল, শুকনো পাতার ঘূর্ণি, দীঘির পানির তিরতির কাঁপন, কিছুই কী দেখা যায় না। গরমে চরাচর সিদ্ধ হতে হতে সবুজও যেন ফ্যাকাশে। বাসের ভিড়ের ভেতর মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে জুয়েল লক্ষ্য করেছে থানা সদর থেকে পুরো রাস্তা যাচ্ছেতাই, কোথাও কোথাও বিটুমিন উঠে গেছে-দু’পাশের সেই বড় বড় গাছগুলো লোপাট। গরম এতে দ্বিগুণ মনে হয়।
এক সপ্তাহের ছুটিতে জুয়েল বাড়ি যাচ্ছে শুনে চিফ রিপোর্টার মফস্বল শহর লাগোয়া গ্রামের কোন এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সাক্ষাতকার নিতে বলেন। জুয়েল এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে গ্রামে আসতে হবে, খুঁজে পেতে মুক্তিযোদ্ধা ডাকতে হবে-অতি সহজ কাজ না। ঢাকা ছেড়ে আসার সময় পদ্মার ফেরিতে দাঁড়িয়ে সে মোবাইল ফোনে গ্রামে মামার সঙ্গে কথা বলে। একদিন একবেলার জন্য হলেও সে আসছে-ছোট্ট একটা কাজ আছে, এসে সব বলবে, মামার সহায়তা দরকার। হঠাৎ ফোন পেয়ে উল্লাসে মামা তখুনি ভাগ্নেকে উড়াল দিয়ে চলে আসতে বলেন, পারলে ফোনের মধ্যে দিয়ে সে এসে পড়ুক। কত কথা তাঁর ভাগ্নেকে সে অনেক অনেকদিন দেখে না, এদিকে মামীর চোখে ছানি পড়ছে, স্নেহের ভাগ্নের জন্য ভাল ভাল কত পদের রান্না স্থগিত রেখে হাত তাঁর অলস হয়ে গেছে, মামাতো ভাই দুটি জুয়েল ভাইয়া জুয়েল ভাইয়া করে গলার স্বর আগেই ভেঙ্গে রেখেছে। শুনে জুয়েলের সারা শরীরে ত্রাস ছড়িয়ে যায়। মামার কথার মানে-জুয়েল বুঝি কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু সময় তাঁর হাতে নেই। একবেলা মামা বাড়ি, পরের বেলা গ্রামের কোন এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ সেরে দিন থাকতে থাকতে সে শহরে ফিরবে। মামা এতেও রাজি; আর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ, এমনকি কঠিন ব্যাপার, তাঁদের গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা অনেক আছে, খুব সাহসের সঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সব তাঁর কাছের লোক।
দেখো কা-, মামা মুক্তিযোদ্ধা আফাজ আলীকে তার সামনে রেখে আসছি বলে হনহন পায়ে সেই যে কোথায় গেল এ পর্যন্ত চেহারা, কিসের চেহারা, তাঁর কোন্দল করা খরখরে স্বরও আশপাশের কোন উঠোন বা গাছপালার আড়ালেও শোনা যাচ্ছে না। এ দিকে দিনের বাকি আলো কুড়িয়ে নিয়ে বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ডালপালা ধরে নেমে ছায়া আয়তন বাড়িয়ে নিচ্ছে। তাহলে দাঁড়াল কী, নির্ঘুম রাত তার মামাবাড়ির ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা বিছানায় কাটবে, শোনা যাবে বাদুরের সাঁই সাঁই ডানার আওয়াজ, ঝিঁঝি আর পোকামাকড়ের কিটির কিটির ক্রমাগত জোগান দিয়ে যাবে কালিবিষ অন্ধকার। ধুর, নিজের উপর নিদারুণ বিরক্ত হয় জুয়েল। কোথায় ভৈরবের পাশঘেঁষা তার নিজস্ব মফস্বলে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে গুলতানি আড্ডায় মশগুল থাকার কথা। কতদিন পর মজার খোসা ছাড়িয়ে ফুর্তি চুষে খাওয়া। সব গুবলেট। আরে গ্রাম বলে নয়। মামাবাড়ি এমনিতেই তার ভাল লাগে না। আগের সেই সেকেলে চলাচল অনুপযোগী কাদা মাটি