যোগাযোগ অবকাঠামো-তাৎক্ষণিকতা নয়, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার by আবু সাঈদ খান

অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থার কারণে দুর্ঘটনাই কেবল বাড়ছে না, প্রাকৃতিক ভারসাম্যও হুমকির সম্মুখীন। এতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় রাস্তাও তৈরি হচ্ছে। ফলে কৃষিজমি হচ্ছে সংকুচিত।


গ্রাম এলাকায় দেখা যায়_ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা টেস্ট রিলিফের গম পাওয়ার
আশায়, কখনও নিজের বাড়ির সামনে রাস্তা করার মানসিকতায় অপ্রয়োজনীয় রাস্তার প্রকল্প দিচ্ছেন


উন্নয়নই শেষ কথা নয়, কাজটির স্থায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন টেকসই উন্নয়ন বহুল ব্যবহৃত শব্দ। দেশে তড়িঘড়ি করে যেসব রাস্তা ও স্থাপনা তৈরি বা মেরামত হচ্ছে তা কেবল ক্ষণস্থায়ীই নয়, জননিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।
গত বছরের মতো এবারও ঈদ সামনে রেখে খুব দ্রুততার সঙ্গে বেশকিছু সড়ক মেরামত করা হয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বয়ং মেরামতের কাজ তদারক করেছেন, অলস-অযোগ্য প্রকৌশলী-কর্মকর্তাদের ধমকিয়েছেন, সাময়িক বরখাস্ত করেছেন কাউকে কাউকে। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মেরামত কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে_ এ জন্য মন্ত্রী মহোদয়ের ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে_ জোড়াতালি দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য করা এসব রাস্তা কতদিন টিকবে?
অতীতেও দেখেছি, ঈদ এলেই সাধারণের মধ্যে এবং গণমাধ্যমেও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়_ এর ফলে সরকারও তড়িঘড়ি কিছু উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। ঈদ সামনে রেখে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা হয়_ স্থায়িত্বের চেয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনই লক্ষ্য। এসব কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। ফলে যত দ্রুত কাজ হয়, তার চেয়ে বেশি দ্রুত তা মুছে যায়। ঈদের সময় আসা-যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি এলেও সারা বছর দুর্ভোগ পোহাতেই হয়। কখনও দেখা গেছে, যাত্রীরা ফেরার পথেই রাস্তার বেহাল অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। এবারও যে এর ব্যতিক্রম হবে না, তা একবাক্যে বলে দেওয়া যায়।
যোগাযোগমন্ত্রী যখন সায়েদাবাদের রাস্তাটির কাজ তদারক করছিলেন, তখন একটি চ্যানেলে স্থানীয় জনগণের মন্তব্য শুনেছি। তাদের কথা_ যেভাবে রাস্তা হচ্ছে, যে নিম্নমানের বালি-ইট-সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বৃষ্টি এলেই ধুয়ে-মুছে যাবে। যা ছিল আবার তা-ই হবে। অনেক রাস্তার ক্ষেত্রে হয়তো হয়েছেও তাই।
ঈদের দু'দিন আগে একটি চ্যানেলে সংবাদ বিশ্লেষণের সময় উপস্থাপক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যে তৎপরতা দেখাচ্ছেন সে ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী। আমি বলেছিলাম, আগের যোগাযোগমন্ত্রী ফেইল করেছিলেন, আর ওবায়দুল কাদের অবশ্যই পাস করেছেন, তবে তাকে এ প্লাস দিতে পারব না। যেসব শিক্ষার্থী তিন দিন বা সাত দিনে নোটবই পড়ে পরীক্ষা দেয়, তারা পাস নম্বর পায়। স্ট্যান্ড বা এ প্লাস পায় না। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি একইভাবে বিবেচ্য।
