কবি নজরুল ॥ যাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই by নিয়ামত হোসেন
আজ ১২ ভাদ্র। আমাদের সবার প্রিয় সেই মানুষটির তিরোধান দিবস। তাঁর কথা স্মরণ করতে গেলে স্মরণে আসে বহু কথা, বহু তথ্য। আসলেই তিনি একজন বিস্ময়কর মানুষ। পশ্চিবঙ্গের বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলের লেটোর দলের সেই ছোট্ট বালকটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
তাঁর গোটা জীবনের ঘটনাবলী চিন্তা করলে দেখা যায়, তাঁর আগমটাই ছিল বিস্ময়কর। তারপর একের পর এক বিস্ময়। একটা কবিতা লিখলেন। নাম ‘বিদ্রোহী’। তখন ভারত ভাগ হয়নি। তখনকার সমগ্র বঙ্গে চমক সৃষ্টি হলো। লোকের মুখে মুখে তখন এই কবিতা এবং কবির কথা। কেউ ভাল করে চেনেনা, জানে না। হঠাৎ করে কবিতাটা লিখে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি অগণিত পাঠক তথা মানুষের কাছে সৃষ্টি করলেন বিস্ময়। বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী জায়গা হয়ে গেল তাঁর।
এটাই শেষ নয়। এরপরে একের পর এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেন একেকটি লেখায় একেকটি বইতে। ‘অগ্নিবীণা’ ‘বিষের বাঁশি’ ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’ এভাবে একের পর এক বই বের হচ্ছে এবং নতুন নতুন চমক সৃষ্টি হচ্ছে। লোকে বুঝল, এ কবির কবিতা আলাদা, কবিতার ভাষা আলাদা, বিষয়বস্তুও আলাদা। তারপর আবার চমক। এমন এক পর্যায় এল যখন কলকাতায় তাঁর একটার পর একটা বই বের হচ্ছে আর ব্রিটিশ সরকার সেটাকে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা বাংলা সাহিত্যে। আরেক বিস্ময় কবিতা লেখার অপরাধে জেল হয়ে গেল নজরুলের। একেবারে তরুণ এক কবি। তাঁর স্বদেশ বিদেশীদের কব্জায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা তখন শাসন ও শোষণ করছে। তিনি কলম ধরলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। শাসক শ্রেণী তাঁর ওপর প্রচ- নাখোশ। জেলে দিল কবিকে। জেলের নানা নিয়মবিধি। তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুল অনশন ধর্মঘট করলেন জেলখানায়। দেশে বিখ্যাত সব মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন কবির স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। বরীন্দ্রনাথ জরুরী টেলিগ্রাম পাঠালেন নজরুলের কাছে। তাতে তিনি জানালেন অনশন ভঙ্গ কর, আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়। অর্থাৎ তোমাকে আমাদের সাহিত্যের প্রয়োজন রয়েছে। ঐ সময়ই রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বই উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। বইটির নাম ‘বসন্ত’। শীতের জড়তা কটিয়ে বসন্ত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে নতুন জীবনের প্রেরণা, জাগিয়ে তোলে সবাইকে অর্থাৎ বসন্ত জাগরণের দূত। রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের দূত মনে করতেন।
বিদ্রোহী কবিতা লিখে নজরুল রাতারাতি খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। আসলে তিনি বিদ্রোহী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী সামাজিক অসাম্য, অত্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত নিপীড়িত গণমানুষের কথা, তাঁদের বেদনা, তাদের দীর্ঘশ্বাসÑসবই মূর্ত হয়ে উঠছে নজরুলের কবিতায়। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন নিপীড়িত মানুষের কবি, শোষিত মানুষের কবি, সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কবি। নজরুলের কবিতা, গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, জাগিয়ে তুলেছে, প্রেরণা দিয়েছে। কলকাতায় নজরুলকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সংবর্ধনা দিচ্ছেন, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সে সভার সভাপতি। অনেক বড় বড় মানুষ ভাষণ দিলেন। এক সময় উঠলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর বক্তব্য, তিনি বহু জায়গায় গিয়েছেন, সেসব স্থানের বহু গান শুনেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরুর’ মতো গান কোথাও শোনেননি। অসাধারণ এই গান। তিনি জানালেন, ‘আমরা জেলে যাওয়ার সময় এই গান গাইব, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও এই গান গাইব।’
এরপর মাত্র কয়েক বছর লেখার সময় পেলেন নজরুল। এর মধ্যে কত কিছু করলেন। একের পর এক কবিতা, গল্প উপন্যাস এবং অগণিত গান লিখলেন। নতুন নতুন সুরও তৈরি করলেন। সিনেমা বানালেন। সিনেমাতে অভিনয়ও করলেন। তাঁর গানের ভা-ার বিশাল। বিরাট প্রতিভার অধিকারী এই কবি যা সৃষ্টি করেছেন তা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ, যার তুলনা হয় না। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি লেখার এবং কথা বলার শক্তি হারান। তারপর চিকিৎসা হয়, কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে বিদেশেও চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু কবি আর সেরে ওঠেননি।
তারপর অনেক ঘটনা। অনেক ইতিহাস সৃষ্টি। ভারত বিভক্ত হলো। সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আশা করেছিল হয়ত তারা সত্যিকার অর্থে মুক্ত হবে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই স্বপ্নভঙ্গ হলো। দেখা গেল এক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন গেলেও জেঁকে বসেছে অনেক আধা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসন। একটা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা। চলছে তাদের শাসন ও শোষণ অবাধে। তারা বাঙালীর স্বাধীনতার শত্রু, সংস্কৃতির শত্রু। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেবার জন্য বহু চেষ্টা হলো। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হলো। তারা মানবে না। রক্ত ঝরল একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে। শুধু ভাষা-সংস্কৃতির দিক কেনÑকোন দিকেই তারা বাঙালীর হাতে কোন কিছু দেবে না। শুরু হলো আন্দোলন মিছিল। জেল জুলুম। মানুষ পথে নামছে, আন্দোলন করছে, সঙ্গে প্রিয় কবি নজরুল। তাঁর ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু/দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানে গানে উদ্দীপনা পাচ্ছে মানুষ। ছাত্র-জনতা সাধারণ মানুষ শপথ নিচ্ছে মনে প্রাণে। অত্যাচার জুলুম যত বাড়ছে, জেলখানা যত ভরে উঠছে ততই জোরে ধ্বনিত হচ্ছে নজরুলের গান : ‘কাবার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট।’ গাওয়া হচ্ছে ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি গান। মানুষ বুকে সাহস পাচ্ছে।
পাকিস্তানী আমলে বাঙালীর এই প্রাণের কবি নজরুলের প্রতিও কম অন্যায় করা হয়নি। এক শ্রেণীর তাঁবেদার নজরুলকে উপস্থাপন করেছে খ-িতভাবে। নজরুলের লেখা যে কত ব্যাপক তার ব্যাপ্তি যে কতখানি সেসব চেপে রাখার চেষ্টা হয়েছে নানাভাবে। নজরুলের কোন কোন কবিতাকে কোন কোন ‘মহাপ-িত’ কারেকশন করে ছেপেছেন। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে!
