স্বদেশে কেমন থাকেন বাঙালীরা? by সুলতানা আজীম
শিরোনামটি স্বদেশে হলেও লিখবো আমি প্রধানত ঢাকার কথা। মানে, ঢাকায় কেমন থাকেন বাঙালীরা। প্রাসঙ্গিকভাবে আসতে পারে ঢাকার বাইরের কথা। অন্য অনেক কথা। যা লেখার কোন রকম পরিকল্পনা নেই, থাকতে পারে তেমন বিষয়ও। কারণটি কি? প্রথাগত শৃঙ্খলা মেনে লিখতে পারি না আমি। খুব পরিকল্পিতও নয় আমার লেখা।
বাঙালী বলতে, সচ্ছল এবং ধনী বাঙালীদের সম্পর্কে লিখতে চাচ্ছি প্রথম। এদেশের অধিকাংশ মানুষ, দরিদ্র যারা, মানবেতর জীবন যাদের, তাদের কি বাঙালী মনে করি আমরা? মানুষ কি মনে করি তাদের? করি না। তাঁরা কেমন থাকেন নিজের দেশে, তাতে আমাদের আগ্রহ কতটুকু? সেজন্যেই তাদের জীবনযাপন নিয়ে লিখবো পরে।
বাংলাদেশ একটি জাতি, একটি মাতৃভাষার দেশ হলেও, এর অজস্র চেহারা। সব লিখে বোঝানো অসম্ভব। সব নয়, কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো।
‘বড়লোক’ বলা হয় ধনীদের এদেশে। লেখাও হয়। যুক্তি এবং কারণ কি জানি না। সঠিক অর্থ কি শব্দটির, বুঝতে পারি না। এই শব্দ কোনো মানুষের ওপর প্রজোয্য হতে পারে না বলে মনে করি আমি। তাই ব্যবহার করি না শব্দটি। একইভাবে ‘ছোটলোক’ শব্দটিও নয়।
লিখতে শুরু করেছিলাম এটি দু’হাজার পাঁচ সালে। শেষ করিনি, আমার স্বভাবের নিয়মে। ভুলে গিয়েছিলাম অসমাপ্ত এই লেখাটির কথা। পুরনো অংশ যোগ করতে যেয়ে ঝামেলায় পড়েছি। কারণ হচ্ছে, পরিস্থিতির ব্যবধান। যারা পড়বেন, তাঁরা যদি বোঝেন ব্যাপারটি, তা হলেই হবে।
নিজের দেশে আমার জীবনযাপন কেমন, তা নিয়ে লিখছি শুরুতে। ‘সংক্ষেপ’ শব্দটি মনে রেখে। ধারণা করছি, এটা হবে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতা। আমার দৃষ্টিভঙ্গি চেতনা ও মানসিকতার সাথে একমতও হতে পারেন কেউ কেউ।
অজস্র শ্রেণীতে বিভক্ত মানুষের এই দেশে, কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি আমি। শ্রেণীহীন এই আমার, কোন সম্পত্তি নেই বাংলাদেশে। সম্পত্তি, লোভ আর ভোগ বিলাস ব্যাপারগুলো, আগ্রহের বিষয় ছিলো না কখনো। নেই এখনো। জীবন সম্পর্কে নিজের যে দর্শন তা হচ্ছে, এই জীবনটি একটি দৈব। পৃথিবীতে নাও আসতে পারতাম। তাতে কিছুই যেত আসত না কারো। জন্মেছি কোথায়, দৈব সেটাও। রাস্তার নর্দমার পাশে, অথবা কোন প্রাসাদে জন্ম হতে পারতো। হতে পারতো, পৃথিবীর যে কোন স্থানে। যেখানে রয়েছে মানুষের সমাজ। আদিবাসী সমাজেও।
গুরুত্ব কি এই প্রকৃতির কাছে মানুষ হিসেবে আমার? না, কোন গুরুত্বই নেই। প্রকৃতির কাউকে, কোন কিছুকেই চেনে না প্রকৃতি। ‘অন্ধ ঘড়ি নির্মাতা’ বলেছেন তাই বিজ্ঞানী ‘রিচার্ড ডাওকিন্স’ প্রকৃতিকে। বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের ভেতরে দুইশত বছর যদি বেঁচে থাকি, তাও কিছু নয়। জীবন এই মুহূর্তের। পরের মুহূর্তে নাও থাকতে পারে। এক সেকেন্ডের এই জীবনটি, তবুও সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। অপরূপ এই জীবনটি পেয়েছি আমি, একবারের জন্যে। প্রকৃতির কারো কোন রকম ক্ষতি না করে, কিভাবে কাটাবো নিজের জীবন, সেই সিদ্ধান্ত শুধুই আমার।
খানিকটা সচ্ছলভাবে চলার মতো টাকা উপার্জন করবো, সততার সাথে। নিয়মিত অভাবের অশান্তি যেনো বিঘিœত করতে না পারে, জীবনের অসীম সৌন্দর্যকে। ভালোবাসবো প্রকৃতির সব কিছুকে, যা সাহায্য করছে বাঁচিয়ে রাখতে আমাকে। রক্ষা করবো প্রকৃতির মর্যাদা এবং সম্মান, সবটুকু দায়িত্ব মেনে। থাকবো সুস্থ, যতটা সম্ভব, শরীরে মনে মগজে। হাসবো দু’ঠোঁট ভরে, যত পারি। ঘুমাবো, নিশ্চিন্তে আর পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে। অনুভব করবো প্রতিদিন, সেভাবেই বেঁচে আছি যেভাবে বাঁচতে চাচ্ছি। জীবনের প্রধান সুখ আমার এটা। নিজের ইচ্ছে আর আনন্দে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা।
নিজের জন্যে যে বাঁচে, সে আসলে বাঁচে না। অন্যের জন্যে যে বাঁচে, সে কখনো মরে না। মেনে চলবো নিজের এই দর্শন, প্রতিদিনের কর্মকা-ে। চলে যাবার সময় যেনো অনুভব করি, এসেছিলাম মানুষ হিসেবে। ফিরেও যাচ্ছি সেভাবে। নিয়ে আসিনি কোন সম্পত্তি সাথে করে। রেখেও যাচ্ছি না কিছু। যা রইলো, তা আমার কাজগুলো আর আমার দর্শন, যদি তা হয়ে থাকে কল্যাণকর। আর সম্পদ? গেত আমার মগজ, চরিত্র, আর যৌক্তিক চেতনা। এর চেয়ে বড় সম্পদ, কি আর হতে পারে মানুষের?
লোভ ভোগ আর স্বার্থকে সব কিছুর ওপরে মেনে, তা আদায় করতে যেয়েই কি জটিল আর কঠিন করে তুলি না আমরা, খুব ছোট্ট এ জীবন? জীবনের স্বার্থ তো এই, বেঁচে থাকা, যতদিন পারি। স্বার্থ তো এই, বেঁচে থাকা সুস্থভাবে, যতটা সম্ভব। স্বার্থ আরও একটি, নিজে বাঁচি, অন্যকেও বাঁচতে দিই। এসো আমরা সবাই মিলে চমৎকারভাবে বাঁচি। সব মানুষ, প্রাণী এবং প্রকৃতির অধিকার রক্ষা করে যে জীবন, তা-ই সবচেয়ে সুন্দর। সে জীবনে না পাওয়ার অভাব আর বেদনা থাকে না।
‘জীবন অর্থহীন, তাই তাকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করে মানুষ বিভিন্নভাবে।’ আলবেয়ার ক্যামোর এই দর্শন মানতে পারিনি আমি। অপূর্ব এই জীবনটি যে যাপন করতে পারছি নিজের ইচ্ছে মতো, এটাই জীবনের অর্থ। তারপর আরও অর্থবহ করার চিন্তা এবং চেষ্টা কেন করবো? সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি? তা তো মানুষের মগজ এবং মননের অন্তর্ভুক্ত। অন্তর্গত এই সৃষ্টিশীলতার চাপ এবং দায়বদ্ধতা বাধ্য করে তাকে সৃষ্টি করতে। বাধ্য করে, সৃষ্টিশীলতার ধারাবাহিকতায় থাকতে। এটা মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়। জীবনকে অর্থপূর্ণ করার প্রচেষ্টাও মনে হয় না আমার। এটা তার ভেতরে থাকা চ্যালেঞ্জ। সৃষ্টিশীলতাই তার আনন্দ। তার সুখ। সৃষ্টিশীলতার যে চাপ, তা-ই তার যন্ত্রণা এবং অসুখ। যন্ত্রণা এবং অসুখ, তবুও সে উপেক্ষা করতে পারে না এই চ্যালেঞ্জ। এড়িয়ে যেতে পারে না, এই আনন্দ আর সুখকে। মানুষ, বেঁচে থাকে না। কিন্তু তার কাজ, সাহায্য সমৃদ্ধ ও সুখী করে অন্যদের। এটাই হতে পারে, সৃষ্টিশীলতার অর্থ।
সম্পত্তিহীন, শ্রেণীহীন এই আমাকে যাদের কাছে থাকতে হয় বাংলাদেশে, তারা শ্রেণীবিহীন নন, আমার মতো। নির্দিষ্ট শ্রেণীর আশ্রয়ে থাকা আমার, অনেক কিছুই থাকে না, নিজের বলে। থাকে না, স্বাধীনতার মতো সবচে জরুরী সম্পদও পুরোপুরি। স্বাধীনতা, জীবনের প্রধান সম্পদ এবং বিলাসিতা আমার। অনুভব করি, প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি, খুব স্বাধীন নই আমি নিজের দেশে। শোষণ করছে আমার স্বাধীনতাকে, এদেশের পরিবার সমাজ রাষ্ট্র এবং প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থা। মানে অন্যায় অপব্যবস্থা। এই ব্যাপারগুলো কেমন?
