স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ by অজয় রায়

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাক সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেয়া সেনা-বাহিনীর নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা শুরুর পর পরই বন্দী হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৫ মার্চের গভীর রাত্রে, বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।


তিনি বস্তুত দুটি ঘোষণা দেনÑ প্রথমটি পূর্ব-রেকর্ডকৃত যেখানে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর ওপর পাকসেনাদের ওপর বর্বর হামলার প্রসঙ্গ নেই, দ্বিতীয়টি তিনি ঘোষণা দেন টেলিফোন মারফত টেলিভবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ পরিচিত উচ্চপদস্থ অফিসারের মাধ্যমে। প্রথমটি প্রচারিত হয় তৎকালীন ইপিআর সম্প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে। দেশের সকল ইপিআর’এর রিসিভিং স্টেশনে ধরা পড়ে এবং ইপিআর-এর সৈনিকরা তা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের নিকট পৌঁছে দেন। দ্বিতীয়টি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দেশের সকল এলাকায় প্রচারিত হয়, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগের কর্মচারী-অফিসারদের মাধ্যমে। এরই একটি বাণী চট্টগ্রামস্থ আওয়ামী লীগের নেতা জহুর হোসেন চৌধুরীর নিকট পৌঁছায়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আমি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিÑ যা অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এ সম্পর্কে বিশদ তথ্য দেয়া আছে।
প্রথম ঘোষণাটি নিম্নরূপ:

DECLARATION OF INDEPENDENCE
This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistani occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
(Message embodying Declaration of Independence sent by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to Chittagong shortly after midnight of 25th March, i.e. early hours of 26th March, 1971 for transmission throughout Bangladesh over the ex-EPR transmitter)
এই স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলটির সূত্র হিসেবে পুরাতন ৩য় খ-ে ঘোষণাটির শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে :
বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা-ঘোষণার দুটি ভাষ্য পাওয়া যায়। প্রথমটি আমরা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, যা পুরাতন সংস্করণের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলের ৩য় খ-ে অন্তর্ভুক্ত। পাঠক লক্ষ্য করবেন যে এখানে ২৫শে মার্চের রাতের পাকিস্তানী বাহিনীর ঢাকার ওপর আক্রমণ বা গণহত্যার কোন প্রসঙ্গ নেই। বলা হয়েছে ‘এটি হয়তো আমার শেষ বাণী, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ ((This may be my last message, from today Bangladesh is independent)। ঘোষণাটি সংক্ষিপ্ত এবং সরাসরি, আর সেজন্যই এর বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাটি ২৫শে মার্চের কালরাত্রির পূর্বেই বাণীবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের কোন না কোন ওয়ারলেস ট্রান্সমিশন যন্ত্র ব্যবহার করে সম্প্রচারিত হয়েছিল ২৫শে মার্চের রাতে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর পরই। ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং শেখ সাহেবের নির্দেশেই যে বাস্তবায়িত হয়েছিল- এটিও অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না। ২৬শে মার্চের পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিগ্রাফ অফিসে এবং বিভিন্ন ওয়ারলেস রিসিভিং স্টেশনে বঙ্গবন্ধুর নামে আর একটি স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়েছে। এটির ভাষ্য তাৎপর্যময়ভাবে ভিন্নতর। সামান্য তারতম্যসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রেরিত ঘোষণাটি মোটামুটি এরকম :
Declaration of War of Independence
Pak army suddenly attacked EPR base at Pilkhana and Rajarbag Police line killing citizens. Street battles are going on in every streets of Dacca, Chittagong. I appeal to the nation of the world for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, EPR, Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight, no compromise, victory is ours. Drive out the enemies from the holy soil of the motherland. Convey this message to all Awami league leaders, workers and other patriots and lovers of freedom.

May Allah, bless you.
Joy Bangla
Sheikh Mujibur Rahman

যদিও বিষয়বস্তুতে তারতম্য নেই, তবুুও ভাষাগত বৈসাদৃশ্যে এই ঘোষণাটিরই একটি ভিন্নতর রূপও দেখা যায়, সেটি নিম্নরূপ:
Bangladesh: A New Sovereign State

BROADCAST DECLARING INDEPENDENCE FROM BANGLADESH RADIO ON 26th MARCH, 1971.

