চিরকালের আর্মস্ট্রং by পল রিনকন
নিল আর্মস্ট্রং হয়তো পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত জমকালো ব্যক্তিত্ব নন, তবে মহাকাশ-উড়ান জগতের সুউচ্চ স্থানে তার আসন চিরকালের জন্য পাতা রইবে। যারা প্রথম চাঁদে মানুষের প্রথম পদচারণা প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই প্রজন্মের মনোজগতে এ বিস্ময়জাগানিয়া স্মৃতি চিরকালের জন্য আঁকা রইবে।
আর্মস্ট্রংয়ের পদচারণা ছিল আসলে মানব ইতিহাসে বিরাট উল্লম্ফন। তিনি নিজেই চাঁদের মাটি স্পর্শ করে বলেছিলেন, 'এটা মানুষের জন্য ছোট পদক্ষেপ, তবে মানবজাতির জন্য বড় অগ্রগতি।' গত শনিবার তার মৃত্যু আমাদের চাঁদে মানুষের প্রথম পা রাখার সেই ঐতিহাসিক ক্ষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
চাঁদে মানুষ প্রেরণে অ্যাপোলো-১১ নভোযানের সাফল্য মহাকাশ প্রতিযোগিতায় তখন সমাপ্তি টেনেছিল। এর পরিণতিতে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দেখা দিয়েছিল মহাকাশ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সহযোগিতা। ১৯৭০-এর দিকে অ্যাপোলো-সয়ুজ প্রকল্পের ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যার যাত্রা শুরু সেই সহযোগিতা যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতিষ্ঠায় পল্লবিত হয়েছে। চাঁদে অবতরণের নায়ক আর্মস্ট্রং ও ত্রুক্র সদস্য এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স মিশন শেষে যখন মর্ত্যে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাদের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার অত কিছু ছিল না। রেডিও-টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার, সংবর্ধনা আর মানুষের আতিশয্যের তোড়ে তখন নায়করা ভাসছিলেন। তবে ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে চাঁদে পা রাখার মিশন পরিচালনায় কৃতিত্বের কারণে মানুষের কাছে ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া আর্মস্ট্রং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। অচঞ্চল দৃষ্টি যার সেই নিল আর্মস্ট্রং কিন্তু অসম্ভব রকমের নিভৃতচারী ছিলেন। এক সময় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের পাইলট ১৯৭১ সালেই নাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ভবিষ্যতের নভোচারীদের তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (বিমান ও নভোযান প্রকৌশল) বিষয়ে পড়াতেন। তাকে নিয়ে মাতামাতি দেখে এক সময় বলেছিলেন, তিনি জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ হতে চান না। শুধু দেশের সেবাই ছিল ওহিওর এই মানুষটির মনে।
বিবিসির সাবেক অ্যারোস্পেস প্রতিনিধি রেগ টারনিল আর্মস্ট্রংকে একজন সংশয়ী ও একান্তবাসী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর্মস্ট্রং চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষ হিসেবে তার অনুভূতির কথা বলতে বলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং এক সময় তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধও করে দেন। ওহিওর নির্জন বাসেও তিনি একেবারে কখনোই নিরুপদ্রব থাকতে পারেননি। ২০০৫ সালের দিকে তিনি তার চুলের বিন্যাস অন্য একজনের কাছে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করার জন্য ক্ষৌরকর্মের দোকানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। নিল আর্মস্ট্রং এমন একজন আমেরিকান ছিলেন যিনি মনে করতেন, তিনি শুধু তার কর্তব্যকর্মই করে যাচ্ছেন, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে অ্যাপোলো
১১ কমান্ড মডিউলের পাইলট মাইকেল কলিন্স বলেন, তিনি ছিলেন উত্তম মানুষ, আমরা ভীষণভাবে তার অভাব অনুভব করব। চাঁদে অবতরণের সময় তার সঙ্গী অলড্রিন বলেন, 'আমরা মহাকাশ কর্মসূচির একজন মস্ত বড় মুখপাত্র ও নেতাকে হারালাম।' প্রেসিডেন্ট ওবামা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি শুধু তার সময়েরই নন, চিরকালের সেরা নায়ক।
তবে আর্থিক সংকটের কারণে বাজেট কাটছাঁট করতে গিয়ে ২০২০ সালের প্রথম দিকে চাঁদে মনুষ্যযান প্রেরণের কর্মসূচি ওবামা প্রশাসন বাতিল করে দেওয়ায় আর্মস্ট্রং এর প্রতিবাদ জানান। সেই থেকে এ ব্যাপারে তিনি ওবামা প্রশাসনের একজন সমালোচক। সিনেট কমিটির শুনানিতেও এ ব্যাপারে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। মহাকাশ কর্মসূচি ছেঁটে ফেলার কারণে এ ক্ষেত্রে এক সময়ের অগ্রগামী যুক্তরাষ্ট্র এক সময় অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করতেন তিনি।
আর্মস্ট্রং মাত্র ছয় বছর বয়সেই বাবার সঙ্গে বিমানে চড়েন। সেই থেকে বিমানের নেশায় তাকে পেয়ে বসে। ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি চাঁদে মানুষ পাঠানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ঘোষণার পর তার চোখে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন চাপে। অতঃপর ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসায় যোগদান করেন। অসামান্য গৌরবের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণকারী মানুষটি ৮২ বছর বয়সে শনিবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছেন।