জরুরী কাজে বাইরে যাবার অস্থিরতা মনে রেখে, ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর অধিকাংশ সময় জানতে পারি, সাপ্লাই ওয়াটার, মানে, কলে পানি নেই। নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাব, ‘নিচের ট্যাঙ্কের পানি শেষ হয়ে গেছে। মোটর ছাড়তে হবে। প্রথমে পানি জমবে ওখানে। পরে সেই পানি যাবে ওপরের ট্যাঙ্কে। তারপরে তা আসবে কলের পাইপে।’
কতক্ষণ লাগবে এতে, জানে না কেউ। জলের প্রবাহ কম হলে, এটা নেবে দীর্ঘ সময়। ছাড়া হলো মোটর। বন্ধ কেন হয়ে গেলো হঠাৎ জবাব পাই, ‘কারেন্ট মানে বিদ্যুত চলে গেছে।’ কখন আসবে বিদ্যুত? জবাব, ‘কমপক্ষে এক ঘণ্টাতো লাগবেই’।
কি করতে পারি এই সময়ে? আইপিএসের সহযোগিতায় সিলিংফ্যানটি যে চলছে অনবরত, খুব সৌভাগ্য মনে হয় এটা। শান্ত করতে চাই নিজেকে। পড়তে চাই আজকের পত্রিকা। রয়েছে যে খবরগুলো প্রতিটি পাতায়, আর বিজ্ঞাপনগুলো, হজম করতে পারি না তার বেশিরভাগ। পড়তে পারি না, মনোযোগ আর আগ্রহ নিয়ে। রেখে দেই। কোন মানে হয় না সময় অপচয় করার।
বিপুল বাণিজ্যের ধান্দাবাজিতে একনিষ্ঠ, তথাকথিত জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোর ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বোঝে না, এদেশের বিপুল পাঠক। বোঝে না, নির্লজ্জভাবে নকল আর অনুকরণ করার নগ্ন কৌশল। বোঝে না, অনলাইন থেকে নেয়া বিদেশী খবরের তথ্য শব্দ এবং চেতনাগত ভুল অনুবাদ। বোঝে না ‘সেনসেশন’ তৈরির জন্যে খবরের শিরোনামে যা লেখা হয়, নিচের খবরের সঙ্গে অমিল থাকে তার। পড়ার জন্যে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে এমন শিরোনামের খবর, হতে পারে একেবারেই ফালতু কোন বিষয়। কারণটি কি? ‘সেনসেশান’ মানে উত্তেজনা বিক্রি করেই সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করা যায়। সুগঠিত সুখপাঠ্য মানসম্মতও নয় এইসব পত্রিকার রিপোর্টিংগুলো।
বুঝে পড়ুক বা না পড়ুক, কেনে পাঠক অভ্যাসের কারণে। কেনে তারা, অধিকাংশ কলামনিস্টদের স্ববিরোধী কলামগুলো টাকার বিনিময়ে। টাকা দিয়ে কেনে, পাতার পর পাতা জুড়ে রাজনীতিবিদদের অনর্গল মিথ্যে, অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, আক্রমণাত্মক, মানহীন বক্তব্য, বিবৃতি, ঝগড়া। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। দেশ ও মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো এবং জরুরী জাতীয় কল্যাণকর্মগুলোর ব্যাপারে, অধিকাংশ বক্তব্যই থাকে, ‘করতে হবে’র পর্যায়ে।
প্রতিদিনের অপরাধ দুর্নীতি সম্পৃক্ত মামলার খবরগুলো এবং অনেক জরুরী খবরের ফলোআপও থাকে না এইসব পত্রিকায়। নিরপরাধী পাঠকের যথেষ্ট আগ্রহ থাকার কথা, কি শাস্তি পেলো অপরাধীগুলো, তা জানার জন্যে। সেনসেশন সৃষ্টি করা খবরগুলো পত্রিকার বিক্রি বাড়ায় অনেক। বিচারের রায় তো বাড়াবে না পত্রিকার বিক্রি। সেটাই কি কারণ? থাকে আরো অনেক অর্থহীন আয়োজন। সবই পাঠক ধরে রাখার জন্যে। পাঠক বাড়ানোর জন্যে। মানে, সবই ব্যবসা।
বিদায় নেয় জীবন থেকে, দেড় অথবা দু’ঘন্টা সময়, কিছু না করে। চাকরিজীবী নই আমি। প্রায় নিয়মিত এই পরিস্থিতিতে কি করেন একজন, যাকে কাজে পৌঁছাতে হয় নির্দিষ্ট সময়ে? বুঝতে পারি না।
জল আসে কলে। আসে দুর্গন্ধময় ময়লা বিবর্ণ তরল প্রবাহ। ছুঁতে পারি না ওই জল। ময়লা ঠেকাতে, ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে রাখে কলের মুখ, অনেক বাড়িতে। সম্ভবত সব বাড়িতে। ঠেকানো কি যায় তাতে কিছু? বসে থাকি, কবে কখন আসবে এক অঞ্জলি বিশুদ্ধ না হোক, কিছুটাও শুদ্ধ জল, তার প্রতীক্ষায়। আসে না, আসে না, আসে না। বাইরে যাবার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। খুব জরুরী কাজগুলো করা হয় না আমার। ক্ষতি হয় অনেক এবং বিভিন্ন ধরনের। সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো, অসহ্য এই অবস্থার অধীনতা। শুরু করতে পারি না দিনটি নিজের মতো করে। জরুরী প্রয়োজনেও। সাপ্লাই ওয়াটার এই বাড়িতে তবুও আসে। রুগ্ন হলেও। যে বাড়িগুলোতে এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা, এক ঘন্টা জল এলে পাঁচ ঘণ্টা আসে না, অথবা জলই নেই, কি অবস্থা তাদের?
মনে পড়ে, পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছর। বুঝি, জন্ম থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, কঠিন সমস্যাগুলোকেও সমস্যা মনে হয় না আর। কিন্তু জল ছাড়া জীবন, স্বাভাবিক থাকতে পারে কতক্ষণ? অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোও কেন এতো স্বাভাবিক এদেশে!
ব্রেইকফাস্ট পৌঁছায় টেবিলে। ওই জল দিয়েই কি তৈরি হয়নি তা? বেঁচে থাকার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন, খাবার, অন্যতম তার মধ্যে। প্রতিটি খাবার সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রচারিত এদেশে, যদি তা সত্য হয়, তাহলে, মুখে দেয়া উচিত নয় এই খাবারের কোন একটিও। বেঁচে থাকার জন্যে এসব খেয়ে, নিশ্চিত করতে পারি অবিরত অসুস্থতা এবং দ্রুত মৃত্যু।
ফল সকালের খাবার নয়। তুলে নেই হাতে তবুও। জানি এদের জীবন ইতিহাস। দুর্বৃত্তদের হাতে বিষাক্ত হয়ে টেবিল পর্যন্ত আসে কিভাবে, মনে পড়ে। পারি না খেতে। জল খাবো? কোন জল? কেনা জল বোতলের? ফুটিয়ে ফিল্টারে রাখা জল? দেখেছি টেস্ট করে সব ধরনের জল। চমকে উঠেছি। দীর্ঘক্ষণ ফুটালেও স্নানের যোগ্য হয় না যে জল, তাই পান করে এদেশের ৯৮ ভাগ মানুষ।
মহামান্য, মাননীয় আর মহোদয় শব্দগুলো ব্যবহৃত খুব, এদেশের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যে। সম্মান প্রকাশের জন্যে কতটা জানি না। চাটুকারিতা, স্তাবকতা, চামচামির জন্যে যে শব্দগুলো জরুরী, তা প্রমাণিত। অর্থ কি মাননীয় আর মহামান্য শব্দের? পানের নয়, স্নানের যোগ্য জলও দিতে পারেনি যারা চল্লিশ বছর বয়সি দেশের জনগণকে, কি করে হতে পারেন তারা মাননীয়? যুক্ত কেন করতে হয় তবুও তাদের পদের শুরুতে এসব শব্দ? এটা কি অন্যায় নয়? যুক্ত করে যারা, তারা কারা? এবং কেন করে?