এলাকায়, সুযোগ-বঞ্চিত এলাকা আর নেই। অনায়াসে শহর ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে মাঠে মাঠে রাস্তায়। পল্লী বিদ্যুতের কল্যাণে টিভি বলো, ভিসিপি বলো, ডিশলাইনÑকত কিসিমের অশেষ বিনোদন দোচালা, চারচালার দরজা- বেড়া ছাউনি ধরে ধেই ধেই নৃত্য করছে। ছেলেমেয়েদের গায়ে পায়ে এখন হালফ্যাশন। কী নেই, খুঁজলে বুঁদ হয়ে যাওয়ার নেশার পুরিয়াও পাওয়া যেতে পারে। জুয়েলের এসবে আগ্রহ নেই, ঢের দেখছে সে তার ছাব্বিশ বছরে। ঘোর জ্বালা অপেক্ষা করছে সামনে, মামা ভাগ্নেকে সামনে বসিয়ে রাতে যখন তাঁর বাচালতা চালু করবেন। কী থাকে না তাঁর কথার মধ্যে। যত অরান্তর প্রসঙ্গ : ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, কোন পেয়ার মোহাম্মদ না ইয়ার মোহাম্মদ। তাঁর দোস্ত হয়, মামার কাছে নারকেলের দশটা চারা চেয়েছে। এ বাড়ির নারকেলের ফলন নাকি বেশি বেশি। কি করা, মামা দশটা না এক ডজন চারা চেয়ারম্যান বাড়িতে ভ্যানগাড়িতে করে পাঠিয়ে দিলেন। এই অনাবশ্যক ফালতু প্যাঁচল শোনার কী! জুয়েলের প্রয়োজন আছে! দেখো, গ-ার সাইজের দুই মামাতো ভাই জুয়েলের ডানে-বামে সেঁটে বাড়তি তাপের জোগান দিয়ে যাবে-সরিয়ে দিলেও নড়বে না। জুয়েল ভাইয়াকে দেখেও নাকি শান্তি। তাদের ইচ্ছা, আব্বা রাজি হলে ঢাকায় গিয়ে সর্বক্ষণ ভাইয়ার সঙ্গে থাকা। কত মজার মানুষ, দিন দুনিয়ার সব খবর ভাইয়া জানে। শুধু শরীরে না, মাথামোটাও মামাতো ভাই দুটির একজন আগেই বই-পুস্তুক ফেলে দিয়েছে, আরেকজন পঁচানব্বই পার্সেন্ট পাস করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এসএসসিতে এবারও ইংরেজী ও অঙ্কে ফেল করেছে। মামার উচিত তাঁর স্নেহের বদল জোড়াকে চাষের কাজে জুড়ে দেয়া। আর মামি; অসুখে ভুগে ভুগে কাহিল মানুষটির জন্য সত্যি জুয়েলের দুঃখ হয়। মামা বাড়ির এই একটি লোক মুখে যার রা নেই, কেবল নিষ্প্রভ নজর জ্বেলে ধরে রাখে। তাঁর অকথিত জমাট বেদনা। জুয়েলের কাছে মামিকে সবসময়ের দুখিনী মনে হয়। কেন, জানার আদৌ চেষ্টা করেনি সে। মায়ের সমান সাদাসিধা এই নারী ছেলের বয়েসী জুয়েলকে দেখে খামখা কেন ঝড় হয়ে থাকে-সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মামা যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন- রহস্য কী! চায়ের ছাপড়ার একপাশে আফাজ আলীকে নিয়ে সে ঠায় বসা, দু’জনেরই মুখ বন্ধ, হঠাৎ হঠাৎ এ ওর মুখ পড়া। নতুন মানুষ জুয়েল তার দ্বিধা কাটাতে পারছে না। কোন্্ কথা থেকে কোন্্ কথা সে শুরু করে।
ক্ষয়াটে ইটের উঁচু নিচু পুরনো পথের বাঁ পাশে বুড়ো নারকেল গাছের গোড়ালাগোয়া তুচ্ছ এই চায়ের ছাপড়া। পাড়াগাঁর ভেতর দারুণ আয়োজন বৈকি। জানা গেল, সিডরের প্রলয়ের পর সাহায্য দিতে আসা সাহেব সুবোদের কণ্ঠের পিপাসা মেটাতে এই ছাপড়াটা রাতারাতি চালু হয়। তখন থেকে এটা চলছে। সকালের রোদ চড়ে যাওয়ার আগে আর বিকাল ফুরিয়ে যাওয়ার পর রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত ছাপড়ার মাটির উনুনটা জ্বলে। ভরদুপুরে ছাপড়া বন্ধÑ গ্রামের খাটুয়ে মনুষ্যিরা থাকে মাঠে ঘাটে, এত শখ কার কে খাবে চা। রোদ মরে এলে প্রাণের গ্রামের জোয়ান