লক্ষণীয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সারা বছর অলস বসে থাকেন, তাদের ফাইলে ধুলা জমে। আর ঈদ বা বর্ষার আগে দ্রুত কাজ বণ্টন করা হয়। এটি নিছক আলস্যের ব্যাপার নয়, এসবের পেছনে যে দুর্নীতির লালসা থাকে তা কারও অজানা নেই। ঠিকাদার অতি দ্রুত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাজ করবেন, কর্মকর্তারা চোখ বুজে থাকবেন। বিনিময়ে বড় অঙ্কের পার্সেন্টেজ। এর ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হয়, কোন স্তরে তা পেঁৗছে_ সেটি এখন ওপেনসিক্রেট। এভাবেই অফিসার আর ঠিকাদারদের জৌলুসপূর্ণ ঈদ উদযাপনের খরচ জোগাড় হয়। আর ঠিকাদার মানেই ক্ষমতাসীনদের বরপুত্র। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলের কর্মীরাও এমন আশীর্বাদ থেকে একেবারে বঞ্চিত হন না। তবে তাদের প্রাপ্তিযোগ ক্ষমতাসীন ঠিকাদার-ক্যাডারদের থেকে অনেক কম।
ঈদ ও বর্ষা কয়েক বছর ধরে এক সঙ্গে হচ্ছে। এটি বিশেষ সুবিধার ব্যাপার। কারণ দ্রুত কাজের আলামত মুছে যাওয়ার জন্য প্রকৃতির দোহাই দেওয়া যায়। তবে ঈদ না হলেও প্রকৃতিগত সুবিধার জন্য বর্ষার সময় মেরামত কাজ করার রেওয়াজ চালু রয়েছে। জুন ফাইনাল অর্থাৎ অর্থবছরের শেষ লগ্নে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের হিড়িক লক্ষ্য করা যায়। রাস্তাঘাট মেরামতের বিষয়টি বার্ষিক বা মৌসুমি ব্যাপার নয়, আর তদারকি করে গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ার বিষয়ও নয়_ এটি সাংবৎসরিক কাজ এবং সর্বক্ষণ মনিটর করার ব্যাপার।
এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থবছর একটি সমস্যা। জুলাই থেকে জুন অর্থবছর হওয়ার কারণে রাস্তা বা স্থাপনা নির্মাণকাজ বর্ষা মৌসুমে শুরু করতে হয়। সেই বিবেচনায় রাস্তা-ব্রিজ নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অর্থবছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর করা যেতে পারে। অথবা জুলাই-জুন অর্থবছর ঠিক থাকলে কীভাবে শুষ্ক মৌসুমে কাজ সম্পন্ন করা যায়, সেই পদ্ধতি নিরূপণ করা দরকার।
সঙ্গত কারণেই রাস্তা মেরামত নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছি, তবে রাস্তা নির্মাণের মধ্যেও বড় গলদ থেকে যায়। সেটি কেবল সড়ক-ব্রিজেই নয়, ভবনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও। নিম্নমানের বালি-সিমেন্ট-রড দিয়ে সড়ক-ব্রিজ তৈরি হয়। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে অগণিত সংবাদও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বা প্রকৌশলীর সাজা হয়েছে_ এমন দৃষ্টান্ত দেখিনি। নির্মাণে যখন ত্রুটি, তা সহজে বেহাল হয়ে পড়ে। তখন কেবল জোড়াতালি দিয়ে চলা ছাড়া উপায় থাকে না। তা ছাড়া কোথা দিয়ে কীভাবে রাস্তা যাবে, কোন স্থান দিয়ে গেলে বেশি মানুষ উপকৃত হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে; সেসব বিবেচনায় আসে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা-আরিচা সড়কের বহুল আলোচিত বাঁকগুলোর কথা বলা যায়। প্রতিটি বাঁক সেখানে মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁকে বাঁকে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এবার মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে রাস্তার কয়েকটি বাঁক সোজা করা হয়েছে। তবে সব ত্রুটি দূর করতে কত দিন লাগবে, বলা কঠিন।
অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থার কারণে দুর্ঘটনাই কেবল বাড়ছে না, প্রাকৃতিক ভারসাম্যও হুমকির সম্মুখীন। এতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় রাস্তাও তৈরি হচ্ছে। ফলে কৃষিজমি হচ্ছে সংকুচিত। গ্রাম এলাকায় দেখা যায়_ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা টেস্ট রিলিফের গম পাওয়ার আশায়, কখনও নিজের বাড়ির সামনে রাস্তা করার মানসিকতায় অপ্রয়োজনীয় রাস্তার প্রকল্প দিচ্ছেন। বিল পাস হচ্ছে। রাস্তা হচ্ছে। কিন্তু এতে কতটুকু লাভ-ক্ষতি হলো_ তা খতিয়ে দেখছে না কেউ। অনেক ব্রিজ বা কালভার্টের জন্য নৌ-যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমি দুটি ঘটনা নিয়ে ইতিপূর্বে লিখেছি। এখানে তা পুনরুল্লেখ করব।