বাড়ে রোদের তাপ, বাড়তেই থাকে দিশেহারা হয়ে। সাহস হয় না বাইরে যাবার। জরুরী একটি কাজ শেষ করার সময় পেরিয়ে যায়নি এখনো। পা রাখতেই রাস্তায়, অসহ্য পরিবেশ। আমি কি পারবো পৌঁছুতে ব্যাংকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে? অসহ্য যানজট, নর্দমা, আবর্জনা, দুর্গন্ধ, ধুলো, অবিরাম গাড়ির হর্ন, পথচারীদের অস্থির চেঁচামেচি, আগুন ছড়ানো রোদ এবং সবকিছু উপভোগ করে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছি এক ঘন্টায়। পৌঁছুতে পেরেছি ব্যাংকে, বন্ধ হবার আধাঘন্টা আগে। সৌভাগ্য মনে হয় এটা।
দোতলায় উঠতে সিঁড়ির একপাশে খোলা দরজা পথে বের হওয়া দুর্গন্ধে গুলিয়ে ওঠে শরীর। বুঝতে পারি, এটি টয়লেট। মানসিকতা কতটা বিকৃত হলে টয়লেটের অবস্থা এমন হতে পারে, ভাবতে পারি না। সিঁড়ির মধ্যেই রাখা হয়েছে কয়েকশ’ অথবা কয়েক হাজার, জীর্ণ পোকা খাওয়া ফাইল ভর্তি অনেকগুলো নোংরা কার্টুন, যা বন্ধ করার দায়িত্বও নেয়নি এই ব্যাংকে কর্মরতদের কেউ। ফাইলগুলোর শরীরে নিরাপদ ভেবে, ফ্ল্যাট অথবা বাড়ি বানিয়েছে অগণিত মাকড়সা। তার মধ্যে জায়গা খুঁজে ওপরে উঠতে হয়।
ধুলো বিবর্ণ, নোংরা মলিন অসুস্থ দেশীয় ব্যাংকটির, রং নষ্ট হয়ে যাওয়া বহু পুরনো যে টেবিলে আমার ফাইল, সেখানে দাঁড়াতেই, দুটো দাঁতবিহীন পান খাওয়া মুখে হাসেন কর্মরত ব্যক্তি। তার পোশাক, জুতো, বসার ভঙ্গি আচরণে মনে হয় না এটি তার কার্যালয়। পাশের টেবিলে আঙ্গুল চেটে ঠোঁট খুলে শব্দ করে ভাত খাচ্ছেন তার সহকর্মী। ছড়িয়ে রয়েছে টেবিলের ওপর, খাবারের খোলা প্লাস্টিক বাটিগুলো। অন্য টেবিলে নিবিড় মনোযোগে আঙ্গুল দিয়ে নাক পরিষ্কার করছেন আর এক কর্মী। আরামদায়ক ভংগিতে। প্রায় বেরিয়ে আসা বমি ঠেকাই, মুখে হাত চেপে। ইচ্ছে করে বেরিয়ে যাই। অসহ্য হয়ে ওঠে এই অবস্থা। শান্ত করি নিজেকে। শেষ করতে হবে কাজটি। নাহলে আবার আসতে হবে। সে ইচ্ছে নেই। অন্য যে টেবিলগুলোতে কাজ করছেন লোকজন, তাকাতে ইচ্ছে করে না তাদের দিকে আর। এরা কথা বলছেন একে অন্যের সঙ্গে। হাসছেন উচ্ছ্বাসে উল্লাসে। জোরে কথা বলছেন বলেই বোঝা যায়, ব্যক্তিগত কথা বলতে করতে পছন্দ করেন এরা, অফিসের কাজের মাঝে। যত ফালতু বিষয় হোক সেটা। হয়তো এটাও তাদের কাজের অংশ এবং অভ্যেস। কিছু মনে করে না কেউ। কিছু বলেও না কেউ হয়তো। মনে হচ্ছে, কাউকেই কারো কিছু বলার নেই এখানে। এটাই অলিখিত র্শত। তা জানে সবাই।
লুকোতে পারি না স্বভাবের ভদ্রতা। জানতে চাই ভদ্রলোককে, ‘কেমন আছেন?’ ‘বসেন আপা। কেমন আর থাকবো, এই দেশে কি বাইচা থাকা যায়? আপনার ফাইল শেষ করে পাঠায়া দিতেছি ম্যানেজারের রুমে। চা পানি না খাওয়াইলে তো কাজ আগায় না। আপনে এতো উদার মানুষ, আপনার কাছে না চাইলে কার কাছে চাবো বলেন?’
অসংস্কৃত নোংরা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশকে, আরও নোংরা করে তোলে লোকটির মানসিকতা এবং প্রকাশ ভংগি। ‘চা পানির’ অভাবে পিপাসার্ত নয় সে। ক্ষুধার্ত তার নির্লজ্জ দুটো চোখ। ‘চা পানি খাননি কেন? আপনাকে কি বেতন দেয়া হয় না কাজের জন্যে? বুঝতে পারছেন না কাকে কি বলছেন আপনি।’ বলি। ক্ষুধার্ত দু’চোখ হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ। অথবা বিক্ষুব্ধ। আর কিছু বলার সাহস অথবা ইচ্ছে নেই তার।
‘সালামালাইকুম, কখন এসেছেন আপা, আসেন আসেন আমার রুমে চলে আসেন।’ বলেন ম্যানেজার। কোনো কাজে নিজের রুমের বাইরে এসে, আমাকে দেখতে পেয়েছেন। সুবিধাভোগী পর্যায়ের কেউ নই আমি। এদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান সেভাবে বিবেচনা করতে চায় আমাকে, তবুও। অস্বস্তি হয় খুব ওরকম অবস্থায়, অনভ্যস্ত আমার। ম্যানেজারের মাধ্যমেই শেষ হবে কাজটি। তাই যেতে হয় তার রুমে।
রুমটি, ধুলো মলিন আর ছোট হলেও, তুলনায় একটু ভালো। ছিঁড়েটিরে জীর্ণ হয়ে যাওয়া ময়লা একটি সোফা রয়েছে একপাশে। রুমটির জানালায় ঝুলছে পর্দা। লাগানোর পরে কোনদিন যে ধোয়া হয়নি, নিশ্চিত হতে হয় তার শরীরের অবস্থা দেখে। যে গ্রিল রয়েছে জানলায়, কোন মানুষের হাত পড়েনি সেখানে কোনদিন, পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। পরিষ্কার করাতে বা করতে কত টাকা লাগে? আর লাগে কতটুকু সময়? না সেটা কোন ব্যাপার নয়। ব্যাপারটি হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতাবোধ। ঘরে এবং বাইরে। সব জায়গায়। সেটি না থাকলে তো, এ রকমই থাকবে। যেমন রয়েছে।
হাফসিøভ শার্টের কলারে টাই পরে বসেছেন ম্যানেজার, তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা চেয়ারে। চেয়ারে তোয়ালে রাখা, এদেশের প্রায় সব ‘বস’দের সমবেত অভ্যেস। অথবা লিখিত নির্দেশ। কারণটি কি? দেখতে কেমন লাগে এটা? এই তোয়ালেটিও কি ধোয়া হয় কখনো? ধুলেও বছরে ক’বার?
ছড়িয়ে রেখেছেন চেয়ারটিতে নিসঙ্কোচে নিজেকে, ভদ্রলোক। নড়ছেন পুরো শরীরে, অকারণে। নাড়াচ্ছেন হাত দুটো অনবরত, তাও অকারণে। জানেন না ইনিও, বসতে হয় কিভাবে একটি অফিসে। বসতে হয় কিভাবে, অতিথি এবং কাস্টমারদের সামনে। বোঝেন না সম্ভবত, অফিসটি যে তার একান্ত গৃহকোণ নয়। টেবিলের একপাশে রয়েছে একটি ফ্লাটস্ক্রিন মনিটর আর কম্পিউটর। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আধুনিক প্রযুক্তি। বার বার তাকাচ্ছেন সেদিকে, কথা বলার মাঝে। মাউস এবং কিবোর্ডে হাত দিয়েও কিছু করার চেষ্টা করছেন, যার সাথে সামনে বসে থাকা আমার কাজের, কোন সম্পর্ক নেই। এই প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকান্ড, ফাইল এবং কাগজপত্রের যে জীর্ণ অবস্থা, কি সম্পর্ক তার সঙ্গে এই কম্পিউটারটির, বুঝতে চেষ্টা করি। সম্ভব হয় না বোঝা।
‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে চাকরি করছেন যারা তাদের কেউ কেউ কাস্টমারের কাছে ঘুষ চান, তা কি আপনি জানেন?’ করতেই হয় প্রশ্নটি ম্যানেজারকে।
‘আপনার কাছে ঘুষ চেয়েছে? কে? কি বলবো বলেন, এই অবস্থাতো দেশের সব জায়গায়। রাষ্ট্র পরিচালকরা হাজার হাজার কোটি চায়। আর এরা পাঁচশ’ বা এক হাজার চায়। আমি জানাবো জায়গা মতো কথাটা। আপনার কাছে চাওয়া উচিত হয়নি।’ জবাব দেন তিনি।
আর কিছু বলি এ ব্যাপারে, তা চাচ্ছেন না ইনি। বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কারণ এর পরে যে বিষয়টি তিনি আনেন, তা, তার লেখা কবিতা। লিখেছেন গত রাতে। পৃথিবীতে প্রথম জন্মানো কবিতাটি, সফল কতটা, শুনতে আগ্রহী তিনি।
কিছুক্ষণের মাঝে প্রবেশ করেন এক ব্যক্তি। ‘স্যরি একটু অপেক্ষা করুন’ বা এ রকম জরুরী ভদ্রতা না দেখিয়ে, ব্যস্ত হয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি নবাগতের সাথে। বুঝি, এটি হয়ে ওঠেনি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যেস, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের। হবে কি কখনো?
