নিশ্চিত হোক লিবিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের পুনঃপ্রবেশ by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ
অর্থনৈতিক বিবেচনা আর শিক্ষাদীক্ষায় একসময় উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। দরিদ্র দেশ হিসেবেই এই দেশটির পরিচিতি ছিল বিশ্বব্যাপী। সেটি অবশ্য চল্লিশের দশকের কথা। কিন্তু এই দেশটির অর্থনৈতিক মোড় বদলে যেতে শুরু করে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে।
এই দশকের শেষ লগ্নে দেশটিতে বৃহদাকারে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের অফুরন্ত সন্ধান মিললে দেশটির ভাগ্য বদলে যায় রাতারাতি। তেল আর গ্যাসের বদৌলতে আফ্রিকার মানচিত্রে দ্রুতই লিবিয়া এক ধনী দেশে পরিণত হতে থাকে। দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অনেকটা সোনার বাটি হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হু হু করে জিডিপির হার বাড়তে থাকে। বিশ্বব্যাংকের রেটিং অনুযায়ী মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করে দ্রুত। বলা যায় আশির দশকে লিবিয়া রীতিমতো চমকে দেয় আফ্রিকাসহ গোটা বিশ্বকে। তেল রপ্তানির মাধ্যমে দেশটি অর্থনীতিতে এতটাই এগিয়ে যায়, এই দশকের প্রারম্ভে আফ্রিকার বুকে অর্থনৈতিকভাবে এক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে লিবিয়া। শুধু তা-ই নয়, সিঙ্গাপুর, ইতালি, স্পেনের মতো ধনী দেশ থেকেও তারা জিডিপিতে অনেক বেশি এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কম জনসংখ্যার কারণে আর তেল থেকে অধিক আয় দেশটিকে অর্থনৈতিক মর্যাদায় অনেক উঁচুতে আসীন করে।
এই সময় থেকেই বাংলাদেশি শ্রমিক এবং পেশাজীবীরা লিবিয়ায় ব্যাপকহারে গমন শুরু করে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই দেশটির নাম। সাধারণ মানুষের কাছে তেলসমৃদ্ধ 'লিবিয়া' নামের দেশটি দুটি কারণে বড় বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রথমত, আশির দশকে কর্মসংস্থান প্রত্যাশী তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ ও প্রচুর পেশাজীবী চাকরি নিয়ে লিবিয়ায় গমন শুরু করে এবং এই অভিবাসী তরুণরা বিভিন্ন কম্পানিতে কাজ করে দ্রুতই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, আশির দশকে লিবিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি আমেরিকার আধিপত্যবাদী আচরণের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে লিবিয়ার বীরোচিত মনোভাব এ দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিপুল সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। এ ছাড়া আরো কিছু কারণে দেশটি বরাবরই বাংলাদেশের পাশে থেকেছে, সপক্ষে থেকেছে। বাংলাদেশের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে লিবিয়ার প্রতি আগাগোড়াই এ দেশের সাধারণ জনগণের এক ধরনের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা রয়েছে বলেই দৃশ্যমান।
আশির দশক থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি প্রেরণ শুরু হলেও তা অব্যাহত থাকে এই দেশটির লৌহমানবখ্যাত রাষ্ট্রপতি মুয়াম্মার গাদ্দাফি যুগের অবসান হওয়া পর্যন্ত। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কমবেশি এই দেশটিতে আরো জনশক্তি প্রেরিত হয়েছে। তবে আশি-নব্বইয়ের দশকে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে লিবিয়ার একটা বড় অবদান চোখে পড়ে। অনেকেই লিবিয়ায় চাকরি করার কারণে নিজের বা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। হিসাব অনুযায়ী একসময় বাংলাদেশের মোট আয়কৃত রেমিট্যান্সের কম করে হলেও অন্তত ১০ শতাংশ আসত এই দেশটি থেকেই। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই দেশটিতে সব মিলিয়ে ৬০ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। যাঁরা প্রতি মাসে কম করে হলেও গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকা দেশে প্রেরণ করতেন। সর্বশেষ ২০১০ সালে লিবিয়া থেকে দশমিক ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স (প্রায় ৬৫ কোটি টাকা) বাংলাদেশে আসে।
কিন্তু সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গত বছরের শুরুতে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে। গত বছর তিউনিসিয়া এবং মিসরে প্রথমে শাসক দলের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারিতে লৌহমানবখ্যাত গাদ্দাফি সরকারের অপসারণের দাবিতে ত্রিপোলিতে গণতন্ত্রকামী জনতা বিদ্রোহ করে রাস্তায় নেমে আসে। দ্রুতই এই বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বিদ্রোহে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়। ত্রিপোলি থেকে বেনগাজিসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা একপর্যায়ে ন্যাশনাল ট্র্যানজিশনাল কাউন্সিল তথা এনটিসি গঠন করে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এই ধারাবাহিকতায় সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই শুরু হয়। বিদ্রোহীরা একের পর এক বিভিন্ন শহর দখল করে নিতে থাকে। একপর্যায়ে বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে গাদ্দাফি নিহত হলে আপাতত গাদ্দাফি যুগের অবসান ঘটে। এরপর পুরো রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় গাদ্দাফিবিরোধীদের হাতে। শুরু হয় নতুন এক লিবিয়ার পথচলা। কিন্তু গৃহযুদ্ধ চলাকালে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে বাংলাদেশের শ্রমিকরা দারুণভাবে নিরাপদহীন হয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে অনেকেই লিবীয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে অবস্থান গ্রহণ করে। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীন শ্রমিকরা আইওএম, সরকার এবং নিজস্ব কম্পানির সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসে। আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক শ্রমিক লিবিয়ায় থেকে যায়। তবে বিভিন্নভাবে দেশে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক ফিরে আসে। লিবিয়া থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের সরকার এবং বিভিন্ন কম্পানি কিছু আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করে।
লিবিয়ায় এখন আর তেমন যুদ্ধাবস্থা নেই। লিবিয়া এখন অনেকটা শান্ত এবং আরো শান্তির দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। অনেকেরই মনে হচ্ছে লিবিয়ায় নতুন করে জনশক্তি প্রেরণ করতে গিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে সেটা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়, এতে করে আমাদের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি করে দেখা যাচ্ছে। লিবিয়া খানিকটা শান্ত হয়ে এলেই বিভিন্ন পথে আমাদের শ্রমিকরা ফের তার পুরনো কর্মস্থলে যেতে তৎপর হয়ে ওঠে। আবার পুরনোদের ভিড়ে নতুন করেও জনশক্তি প্রেরণে অনুমোদন লাভ করে কোনো কোনো এজেন্সি- যারা বৈধ ভিসায় জনশক্তি প্রেরণ করে। কিন্তু সম্প্রতি লিবিয়া ইমিগ্রেশন অবৈধ ভিসা বলে চিহ্নিত করে বেশ কিছু শ্রমিককে সে দেশ থেকে ফেরত পাঠায়। কাউকে কাউকে পুলিশ আটকেও রাখে। কিন্তু এমনও দেখা গেছে, এক ফ্লাইটে ৫০ জনের মতো শ্রমিক প্রেরণ করা হয়েছে, এর মধ্যে হয়তো ১০ জন শ্রমিক বৈধ প্রক্রিয়ায় গমন করেনি; কিন্তু জাল ভিসা সন্দেহে সেই ফ্লাইটের সব বৈধ-অবৈধ শ্রমিককে লিবিয়া থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে বিএমইটি লিবিয়া যাওয়ার ছাড়পত্র প্রদান পর্যন্ত বন্ধ রাখে। উল্লেখ্য, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সঠিক ভিসা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশস্থ লিবিয়া দূতাবাস থেকে ওই ভিসার বিপরীতে অনলাইনে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ছাড়পত্র প্রদান করত। এত নজরদারির পরেও লিবিয়া ইমিগ্রেশন থেকে অবৈধ ভিসা চিহ্নিত হয়ে কিছু শ্রমিক দেশে ফেরত আসে। অনেকে অভিযোগ করেন, ঢাকাস্থ লিবিয়ান দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা এবং কথিত কিছু জনশক্তি রপ্তানিকারক লিবিয়ায় কোনো চাকরিদাতা কম্পানি না থাকা সত্ত্বেও সুকৌশলে ভিসা লাগিয়ে শ্রমিক প্রেরণ করে, যা কার্যত বাংলাদেশের ইমেজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে লিবিয়ান দূতাবাসের চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স কামেল আল মাহজুবও এক সংবাদ সম্মেলনে জোর আপত্তি প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে দূতাবাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমরা বারবারই দেখছি, একটি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হতে না হতেই একশ্রেণীর দালাল এবং কথিত এজেন্সি অবৈধ পন্থায় লোক পাঠিয়ে দেশের ইমেজকে শুধু ক্ষুণ্নই নয়, ভবিষ্যৎ রুজি-রোজগারের সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। লিবিয়ার শ্রমবাজার যাতে নষ্ট না হয়, এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এখনই কিছু সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই শক্তহাতে জাল ভিসা এবং ভিসা ট্রেডিং বন্ধে কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে লিবিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করে গৃহযুদ্ধাবস্থায় যে শ্রমিকরা ফিরে এসেছে, তাঁদের পুরনো কম্পানিগুলো যাতে আবার ফিরিয়ে নেয় সে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বরাবরই জনশক্তি খাতে একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লিবিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা নিরসনে মন্ত্রী মহোদয় বায়রাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে লিবিয়ার শ্রমবাজারে আমাদের শক্তিশালী অবস্থান পুনঃস্থাপিত হবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
লেখক : জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান,
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondibate@gmail.com
No comments