On the Morning of March, the following announcement was broadcast by a radio station controlled by the Bangladesh Liberation army:

“Today Bangladesh is a sovereign and independent state. On Thursday night West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Rajarbagh and the EPR Headquarters at Pheelkhana in Dacca. Many innocent and armed people have been killed in Dacca city and other places of Bangladesh. Violent clashes between East Pakistan Rifles and Police on the one hand and the armed forces of Pindi on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. Resist the treacherous enemy in every corner of Bangladesh. May God aid us in our fight for freedom.”

“JOY BANGLA”
বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত এই ঘোষণার সাথে বাক্য গঠন ও শব্দ নিয়ে তারতম্য লক্ষিত হলেও মূল স্পিরিট এক ও অভিন্ন। আমি দুটো মাত্র উদাহরণ দেব। তবে প্রথমে বলে রাখি উপরিল্লিখিত মর্মে স্বাধীনতার ঘোষণাটি কোথায় ধরা পড়েছিল। উক্ত বাণীটি চট্টগ্রামের সলিমপুর (কোস্টাল) ওয়ারলেস স্টেশনে ধরা পড়ে। উপরে বর্ণিত ব্যক্তিবর্গ চট্টগ্রামের বিভিন্ন ওয়ারলেস স্টেশনের কর্মচারী ছিলেন। এরাই সে সময় বাণীটির গুরুত্ব অনুধাবন করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

প্রথম উদাহরণ : উপর্যুক্ত একটি প্রচেষ্টার ফল হল কোলকাতায় কোস্টাল রেডিও স্টেশনে (ঠডঈ) এই বাণীটি ধরা পড়ে, যার ভিত্তিতে বার্তাসংস্থা ইউ.এন.আই’র বরাত দিয়ে বিখ্যাত স্টেটসম্যান পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ সেদিন (২৭শে মার্চ, ১৯৭১) পরিবেশন করে। সেটি ছিল নিম্নরূপ :
Bangladesh Declares Freedom: Rahman’s step follows Army crackdown:

Pakistan’s Eastern wing rechristened the independent state of Bangladesh by Sheikh Mujibur Rahman in a clandestine radio broadcast … …. Speaking over Swadhin Bangla (free Bengal) Betar Kendra. Mr. Rahman later proclaimed the birth of an independent Bangladesh. Mr. Rahman Said: “Pakistan armed forces suddenly attacked the East Pakistan Rifles base of Pilkhana and Rajarbagh police station in Dacca at zero hours on March 26, killing a number of unarmed people. Fierce fighting is going on with East Pakistan Rifles at Dacca; people are fighting gallantly with the enemy for the cause of freedom of Bangladesh. Every section of the people of Bangladesh asked to resist the enemy forces at any cost in every corner of Bangladesh. May Allah bless you and help you in your struggle for freedom from the enemy. Jai Bangla.”
দ্বিতীয় উদাহরণ : ২৫শে মার্চের কালরাত্রির অন্ধকারে পাকিস্তানীরা গণহত্যা শুরু করলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সর্Ÿত্র স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। টাঙ্গাইলেও জনাব লতিফ সিদ্দিকী ও কাদের সিদ্দিকী এবং স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। গড়ে ওঠে কাদের সিদ্দিকের নেতৃত্বে একটি দুর্ধর্ষ সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী কালক্রমে। ২৬শে মার্চ দুপুরে টাঙ্গাইল ওয়ারলেস কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী ধরা পড়েছিল, যা কাদের সিদ্দিকী রচিত স্বাধীনতা ’৭১ গ্রন্থটিতে স্থ্ান পেয়েছে এবং গণভবনে রক্ষিত মেসেজটির প্রায় অনুরূপ। জনাব কাদের সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন:

“এই সময় এক পর্যায়ে কাগমারী বেতারে ২৫ শে মার্চ ’৭১ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ধরা পড়ে -

Pak army suddenly attacked EPR base at Pilkhana and Rajar-bag Police Line killing citizens. Street battles are going on in every streets of Dacca, Chittagong. I appeal to the Nation of the world for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, EPR, Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight, no compromise, victory is ours. Drive out the enemies from the holy soil of the motherland. Convey this message to all Awami league leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah, bless you. Joy Bangla