ছেলেরা হাজিরÑতুমুল কথা চালাচালি হাসি-তামাশার সঙ্গে হাতে ধরা থাকে কাপ। রাতে হেরিকেন একটা জ্বলে। চিমনির ঘষা কাচের ভেতর থেকে আসা আলো এতটাই মরা যে কারও মুখ পরিষ্কার থাকে না। দেখো কা-, অনুমান করা মাত্র বুঝি আফাজ আলীর চেহারা সাফ সাফ ধরা যাচ্ছে না ওই নীরব গম্ভীর বয়স্ক মুখের আড়ালে এমন অনেক স্মৃতি জমা আছে যা ভেদ করে বাইরে টেনে আনা মুশকিল; অত সহজ কাজ না। জুয়েল জেনেছে, মাইলখানেক দূরে গ্রামের উত্তরডাঙ্গায় সামান্য জায়গার উপর এই মুক্তিযোদ্ধার বাস। হরহামেশা আফাজ আলীকে তাই হাতের কাছে বা আলাপের মধ্যে পাওয়া যায় না। সময় খরচ করা ভেরেন্ডাবাজদের মতো হাটে মাঠে পথে খামখা সে ঘুরঘুরও করে না। রীতিমতো বাড়ির কামলা পাঠিয়ে মামার আফাজ আলীকে ডাকতে হয়েছে। পয়লা সে পাত্তা দেয়নি-আসার ব্যাপারে তাঁর গরজ নেই। আসবে কেন? ঢাকা থেকে কোন মামার কোন্্ ভাগ্নে এসেছে এত বছর পর আলাপ জুড়তে, ধুর, তাঁর আসে কী! গ্রামে উচ্ছন্নে যাওয়া নষ্ট মুক্তিযোদ্ধাও দু’চারটা আছে, তাদের মুখের বানিয়ে তোলা কেচ্ছা শুনে গেলে হয়। মামার কামলাটা নাছোড়বান্দা, আফাজ আলীকে কোলে নিয়ে হলেও সে পথ পাড়ি দেবে। এত পীড়াপীড়ি শেষে মন গলে তাঁর। জানা গেছে, মানুষটা এ বয়সেও মাটির ঢেলায় মুগুর মারে, ক্ষেতের আগাছা সাফ করে আঙুল অচল রাখতে নারাজ সে। বড়ই আফসোস, তাঁর খাটুয়ে শক্তি সোমত্ত ছেলেটা এক রাতের অসুখে হঠাৎ মারা যায়। আফাজ আলী নির্বাক তাঁর মনের অতল জায়গা দুঃখ-কষ্টে খাক হয়ে গেলে ভেতরের জোর আলগা হয়ে যায়। মনে ও শরীরে সে আরও কাবু হয়ে পড়ে। ব্যাপার কী, বসে থেকে থেকে সে ঝিমিয়ে পড়েছে নাকি! না, ওই তো আবার চোখ খুলেছেন। তার জোড়া ঘোলা চোখ অপলকে চেয়ে থাকলে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে যায় জুয়েল। ওই পানসে কমজোরি দৃষ্টির আড়ালে থাকা সম্বল মনের আলো দিয়ে বুঝি জুয়েলকে সে নিড়িয়ে নিচ্ছে। হয়তো বুঝতে চাইছেন, তাঁকে নিয়ে বাইরের এই যুবকের হঠাৎ আগ্রহের কারণ কী হতে পারে! স্থির চাহনির সামনে জুয়েল দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ছাপড়ার বসার পর সম্ভাবপর চোখ চালিয়ে সে আশপাশ দেখে নিয়েছে। পেছনে নলবন, কাঁটা কোপ, হেজিপেজি লতাপাতার দখলে যাওয়া সরু খাল, তার তলের থিকথিকে কাদার মধ্যে পড়ে আছে বাতিল একটা ডিঙ্গি নৌকো। নৌকোর উঁচু একমাথা এখনও দেখা যায় Ñনিচু অংশ কাদার গভীরে ডুবে গেছে। নৌকোটা বাতিল, আদৌ আর কাজে আসবে না। হয়তো এতদিন কাঠ পচে গেছে। পচে যাওয়ার সম্ভাবনাই ষোলোআনা, মন্দ কাদা পানি শুষে নিয়েছে কাঠের শক্তি, আর বাকি কি, চাপ পড়লেই বডি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ছাপড়ার চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা নোনা গন্ধ। আশপাশের কোন বাড়ির উঠোনে জড়ো করা সাতবাসি খড়কুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আজ রোদে দিয়েছিল, বাতাসে তারও দুর্ভোগ ভাসছে। জুয়েল গ্লাসের চা শুষে নিতে নিতে মুরুব্বি আফাজ আলীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেÑ ‘মনে হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা শুনেছেন?