রুমের তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে, আগ্রহী হই বা না হই, শুনি কিছু সংলাপ। বুঝি, বিষয়টি লোন সংক্রান্ত। এড়াতে চান আগত ব্যক্তি আমাকে। ম্যানেজারও।
‘আমার ব্যাগটা এখানেই থাকুক, আমি পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে আসতেছি।’ ম্যানেজারের টেবিলের নিচে ব্যাগটি রেখে দ্রুত চলে যান ভদ্রলোক। কাজ সেরে চলে আসি আমিও, কিছুক্ষণের মধ্যে কাউন্টারে। কোন ব্যাংকের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টাকা নিতে হয় না আমাকে ঢাকায়। বেশিরভাগ সময়। যখন যে ম্যানেজার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার থাকেন, কাউন্টার থেকে আনিয়ে দেন টাকা। সে প্রসঙ্গ ওঠেনি আজ। নির্ধারিত সময় অতিক্রম করতে চাননি হয়তো ম্যানেজার, এই সুবিধাটুকু দিতে যেয়ে আমাকে।
কত টাকা ঘুষ দিতে হয় এদেশে, কি পরিমাণ লোন অনৈতিকভাবে পেতে চাইলে? দিতে হয় কাকে, কাকে এবং কাকে? প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতির নির্দিষ্ট চেইনের ভেতর থেকে, বাদ কি দেয়া যায় কাউকে? এ বিষয়টি ভেবেই কাটে সময়টুকু, কাউন্টারে। টাকা দেন ক্যাশিয়ার। গুনি ওখানে দাঁড়িয়ে। দু’শ’ টাকা কম। তাকাই ক্যাশিয়ারের দিকে। ভুল করেননি তো? মিষ্টি হাসেন তিনি। খুব পুরনো অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরেছেন যিনি। তার চেয়েও অপরিচ্ছন্ন তার চুল এবং দাঁত। ‘এর চেয়ে বেশি তো চাচ্ছি না আপা। এইটুকু পাবার হক তো আছে আমাদের।’ জবাব দেন তিনি শান্ত কণ্ঠে। পাশেই রয়েছেন কর্মরত আর একজন ক্যাশিয়ার। কোন অসুবিধা হচ্ছে না তাতে। কেন?
‘দু’শ’ টাকা দেন আমাকে, কথা বলতে বাধ্য করবেন না প্লিজ।’ বলি দৃঢ় স্বরে। বেরিয়ে আসি নোট দুটো নিয়ে। মিষ্টি হাসি বিলুপ্ত হয়েছে তার ততক্ষণে। ব্যর্থতার আক্রোশ দখল করে নিয়েছে সে জায়গাটি।
কত টাকা উপার্জন করেন ইনি এবং এরা, এভাবে প্রতিদিন? আর কত টাকা উপার্জন করেন ম্যানেজার এবং এদেশের ম্যানেজাররা? এবং বাকি সবাই? বের করতে কি পারবে সে হিসেব, কোন ক্যালকুলেটর? কোন মানুষ? কোন মহাশক্তি? কোথায় এবং কার কাছে নালিশ করলে, সমাধান হতে পারে, সর্বগ্রাসী এই সর্বনাশা অবস্থার?
ঘুষ চায়নি ক্যাশিয়ার লোকটি। চাইবার মতো অবস্থানে নেই সে। অবস্থানে রয়েছে যারা, ঘুষ চায় না তারাও। টাকা দাবি করে, কাজের বিনিময়ে পাওনা অধিকার অথবা পারিশ্রমিক হিসেবে। প্রচলিত নিয়মে। অভ্যস্ত অভ্যাসে। যে বেতন তারা পায়, তা হয়তো কিছুই মনে হয় না তাদের। শুধুমাত্র বেতন পাবার জন্যে কি চাকরি নেয় তারা?
ক্যাশিয়ার লোকটি চেয়েছে দয়া। অন্যরা ঘুষ দাবি করবে, পাবে, আর সে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, দয়ার দান আদায় করবে না, তা হয় না। তার জীর্ণ পোশাক আর অতিশয় রুগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে, এই আমি ছাড়া, দয়া করে দান করবে না কে? জনপ্রতি প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে দু’শ’ টাকা করে ভিক্ষে পেলে, কত হয় দিনে, এই হিসেব সে ছাড়া বের করতে পারবে না কেউ।
হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে, যে দেশে ঘুষ দেয়া এবং নেয়ার জন্যে, কারোই শাস্তি হয় না, সে দেশে দয়ার দান বা ভিক্ষে নিলে, এদের যে কিছুই হবে না, সে নিশ্চয়তা অবশ্যই আছে। এতো টাকা ভিক্ষে করেও প্রতিদিন, নতুন অথবা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে না সে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে, সুস্থও করে না চেহারা। করে কি সে তাহলে টাকা নিয়ে? পরিচ্ছন্ন নতুন পোশাক এবং সুস্থ চেহারা দেখলে কি, দান করবে না কাস্টমাররা তাকে?
কে এবং কারা দেয় ঘুষ? দেয় এদেশেরই জনগণ। তারাই ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ, ঘুষ দেয় যারা। কেন দেয়? দেয় নিজেদের কাজের স্বার্থে, ব্যবসার স্বার্থে। সুবিধার স্বার্থে। সুযোগের স্বার্থে। ঘুষ পেয়ে ধনী হয় মানুষ। ঘুষ দিয়েও ধনী হয়। হতে পারে অনে-ক ধনী।
দুর্নীতির অনেক অনেক ধরনের মধ্যে ঘুষ একটি। ঘুষ নেয় যারা, দুর্নীতিবাজ বলা হয় তাদের। অপরাধী তারা। ঘুষ দেয় যারা, তারা কি? তারাও কি সমান দুর্নীতিবাজ আর অপরাধী নয়? ঘুষ দিয়ে যে কাজ, ব্যবসা, স্বার্থ, সুযোগ, সুবিধা সে আদায় করে, তা থেকে সে উপার্জন বা আদায় করে অনেক অনেক অনেক বেশি।
ঘুষ চায় এবং ঘুষ দেয় যারা, ভয়ঙ্কর লোভী তারা। লজ্জা সম্মান বোধহীন এক প্রজাতি। এদের ধারাবাহিক লোভ এবং চাহিদার লিফটটি মহাকাশগামী। এরা না দিলে ওরা মহাকাশে পৌঁছায় কি করে? ঘুষ দেবার জন্যেও তো দরকার টাকা। পর্যাপ্ত টাকা। তা এরা পায় কোথায়? কিভাবে? দেয়া এবং পাওয়া দুটোর অবস্থান সমান্তরালে। অপরাধও সমান।
এই যে ঘুষদাতা, এবং ঘুষ গ্রহীতা, এদেশে এরাই বলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, উচ্চ কণ্ঠ। লেখেনও এদেরই অনেকে পত্রিকায়, একই বিষয়ে বার বার। অনেক বার। বলেন এবং লেখেন, কারণ, নিশ্চয়ই দাবি করেন নিজেকে সত হিসেবে। অথবা, পাঠক এবং শ্রোতাকে বোঝাতে, তিনি সৎ। নাহলে, কেন তিনি বলবেন অথবা লিখবেন, এই সব অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে? এইযে নব্বই অথবা পঁচান্নব্বই ভাগ, এরা যদি সৎ হন, তো অসৎ কারা?