পল রিনকন :বিবিসি নিউজের বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক
চাঁদে মানুষ প্রেরণে অ্যাপোলো-১১ নভোযানের সাফল্য মহাকাশ প্রতিযোগিতায় তখন সমাপ্তি টেনেছিল। এর পরিণতিতে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দেখা দিয়েছিল মহাকাশ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সহযোগিতা। ১৯৭০-এর দিকে অ্যাপোলো-সয়ুজ প্রকল্পের ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যার যাত্রা শুরু সেই সহযোগিতা যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতিষ্ঠায় পল্লবিত হয়েছে। চাঁদে অবতরণের নায়ক আর্মস্ট্রং ও ত্রুক্র সদস্য এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স মিশন শেষে যখন মর্ত্যে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাদের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার অত কিছু ছিল না। রেডিও-টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার, সংবর্ধনা আর মানুষের আতিশয্যের তোড়ে তখন নায়করা ভাসছিলেন। তবে ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে চাঁদে পা রাখার মিশন পরিচালনায় কৃতিত্বের কারণে মানুষের কাছে ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া আর্মস্ট্রং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। অচঞ্চল দৃষ্টি যার সেই নিল আর্মস্ট্রং কিন্তু অসম্ভব রকমের নিভৃতচারী ছিলেন। এক সময় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের পাইলট ১৯৭১ সালেই নাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ভবিষ্যতের নভোচারীদের তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (বিমান ও নভোযান প্রকৌশল) বিষয়ে পড়াতেন। তাকে নিয়ে মাতামাতি দেখে এক সময় বলেছিলেন, তিনি জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ হতে চান না। শুধু দেশের সেবাই ছিল ওহিওর এই মানুষটির মনে।
বিবিসির সাবেক অ্যারোস্পেস প্রতিনিধি রেগ টারনিল আর্মস্ট্রংকে একজন সংশয়ী ও একান্তবাসী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর্মস্ট্রং চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষ হিসেবে তার অনুভূতির কথা বলতে বলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং এক সময় তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধও করে দেন। ওহিওর নির্জন বাসেও তিনি একেবারে কখনোই নিরুপদ্রব থাকতে পারেননি। ২০০৫ সালের দিকে তিনি তার চুলের বিন্যাস অন্য একজনের কাছে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করার জন্য ক্ষৌরকর্মের দোকানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। নিল আর্মস্ট্রং এমন একজন আমেরিকান ছিলেন যিনি মনে করতেন, তিনি শুধু তার কর্তব্যকর্মই করে যাচ্ছেন, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে অ্যাপোলো
১১ কমান্ড মডিউলের পাইলট মাইকেল কলিন্স বলেন, তিনি ছিলেন উত্তম মানুষ, আমরা ভীষণভাবে তার অভাব অনুভব করব। চাঁদে অবতরণের সময় তার সঙ্গী অলড্রিন বলেন, 'আমরা মহাকাশ কর্মসূচির একজন মস্ত বড় মুখপাত্র ও নেতাকে হারালাম।' প্রেসিডেন্ট ওবামা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি শুধু তার সময়েরই নন, চিরকালের সেরা নায়ক।
তবে আর্থিক সংকটের কারণে বাজেট কাটছাঁট করতে গিয়ে ২০২০ সালের প্রথম দিকে চাঁদে মনুষ্যযান প্রেরণের কর্মসূচি ওবামা প্রশাসন বাতিল করে দেওয়ায় আর্মস্ট্রং এর প্রতিবাদ জানান। সেই থেকে এ ব্যাপারে তিনি ওবামা প্রশাসনের একজন সমালোচক। সিনেট কমিটির শুনানিতেও এ ব্যাপারে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। মহাকাশ কর্মসূচি ছেঁটে ফেলার কারণে এ ক্ষেত্রে এক সময়ের অগ্রগামী যুক্তরাষ্ট্র এক সময় অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করতেন তিনি।
আর্মস্ট্রং মাত্র ছয় বছর বয়সেই বাবার সঙ্গে বিমানে চড়েন। সেই থেকে বিমানের নেশায় তাকে পেয়ে বসে। ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি চাঁদে মানুষ পাঠানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ঘোষণার পর তার চোখে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন চাপে। অতঃপর ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসায় যোগদান করেন। অসামান্য গৌরবের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণকারী মানুষটি ৮২ বছর বয়সে শনিবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছেন।
পল রিনকন :বিবিসি নিউজের বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক
No comments