আফাজ আলী টুঁ শব্দটিও করে না যেন জুয়েলের রাখা প্রশ্নের দিকে ফ্যালফ্যাল সে চেয়ে আছে। মনে হয়, চা পানের অভ্যাস তাঁর নেই। কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঝোলটানার মতো করে সে আওয়াজ করছে। সারা মুখময় তাঁর সাদা দাড়িÑভাঁজ পড়া পরিণত গাছ পাথুরে চোয়াল চুপসানো। ওই মুখেও অন্ধকারের সর কমে আছে।
মানুষটা কথা বলতে কি নারাজ? নাকি এতদিন পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বলাবলি তাঁর মহাঅপছন্দের। পরনের ময়লাধরা পুরনো লুঙ্গি, গায়ের রঙজ্বলা জামা দেখে নিশ্চিত বোঝা যায়Ñতাঁর দিনকাল সুবিধার না, কষ্টেসৃষ্টে গোঁজামিল দিয়ে বয়সটা ফুরিয়ে দিচ্ছেন। এমনও হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের একচল্লিশ বছরে অভাবের চরম ছোবলে নীল হয়ে নিজেকে সে আড়ালে সরিয়ে নিয়েছেÑ প্রাণ শুকিয়ে খটখটে, কোন কিছুতেই আর উৎসাহ নেই।
জুয়েল থাকে রাজধানীতে, চাকরি সূত্রে পত্রিকায় প্রয়োজনে দু’চার কথার আলাপ বা সাক্ষাতকার যাই হোক গ্রহণ করবে শুনে আফাজ আলীর ভারিক্কি ভাব হয়তো আরও জমাট হয়েছে। আফাজ আলীর কাঁধ হঠাৎ কেঁপে ওঠে। পিঠে মোচড় রেখে এই কাঁপুনি সে সামাল দিতে চায়। ডানহাতের আঙুল দিয়ে দ্রুত বাঁ বাহু, পরে ওই বাঁ হাত উপরে তুলে ঘাড়ের ওপর অংশ চুলকান। খানিক পর ঠা-া যেন কিছুই হয়নি। তার ঠোঁট বেয়ে আলগোছে অস্পষ্ট আওয়াজ খসে পড়ে-চিডুর মিডুর।
বলে কি মুক্তিযোদ্ধা? এমন শব্দ তার অজানা, আগে শোনেনি-তাহলে অর্থোদ্ধার কেমনে করবে! হতে পরে স্থানীয়ভাবে শব্দটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে, এর অর্থ এরাই জানে। জুয়েলের মুখাবয়বে নির্বোধ ভাব দেখে, এই আছে হৈ চৈ ফেলানোর মতো কইরে আছে, আবার নাই, হঠাৎ হঠাৎ কাড়া মাইরে ওডে, বলে, আফাজ আলী চিডুর মিডুর নিয়ে কথার গিঁট এঁটে দেয়। অল্পভাষী এই মানুষটির ছাড়া ছাড়া বাক্যের মধ্যে এতো রহস্য কেন? ধুর এমন মারফতি গুপ্ত কথার চালাচালি তার ভাল লাগে না। সহসা জুয়েলের মাথার মধ্যে খুব গভীরে চকচকে চিকন তারে টোকা পড়ে-আফাজ আলী কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সাময়িক আলোড়নমাত্র মনে করে চিডুর মিডুর বলে সন্দেহ করছেন? আরে মানুষটি হঠাৎ তন্নতন্ন করে দেখার মতো করে অমন চেয়ে আছে কেন? কি দেখছে? বুঝি ভাবখানা, এই উল্টাপাল্টা জামানার ছেলেপেলে সে ঢের দেখেছে, এরা পোকায় খাওয়াÑ জোয়ানী রক্তে দোষ, এদের লাগাম টানবে কে, এদের বাপ-চাচার দলাদলি, অবৈধ উপার্জন ক্ষমতার দম্ভে দেশেরই স্বার্থ উঠেছে।
ভাবতেই জুয়েলের বোধের থেকে ধাক্কা উঠে আসেÑ এ মানুষটা তার মতো করে ভাবতে নাও পারেন। হতে পারে, পলকশূন্য চাহনি উড়ে গেছে পেছনের অমলিন শ্রেষ্ঠ সারি সারি স্মৃতির ওপর, সেই যুদ্ধ দিনে তাঁর কষ্ট ত্যাগ সাহসী লড়াই, সহযোদ্ধাদের মুখ, ক্যাম্প জীবন এই মুহূর্তে খুব বেশি মনে আসছে। ওই তো আফাজ আলী নিজের থেকে তাঁর চুল কমে আসা শুকনো মাথাটা নাড়ছেন। অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি চায়ের গ্লাসটা ফিরিয়ে দেন। কোন এক বোধের নাগাল পেয়ে ধীরে ধীরে তিনি জেগে উঠছেন। তাঁর অনুচ্চস্বর ঝরে পড়লে জুয়েল কিছুটা ধরতে পারে।
‘কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু না, কেডা বিচার বিচার করবে?’