দিনের প্রতিটি ঘণ্টায়, চব্বিশ থেকে আটচল্লিশটি, অথবা তারও বেশি অন্যায় কাজ করে, অন্যায়কারী মনে করে না নিজেকে এদেশে কেউ। গড়ে প্রতিদিন অনেক অনেকগুলো অসততা করেও, সৎ মনে করে নিজেকে সবাই। বিলীন হয়ে গেছে এখানে ন্যায় অন্যায়, সত্য মিথ্যা, ভালো মন্দ, সততা অসততার পার্থক্য। স্বামী প্রতারণা করে স্ত্রীকে। স্ত্রী প্রতারণা করে একইভাবে স্বামীকে। গোপনে। সরকার প্রতারণা করে জনগণকে। জনগণ প্রতারণা করে সরকারকে। এবং নিজেরা নিজেদেরকেও। সবচেয়ে বড় কাজটি এদেশে প্রতারণা। এই প্রতারণা দেখা যায় এবং দেখা যায় না। অতি অভ্যস্ত এই প্রতারণা, মনেও হয় না প্রতারণা। মনেও হয় না অপরাধ। সবই হয়ে গেছে স্বাভাবিক। খুব-ই স্বাভাবিক।
(চলবে)
বাংলাদেশ একটি জাতি, একটি মাতৃভাষার দেশ হলেও, এর অজস্র চেহারা। সব লিখে বোঝানো অসম্ভব। সব নয়, কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো।
‘বড়লোক’ বলা হয় ধনীদের এদেশে। লেখাও হয়। যুক্তি এবং কারণ কি জানি না। সঠিক অর্থ কি শব্দটির, বুঝতে পারি না। এই শব্দ কোনো মানুষের ওপর প্রজোয্য হতে পারে না বলে মনে করি আমি। তাই ব্যবহার করি না শব্দটি। একইভাবে ‘ছোটলোক’ শব্দটিও নয়।
লিখতে শুরু করেছিলাম এটি দু’হাজার পাঁচ সালে। শেষ করিনি, আমার স্বভাবের নিয়মে। ভুলে গিয়েছিলাম অসমাপ্ত এই লেখাটির কথা। পুরনো অংশ যোগ করতে যেয়ে ঝামেলায় পড়েছি। কারণ হচ্ছে, পরিস্থিতির ব্যবধান। যারা পড়বেন, তাঁরা যদি বোঝেন ব্যাপারটি, তা হলেই হবে।
নিজের দেশে আমার জীবনযাপন কেমন, তা নিয়ে লিখছি শুরুতে। ‘সংক্ষেপ’ শব্দটি মনে রেখে। ধারণা করছি, এটা হবে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতা। আমার দৃষ্টিভঙ্গি চেতনা ও মানসিকতার সাথে একমতও হতে পারেন কেউ কেউ।
অজস্র শ্রেণীতে বিভক্ত মানুষের এই দেশে, কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি আমি। শ্রেণীহীন এই আমার, কোন সম্পত্তি নেই বাংলাদেশে। সম্পত্তি, লোভ আর ভোগ বিলাস ব্যাপারগুলো, আগ্রহের বিষয় ছিলো না কখনো। নেই এখনো। জীবন সম্পর্কে নিজের যে দর্শন তা হচ্ছে, এই জীবনটি একটি দৈব। পৃথিবীতে নাও আসতে পারতাম। তাতে কিছুই যেত আসত না কারো। জন্মেছি কোথায়, দৈব সেটাও। রাস্তার নর্দমার পাশে, অথবা কোন প্রাসাদে জন্ম হতে পারতো। হতে পারতো, পৃথিবীর যে কোন স্থানে। যেখানে রয়েছে মানুষের সমাজ। আদিবাসী সমাজেও।
গুরুত্ব কি এই প্রকৃতির কাছে মানুষ হিসেবে আমার? না, কোন গুরুত্বই নেই। প্রকৃতির কাউকে, কোন কিছুকেই চেনে না প্রকৃতি। ‘অন্ধ ঘড়ি নির্মাতা’ বলেছেন তাই বিজ্ঞানী ‘রিচার্ড ডাওকিন্স’ প্রকৃতিকে। বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের ভেতরে দুইশত বছর যদি বেঁচে থাকি, তাও কিছু নয়। জীবন এই মুহূর্তের। পরের মুহূর্তে নাও থাকতে পারে। এক সেকেন্ডের এই জীবনটি, তবুও সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। অপরূপ এই জীবনটি পেয়েছি আমি, একবারের জন্যে। প্রকৃতির কারো কোন রকম ক্ষতি না করে, কিভাবে কাটাবো নিজের জীবন, সেই সিদ্ধান্ত শুধুই আমার।
খানিকটা সচ্ছলভাবে চলার মতো টাকা উপার্জন করবো, সততার সাথে। নিয়মিত অভাবের অশান্তি যেনো বিঘিœত করতে না পারে, জীবনের অসীম সৌন্দর্যকে। ভালোবাসবো প্রকৃতির সব কিছুকে, যা সাহায্য করছে বাঁচিয়ে রাখতে আমাকে। রক্ষা করবো প্রকৃতির মর্যাদা এবং সম্মান, সবটুকু দায়িত্ব মেনে। থাকবো সুস্থ, যতটা সম্ভব, শরীরে মনে মগজে। হাসবো দু’ঠোঁট ভরে, যত পারি। ঘুমাবো, নিশ্চিন্তে আর পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে। অনুভব করবো প্রতিদিন, সেভাবেই বেঁচে আছি যেভাবে বাঁচতে চাচ্ছি। জীবনের প্রধান সুখ আমার এটা। নিজের ইচ্ছে আর আনন্দে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা।
নিজের জন্যে যে বাঁচে, সে আসলে বাঁচে না। অন্যের জন্যে যে বাঁচে, সে কখনো মরে না। মেনে চলবো নিজের এই দর্শন, প্রতিদিনের কর্মকা-ে। চলে যাবার সময় যেনো অনুভব করি, এসেছিলাম মানুষ হিসেবে। ফিরেও যাচ্ছি সেভাবে। নিয়ে আসিনি কোন সম্পত্তি সাথে করে। রেখেও যাচ্ছি না কিছু। যা রইলো, তা আমার কাজগুলো আর আমার দর্শন, যদি তা হয়ে থাকে কল্যাণকর। আর সম্পদ? গেত আমার মগজ, চরিত্র, আর যৌক্তিক চেতনা। এর চেয়ে বড় সম্পদ, কি আর হতে পারে মানুষের?
লোভ ভোগ আর স্বার্থকে সব কিছুর ওপরে মেনে, তা আদায় করতে যেয়েই কি জটিল আর কঠিন করে তুলি না আমরা, খুব ছোট্ট এ জীবন? জীবনের স্বার্থ তো এই, বেঁচে থাকা, যতদিন পারি। স্বার্থ তো এই, বেঁচে থাকা সুস্থভাবে, যতটা সম্ভব। স্বার্থ আরও একটি, নিজে বাঁচি, অন্যকেও বাঁচতে দিই। এসো আমরা সবাই মিলে চমৎকারভাবে বাঁচি। সব মানুষ, প্রাণী এবং প্রকৃতির অধিকার রক্ষা করে যে জীবন, তা-ই সবচেয়ে সুন্দর। সে জীবনে না পাওয়ার অভাব আর বেদনা থাকে না।
‘জীবন অর্থহীন, তাই তাকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করে মানুষ বিভিন্নভাবে।’ আলবেয়ার ক্যামোর এই দর্শন মানতে পারিনি আমি। অপূর্ব এই জীবনটি যে যাপন করতে পারছি নিজের ইচ্ছে মতো, এটাই জীবনের অর্থ। তারপর আরও অর্থবহ করার চিন্তা এবং চেষ্টা কেন করবো? সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি? তা তো মানুষের মগজ এবং মননের অন্তর্ভুক্ত। অন্তর্গত এই সৃষ্টিশীলতার চাপ এবং দায়বদ্ধতা বাধ্য করে তাকে সৃষ্টি করতে। বাধ্য করে, সৃষ্টিশীলতার ধারাবাহিকতায় থাকতে। এটা মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়। জীবনকে অর্থপূর্ণ করার প্রচেষ্টাও মনে হয় না আমার। এটা তার ভেতরে থাকা চ্যালেঞ্জ। সৃষ্টিশীলতাই তার আনন্দ। তার সুখ। সৃষ্টিশীলতার যে চাপ, তা-ই তার যন্ত্রণা এবং অসুখ। যন্ত্রণা এবং অসুখ, তবুও সে উপেক্ষা করতে পারে না এই চ্যালেঞ্জ। এড়িয়ে যেতে পারে না, এই আনন্দ আর সুখকে। মানুষ, বেঁচে থাকে না। কিন্তু তার কাজ, সাহায্য সমৃদ্ধ ও সুখী করে অন্যদের। এটাই হতে পারে, সৃষ্টিশীলতার অর্থ।
সম্পত্তিহীন, শ্রেণীহীন এই আমাকে যাদের কাছে থাকতে হয় বাংলাদেশে, তারা শ্রেণীবিহীন নন, আমার মতো। নির্দিষ্ট শ্রেণীর আশ্রয়ে থাকা আমার, অনেক কিছুই থাকে না, নিজের বলে। থাকে না, স্বাধীনতার মতো সবচে জরুরী সম্পদও পুরোপুরি। স্বাধীনতা, জীবনের প্রধান সম্পদ এবং বিলাসিতা আমার। অনুভব করি, প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি, খুব স্বাধীন নই আমি নিজের দেশে। শোষণ করছে আমার স্বাধীনতাকে, এদেশের পরিবার সমাজ রাষ্ট্র এবং প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থা। মানে অন্যায় অপব্যবস্থা। এই ব্যাপারগুলো কেমন?
জরুরী কাজে বাইরে যাবার অস্থিরতা মনে রেখে, ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর অধিকাংশ সময় জানতে পারি, সাপ্লাই ওয়াটার, মানে, কলে পানি নেই। নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাব, ‘নিচের ট্যাঙ্কের পানি শেষ হয়ে গেছে। মোটর ছাড়তে হবে। প্রথমে পানি জমবে ওখানে। পরে সেই পানি যাবে ওপরের ট্যাঙ্কে। তারপরে তা আসবে কলের পাইপে।’
কতক্ষণ লাগবে এতে, জানে না কেউ। জলের প্রবাহ কম হলে, এটা নেবে দীর্ঘ সময়। ছাড়া হলো মোটর। বন্ধ কেন হয়ে গেলো হঠাৎ জবাব পাই, ‘কারেন্ট মানে বিদ্যুত চলে গেছে।’ কখন আসবে বিদ্যুত? জবাব, ‘কমপক্ষে এক ঘণ্টাতো লাগবেই’।
কি করতে পারি এই সময়ে? আইপিএসের সহযোগিতায় সিলিংফ্যানটি যে চলছে অনবরত, খুব সৌভাগ্য মনে হয় এটা। শান্ত করতে চাই নিজেকে। পড়তে চাই আজকের পত্রিকা। রয়েছে যে খবরগুলো প্রতিটি পাতায়, আর বিজ্ঞাপনগুলো, হজম করতে পারি না তার বেশিরভাগ। পড়তে পারি না, মনোযোগ আর আগ্রহ নিয়ে। রেখে দেই। কোন মানে হয় না সময় অপচয় করার।
বিপুল বাণিজ্যের ধান্দাবাজিতে একনিষ্ঠ, তথাকথিত জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোর ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বোঝে না, এদেশের বিপুল পাঠক। বোঝে না, নির্লজ্জভাবে নকল আর অনুকরণ করার নগ্ন কৌশল। বোঝে না, অনলাইন থেকে নেয়া বিদেশী খবরের তথ্য শব্দ এবং চেতনাগত ভুল অনুবাদ। বোঝে না ‘সেনসেশন’ তৈরির জন্যে খবরের শিরোনামে যা লেখা হয়, নিচের খবরের সঙ্গে অমিল থাকে তার। পড়ার জন্যে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে এমন শিরোনামের খবর, হতে পারে একেবারেই ফালতু কোন বিষয়। কারণটি কি? ‘সেনসেশান’ মানে উত্তেজনা বিক্রি করেই সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করা যায়। সুগঠিত সুখপাঠ্য মানসম্মতও নয় এইসব পত্রিকার রিপোর্টিংগুলো।
বুঝে পড়ুক বা না পড়ুক, কেনে পাঠক অভ্যাসের কারণে। কেনে তারা, অধিকাংশ কলামনিস্টদের স্ববিরোধী কলামগুলো টাকার বিনিময়ে। টাকা দিয়ে কেনে, পাতার পর পাতা জুড়ে রাজনীতিবিদদের অনর্গল মিথ্যে, অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, আক্রমণাত্মক, মানহীন বক্তব্য, বিবৃতি, ঝগড়া। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। দেশ ও মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো এবং জরুরী জাতীয় কল্যাণকর্মগুলোর ব্যাপারে, অধিকাংশ বক্তব্যই থাকে, ‘করতে হবে’র পর্যায়ে।
প্রতিদিনের অপরাধ দুর্নীতি সম্পৃক্ত মামলার খবরগুলো এবং অনেক জরুরী খবরের ফলোআপও থাকে না এইসব পত্রিকায়। নিরপরাধী পাঠকের যথেষ্ট আগ্রহ থাকার কথা, কি শাস্তি পেলো অপরাধীগুলো, তা জানার জন্যে। সেনসেশন সৃষ্টি করা খবরগুলো পত্রিকার বিক্রি বাড়ায় অনেক। বিচারের রায় তো বাড়াবে না পত্রিকার বিক্রি। সেটাই কি কারণ? থাকে আরো অনেক অর্থহীন আয়োজন। সবই পাঠক ধরে রাখার জন্যে। পাঠক বাড়ানোর জন্যে। মানে, সবই ব্যবসা।
বিদায় নেয় জীবন থেকে, দেড় অথবা দু’ঘন্টা সময়, কিছু না করে। চাকরিজীবী নই আমি। প্রায় নিয়মিত এই পরিস্থিতিতে কি করেন একজন, যাকে কাজে পৌঁছাতে হয় নির্দিষ্ট সময়ে? বুঝতে পারি না।
জল আসে কলে। আসে দুর্গন্ধময় ময়লা বিবর্ণ তরল প্রবাহ। ছুঁতে পারি না ওই জল। ময়লা ঠেকাতে, ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে রাখে কলের মুখ, অনেক বাড়িতে। সম্ভবত সব বাড়িতে। ঠেকানো কি যায় তাতে কিছু? বসে থাকি, কবে কখন আসবে এক অঞ্জলি বিশুদ্ধ না হোক, কিছুটাও শুদ্ধ জল, তার প্রতীক্ষায়। আসে না, আসে না, আসে না। বাইরে যাবার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। খুব জরুরী কাজগুলো করা হয় না আমার। ক্ষতি হয় অনেক এবং বিভিন্ন ধরনের। সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো, অসহ্য এই অবস্থার অধীনতা। শুরু করতে পারি না দিনটি নিজের মতো করে। জরুরী প্রয়োজনেও। সাপ্লাই ওয়াটার এই বাড়িতে তবুও আসে। রুগ্ন হলেও। যে বাড়িগুলোতে এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা, এক ঘন্টা জল এলে পাঁচ ঘণ্টা আসে না, অথবা জলই নেই, কি অবস্থা তাদের?
মনে পড়ে, পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছর। বুঝি, জন্ম থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, কঠিন সমস্যাগুলোকেও সমস্যা মনে হয় না আর। কিন্তু জল ছাড়া জীবন, স্বাভাবিক থাকতে পারে কতক্ষণ? অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোও কেন এতো স্বাভাবিক এদেশে!
ব্রেইকফাস্ট পৌঁছায় টেবিলে। ওই জল দিয়েই কি তৈরি হয়নি তা? বেঁচে থাকার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন, খাবার, অন্যতম তার মধ্যে। প্রতিটি খাবার সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রচারিত এদেশে, যদি তা সত্য হয়, তাহলে, মুখে দেয়া উচিত নয় এই খাবারের কোন একটিও। বেঁচে থাকার জন্যে এসব খেয়ে, নিশ্চিত করতে পারি অবিরত অসুস্থতা এবং দ্রুত মৃত্যু।
ফল সকালের খাবার নয়। তুলে নেই হাতে তবুও। জানি এদের জীবন ইতিহাস। দুর্বৃত্তদের হাতে বিষাক্ত হয়ে টেবিল পর্যন্ত আসে কিভাবে, মনে পড়ে। পারি না খেতে। জল খাবো? কোন জল? কেনা জল বোতলের? ফুটিয়ে ফিল্টারে রাখা জল? দেখেছি টেস্ট করে সব ধরনের জল। চমকে উঠেছি। দীর্ঘক্ষণ ফুটালেও স্নানের যোগ্য হয় না যে জল, তাই পান করে এদেশের ৯৮ ভাগ মানুষ।
মহামান্য, মাননীয় আর মহোদয় শব্দগুলো ব্যবহৃত খুব, এদেশের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যে। সম্মান প্রকাশের জন্যে কতটা জানি না। চাটুকারিতা, স্তাবকতা, চামচামির জন্যে যে শব্দগুলো জরুরী, তা প্রমাণিত। অর্থ কি মাননীয় আর মহামান্য শব্দের? পানের নয়, স্নানের যোগ্য জলও দিতে পারেনি যারা চল্লিশ বছর বয়সি দেশের জনগণকে, কি করে হতে পারেন তারা মাননীয়? যুক্ত কেন করতে হয় তবুও তাদের পদের শুরুতে এসব শব্দ? এটা কি অন্যায় নয়? যুক্ত করে যারা, তারা কারা? এবং কেন করে?
