মন্ত্রীকেই যদি এভাবে ছুটতে হয়? by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

গেল বছর এই সময় ওবায়দুল কাদের সাহেব একজন সাংসদ এবং আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে কিছু আলোচনা সভায় ভাল ভাল কথা বলতেন, তাঁর কথায় স্পষ্টবাদিতার ছাপ সবাইকে আকৃষ্ট করত। অবশ্য সমালোচক এবং নিন্দুকেরা তখন তাঁর এসব কথাকে ‘মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বেদনা’ বলতেও দ্বিধা করেননি।


মন্ত্রিত্ব পেলে তিনিও অন্য মন্ত্রীদের মতো সচিবালয়ের চার দেয়ালে আটকে পড়বেন বলে কেউ কেউ মত দিতেন। গেল বছর বর্ষায় সড়কপথের বেহাল অবস্থায় তৎকালীন মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মিডিয়া এবং নিজের দলে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। যদিও সৈয়দ আবুল হোসেন রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য বেশ ক’বার রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হননি, সেপ্টেম্বর মাসে নতুন করে পদ্মা সেতু নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রীকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বদলি করেন, রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে পৃথক করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেল মন্ত্রণালয় এবং ওবায়দুল কাদেরকে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। দু’টো মন্ত্রণালয়ে বিভক্তি জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল। যে দু’জন মন্ত্রীকে নতুনভাবে উক্ত দু’টো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয় তাও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুরুটা বেশ ভালই করেছিলেন, রেল ব্যবস্থায় নতুন কিছু উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনামতোই এগুচ্ছিলেন। কিন্তু রেলের নাকি অন্য কোন বনজঙ্গলের এক অজানা-অচেনা কালো বিড়াল রাতের বেলায় গাড়ি নিয়ে পিলখানায় ঢুকে পড়ল। তা নিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ওপর কালিমা লেপে দিল। এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করলে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হলো যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেই। ফলে এ বছর ওবায়দুল কাদেরকে এখন একটি নয়, দুটো মন্ত্রণালয়ের চাপ নিতে হচ্ছে। সেই চাপ তিনি কিভাবে সহ্য করছেন তা আমরা জানিনা, তবে তাঁকে প্রতিদিনই ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে হয় কোন রেল স্টেশনে, নতুবা কোন সড়কপথে।
এবার আর ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে সেমিনারে বসে দৃষ্টিকাড়া নানা কথা বলার সুযোগ নেই। তবে তিনি বোধ হয় নিন্দুক ও সমালোচকদের সকল অনুমান ও সন্দেহ ব্যর্থ প্রমাণিত করে দিতে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কতটা পুরোপুরি সফল হবেন তা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। রেল এবং যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোজার আগ থেকেই রাস্তায় আছেন। ঢাকার বাইরেও যাচ্ছেন। রাস্তাঘাটের অনিয়ম, বেহাল দশায় তিনি নিজে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক’জনকে শোকজও করেছেন, ক’জনের চাকরি থাকবে কি থাকবে না-এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি চাঁদপুরে গিয়ে বলেছেন, এই অঞ্চলে রাস্তাঘাটের মতো বেহাল অবস্থা দেশের আর কোথাও নেই। অন্যত্র কতটা ভাল তা আমি জানি না। তবে চাঁদপুরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে আমার গ্রামের বাড়ি। হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ রাস্তাটির ভাঙ্গা অবস্থার কথা জানিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেল বছরই একটি লেখা লিখেছিলাম। এখনও সেই রাস্তাটি চলাচলের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায়নি। চাঁদপুর-দাউদকান্দি গৌরীপুরের ভেতরের সব রাস্তার অবস্থা প্রায় একই রকম। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীকে গিয়ে কেন রাস্তাঘাটের এমন দুরবস্থার চিত্র দেখতে হবে, ক্ষোভ প্রকাশ হবে? একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সচিবালয়, জেলা উপজেলা পর্যায়ে কত শত কর্মকর্তা চাকরি করেন তা সকলেরই জানা। একজন মন্ত্রীর চাইতে তাদেরই তো এসব অঞ্চলের রাস্তাঘাটের সমস্যা বেশি জানার কথা। মন্ত্রী তো আসলেন এই সেই দিন মাত্র। এখন তাঁকেই খুঁজে খুঁজে এসব চলাচলের অযোগ্য রাস্তাঘাটের মেরামতের তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিতে হচ্ছে কেন? সত্যিকার অর্থে এভাবে কাজের মানও ভাল হয় না, বছর ঘুরতে না ঘুরতে ওই সব রাস্তাঘাট আবারও ভেঙ্গেচুরে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করার সুযোগ পায় ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে বাস্তবে চলে এমনটিই। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে এ ধরনের তুঘলকি কর্মকা-ই চলে আসছে। তাছাড়া কাজটা শুরুও করা হয় বর্ষা শুরুর মৌসুমে যখন কাদা, ইট, সুড়কিতে সবই এলাকার হয়ে যায়। বস্তুত বাংলাদেশ সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে জনগণ ভোগান্তিতে আছে, পরিবহনসমূহ খানাখন্দে পড়ে বা সেগুলো আয়ুষ্কাল হারায়, সরকার তথা মন্ত্রী পড়েন ব্যাপক সমালোচনার মুখে।
রাস্তাঘাটে যখন এসব দুরবস্থা থাকে তখন গাড়ির চালক, যাত্রী সাধারণ প্রতিনিয়ত মন্ত্রীকে গালাগাল করেন, সরকার, প্রধানকেও তিরস্কার করতে কেউ ছাড়েন না। স্থানীয় সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের নাম ধাম কেউই জানেন না, তাদের কেউ চেনেনও না। ফলে সব সমালোচনা ও গালমন্দ গিয়ে পড়ে সরকারপ্রধান ও যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর। এ হচ্ছে, বাংলাদেশের বাস্তবতা। এমনটি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে বা ঘটছে এমনটিই। যোগাযোগ ও রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এখন রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে, দিনের বেলাতেও দুই মন্ত্রণালয়ের ফাইল দেখা, সভা করা থেকে সময় বের করে তাঁকে ছুটে যেতে হচ্ছে কখনও গাজীপুর, কখনও বিভিন্ন সড়কে বা কমলাপুর রেল স্টেশনে। তাতে অবশ্য সাড়া পড়ে গেছে, কাজও হচ্ছে। এ সব বিভাগের কর্মকর্তারা এবার নড়েচড়ে উঠেছেন, আগের মতো অফিসে বসে থাকতে পারছেন না, যার যার এলাকার রাস্তাঘাট নিয়ে তাদের একটু তটস্থ হতে হচ্ছে। কথা হচ্ছে, তাঁরাই বা এভাবে কাজ করে থাকবেন কেন? তাঁরা কেন শুকনো মৌসুমে রাস্তাঘাট মেরামতের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছেন না? ফাইল তো তাঁরাই উপস্থাপন করেন, চালাচালি করেন, দেরিও তাঁরাই করেন। সারা বছর স্বাভাবিক গতিতে কাজ হলে তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মন্ত্রী নির্দেশ দিলে স্বল্পসময়েও অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন পাওয়া যায়, রাতদিন কাজ করার দৃশ্যও দেখা যায়। সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কাজের নমুনা, গতি কেন এমন হবে আমরা জানি না। তারা কি আসলেই ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’-এই প্রবাদেরই সার্থক প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকার কিনা। অবস্থা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। গেল বছর সৈয়দ আবুল হোসেন রাস্তায় কয়েকবার নামলেও রূঢ় বা শক্ত কোন ব্যবস্থা তিনি নেননি। ফলে কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক হয়নি। এ বছর ওবায়দুল কাদের সাহেব বেশ চোখাচোখা কথা বলছেন, শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন তাতে কাজ কম বেশি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখন গোটা সড়ক ব্যবস্থায় ‘ওবায়দুল কাদের আতঙ্ক’ কাজ করছে। ‘অনেকেই এখন কাজে হাত দিয়েছেন, চারদিকে ঈদের আগে সড়ক মেরামত নিয়ে হুলস্থূল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এক অর্থে সুসংবাদ। অন্যদিকে বলতে হবে, এটি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের জন্য লজ্জার বিষয়, দাসতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলনই তাতে ঘটছে। প্রাচীন যুগে চাবুক হাতে নিয়ে দাসমালিকরা দাঁড়িয়ে থেকে দাসদের দিয়ে কাজ করানোর দৃশ্যই চোখে ভেসে ওঠে। মনে হয় সেই দৃশ্যই এখন আমরা বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। এটি কোন সভ্য সমাজের প্রশাসন হতে পারে না। আমরা এখন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি। প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে, নানা