বেশ আগের ঘটনা, ফরিদপুরের কানাইপুর-বিভাগদী সড়কের জয়কালীর বিলের মাঝখানে ছোট্ট কালভার্ট দেওয়া হলো। বিলের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা যেতে পারে কি-না, সে প্রশ্নও উঠতে পারত। ওঠেনি, কিন্তু কালভার্ট করার সময় এলাকার লোক বলল, বর্ষাকালে এটি পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করবে; তা-ই হলো। বর্ষা শেষে দেখা গেল, কালভার্টের দুই পাশে গর্ত তৈরি হয়েছে, দুই পারে দুটি বাড়তি সাঁকো দিয়ে পারাপার করতে হচ্ছে। আমি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে বললাম। তিনি হেসে বললেন, টাকা কম ছিল বলে ব্রিজ করা সম্ভব হয়নি, কালভার্ট দিতে হয়েছে। এ যেন জুতার মাপে পা কাটার ব্যাপার। অপর ঘটনাটি ফরিদপুরের সালথার। কুমার নদের ওপর ব্রিজ হলো। এলাকার লোক বলল, এত নিচু করে ব্রিজ হলে বর্ষার সময় ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা যাবে না। তারা গাছের গায়ে চিহ্ন দেখান, '৭৮ সালের বর্ষায় কোথায় পানি উঠেছিল। প্রকৌশলীরা সাফ জানিয়ে দিলেন, যা পাকা হয়ে গেছে, তার নড়চড় হবে না। কে শোনে কার কথা? এলাকাবাসীর কথায় আমি কলাম লিখলাম। ঢাকার বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম, কিছু হলো না। বর্ষার সময় দেখা গেল, ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা যাচ্ছে না। চলাফেরায় এক বাড়তি বিপত্তি তৈরি হলো।
এমনই বহু ভ্রান্ত পদক্ষেপে নৌপথ ধ্বংস করা হয়েছে। দাতাদের বুদ্ধিতে রেলপথ গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। রেলের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে স্বার্থান্বেষী মহল। ভরসা করা হয়েছে সড়কপথের ওপর। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, সড়কপথ আর চাপ সইতে পারছে না। বাড়ছে দুর্ঘটনার হার। বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশ।
এই অপরিকল্পিত ও ভ্রান্ত নীতিতে কিছু লোক বাস-ট্রাকের মালিক হয়ে ধনীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের ভূপ্রকৃতি, লোকসংখ্যা, জীবনাচার, ঐতিহ্য বিবেচনা করে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। আমাদের মনে রাখা দরকার, এখানে শহর গড়ে উঠেছে, মানুষ শহরমুখী হচ্ছে; কিন্তু শিকড় গ্রামে। ঈদ বা অন্য ছুটিতে মানুষ একযোগে গ্রামে ছোটে। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য নৌপথ ও রেলপথের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
অনেক স্থানেই নৌপথ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। নিকট অতীতেও বৃহত্তর ফরিদপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ নৌপথেই রাজধানীতে যাতায়াত করত। সেই সুযোগ নিশ্চিত হলে মানুষ আবার নৌপথে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করবে। নৌপথ ও রেলপথের ওপর গুরুত্ব দিলে সড়ক নির্মাণ ও জ্বালানির পেছনে ব্যয়ের বড় অংশ কমে আসবে। আর যাত্রা হবে নিরাপদ।
এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আমাদের পঁচিশ বছর, পঞ্চাশ বছর, একশ' বছর পরের বাংলাদেশের দিকে তাকাতে হবে। সেই আলোকে পরিকল্পনা নিতে হবে; দাতাদের বুদ্ধি-পরামর্শ বা বাস মালিকদের দিকে তাকিয়ে নয়_ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার তাগিদে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.