বাড়ে রোদের তাপ, বাড়তেই থাকে দিশেহারা হয়ে। সাহস হয় না বাইরে যাবার। জরুরী একটি কাজ শেষ করার সময় পেরিয়ে যায়নি এখনো। পা রাখতেই রাস্তায়, অসহ্য পরিবেশ। আমি কি পারবো পৌঁছুতে ব্যাংকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে? অসহ্য যানজট, নর্দমা, আবর্জনা, দুর্গন্ধ, ধুলো, অবিরাম গাড়ির হর্ন, পথচারীদের অস্থির চেঁচামেচি, আগুন ছড়ানো রোদ এবং সবকিছু উপভোগ করে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছি এক ঘন্টায়। পৌঁছুতে পেরেছি ব্যাংকে, বন্ধ হবার আধাঘন্টা আগে। সৌভাগ্য মনে হয় এটা।
দোতলায় উঠতে সিঁড়ির একপাশে খোলা দরজা পথে বের হওয়া দুর্গন্ধে গুলিয়ে ওঠে শরীর। বুঝতে পারি, এটি টয়লেট। মানসিকতা কতটা বিকৃত হলে টয়লেটের অবস্থা এমন হতে পারে, ভাবতে পারি না। সিঁড়ির মধ্যেই রাখা হয়েছে কয়েকশ’ অথবা কয়েক হাজার, জীর্ণ পোকা খাওয়া ফাইল ভর্তি অনেকগুলো নোংরা কার্টুন, যা বন্ধ করার দায়িত্বও নেয়নি এই ব্যাংকে কর্মরতদের কেউ। ফাইলগুলোর শরীরে নিরাপদ ভেবে, ফ্ল্যাট অথবা বাড়ি বানিয়েছে অগণিত মাকড়সা। তার মধ্যে জায়গা খুঁজে ওপরে উঠতে হয়।
ধুলো বিবর্ণ, নোংরা মলিন অসুস্থ দেশীয় ব্যাংকটির, রং নষ্ট হয়ে যাওয়া বহু পুরনো যে টেবিলে আমার ফাইল, সেখানে দাঁড়াতেই, দুটো দাঁতবিহীন পান খাওয়া মুখে হাসেন কর্মরত ব্যক্তি। তার পোশাক, জুতো, বসার ভঙ্গি আচরণে মনে হয় না এটি তার কার্যালয়। পাশের টেবিলে আঙ্গুল চেটে ঠোঁট খুলে শব্দ করে ভাত খাচ্ছেন তার সহকর্মী। ছড়িয়ে রয়েছে টেবিলের ওপর, খাবারের খোলা প্লাস্টিক বাটিগুলো। অন্য টেবিলে নিবিড় মনোযোগে আঙ্গুল দিয়ে নাক পরিষ্কার করছেন আর এক কর্মী। আরামদায়ক ভংগিতে। প্রায় বেরিয়ে আসা বমি ঠেকাই, মুখে হাত চেপে। ইচ্ছে করে বেরিয়ে যাই। অসহ্য হয়ে ওঠে এই অবস্থা। শান্ত করি নিজেকে। শেষ করতে হবে কাজটি। নাহলে আবার আসতে হবে। সে ইচ্ছে নেই। অন্য যে টেবিলগুলোতে কাজ করছেন লোকজন, তাকাতে ইচ্ছে করে না তাদের দিকে আর। এরা কথা বলছেন একে অন্যের সঙ্গে। হাসছেন উচ্ছ্বাসে উল্লাসে। জোরে কথা বলছেন বলেই বোঝা যায়, ব্যক্তিগত কথা বলতে করতে পছন্দ করেন এরা, অফিসের কাজের মাঝে। যত ফালতু বিষয় হোক সেটা। হয়তো এটাও তাদের কাজের অংশ এবং অভ্যেস। কিছু মনে করে না কেউ। কিছু বলেও না কেউ হয়তো। মনে হচ্ছে, কাউকেই কারো কিছু বলার নেই এখানে। এটাই অলিখিত র্শত। তা জানে সবাই।
লুকোতে পারি না স্বভাবের ভদ্রতা। জানতে চাই ভদ্রলোককে, ‘কেমন আছেন?’ ‘বসেন আপা। কেমন আর থাকবো, এই দেশে কি বাইচা থাকা যায়? আপনার ফাইল শেষ করে পাঠায়া দিতেছি ম্যানেজারের রুমে। চা পানি না খাওয়াইলে তো কাজ আগায় না। আপনে এতো উদার মানুষ, আপনার কাছে না চাইলে কার কাছে চাবো বলেন?’
অসংস্কৃত নোংরা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশকে, আরও নোংরা করে তোলে লোকটির মানসিকতা এবং প্রকাশ ভংগি। ‘চা পানির’ অভাবে পিপাসার্ত নয় সে। ক্ষুধার্ত তার নির্লজ্জ দুটো চোখ। ‘চা পানি খাননি কেন? আপনাকে কি বেতন দেয়া হয় না কাজের জন্যে? বুঝতে পারছেন না কাকে কি বলছেন আপনি।’ বলি। ক্ষুধার্ত দু’চোখ হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ। অথবা বিক্ষুব্ধ। আর কিছু বলার সাহস অথবা ইচ্ছে নেই তার।
‘সালামালাইকুম, কখন এসেছেন আপা, আসেন আসেন আমার রুমে চলে আসেন।’ বলেন ম্যানেজার। কোনো কাজে নিজের রুমের বাইরে এসে, আমাকে দেখতে পেয়েছেন। সুবিধাভোগী পর্যায়ের কেউ নই আমি। এদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান সেভাবে বিবেচনা করতে চায় আমাকে, তবুও। অস্বস্তি হয় খুব ওরকম অবস্থায়, অনভ্যস্ত আমার। ম্যানেজারের মাধ্যমেই শেষ হবে কাজটি। তাই যেতে হয় তার রুমে।
রুমটি, ধুলো মলিন আর ছোট হলেও, তুলনায় একটু ভালো। ছিঁড়েটিরে জীর্ণ হয়ে যাওয়া ময়লা একটি সোফা রয়েছে একপাশে। রুমটির জানালায় ঝুলছে পর্দা। লাগানোর পরে কোনদিন যে ধোয়া হয়নি, নিশ্চিত হতে হয় তার শরীরের অবস্থা দেখে। যে গ্রিল রয়েছে জানলায়, কোন মানুষের হাত পড়েনি সেখানে কোনদিন, পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। পরিষ্কার করাতে বা করতে কত টাকা লাগে? আর লাগে কতটুকু সময়? না সেটা কোন ব্যাপার নয়। ব্যাপারটি হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতাবোধ। ঘরে এবং বাইরে। সব জায়গায়। সেটি না থাকলে তো, এ রকমই থাকবে। যেমন রয়েছে।
হাফসিøভ শার্টের কলারে টাই পরে বসেছেন ম্যানেজার, তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা চেয়ারে। চেয়ারে তোয়ালে রাখা, এদেশের প্রায় সব ‘বস’দের সমবেত অভ্যেস। অথবা লিখিত নির্দেশ। কারণটি কি? দেখতে কেমন লাগে এটা? এই তোয়ালেটিও কি ধোয়া হয় কখনো? ধুলেও বছরে ক’বার?
ছড়িয়ে রেখেছেন চেয়ারটিতে নিসঙ্কোচে নিজেকে, ভদ্রলোক। নড়ছেন পুরো শরীরে, অকারণে। নাড়াচ্ছেন হাত দুটো অনবরত, তাও অকারণে। জানেন না ইনিও, বসতে হয় কিভাবে একটি অফিসে। বসতে হয় কিভাবে, অতিথি এবং কাস্টমারদের সামনে। বোঝেন না সম্ভবত, অফিসটি যে তার একান্ত গৃহকোণ নয়। টেবিলের একপাশে রয়েছে একটি ফ্লাটস্ক্রিন মনিটর আর কম্পিউটর। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আধুনিক প্রযুক্তি। বার বার তাকাচ্ছেন সেদিকে, কথা বলার মাঝে। মাউস এবং কিবোর্ডে হাত দিয়েও কিছু করার চেষ্টা করছেন, যার সাথে সামনে বসে থাকা আমার কাজের, কোন সম্পর্ক নেই। এই প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকান্ড, ফাইল এবং কাগজপত্রের যে জীর্ণ অবস্থা, কি সম্পর্ক তার সঙ্গে এই কম্পিউটারটির, বুঝতে চেষ্টা করি। সম্ভব হয় না বোঝা।
‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে চাকরি করছেন যারা তাদের কেউ কেউ কাস্টমারের কাছে ঘুষ চান, তা কি আপনি জানেন?’ করতেই হয় প্রশ্নটি ম্যানেজারকে।
‘আপনার কাছে ঘুষ চেয়েছে? কে? কি বলবো বলেন, এই অবস্থাতো দেশের সব জায়গায়। রাষ্ট্র পরিচালকরা হাজার হাজার কোটি চায়। আর এরা পাঁচশ’ বা এক হাজার চায়। আমি জানাবো জায়গা মতো কথাটা। আপনার কাছে চাওয়া উচিত হয়নি।’ জবাব দেন তিনি।
আর কিছু বলি এ ব্যাপারে, তা চাচ্ছেন না ইনি। বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কারণ এর পরে যে বিষয়টি তিনি আনেন, তা, তার লেখা কবিতা। লিখেছেন গত রাতে। পৃথিবীতে প্রথম জন্মানো কবিতাটি, সফল কতটা, শুনতে আগ্রহী তিনি।
কিছুক্ষণের মাঝে প্রবেশ করেন এক ব্যক্তি। ‘স্যরি একটু অপেক্ষা করুন’ বা এ রকম জরুরী ভদ্রতা না দেখিয়ে, ব্যস্ত হয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি নবাগতের সাথে। বুঝি, এটি হয়ে ওঠেনি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যেস, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের। হবে কি কখনো?
