স্মরণে মননেঃ মাতৃহীন জননী by কে জি মোস্তফা
এখন জীবনের কোয়ালিটি বদলে গেছে, ইনটেনসিটি বদলে গেছে, মানুষের মূল্যবোধ তো আগের মতো নেই। তবু একজন মানুষের দুর্ভাগ্য আমাদের বিচলিত ও মর্মাহত করে। কারণ হতভাগ্যের প্রতি করুণা থেকে আত্মকরুণার উদ্রেক হয়। লেখালেখির মতো হোমিও চর্চা আমার অন্যতম নেশা। সেই সুবাদে আশির দশকে এমন এক পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে যারা ঐতিহ্যে, আভিজাত্যে এবং শিক্ষায়-দীক্ষায় সমাজের মধ্যমণি।
পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ ছিলেন ঢাকার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এদের আত্মীয়স্বজন। পরিবারে মেয়ে-পুরুষ সবাই সমভাবে উচ্চশিক্ষিত। আমার পরিচিত ওই পরিবারটির প্রধান এক বিধবা মহিলা। তার ফুটফুটে ৪টি মেয়ে। যেন একই বৃন্তে ৪টি ফুল। তারা স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রী। ভদ্রমহিলা ছিলেন মেয়েঅন্ত প্রাণ। মেয়েরা তার চোখের মণি। তাদের সামান্য অসুখ-বিসুখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। বিশেষ করে সেজো মেয়েটির প্রতি ছিল তার বেশি দুর্বলতা। প্রায়ই সর্দি-কাশিতে ভুগত সে। মেয়েটি ছিল যেমন টলটলে তেমনি হাসিখুশি। ভদ্রমহিলা থাকতেন পিতৃমহলে। অশীতিপর বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনার ভার ছিল তার ওপর। বৃদ্ধা মায়ের ইন্তেকালের পর তিনি স্থির করলেন, পাশেই নিজের প্লটে বাড়ি বানাবেন। এলাকাটি অভিজাত। যথারীতি নির্মাণের কাজ শুরু এবং ৭-৮ মাসেই সমাপ্ত। ছিমছাম সুন্দর দোতলা বাড়ি। একদিন সেই নতুন বাড়িতে আমাকে ডেকে পাঠালেন। ভদ্রমহিলা গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরপর কয়েকদিন যাতায়াত করলাম। কিন্তু হাসিখুশি সেজো মেয়েটিকে একদিনও দেখতে পেলাম না। আমাকে অভ্যর্থনা বা আপ্যায়নে সে-ই এগিয়ে আসত। কৌতূহলবশত একদিন তার কথা জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রমহিলা খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনুরোধ করলেন আমি যেন ওই মেয়েটির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস না করি। আমি তো হতবাক। কিছুদিন পর অবশ্য জানতে পারলাম, নতুন বাড়ি নির্মাণের সময় সবার অলক্ষ্যে সুপারভাইজার লোকটির সঙ্গে মেয়েটির অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তার মা, বোন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন তাকে ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন; কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। নিজের শিক্ষা, নিজের বিশ্বাস, নিজের সংস্কার দিয়ে যে মা বড় করেছেন তাকে; মেয়েটি অনায়াসে ছেড়ে চলে গেল তাকে।
ভদ্রমহিলা সারা জীবন ধরে মুখ বুজে মেয়েদের জন্য সবকিছু করেছেন, বিনিময়ে কী পেলেন! জীবনের সঙ্গে জন্মগত ও ঐতিহ্যগত প্রাত্যহিক পরিচয় বিসর্জন দিতে মেয়েটির এতটুকু কুণ্ঠাবোধ হলো না কেন! যে লাজুক, নম্র, ভদ্র; যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসত, সে এমন অবাধ্যতা করতে পারে এমন ধারণা অচিন্ত্যনীয়। কী করে এমন অচেনা হয়ে গেল! মনের কষ্ট, মনের উদ্বেগ মনের মধ্যে চেপে সেই মা-জননী এখন সংসারে শিকড়হীন এক অস্তিত্ব। যতদূর জানি, অপ্রয়োজনীয় একটা জীবনকে বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি এখন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। মনের দিক থেকে তিনি সমাজ-সংসার সব মানবিক সম্পর্কের বাইরে।