Sheikh Mujibur Rahman.
26.3.71
“এখন আমরা জানি যে ২য় বার্তাটি যেখানে পিলখানা ও পুলিশ লাইন আক্রান্ত হওয়ার কথা রয়েছে মগবাজারস্থ ওয়ারলেস কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামস্থ সলিমপুর কোস্টাল স্টেশনে ধরা পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই শেষোক্ত বাণীটি বঙ্গবন্ধু কিভাবে ওয়ারলেস স্টেশনে পৌঁছালেন ? সেই ভয়ঙ্কর রাতে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিভিন্ন টেলিফোন বার্তা থেকে জেনে ফেলেছিলেন যে পিলখানা-ইপিআর প্রধান দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রবলভাবে পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে; সর্বশেষ অবস্থা জানার পর পরই শেখ সাহেব অতি দ্রুত ২য় বার্তাটি তৈরি করেন, এবং প্রথমত, আগে থেকে ব্যবস্থা করা সেন্ট্রাল ‘টি এন্ড টি’ অফিসের এক বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র পাঠাতে যা বিশ্বস্ততার সাথে প্রেরিত হয়েছিল ‘টি এন্ড টি’ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন ঐ বিভীষিকাময় রাত্রেও লোক মারফৎ লিখিত মেসেজটি পাঠিয়ে মগবাজারস্থ ওয়ারলেস স্টেশনের মাধ্যমে সারা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে। কি অসীম সাহসিক সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতা । এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে রবার্ট পেইন তাঁর পুস্তকে লিখেছেন :
“গভীর রাত নাগাদ তিনি বুঝতে পারলেন যে, ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাঁর টেলিফোনটা অবিরাম বেজে চলছে, কামানের গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আর দূর থেকে আর্ত চিৎকার আর শব্দ ভেসে আসছে .. .. তিনি জেনে ফেলেছেন যে পূর্বপাকিস্তান রাইফেলস এর ব্যারাকগুলো ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রান্ত হয়েছে। এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বাঙ্গালী সশস্ত্র বাহিনীর ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। তাই সেই রাত্রে ২৬ শে মার্চ তিনি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বত্র বেতার যোগে পাঠাবার জন্য টেলিফোনে নিম্নোক্ত বাণীটি সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে জনৈক বন্ধুকে ডিক্টেশন দিলেন।” বাণীটি হচ্ছে Ñ
ÒThe Pakistani Army has attacked police at Rajarbagh and East Pakistan Rifles headquarters at Pillkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for a war of Independence. বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এই বাণীটি পরদিন সকালেই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে ও জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব এম এ হান্নান সেদিনই অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ প্রায় দুপুর দুটার দিকে চট্টগ্রাম (আগ্রাবাদ) বেতার থেকে মিনিট পাঁচেকের ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ইংরেজীতে ঘোষিত স্বাধীনতার বাণীটির বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। পরবর্তীকালে একটি স্মৃতিচারণে এ সম্পর্কে বলেছেন :
“.. .. সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬ শে মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টার হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করি। প্রচারে আমাকে সহযোগিতা করেন রেডিও অফিসের রাখাল চন্দ্র বণিক, মীর্জা আবু মনসুর, অতাউর রহমান কায়সার ও মোশাররফ হোসেন প্রমুখ এম, পি, এ ও এম, এন, এ গণ।”
এ সম্পর্কে কালুরঘাটে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা জনাব বেলাল মোহাম্মদ তাঁর পুস্তকে উল্লেখ করেছেন :
.. .. চট্টগাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। তাঁকে আমি চিনতাম না। ২৬ মার্চ দুপুরে তিনি আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরউদ্দিন এবং বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, দেলওয়ার হোসেন ও মোসলেম খানের প্রকৌশলিক সহযোগিতা আদায় করেছিলেন। পাঁচ মিনিট স্থায়ী একটি বিক্ষিপ্ত অধিবেশনে। ওতে তিনি নিজের নাম-পরিচয়সহ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন (পৃ ২৯)।