রুমের তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে, আগ্রহী হই বা না হই, শুনি কিছু সংলাপ। বুঝি, বিষয়টি লোন সংক্রান্ত। এড়াতে চান আগত ব্যক্তি আমাকে। ম্যানেজারও।
‘আমার ব্যাগটা এখানেই থাকুক, আমি পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে আসতেছি।’ ম্যানেজারের টেবিলের নিচে ব্যাগটি রেখে দ্রুত চলে যান ভদ্রলোক। কাজ সেরে চলে আসি আমিও, কিছুক্ষণের মধ্যে কাউন্টারে। কোন ব্যাংকের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টাকা নিতে হয় না আমাকে ঢাকায়। বেশিরভাগ সময়। যখন যে ম্যানেজার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার থাকেন, কাউন্টার থেকে আনিয়ে দেন টাকা। সে প্রসঙ্গ ওঠেনি আজ। নির্ধারিত সময় অতিক্রম করতে চাননি হয়তো ম্যানেজার, এই সুবিধাটুকু দিতে যেয়ে আমাকে।
কত টাকা ঘুষ দিতে হয় এদেশে, কি পরিমাণ লোন অনৈতিকভাবে পেতে চাইলে? দিতে হয় কাকে, কাকে এবং কাকে? প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতির নির্দিষ্ট চেইনের ভেতর থেকে, বাদ কি দেয়া যায় কাউকে? এ বিষয়টি ভেবেই কাটে সময়টুকু, কাউন্টারে। টাকা দেন ক্যাশিয়ার। গুনি ওখানে দাঁড়িয়ে। দু’শ’ টাকা কম। তাকাই ক্যাশিয়ারের দিকে। ভুল করেননি তো? মিষ্টি হাসেন তিনি। খুব পুরনো অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরেছেন যিনি। তার চেয়েও অপরিচ্ছন্ন তার চুল এবং দাঁত। ‘এর চেয়ে বেশি তো চাচ্ছি না আপা। এইটুকু পাবার হক তো আছে আমাদের।’ জবাব দেন তিনি শান্ত কণ্ঠে। পাশেই রয়েছেন কর্মরত আর একজন ক্যাশিয়ার। কোন অসুবিধা হচ্ছে না তাতে। কেন?
‘দু’শ’ টাকা দেন আমাকে, কথা বলতে বাধ্য করবেন না প্লিজ।’ বলি দৃঢ় স্বরে। বেরিয়ে আসি নোট দুটো নিয়ে। মিষ্টি হাসি বিলুপ্ত হয়েছে তার ততক্ষণে। ব্যর্থতার আক্রোশ দখল করে নিয়েছে সে জায়গাটি।
কত টাকা উপার্জন করেন ইনি এবং এরা, এভাবে প্রতিদিন? আর কত টাকা উপার্জন করেন ম্যানেজার এবং এদেশের ম্যানেজাররা? এবং বাকি সবাই? বের করতে কি পারবে সে হিসেব, কোন ক্যালকুলেটর? কোন মানুষ? কোন মহাশক্তি? কোথায় এবং কার কাছে নালিশ করলে, সমাধান হতে পারে, সর্বগ্রাসী এই সর্বনাশা অবস্থার?
ঘুষ চায়নি ক্যাশিয়ার লোকটি। চাইবার মতো অবস্থানে নেই সে। অবস্থানে রয়েছে যারা, ঘুষ চায় না তারাও। টাকা দাবি করে, কাজের বিনিময়ে পাওনা অধিকার অথবা পারিশ্রমিক হিসেবে। প্রচলিত নিয়মে। অভ্যস্ত অভ্যাসে। যে বেতন তারা পায়, তা হয়তো কিছুই মনে হয় না তাদের। শুধুমাত্র বেতন পাবার জন্যে কি চাকরি নেয় তারা?
ক্যাশিয়ার লোকটি চেয়েছে দয়া। অন্যরা ঘুষ দাবি করবে, পাবে, আর সে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, দয়ার দান আদায় করবে না, তা হয় না। তার জীর্ণ পোশাক আর অতিশয় রুগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে, এই আমি ছাড়া, দয়া করে দান করবে না কে? জনপ্রতি প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে দু’শ’ টাকা করে ভিক্ষে পেলে, কত হয় দিনে, এই হিসেব সে ছাড়া বের করতে পারবে না কেউ।
হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে, যে দেশে ঘুষ দেয়া এবং নেয়ার জন্যে, কারোই শাস্তি হয় না, সে দেশে দয়ার দান বা ভিক্ষে নিলে, এদের যে কিছুই হবে না, সে নিশ্চয়তা অবশ্যই আছে। এতো টাকা ভিক্ষে করেও প্রতিদিন, নতুন অথবা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে না সে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে, সুস্থও করে না চেহারা। করে কি সে তাহলে টাকা নিয়ে? পরিচ্ছন্ন নতুন পোশাক এবং সুস্থ চেহারা দেখলে কি, দান করবে না কাস্টমাররা তাকে?
কে এবং কারা দেয় ঘুষ? দেয় এদেশেরই জনগণ। তারাই ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ, ঘুষ দেয় যারা। কেন দেয়? দেয় নিজেদের কাজের স্বার্থে, ব্যবসার স্বার্থে। সুবিধার স্বার্থে। সুযোগের স্বার্থে। ঘুষ পেয়ে ধনী হয় মানুষ। ঘুষ দিয়েও ধনী হয়। হতে পারে অনে-ক ধনী।
দুর্নীতির অনেক অনেক ধরনের মধ্যে ঘুষ একটি। ঘুষ নেয় যারা, দুর্নীতিবাজ বলা হয় তাদের। অপরাধী তারা। ঘুষ দেয় যারা, তারা কি? তারাও কি সমান দুর্নীতিবাজ আর অপরাধী নয়? ঘুষ দিয়ে যে কাজ, ব্যবসা, স্বার্থ, সুযোগ, সুবিধা সে আদায় করে, তা থেকে সে উপার্জন বা আদায় করে অনেক অনেক অনেক বেশি।
ঘুষ চায় এবং ঘুষ দেয় যারা, ভয়ঙ্কর লোভী তারা। লজ্জা সম্মান বোধহীন এক প্রজাতি। এদের ধারাবাহিক লোভ এবং চাহিদার লিফটটি মহাকাশগামী। এরা না দিলে ওরা মহাকাশে পৌঁছায় কি করে? ঘুষ দেবার জন্যেও তো দরকার টাকা। পর্যাপ্ত টাকা। তা এরা পায় কোথায়? কিভাবে? দেয়া এবং পাওয়া দুটোর অবস্থান সমান্তরালে। অপরাধও সমান।
এই যে ঘুষদাতা, এবং ঘুষ গ্রহীতা, এদেশে এরাই বলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, উচ্চ কণ্ঠ। লেখেনও এদেরই অনেকে পত্রিকায়, একই বিষয়ে বার বার। অনেক বার। বলেন এবং লেখেন, কারণ, নিশ্চয়ই দাবি করেন নিজেকে সত হিসেবে। অথবা, পাঠক এবং শ্রোতাকে বোঝাতে, তিনি সৎ। নাহলে, কেন তিনি বলবেন অথবা লিখবেন, এই সব অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে? এইযে নব্বই অথবা পঁচান্নব্বই ভাগ, এরা যদি সৎ হন, তো অসৎ কারা?
দিনের প্রতিটি ঘণ্টায়, চব্বিশ থেকে আটচল্লিশটি, অথবা তারও বেশি অন্যায় কাজ করে, অন্যায়কারী মনে করে না নিজেকে এদেশে কেউ। গড়ে প্রতিদিন অনেক অনেকগুলো অসততা করেও, সৎ মনে করে নিজেকে সবাই। বিলীন হয়ে গেছে এখানে ন্যায় অন্যায়, সত্য মিথ্যা, ভালো মন্দ, সততা অসততার পার্থক্য। স্বামী প্রতারণা করে স্ত্রীকে। স্ত্রী প্রতারণা করে একইভাবে স্বামীকে। গোপনে। সরকার প্রতারণা করে জনগণকে। জনগণ প্রতারণা করে সরকারকে। এবং নিজেরা নিজেদেরকেও। সবচেয়ে বড় কাজটি এদেশে প্রতারণা। এই প্রতারণা দেখা যায় এবং দেখা যায় না। অতি অভ্যস্ত এই প্রতারণা, মনেও হয় না প্রতারণা। মনেও হয় না অপরাধ। সবই হয়ে গেছে স্বাভাবিক। খুব-ই স্বাভাবিক।
(চলবে)
No comments