আমার জানামতে এমন শোকাবহ ঘটনা একাধিক আছে। জীবন থেকে আশ্রয় হারিয়ে রুদ্রবেলার দুঃখদহনের ছোঁয়ায় সেসব মেয়ের কষ্ট ও পরিণাম অবর্ণনীয়। জীবনের স্বাধীন পরিচালনা আর নিঃসঙ্গ পরিচালনার মধ্যে যে ধু-ধু ফারাক তা বুঝতে না পারার মাশুল গুনতে হয় তাদের। অনেকখানি হাহাকার ভরা শূন্যতা নিয়ে কাটে বাকি জীবন।
শুনেছি আমেরিকান ছেলেমেয়েরা হাই স্কুল থেকেই ডেটিং করে। এটা নাকি তাদের বার্থ-রাইট। বাবা-মা আপত্তি করলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সময়ের ভঙ্গুরতা বাড়ে। পশ্চিমা সংস্কৃতির ঢেউ ইদানীং আমাদের সমাজ-জীবনেও দুষ্ট ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে। মানবজীবনের অর্ধেক আকাশ তো নারী।
লোকে বলে, সুন্দরী মেয়েরা উড়নচণ্ডী। ‘ফানলাভিং’ মেয়ে মজা হৈচৈ ভালোবাসে। যুক্তির পথে হাঁটে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বিষয় পড়তে গিয়ে একজনের সঙ্গে আরেকজনের আলাপ। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। ‘আই লাভ ইউ’—ছোট্ট একটি কথা। সে কথাটি কখন যে একটা লোহার বলের মতো জোরালো হয়ে ওঠে। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারায় পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে মন। জড়িয়ে পড়ে সম্পর্কে। সেখানে মিথ্যার আশ্রয় নেয় প্রেম। বাবা-মার সঙ্গে মিথ্যাচার করতে বাধ্য হয়।
টুকরো আদর। মনে মাদক আবেশ ছড়ায়। প্রাক-বিবাহ প্রেমে কোনো অন্যায় দেখতে পায় না। শরীরের আবেদনে ক্রমশ বিবশ। মুহূর্তের মধ্যে মোমের পুতুল। বহুশ্রুত শরীরী সুখের জাদুর কাঠিটা যখন এসে যায় হাতে, সন্তর্পণে জেনে যায় রহস্যমোচনের উপায়। পেছনে অতীতের চালচিত্র, চারপাশে বর্তমান ঘূর্ণাবর্ত। সামনে ভবিষ্যতের হাতছানি। পুরনো দিনের স্মৃতি যা অনেক অশ্রু-রক্ত, মান-অভিমান, ভালোবাসা-ঘৃণা, জয়-পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই সময় এই সমাজে মনের আকাশে এমন কিছু মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে যাদের মৃদু হাসিতে পান্না, অট্টহাসিতে কান্না। পরাজয় ও বিশ্বাসের গভীরে অন্তঃশীলা এক আবেগে যাদের সতর্কবাণী : না জেনেশুনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও না আপন-আপন আত্মা, পাথরে কিংবা পাহাড়ে এলোমেলো বুনো না ভালোবাসার পবিত্র বীজ। যে পুরুষ মিথ্যার বেসাতি করে, প্রিয়তমা নারীর সঙ্গে যার নিত্য অভিনয়, অজস্র নীচতা আর তুচ্ছতার সমাবেশ যার প্রাণ-মন-দেহে, ঝাড়-লণ্ঠনের আলোয় কী ভয়ঙ্কর তার রূপ। রোমান্টিক প্রেমিকও বাস্তবে কত গাদ্যিক! মনে রেখো, তথাকথিত ভালোবাসা চুমুর মতো ক্ষণিক, অশ্রুর মতো চিরন্তন।
