পার্বত্য চট্টগ্রামঃ বাফার স্টেট গঠনের ষড়যন্ত্র by ড.মাহবুব উল্লাহ্
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধিবাসীদের আদিবাসী আখ্যায়িত করার একটি প্রয়াস বেশ ক’বছর ধরেই চলছে। বাংলাদেশী এনজিওদের একটি অংশ, কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা দাবি করছে, এরা উপজাতি নয়; বরং আদিবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়কে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে বিশেষ মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিটগং হিলট্রাক্টস কমিশন ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি এনজিও।
জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক চার্টারে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে—এমন বিধান থাকায় উপজাতীয় কতিপয় নেতা দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তদবির করছে। এ ক্ষেত্রে বামপন্থী বলে পরিচিত কিছু রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরও বিশেষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিপুল অর্থ ব্যয়ে আদিবাসী ইস্যুতে বিপজ্জনক প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে।
যেসব বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী চটকদার স্লোগানে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন তাদের বামপন্থা সম্পর্কে সন্দিহান না হয়ে পারা যায় না। একটি রাষ্ট্রে যদি কোনো বঞ্চিত জনগোষ্ঠী থাকে এবং বিশেষ করে তাদের জাতিগত পরিচয় যদি ভিন্ন হয় তাহলে তাদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে কথা বলা এক জিনিস এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে বুঝে কিংবা না বুঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া অন্য জিনিস। এসব বামপন্থী কি জানেন না জাতিসংঘ কার্যত কোন স্বার্থের পাহারাদার? জাতিসংঘের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ কর্তৃত্বের বিষয়টি এখন আর কারও অজানা থাকার কথা নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রয়োজনে জাতিসংঘকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, আবার প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। ইরাকে আগ্রাসন চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুশ প্রশাসন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার তোয়াক্কা করেনি। অন্যদিকে কোরিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নেতৃত্বে তথাকথিত পুলিশি কার্যক্রম (চড়ষরপব অপঃরড়হ) শুরু হয়েছিল ২৫ জুন ১৯৫০। এই কার্যক্রমের জন্য অজুহাত ছিল উত্তর কোরিয়া বাহিনী সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে বিনা উস্কানিতে ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর আক্রমণ শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ কর্তৃক অবরোধ আরোপের আড়ালে ১৬টি দেশকে সঙ্গে নিয়ে কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত করে। ইরাক আক্রমণের সময়ও একইভাবে বহুজাতিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৬ জাতি বাহিনীর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য উভয়পক্ষ সম্মত হয়। সেই থেকে কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভক্ত হয়ে আছে। অদ্যাবধি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাবিধ অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে। উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার জন্য অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যায্যতার কথা বললে উত্তর কোরিয়াকে কতটুকু দায়ী করা যাবে? সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ উত্তর কোরিয়া, ইরান ও ইরাককে ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সুতরাং এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘোষণাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বসবাস করে তারা যে কেউ এই এলাকার আদিবাসী নয়—তার পক্ষে অজস্র ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও অ-উপজাতি উভয় শ্রেণীর লোক বাস করে। সর্বমোট ১৩টি উপজাতির সবাই বহিরাগত। এরা বিভিন্ন কারণে বিশেষত নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য তিব্বত, চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আসে। এদের মধ্যে চাকমারা তুলনামূলকভাবে নবাগত। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এরা সবাই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ১৩টি উপজাতিরই নিজস্ব কথ্য ভাষা আছে। দু’একটি উপজাতির লেখ্য ভাষা থাকলেও তেমন কোনো ব্যবহার নেই। এক উপজাতি অন্য উপজাতির কথ্য ভাষা বোঝে না। মজার ব্যাপার হলো আন্ত-উপজাতি ভাববিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহৃত হয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শাসিত জনগোষ্ঠীকে বোঝার জন্য ব্যাপক গবেষণাকর্ম চালায়। কারণ, যে জনগোষ্ঠীকে তারা শাসন করছে তাদের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি যদি ভালো করে জানা না যায় তাহলে নির্বিবাদে শাসন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এটি তারা উপলব্ধি করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ক্যাপ্টেন লেউইন নামে একজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা চালান। ১৮৬৯-এ প্রকাশিত লেউইনের সেই গবেষণাগ্রন্থটি আজও পার্বত্য চট্টগ্রামকে জানা ও বোঝার জন্য একটি আকরগ্রন্থ রূপে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থে ১৮৬৭ সালের ২৪ জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম প্রতিনিধির কাছে আরাকান রাজ্যের একটি পত্র উদ্ধৃত করা হয়েছে। পার্বত্য উপজাতীয়রা যে অন্য দেশ ও রাজ্য থেকে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন স্থাপন করেছিল তা এই ঐতিহাসিক পত্র থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। পত্রে লেখা হয়েছিল, ‘আমরা পরস্পর এতদিন বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ ছিলাম এবং এক দেশের অধিবাসীরা অন্য দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারত ... ... ‘ক্রটি’ নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার সাম্রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে জোরপূর্বক আনার ইচ্ছে আমাদের ছিল না বলেই তাকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করে আমরা আপনাদের কাছে বিনয় সহকারে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু আপনারা তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধি নেহায়েত কম নয় এবং ‘ক্রটি’ তার অবাধ্য আচরণ দ্বারা আমাদের রাজশক্তির অবমাননা ও শান্তি ভঙ্গ করেছে। ... ... ডোমকান, চাকমা, কিরূপা, লেইস, মুরং এবং অন্যান্য জাতির লোকও আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে ও আপনাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে তারা উভয় দেশের সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের উপর অত্যাচার ও লুটতরাজ করছে। যেহেতু, তারা আমাদের সাম্রাজ্যের অধিবাসী এবং আমাদের রাজশক্তির অবমাননা করে বর্তমানে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করেছে, ... ... তাদেরকে আশ্রয় দেয়া আপনাদের পক্ষে মোটেই সমীচীন নয় এবং ওই সকল, যারা আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে, তাদেরকেও ফেরত পাঠাতে যথাবিহিত ব্যবস্থা করবেন। এতে আমাদের বন্ধুত্ব সূত্র আরও দৃঢ় হবে এবং দু’দেশের পথিক ও ব্যবসায়ীরা ডাকাতের হাত থেকে অব্যাহতি পাবে।’ দুশ’ বছরেরও অধিককাল আগে আরাকান রাজের লেখা এই পত্র স্পষ্টতই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা তারা চাকমা কিংবা মুরং অথবা অন্য কোনো উপজাতীয় গোষ্ঠীভুক্ত হোক না কেন তাদের কেউই এই এলাকায় আদিবাসী নয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত বিভিন্ন দিবস রয়েছে। সবগুলোর নাম আমিও জানি না। তবে মনে হয় বছরের ৩৬৫ দিনের অধিকাংশ দিনেই এসব দিবস পালিত হয়। এখন বিশ্বব্যাপী রব উঠেছে আদিবাসীদের রক্ষা করতে হবে। রব উঠেছে আদিবাসীদের হারিয়ে যাওয়া ভাষা রক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে ৬০০০’র ও অধিক ভাষা হারিয়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো আদিবাসীরা এবং আদিবাসীদের ভাষা এভাবে হারিয়ে গেল কেন। এর জন্য কি ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার, পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ উপনিবেশবাদ দায়ী নয়?
উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বলে পরিচিত আদিবাসীরা কাদের বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? এখন তো আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বা এমার ইন্ডিয়ানরা চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত প্রাণীদের দশা ভোগ করছে। দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন? অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের কারা নির্মূল করেছে? নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসীদের অবস্থা আজ কী দাঁড়িয়েছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠিত হয়। পূর্বের লীগ অব নেশন্সের মৃত্যু ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদীদের খেয়োখেয়ির ফলেই। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মানবাধিকার ও তত্সম্পর্কিত বহু ঘোষণা গৃহীত হওয়ার কথা আমরা শুনেছি। এর মধ্যে অনেক ঘোষণাই উন্নততর মানব সভ্যতা গঠনের জন্য অপরিহার্য। তবে কিছু কিছু ঘোষণা আছে যেগুলো শাঁখের করাতের মতো দু’দিকেই কাটে। আদিবাসীদের রক্ষা করার বিষয়টিও অনেকটা সে রকম।
আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশবাদীরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আফ্রিকান ভূখণ্ডকে তাদের নিজেদের মধ্যে যেভাবে ভাগ-বাটোয়ারা করেছিল তাতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বহু উপজাতি ও গোত্র একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর মানচিত্রের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক রাষ্ট্রের সীমান্ত সরল রেখায় চিহ্নিত হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় জাতিগত সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব না দিয়েই নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মেটাতে এ রকম খামখেয়ালিপূর্ণ সীমান্তরেখা তারা টেনে দিয়েছিল। উপনিবেশ-উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো তারই উত্তরাধিকার। এর ফলে জাতিগত দাঙ্গা-কলহ আফ্রিকায় নিয়তিতে পরিণত হয়েছে এবং এরই সুযোগে আজও উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোতে হস্তক্ষেপ করছে ও নাক গলাচ্ছে। তাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো আফ্রিকার মূল্যবান খনিজসম্পদ হস্তগত করা। একই উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের লালন করেছে। সুতরাং জাতিসত্তার নামে, গোত্রীয় পরিচয়ের অজুহাতে এবং আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ চলছে অন্তহীনভাবে। আজ যেসব বৃহত্শক্তি বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তা আদিবাসী এবং বিলুপ্ত ভাষার জন্য মায়াকান্না কাঁদছে তারাই তো কালো আফ্রিকার মানুষকে জবরদস্তিমূলকভাবে করায়ত্ত করে উত্তর আমেরিকায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এই অঞ্চলের বাগান কৃষি অর্থনীতিতে বিশেষ করে তুলা চাষের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের দাস শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এদের কোনো অধিকার ছিল না। প্রভুর অনুমতি ছাড়া এদের কোথাও যাওয়ার স্বাধীনতা ছিল না। টম কাকার কুটিরের কাহিনী (টহপষব ঞড়স'ং ঈধনরহ) যাদের পড়া আছে তারা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারেন আমেরিকার দাসত্বপ্রথা কত হৃদয়বিদারক ছিল। আমেরিকার সংবিধান যখন সর্বপ্রথম গৃহীত হয় তখন অনেক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা স্বীকার করে নেয়া হলেও দাসপ্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি ভবিষ্যতে মীমাংসার জন্য রেখে দেয়া হয়। যে ১৪টি রাজ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল তা টিকে থাকত না যদি সংবিধানে দাসপ্রথা উচ্ছেদের ঘোষণা সংযোজন করা হতো। মানবাধিকারের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি ফয়সালা হয়েছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। আব্রাহাম লিঙ্কন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। দাসপ্রথা বাতিল হলো বটে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের বহুবিধ নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত থেকে গেল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রায় ১০০ বছর পরে মার্টিন লুথার কিং, স্টোকলি কার্মাইকেল এবং ম্যালকম এক্সদের মতো নেতাদের নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গদের শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ এবং বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকারগুলো স্বীকৃতি অর্জন করে। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গরা আলাদাকরণ বা ঝবমত্বমধঃরড়হ'র নীতি অনুসরণ করত। অনেক স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতাঙ্গরা ভর্তি হতে পারলেও কৃষ্ণাঙ্গরা ভর্তি হতে পারত না। একই রেস্টুরেন্টে খানাপিনাও করতে পারত না। বাসে-ট্রেনে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গরা পাশাপাশি বসতে পারত না। এটাই হলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং আধুনিকতায় সবচেয়ে প্রাগ্রসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের নীতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়কে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে দিতে বিশেষ মিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চিটাগাং হিলট্রাক্টস কমিশন ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেশ কয়েকটি এনজিও। এ ক্ষেত্রে ইউএনডিপি এবং অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এসব বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীলরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগুলোর জন্য যদি আদিবাসী স্বীকৃতি আনুষ্ঠানিকভাবে আদায় করা সম্ভব হয় তাহলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বতিমুরের মতো একটি বাফার স্টেট প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। অনেকের ধারণা এই বাফার স্টেটের সঙ্গে সংযুক্ত হবে ভারতের মিজেরাম রাজ্যটিও। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মান্তরিতকরণের একটি প্রক্রিয়া চালু আছে। অনেক উপজাতি ইতোমধ্যে তাদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম অথবা বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, কালো আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ পা ফেলেছিল এক হাতে বাইবেল এবং অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে। ঘানার জাতীয়তাবাদী নেতা কোয়ামে নক্রুমা তার ঙহ ঈড়ষড়হরধষরংস গ্রন্থে আফ্রিকায় উপনিবেশবাদের আগমন সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামেও প্রায় একই কায়দায় নব্য উপনিবেশবাদ ভয়াবহ পদচারণা শুরু করেছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২৮ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়কে আদিবাসী অভিহিত করার অপতত্পরতা’ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসকদের কাছে এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। প্রেরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতি বাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কোথাও আদিবাসী অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি সাংবাদিকরা ইদানীং উপজাতি না বলে আদিবাসী বলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে প্রজ্ঞাপনে নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সরকারদলীয় এমপি জনাব আসাদুজ্জামান নূর, মহাজোটের অংশীদার এমপি জনাব রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের জন্য রীতিমত দৃঢ় অবস্থানে আছেন। এদের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিরা উপজাতি ও আদিবাসীর পার্থক্য বোঝেন না, তা আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই। পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বাফার স্টেটে পরিণত করার আসল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ থেকে ভূখণ্ড ছিনতাই করে একটি চীনবিরোধী যুদ্ধঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে যদি বাঙালিদের উচ্ছেদ করা যায় তাহলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য এবং চিটাগং হিলট্রাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান মিস্টার এবি ভেরি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে আসার পর হঠাত্ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সঙ্গে ভারতভিত্তিক সংস্থা এশিয়ান সেন্�
যেসব বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী চটকদার স্লোগানে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন তাদের বামপন্থা সম্পর্কে সন্দিহান না হয়ে পারা যায় না। একটি রাষ্ট্রে যদি কোনো বঞ্চিত জনগোষ্ঠী থাকে এবং বিশেষ করে তাদের জাতিগত পরিচয় যদি ভিন্ন হয় তাহলে তাদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে কথা বলা এক জিনিস এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে বুঝে কিংবা না বুঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া অন্য জিনিস। এসব বামপন্থী কি জানেন না জাতিসংঘ কার্যত কোন স্বার্থের পাহারাদার? জাতিসংঘের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ কর্তৃত্বের বিষয়টি এখন আর কারও অজানা থাকার কথা নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রয়োজনে জাতিসংঘকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, আবার প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। ইরাকে আগ্রাসন চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুশ প্রশাসন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার তোয়াক্কা করেনি। অন্যদিকে কোরিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নেতৃত্বে তথাকথিত পুলিশি কার্যক্রম (চড়ষরপব অপঃরড়হ) শুরু হয়েছিল ২৫ জুন ১৯৫০। এই কার্যক্রমের জন্য অজুহাত ছিল উত্তর কোরিয়া বাহিনী সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে বিনা উস্কানিতে ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর আক্রমণ শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ কর্তৃক অবরোধ আরোপের আড়ালে ১৬টি দেশকে সঙ্গে নিয়ে কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত করে। ইরাক আক্রমণের সময়ও একইভাবে বহুজাতিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৬ জাতি বাহিনীর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য উভয়পক্ষ সম্মত হয়। সেই