চরাচর-দিঘলিয়ার দেয়াড়া গণহত্যা by গৌরাঙ্গ নন্দী
একাত্তরের আগস্ট মাস। ২৭ আগস্ট দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই খুলনা জেলার দিঘলিয়ার দেয়াড়া গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে হামলে পড়ে। আক্রমণের মুখে কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও তাদের হাতে ৬১ জন যুবক-বয়স্ক মানুষ ধরা পড়েন।
রাজাকাররা সেদিন ওই ৬১ জনকে গুলি করে, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মম উল্লাসে গুরুতরভাবে আহত করে। ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জনের লাশ ওই পাষণ্ড রাজাকারের দল ভৈরব নদে ছুড়ে ফেলে। বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়। একজন সারা শরীরে ধারালো অস্ত্রের ১৯টি আঘাত সয়েও বেঁচে যান। আজও তিনি সেই ভয়ংকর দিনটির কথা মনে রেখে সময় পার করছেন। অপেক্ষমাণ এই বয়স্ক মানুষটি সৈয়দ আবুল বাশার। রাজাকাররা তাঁকেও সারিবদ্ধভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যে দাঁড় করিয়েছিল; কিন্তু গুলি তাঁর শরীরে লাগেনি। তিনি মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন। হঠাৎ করেই ঘাতকদের চোখে পড়ে তাঁর শরীর থেকে কোনো রক্ত বেরোয়নি। তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, 'বাশারের শরীর থেকে রক্ত বেরোয়নি।' এ কথা শুনেই উৎসাহী এক ঘাতক ধারালো অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসে, আর শুরু করে এলোপাতাড়ি আঘাত। একনাগাড়ে কুপিয়ে তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। সৈয়দ আবুল বাশারের ছেলে সেই সময় ১২-১৩ বছরের, সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ হিরু তাঁকে মৃত ভেবে 'লাশ'টি উদ্ধার করে। সারা দিন রাজাকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে গুরুতর আহত বাবাকে বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। সন্ধ্যার পর এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তাঁকে খুলনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য রাজাকাররা নয়, ডাকাতরা কুপিয়েছে বলে হাসপাতালে জানানো হয়। সুস্থ হলেও বাড়িতে এনে তাঁকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়, যাতে মানুষটির বেঁচে যাওয়ার খবর রাজাকারদের কাছে না পৌঁছায়। সেদিনের স্মৃতি আবুল বাশারের মনে এলে তিনি বেদনায় কুঁকড়ে যান। তিনি বলেন, '৬০ জনকে তারা গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী আফজাল হোসেন বলেন, 'সবে আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। এমন সময় দেখি অস্ত্রধারীরা আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলে নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করেছে। আমার বাবা আমাকে বলেন, যেখানে পারিস পালা। আমি দৌড়ে একটি ঝোপের মধ্যে লুকাই। রাজাকারের দল আমাদের বাড়ি থেকে আমার বাবাসহ ছয়জনকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রামের আরো অনেক পুরুষ সদস্যকে তারা ধরে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি, তারা সেদিন মোট ৬১ জনকে ধরেছিল। এর মধ্যে নিহত হন ৬০ জন। রাজাকারদের হাতে ধৃত সৈয়দ আবুল বাশার বেঁচে যান। রাজাকাররা সেদিন ২২ জনকে দেয়াড়া গ্রামের তিনটি পৃথক স্থানে মাটিচাপা দিয়ে গণকবর দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৩৮ বছর পর ২০১০ সালের প্রথম দিকে একটি কারখানা গড়ে তোলার সময় একটি কবর চিহ্নিত হয়। সেই গণকবরটিকে পরবর্তী সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তরিত করে সেখানে কবর দিয়ে স্মৃতিফলক উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এলাকাবাসী আজকের এই দিনটিকে গভীরভাবে স্মরণ করে আর রাজাকারদের বিচার দাবি করে।
গৌরাঙ্গ নন্দী
No comments