.. .. ঠিক সন্ধে ৭-৪০ মিনিটে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল : স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। .. .. .. ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া হ্যান্ডবিলটিও বারবার প্রচারিত হয়েছিল বিভিন্ন কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ‘জরুরী ঘোষণা’। .. ..অধিবেশন চলাকালে আমি স্টুডিওতেই অবস্থানরত ছিলাম।.. .. স্টুডিওর বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন দুজন আগন্তুক। একজন আমার পূর্ব পরিচিত ডাক্তার। অন্যজন এম এ হান্নান। বলেছিলেন : আপনারা মাইকে আমার নাম ঘোষণা করুন। আমি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করব। : জ্বি আচ্ছা। তবে .. .. আপনার নামটা প্রচার করা হবে না। আপনি নিজের কণ্ঠে শুধু এটি পাঠ করবেন। : কেন, দুপুরবেলা আমি তো আমার নামসহ এটি প্রচার করেছিলাম .. .. বলেছিলাম : দুপুরবেলা আপনি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণাপত্রটি প্রচার করেছিলেন। .. .. এখন থেকে এ হচ্ছে একটি গুপ্ত বেতার কেন্দ্র। এখান থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। তাই কোথায় এর অবস্থান, তা আমরা শত্রুদেরকে জানাতে চাই না। .. .. এম এ হান্নান মেনে নিয়েছিলেন। এবং নাম ঘোষণা ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিলেন। বেতারে নিজের কণ্ঠে দ্বিতীয়বার। .. .. ।
কিন্তু জনাব হান্নান বঙ্গবন্ধুর দুটি ঘোষণার মধ্যে কোনটি প্রচার করেছিলেন, আমাদের কথিত ১মটি না ২য়টি যেখানে পিলখানা ইপিআর ব্যারাক এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্তের কথা বলা হয়েছে। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর বইয়ে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া হ্যান্ডবিলটিও বারবার প্রচারিত হয়েছিল বিভিন্ন কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ‘জরুরী ঘোষণা’ (পৃ ৩৩)। আবার ৩১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে Ñ ‘আনোয়ার আলী আমার হাতে একটি সাইক্লোস্টাইল-কার ক্ষুদে হ্যান্ডবিল এগিয়ে দিয়েছিলেন। শিরোনাম ‘জরুরী ঘোষণা’। নিচে ‘স্বাক্ষর শেখ মুজিবুর রহমান’। বক্তব্য বিষয় : অদ্য রাত ১২টায় বর্বর পাক-বাহিনী ঢাকার পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা চালায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধ চলছে। আমি এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং সমস্ত বিশ্বেও স্বাধীনতাকামী দেশসমূহের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করছি। জয় বাংলা।’ সুতরাং বোঝা যাচ্ছে জনাব হান্নান বঙ্গবন্ধুর ২য় ঘোষণাটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আর এই বাণীটি মগবাজার ওয়ারলেস কেন্দ্র এবং টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায় এবং চট্টগ্রামের নন্দনকানসহ দেশের বিভিন্ন ওয়ারলেস গ্রহণ কেন্দ্রে ধরা পড়ে। এ সম্বন্ধে আরও বিশদ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে জনাব শামসুল হুদা রচিত ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ গ্রন্থটিতে :
“বাংলার বীর সৈনিক ও পুলিশ বাহিনী যখন মরণ যুদ্ধে লিপ্ত তখন সাধারণ মানুষ ছিলেন শোকাকুল, হতবাক এবং স্তব্ধ। ২৬ শে মার্চ ’৭১ এর সকাল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জন্য বয়ে এনেছিল এক সাগর রক্ত, হাহাকার আর শোকের কালো ছায়া। এমনি হতাশার মধ্যে চট্টগ্রামে বিলি হ’ল বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজী হ্যান্ডবিল। .. .. চট্টগ্রামের স্থানীয় চিকিৎসক ডা. সৈয়দ আনোয়ার আলী এমনি একটি হ্যান্ডবিল হাতে নিয়ে বাসায় এসে স্ত্রী ডা. মনজুলা আনোয়ারের হাতে দিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শুধু এর বাংলা অনুবাদই করেননি, বসে গেলেন কপি করার কাজে। .. .. কাজে লাগিয়ে দিলেন ডা. আনোয়ার আলীর ভাইজি কাজী হোসনে আরাকে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের একজন ঘোষিকা। অনুবাদটির কপি চট্টগ্রামের জনগণের কাছে বিলি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এমনি আর কত কপিই বা বিলি করা যায়। .. .. স্বাধীনতা ঘোষণর ঐতিহাসিক বাণীটি চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারই তো সর্বোত্তম কাজ। ডাক্তার মনজুলা আনোয়ার স্বামী ডা. আনোয়ার আলীকে জানালেন তাঁর মনের কথা। ডা. আনোয়ার আলী তাৎক্ষণিকভাবে স্ত্রীর কথার সমর্থন জানালেন। স্থানীয় ওয়াপদার দু’জন ইঞ্জিনিয়ার জনাব আশিকুল ইসলাম ও মি: দিলীপসহ তাঁরা ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম বেতারে। ওদিকে .. জনাব বেলাল মোহাম্মদ ইতিপূর্বেই চট্টগ্রাম বেতার ভবনে এসে পৌঁছে গেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে বেতার চালু করার অনুরোধ নিয়ে। .. জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপও তখন চট্টগ্রাম বেতারে উপস্থিত ছিলেন। .. .. চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক জনাব আবদুল কাহ্হার প্রস্তাবিত বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার কারণে টেলিফোনে বেলাল মোহাম্মদকে পরামর্শ দিলেন কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে চলে যাওয়ার জন্য। পরামর্শ অনুযায়ী তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলামের জীপে ছুটলেন চট্টগ্রাম কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের উদ্দেশে। সাথে গেলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হোসনে আরা, ডাক্তার মনজুলা আনোয়ার, ডাক্তার আনোয়ার আলী, কবি আবদুল সালাম ও ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ। জীপ চালিয়ে নিয়ে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম। .. .. ”
এই হল কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্যোগ। কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠান বাংলার সাত কোটি মানুষ শুনতে শুরু করে একাত্তরের ২৬ মার্চ তারিখে সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিট থেকে। প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের সে সময়ে এই সাহসী পদক্ষেপ স্বাধীন বাংলার মানুষ চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আমরা এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা জনাব জনাব এম আর সিদ্দিকীর কিছু স্মৃতির উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :
.. .. At around 7-00 p.m. (25th March) I manage to contact Sheikh Shaheb through his neighbor Mr. Mosharaff Hossain and Mr. Neem Gouhar. He asked them to tell me that talks had failed. Ask Army, EPR and police not to surrender arms and give a call to people to give resistance. After this all communication with Dhaka was cut off.
The Sangram Parishad discussed the situation and decided to into hiding and go into action. On 26th morning at about 6-30 a.m. my wife Latifa received a phone call from Mr. Moinul Alam (Ittefaq correspondent in Chittagong) who gave her a message from Bangabandhu received through wireless operators of Chittagong. The message read “Message to the people of Bangladesh and to the people of the world. Rajarbagh police camp and Peelkhana EPR suddenly attacked by Pak Army at 24-00 hours. Thousands of people killed. Fierce fighting going on. Appeal to the world for help in our freedom struggle. Resist by all your means. May Allah be with you. Joy Bangla. Message from Sheikh Mujibur Rahman.” .. .. The Sangram Parishad immediately discussed the message and decided to announce the appeal over radio. By this time the radio station at Agrabad was already inaccessible because of the presence of Pak Army. We collected Mr. Belal Chowdhury, Mr. Sultan Ali and other staff of Radio Pakistan Chittagong who suggested broadcasting the message from the Kalurghat relay station. A draft of the announcement was made in Bengali by Dr. Abu Jafar and others and it was decided that Mr. M. A. Hannan, General Secretary of district Awami League would read out the announcement. Accordingly on 26th March at 2-30 p.m. Mr. Hannan read out the historical announcement in the name of Sheikh which is known as the Declaration of Independence. Based on this later Bangladesh Government decided to observe 26th as the National Day. Major Zia and his troops were placed to guard the Kaulurghat Radio Station. Next Day on 27th March Major Zia went on the air and declared himself the President and gave a call for freedom fight. This confused the Awami Leaguers and the public. Mr. A. K. Khan who heard the news said that it will be interpreted as an Army coup and there will be no support nationally or internationally. He made out a new draft in English. Major Zia realized the mistake and read out the new draft saying Sheikh Mujibur Rahman was the president and call himself was on his behalf.

No comments

Powered by Blogger.