থেকে কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভক্ত হয়ে আছে। অদ্যাবধি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাবিধ অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে। উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার জন্য অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যায্যতার কথা বললে উত্তর কোরিয়াকে কতটুকু দায়ী করা যাবে? সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ উত্তর কোরিয়া, ইরান ও ইরাককে ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সুতরাং এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘোষণাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বসবাস করে তারা যে কেউ এই এলাকার আদিবাসী নয়—তার পক্ষে অজস্র ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও অ-উপজাতি উভয় শ্রেণীর লোক বাস করে। সর্বমোট ১৩টি উপজাতির সবাই বহিরাগত। এরা বিভিন্ন কারণে বিশেষত নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য তিব্বত, চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আসে। এদের মধ্যে চাকমারা তুলনামূলকভাবে নবাগত। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এরা সবাই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ১৩টি উপজাতিরই নিজস্ব কথ্য ভাষা আছে। দু’একটি উপজাতির লেখ্য ভাষা থাকলেও তেমন কোনো ব্যবহার নেই। এক উপজাতি অন্য উপজাতির কথ্য ভাষা বোঝে না। মজার ব্যাপার হলো আন্ত-উপজাতি ভাববিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহৃত হয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শাসিত জনগোষ্ঠীকে বোঝার জন্য ব্যাপক গবেষণাকর্ম চালায়। কারণ, যে জনগোষ্ঠীকে তারা শাসন করছে তাদের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি যদি ভালো করে জানা না যায় তাহলে নির্বিবাদে শাসন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এটি তারা উপলব্ধি করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ক্যাপ্টেন লেউইন নামে একজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা চালান। ১৮৬৯-এ প্রকাশিত লেউইনের সেই গবেষণাগ্রন্থটি আজও পার্বত্য চট্টগ্রামকে জানা ও বোঝার জন্য একটি আকরগ্রন্থ রূপে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থে ১৮৬৭ সালের ২৪ জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম প্রতিনিধির কাছে আরাকান রাজ্যের একটি পত্র উদ্ধৃত করা হয়েছে। পার্বত্য উপজাতীয়রা যে অন্য দেশ ও রাজ্য থেকে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন স্থাপন করেছিল তা এই ঐতিহাসিক পত্র থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। পত্রে লেখা হয়েছিল, ‘আমরা পরস্পর এতদিন বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ ছিলাম এবং এক দেশের অধিবাসীরা অন্য দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারত ... ... ‘ক্রটি’ নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার সাম্রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে জোরপূর্বক আনার ইচ্ছে আমাদের ছিল না বলেই তাকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করে আমরা আপনাদের কাছে বিনয় সহকারে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু আপনারা তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধি নেহায়েত কম নয় এবং ‘ক্রটি’ তার অবাধ্য আচরণ দ্বারা আমাদের রাজশক্তির অবমাননা ও শান্তি ভঙ্গ করেছে। ... ... ডোমকান, চাকমা, কিরূপা, লেইস, মুরং এবং অন্যান্য জাতির লোকও আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে ও আপনাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে তারা উভয় দেশের সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের উপর অত্যাচার ও লুটতরাজ করছে। যেহেতু, তারা আমাদের সাম্রাজ্যের অধিবাসী এবং আমাদের রাজশক্তির অবমাননা করে বর্তমানে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করেছে, ... ... তাদেরকে আশ্রয় দেয়া আপনাদের পক্ষে মোটেই সমীচীন নয় এবং ওই সকল, যারা আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে, তাদেরকেও ফেরত পাঠাতে যথাবিহিত ব্যবস্থা করবেন। এতে আমাদের বন্ধুত্ব সূত্র আরও দৃঢ় হবে এবং দু’দেশের পথিক ও ব্যবসায়ীরা ডাকাতের হাত থেকে অব্যাহতি পাবে।’ দুশ’ বছরেরও অধিককাল আগে আরাকান রাজের লেখা এই পত্র স্পষ্টতই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা তারা চাকমা কিংবা মুরং অথবা অন্য কোনো উপজাতীয় গোষ্ঠীভুক্ত হোক না কেন তাদের কেউই এই এলাকায় আদিবাসী নয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত বিভিন্ন দিবস রয়েছে। সবগুলোর নাম আমিও জানি না। তবে মনে হয় বছরের ৩৬৫ দিনের অধিকাংশ দিনেই এসব দিবস পালিত হয়। এখন বিশ্বব্যাপী রব উঠেছে আদিবাসীদের রক্ষা করতে হবে। রব উঠেছে আদিবাসীদের হারিয়ে যাওয়া ভাষা রক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে ৬০০০’র ও অধিক ভাষা হারিয়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো আদিবাসীরা এবং আদিবাসীদের ভাষা এভাবে হারিয়ে গেল কেন। এর জন্য কি ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার, পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ উপনিবেশবাদ দায়ী নয়?
উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বলে পরিচিত আদিবাসীরা কাদের বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? এখন তো আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বা এমার ইন্ডিয়ানরা চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত প্রাণীদের দশা ভোগ করছে। দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন? অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের কারা নির্মূল করেছে? নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসীদের অবস্থা আজ কী দাঁড়িয়েছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠিত হয়। পূর্বের লীগ অব নেশন্সের মৃত্যু ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদীদের খেয়োখেয়ির ফলেই। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মানবাধিকার ও তত্সম্পর্কিত বহু ঘোষণা গৃহীত হওয়ার কথা আমরা শুনেছি। এর মধ্যে অনেক ঘোষণাই উন্নততর মানব সভ্যতা গঠনের জন্য অপরিহার্য। তবে কিছু কিছু ঘোষণা আছে যেগুলো শাঁখের করাতের মতো দু’দিকেই কাটে। আদিবাসীদের রক্ষা করার বিষয়টিও অনেকটা সে রকম।
আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশবাদীরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আফ্রিকান ভূখণ্ডকে তাদের নিজেদের মধ্যে যেভাবে ভাগ-বাটোয়ারা করেছিল তাতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বহু উপজাতি ও গোত্র একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর মানচিত্রের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক রাষ্ট্রের সীমান্ত সরল রেখায় চিহ্নিত হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় জাতিগত সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব না দিয়েই নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মেটাতে এ রকম খামখেয়ালিপূর্ণ সীমান্তরেখা তারা টেনে দিয়েছিল। উপনিবেশ-উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো তারই উত্তরাধিকার। এর ফলে জাতিগত দাঙ্গা-কলহ আফ্রিকায় নিয়তিতে পরিণত হয়েছে এবং এরই সুযোগে আজও উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোতে হস্তক্ষেপ করছে ও নাক গলাচ্ছে। তাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো আফ্রিকার মূল্যবান খনিজসম্পদ হস্তগত করা। একই উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের লালন করেছে। সুতরাং জাতিসত্তার নামে, গোত্রীয় পরিচয়ের অজুহাতে এবং আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ চলছে অন্তহীনভাবে। আজ যেসব বৃহত্শক্তি বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তা আদিবাসী এবং বিলুপ্ত ভাষার জন্য মায়াকান্না কাঁদছে তারাই তো কালো আফ্রিকার মানুষকে জবরদস্তিমূলকভাবে করায়ত্ত করে উত্তর আমেরিকায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এই অঞ্চলের বাগান কৃষি অর্থনীতিতে বিশেষ করে তুলা চাষের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের দাস শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এদের কোনো অধিকার ছিল না। প্রভুর অনুমতি ছাড়া এদের কোথাও যাওয়ার স্বাধীনতা ছিল না। টম কাকার কুটিরের কাহিনী (টহপষব ঞড়স'ং ঈধনরহ) যাদের পড়া আছে তারা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারেন আমেরিকার দাসত্বপ্রথা কত হৃদয়বিদারক ছিল। আমেরিকার সংবিধান যখন সর্বপ্রথম গৃহীত হয় তখন অনেক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা স্বীকার করে নেয়া হলেও দাসপ্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি ভবিষ্যতে মীমাংসার জন্য রেখে দেয়া হয়। যে ১৪টি রাজ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল তা টিকে থাকত না যদি সংবিধানে দাসপ্রথা উচ্ছেদের ঘোষণা সংযোজন করা হতো। মানবাধিকারের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি ফয়সালা হয়েছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। আব্রাহাম লিঙ্কন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। দাসপ্রথা বাতিল হলো বটে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের বহুবিধ নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত থেকে গেল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রায় ১০০ বছর পরে মার্টিন লুথার কিং, স্টোকলি কার্মাইকেল এবং ম্যালকম এক্সদের মতো নেতাদের নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গদের শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ এবং বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকারগুলো স্বীকৃতি অর্জন করে। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গরা আলাদাকরণ বা ঝবমত্বমধঃরড়হ'র নীতি অনুসরণ করত। অনেক স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতাঙ্গরা ভর্তি হতে পারলেও কৃষ্ণাঙ্গরা ভর্তি হতে পারত না। একই রেস্টুরেন্টে খানাপিনাও করতে পারত না। বাসে-ট্রেনে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গরা পাশাপাশি বসতে পারত না। এটাই হলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং আধুনিকতায় সবচেয়ে প্রাগ্রসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের নীতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়কে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে দিতে বিশেষ মিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চিটাগাং হিলট্রাক্টস কমিশন ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেশ কয়েকটি এনজিও। এ ক্ষেত্রে ইউএনডিপি এবং অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এসব বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীলরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগুলোর জন্য যদি আদিবাসী স্বীকৃতি আনুষ্ঠানিকভাবে আদায় করা সম্ভব হয় তাহলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বতিমুরের মতো একটি বাফার স্টেট প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। অনেকের ধারণা এই বাফার স্টেটের সঙ্গে সংযুক্ত হবে ভারতের মিজেরাম রাজ্যটিও। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মান্তরিতকরণের একটি প্রক্রিয়া চালু আছে। অনেক উপজাতি ইতোমধ্যে তাদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম অথবা বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, কালো আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ পা ফেলেছিল এক হাতে বাইবেল এবং অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে। ঘানার জাতীয়তাবাদী নেতা কোয়ামে নক্রুমা তার ঙহ ঈড়ষড়হরধষরংস গ্রন্থে আফ্রিকায় উপনিবেশবাদের আগমন সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামেও প্রায় একই কায়দায় নব্য উপনিবেশবাদ ভয়াবহ পদচারণা শুরু করেছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২৮ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়কে আদিবাসী অভিহিত করার অপতত্পরতা’ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসকদের কাছে এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। প্রেরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতি বাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কোথাও আদিবাসী অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি সাংবাদিকরা ইদানীং উপজাতি না বলে আদিবাসী বলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে প্রজ্ঞাপনে নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সরকারদলীয় এমপি জনাব আসাদুজ্জামান নূর, মহাজোটের অংশীদার এমপি জনাব রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের জন্য রীতিমত দৃঢ় অবস্থানে আছেন। এদের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিরা উপজাতি ও আদিবাসীর পার্থক্য বোঝেন না, তা আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই। পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বাফার স্টেটে পরিণত করার আসল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ থেকে ভূখণ্ড ছিনতাই করে একটি চীনবিরোধী যুদ্ধঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে যদি বাঙালিদের উচ্ছেদ করা যায় তাহলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য এবং চিটাগং হিলট্রাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান মিস্টার এবি ভেরি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে আসার পর হঠাত্ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সঙ্গে ভারতভিত্তিক সংস্থা এশিয়ান সেন্�
No comments