সমস্যার পরও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি অনেক মন্ত্রণালয়েই সন্তোষজনক বলে শুনছি। কিন্তু যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে কাজের গতি কেমন তা জানি না, তবে প্রতিবছরই বর্ষাকালে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা নিয়ে যা দেখা যায় তাতে সবারই ধারণা এ মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি ও মান কোনকালেই বৃদ্ধি পাবে না। রেলের অবস্থা তো বিস্মৃতির অতলেই যাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল, রেলটা আবার মনে হচ্ছে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে নিজেদের মন্ত্রণালয় পাওয়ার পর। এত দিন রেলের পরিচয়টা মুছে যাচ্ছিল, সম্পদ বেদখল হয়ে গেছে অনেকটাই, রাস্তা থেকে পাথর সব হারিয়ে গেছে, আর ক’বছর পর বাংলাদেশ রেলওয়েকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতো। সেখান থেকে মনে হচ্ছে রেলব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস কিছুটা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ওই প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে কালো বিড়ালের কথা বলে গেছেন তা শুধু কালোই নয়, থাবায় বাঘকেও হার মানার মতো বলে মনে হয়, সুরঞ্জিত বাবু নিজেই সেই থাবায় কুপোকাত হয়েছেন কিনা জানি না। তবে ওবায়দুল কাদের স্বল্পসময়ে ওদের কতটা খাঁচার ভেতর বন্দী করতে পারবেন তা দেখার বিষয়। কেননা রেলওয়ের কালো বিড়াল, হিংস্র বাঘ অভ্যন্তরীণই শুধু নয়, বাইরেরও বটে। এরাই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রেলব্যবস্থাটিকে অলাভজনক করে এর সকল সম্পত্তি ভোগ দখল করছিল, যাত্রী সাধারণকে সড়ক পরিবহনে উঠতে বাধ্য করিয়েছিল। একটি বড় ধরনের মাফিয়া চক্র এ সবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছেÑযারা আড়ালে থেকে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, এখনও হয়ত করছে। জানি না, ওবায়দুল কাদের সাহেব এসব অপশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে কতটা সফল হবেন। তাঁর সাফল্যের ওপর দেশের জনগণের যাতায়াতের সুবিধা অনেকটাই নির্ভর করছে। তবে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গণপরিবহন নিয়ে গভীর সঙ্কট তীব্রতর করার একটি অবস্থা চলছে, বিআরটিসির বাস না থাকলে ঢাকা শহরে মানুষের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা কতটা বাড়ত তা সহজেই অনুমেয়। এখন এ খাতে জনদুর্ভোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে জরুরী ভাবা এবং কিছু করা দরকার। নতুবা এর নেতিবাচক প্রভাব সরকারের ওপরই পড়বে।
মৌলিকভাবে চিন্তা করা দরকার দেশের অর্থ বছরের দীর্ঘদিনের নিয়মটি নিয়ে। জুলাই-জুন সময়ের অর্থবছরের ফলে সবচাইতে বেশি অর্থ লোপাট হয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। জুন থেকে আগস্ট মাসে ঝড় বৃষ্টি ও বর্ষার কারণে রাস্তাঘাট নির্মাণ বা মেরামত করার কোন উদ্যোগই ফলপ্রসূ হওয়ার নয়। আমাদের আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে অদূর ভবিষ্যতে অর্থবছর জানুয়ারি ডিসেম্বর করা যায় কিনা সরকার, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞ মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব। তাতে শুকনো মৌসুমে রাস্তাঘাট, ব্রিজ নির্মাণসহ অনেক কাজেই অপচয় বা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই বাস্তব অবস্থার কথা বিবেচনা করে অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তারা সেভাবেই চলছে। আমাদের দেশেও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কথা ভাবতে অনুরোধ করব।
জনাব ওবায়দুল কাদের দেশের সড়ক ও রেলব্যবস্থাকে সচল রাখতে, ঈদে ঘরমুখো মানুষদের যাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিন ছুটছেন। তাতে এবার কিছুটা কাজ হচ্ছে। কিন্তু এটি তো তাঁর নিজের জন্য বা সব মন্ত্রীর জন্যে স্থায়ী অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় কোন নিয়ম হতে পারে না; ভবিষ্যতে যাতে কোন মন্ত্রীকে এভাবে দৌড়ঝাঁপ দিতে না হয় সেটিই আমাদের কাম্য।

লেখক : অধ্যাপক, বাউবি; কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.