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিলেন নজরুলকে বাংলাদেশে আনার। তাঁরই উদ্যোগে ও চেষ্টায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় কবিকে আনা হলো ঢাকায়। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল দেশে। যে কবির কবিতা শিশুকাল থেকে মানুষ পড়েছে আসছে, যে কবি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি পুরুষের মতো, তাঁকে নিজ চোখে দেখে হাজার হাজার মানুষ আনন্দে আপ্লুত। দলে দলে মানুষ ছুটে গেছে ধানম-ির কবি ভবনে। কবিকে দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছে তেমনি তাঁর অসুস্থ অবস্থা এবং বার্ধক্য দেখে মনে বেদনা বোধ করেছে। কবি সবার কাছে তরুণ, বার্ধক্য তাঁকে জড়াতে পারে না। তিনি যৌবনের কবি, জীবনের কবি। মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন প্রেরণা দিয়েছেন কবি নজরুল, তেমনি প্রেরণা দিয়েছেন সামাজিক এবং জাতিগতভাবে গোটা দেশকে। উদ্দীপিত করেছেন যোদ্ধাদের, সীমাহীন প্রেরণা ও সাহস জুড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে।
নজরুল এখনও প্রাসঙ্গিক আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও। নজরুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তিনি কূপম-ূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানির বিরুদ্ধে। নজরুল সাম্যের পক্ষে। নজরুল নারী জাগরণের এক মহাকবি। তিনি বিশ্ব মানবতার কবি। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের ঋণের শেষ নেই।
আজ এই বিশেষ দিনে এই মহান মানবতাবাদী কবির স্মৃতির প্রতি হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা।
এটাই শেষ নয়। এরপরে একের পর এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেন একেকটি লেখায় একেকটি বইতে। ‘অগ্নিবীণা’ ‘বিষের বাঁশি’ ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’ এভাবে একের পর এক বই বের হচ্ছে এবং নতুন নতুন চমক সৃষ্টি হচ্ছে। লোকে বুঝল, এ কবির কবিতা আলাদা, কবিতার ভাষা আলাদা, বিষয়বস্তুও আলাদা। তারপর আবার চমক। এমন এক পর্যায় এল যখন কলকাতায় তাঁর একটার পর একটা বই বের হচ্ছে আর ব্রিটিশ সরকার সেটাকে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা বাংলা সাহিত্যে। আরেক বিস্ময় কবিতা লেখার অপরাধে জেল হয়ে গেল নজরুলের। একেবারে তরুণ এক কবি। তাঁর স্বদেশ বিদেশীদের কব্জায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা তখন শাসন ও শোষণ করছে। তিনি কলম ধরলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। শাসক শ্রেণী তাঁর ওপর প্রচ- নাখোশ। জেলে দিল কবিকে। জেলের নানা নিয়মবিধি। তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুল অনশন ধর্মঘট করলেন জেলখানায়। দেশে বিখ্যাত সব মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন কবির স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। বরীন্দ্রনাথ জরুরী টেলিগ্রাম পাঠালেন নজরুলের কাছে। তাতে তিনি জানালেন অনশন ভঙ্গ কর, আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়। অর্থাৎ তোমাকে আমাদের সাহিত্যের প্রয়োজন রয়েছে। ঐ সময়ই রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বই উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। বইটির নাম ‘বসন্ত’। শীতের জড়তা কটিয়ে বসন্ত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে নতুন জীবনের প্রেরণা, জাগিয়ে তোলে সবাইকে অর্থাৎ বসন্ত জাগরণের দূত। রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের দূত মনে করতেন।
বিদ্রোহী কবিতা লিখে নজরুল রাতারাতি খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। আসলে তিনি বিদ্রোহী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী সামাজিক অসাম্য, অত্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত নিপীড়িত গণমানুষের কথা, তাঁদের বেদনা, তাদের দীর্ঘশ্বাসÑসবই মূর্ত হয়ে উঠছে নজরুলের কবিতায়। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন নিপীড়িত মানুষের কবি, শোষিত মানুষের কবি, সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কবি। নজরুলের কবিতা, গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, জাগিয়ে তুলেছে, প্রেরণা দিয়েছে। কলকাতায় নজরুলকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সংবর্ধনা দিচ্ছেন, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সে সভার সভাপতি। অনেক বড় বড় মানুষ ভাষণ দিলেন। এক সময় উঠলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর বক্তব্য, তিনি বহু জায়গায় গিয়েছেন, সেসব স্থানের বহু গান শুনেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরুর’ মতো গান কোথাও শোনেননি। অসাধারণ এই গান। তিনি জানালেন, ‘আমরা জেলে যাওয়ার সময় এই গান গাইব, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও এই গান গাইব।’