জুয়েল জবাব দেখার উৎসাহ নিয়ে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে খানিক এগিয়ে বসে ‘ কেন, সরকার তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
আফাজ আলী ফের চুপ। নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে কি হারিয়ে গেছেন? হয়তো জীবনের তরঙ্গময় সময়ে কথার ভেলায় ভেসে ভেসে ঘাটে মাঠে ঘরে ঘরে মানুষের কাছে গেছেন; এখন ওসব নিরর্থক ভেবে কথার ব্যাপারে তিনি বীতশ্রদ্ধ।
গরমের মধ্যে থাকতে থাকতে গরম সয়ে এসেছে জুয়েলের। মামার এখনও খোঁজ নেই। হোক তার মামা, মানুষটা মানুষ চরাতে ঘাগু, কথার মারপ্যাঁচে ঝানু জুয়েল তো জানে। মামার হামবড়া ভাবের আসন কোনদিনই তার কাছে পোক্ত নয়। আচ্ছা, তার মামার বর্তমান যে বয়স বিয়োগ করলে একাত্তরে হৃষ্টপুষ্ট চোখ কান খোলা যুবকই হওয়ার কথা, ওই চরম সময়ে সে মুক্তিযোদ্ধা কেন হয়নি?
মুক্তিযোদ্ধা হতে তাঁর সমস্যা কি ছিল? এই জিজ্ঞাসা জুয়েলের মধ্যে আজতক কেন ক্রিয়া করেনি? ভাবতেই সামনে বসা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তার মাথা আর আফাজ আলী প্রতিবেশী বটে, একই ইউনিয়নের মনুষ্যি, পরস্পরের নিবিড় চেনাশোনা, জেনে নেয়ার এই তো মোক্ষম সুযোগ। ও মা, আফাজ আলীর কি ঝিমুনি এসেছে চোখ বুজে আছেন? এমনও হতে পারে, বয়সের ভারে কিংবা কৃশ শরীরের কারণে একটানা কথা বলতে তাঁর কষ্ট হয়। ওই কষ্ট লাঘব করার জন্য তিনি দম নিচ্ছেন। তাঁর কণ্ঠ এবার ধীর, আগের চেয়ে অনুচ্চ।
‘ঢাকায় কয়ডা বুইড়া দালালরে ধরলে হবে ডা কী। গোটা দ্যাশটাই তো গেরাম, সবখানে যুদ্ধাপরাধী আছে। একাত্তরের দালাল শয়তান খুনী গেরামেই বেশি। আমাগো এ গেরামের চ্যায়ারম্যানের বাপ ছিল দালাল-একাত্তরে পাক বাহিনীর দালালী করচে। বুইড়া শয়তানটা এহনো বাঁইচা আচে। এর পোলার পোলা মাইনে দালালের নাতি মহব্বত কইরা এলাকার আওয়ামী নেতার মাইয়ারে বিয়া করচে। সে মহাধুমধামের বিয়া ছিল। কও, বিচার আচার কেমনে হয়? ব্যবসা কও, বাণিজ্য কও, ওঠবস, বিয়া-থাহা কও, এহন এওর কুটুম। ক্যামনে হবে বিচার। আচ্চা, শ্যাখ সাহেবের আত্মীয় আওয়ামী লীগের কোন্্ মন্ত্রী, তার মাইয়ার বলে এমুন বিয়া হইবে?’
জুয়েল নিভে যায়। এই প্রশ্নের সত্য-মিথ্যা কোন উত্তর তার জানা নেই। কাদায় পড়ে থাকা নৌকোর মাথাটা অন্ধকারের কারণে আর দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে চোখ ফেললে নজর ফিরে আসে। গাছপালার পাতা কি নড়ছে, না ইশারা করে তাকে ডাকছেÑ বোঝার উপায় নেই। কেবল পাশের নাম না জানা বেটে গাছটাকে মু-ুহীন মনে হচ্ছে।
No comments