ভদ্রমহিলা সারা জীবন ধরে মুখ বুজে মেয়েদের জন্য সবকিছু করেছেন, বিনিময়ে কী পেলেন! জীবনের সঙ্গে জন্মগত ও ঐতিহ্যগত প্রাত্যহিক পরিচয় বিসর্জন দিতে মেয়েটির এতটুকু কুণ্ঠাবোধ হলো না কেন! যে লাজুক, নম্র, ভদ্র; যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসত, সে এমন অবাধ্যতা করতে পারে এমন ধারণা অচিন্ত্যনীয়। কী করে এমন অচেনা হয়ে গেল! মনের কষ্ট, মনের উদ্বেগ মনের মধ্যে চেপে সেই মা-জননী এখন সংসারে শিকড়হীন এক অস্তিত্ব। যতদূর জানি, অপ্রয়োজনীয় একটা জীবনকে বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি এখন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। মনের দিক থেকে তিনি সমাজ-সংসার সব মানবিক সম্পর্কের বাইরে।
আমার জানামতে এমন শোকাবহ ঘটনা একাধিক আছে। জীবন থেকে আশ্রয় হারিয়ে রুদ্রবেলার দুঃখদহনের ছোঁয়ায় সেসব মেয়ের কষ্ট ও পরিণাম অবর্ণনীয়। জীবনের স্বাধীন পরিচালনা আর নিঃসঙ্গ পরিচালনার মধ্যে যে ধু-ধু ফারাক তা বুঝতে না পারার মাশুল গুনতে হয় তাদের। অনেকখানি হাহাকার ভরা শূন্যতা নিয়ে কাটে বাকি জীবন।
শুনেছি আমেরিকান ছেলেমেয়েরা হাই স্কুল থেকেই ডেটিং করে। এটা নাকি তাদের বার্থ-রাইট। বাবা-মা আপত্তি করলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সময়ের ভঙ্গুরতা বাড়ে। পশ্চিমা সংস্কৃতির ঢেউ ইদানীং আমাদের সমাজ-জীবনেও দুষ্ট ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে। মানবজীবনের অর্ধেক আকাশ তো নারী।
লোকে বলে, সুন্দরী মেয়েরা উড়নচণ্ডী। ‘ফানলাভিং’ মেয়ে মজা হৈচৈ ভালোবাসে। যুক্তির পথে হাঁটে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বিষয় পড়তে গিয়ে একজনের সঙ্গে আরেকজনের আলাপ। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। ‘আই লাভ ইউ’—ছোট্ট একটি কথা। সে কথাটি কখন যে একটা লোহার বলের মতো জোরালো হয়ে ওঠে। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারায় পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে মন। জড়িয়ে পড়ে সম্পর্কে। সেখানে মিথ্যার আশ্রয় নেয় প্রেম। বাবা-মার সঙ্গে মিথ্যাচার করতে বাধ্য হয়।
টুকরো আদর। মনে মাদক আবেশ ছড়ায়। প্রাক-বিবাহ প্রেমে কোনো অন্যায় দেখতে পায় না। শরীরের আবেদনে ক্রমশ বিবশ। মুহূর্তের মধ্যে মোমের পুতুল। বহুশ্রুত শরীরী সুখের জাদুর কাঠিটা যখন এসে যায় হাতে, সন্তর্পণে জেনে যায় রহস্যমোচনের উপায়। পেছনে অতীতের চালচিত্র, চারপাশে বর্তমান ঘূর্ণাবর্ত। সামনে ভবিষ্যতের হাতছানি। পুরনো দিনের স্মৃতি যা অনেক অশ্রু-রক্ত, মান-অভিমান, ভালোবাসা-ঘৃণা, জয়-পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই সময় এই সমাজে মনের আকাশে এমন কিছু মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে যাদের মৃদু হাসিতে পান্না, অট্টহাসিতে কান্না। পরাজয় ও বিশ্বাসের গভীরে অন্তঃশীলা এক আবেগে যাদের সতর্কবাণী : না জেনেশুনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও না আপন-আপন আত্মা, পাথরে কিংবা পাহাড়ে এলোমেলো বুনো না ভালোবাসার পবিত্র বীজ। যে পুরুষ মিথ্যার বেসাতি করে, প্রিয়তমা নারীর সঙ্গে যার নিত্য অভিনয়, অজস্র নীচতা আর তুচ্ছতার সমাবেশ যার প্রাণ-মন-দেহে, ঝাড়-লণ্ঠনের আলোয় কী ভয়ঙ্কর তার রূপ। রোমান্টিক প্রেমিকও বাস্তবে কত গাদ্যিক! মনে রেখো, তথাকথিত ভালোবাসা চুমুর মতো ক্ষণিক, অশ্রুর মতো চিরন্তন।
No comments