এরপর মাত্র কয়েক বছর লেখার সময় পেলেন নজরুল। এর মধ্যে কত কিছু করলেন। একের পর এক কবিতা, গল্প উপন্যাস এবং অগণিত গান লিখলেন। নতুন নতুন সুরও তৈরি করলেন। সিনেমা বানালেন। সিনেমাতে অভিনয়ও করলেন। তাঁর গানের ভা-ার বিশাল। বিরাট প্রতিভার অধিকারী এই কবি যা সৃষ্টি করেছেন তা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ, যার তুলনা হয় না। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি লেখার এবং কথা বলার শক্তি হারান। তারপর চিকিৎসা হয়, কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। পরে তাঁকে বিদেশেও চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু কবি আর সেরে ওঠেননি।
তারপর অনেক ঘটনা। অনেক ইতিহাস সৃষ্টি। ভারত বিভক্ত হলো। সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আশা করেছিল হয়ত তারা সত্যিকার অর্থে মুক্ত হবে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই স্বপ্নভঙ্গ হলো। দেখা গেল এক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন গেলেও জেঁকে বসেছে অনেক আধা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসন। একটা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা। চলছে তাদের শাসন ও শোষণ অবাধে। তারা বাঙালীর স্বাধীনতার শত্রু, সংস্কৃতির শত্রু। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেবার জন্য বহু চেষ্টা হলো। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হলো। তারা মানবে না। রক্ত ঝরল একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে। শুধু ভাষা-সংস্কৃতির দিক কেনÑকোন দিকেই তারা বাঙালীর হাতে কোন কিছু দেবে না। শুরু হলো আন্দোলন মিছিল। জেল জুলুম। মানুষ পথে নামছে, আন্দোলন করছে, সঙ্গে প্রিয় কবি নজরুল। তাঁর ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু/দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানে গানে উদ্দীপনা পাচ্ছে মানুষ। ছাত্র-জনতা সাধারণ মানুষ শপথ নিচ্ছে মনে প্রাণে। অত্যাচার জুলুম যত বাড়ছে, জেলখানা যত ভরে উঠছে ততই জোরে ধ্বনিত হচ্ছে নজরুলের গান : ‘কাবার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট।’ গাওয়া হচ্ছে ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি গান। মানুষ বুকে সাহস পাচ্ছে।
পাকিস্তানী আমলে বাঙালীর এই প্রাণের কবি নজরুলের প্রতিও কম অন্যায় করা হয়নি। এক শ্রেণীর তাঁবেদার নজরুলকে উপস্থাপন করেছে খ-িতভাবে। নজরুলের লেখা যে কত ব্যাপক তার ব্যাপ্তি যে কতখানি সেসব চেপে রাখার চেষ্টা হয়েছে নানাভাবে। নজরুলের কোন কোন কবিতাকে কোন কোন ‘মহাপ-িত’ কারেকশন করে ছেপেছেন। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে!
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিলেন নজরুলকে বাংলাদেশে আনার। তাঁরই উদ্যোগে ও চেষ্টায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় কবিকে আনা হলো ঢাকায়। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল দেশে। যে কবির কবিতা শিশুকাল থেকে মানুষ পড়েছে আসছে, যে কবি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি পুরুষের মতো, তাঁকে নিজ চোখে দেখে হাজার হাজার মানুষ আনন্দে আপ্লুত। দলে দলে মানুষ ছুটে গেছে ধানম-ির কবি ভবনে। কবিকে দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছে তেমনি তাঁর অসুস্থ অবস্থা এবং বার্ধক্য দেখে মনে বেদনা বোধ করেছে। কবি সবার কাছে তরুণ, বার্ধক্য তাঁকে জড়াতে পারে না। তিনি যৌবনের কবি, জীবনের কবি। মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন প্রেরণা দিয়েছেন কবি নজরুল, তেমনি প্রেরণা দিয়েছেন সামাজিক এবং জাতিগতভাবে গোটা দেশকে। উদ্দীপিত করেছেন যোদ্ধাদের, সীমাহীন প্রেরণা ও সাহস জুড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে।
নজরুল এখনও প্রাসঙ্গিক আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও। নজরুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তিনি কূপম-ূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানির বিরুদ্ধে। নজরুল সাম্যের পক্ষে। নজরুল নারী জাগরণের এক মহাকবি। তিনি বিশ্ব মানবতার কবি। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের ঋণের শেষ নেই।
আজ এই বিশেষ দিনে এই মহান মানবতাবাদী কবির স্মৃতির প্রতি হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা।
No comments