বিশ্বব্যাংক ফিরছে না-প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন অর্থমন্ত্রী by আবুল কাশেম

এত কিছুর পরও শেষরক্ষা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টার পদত্যাগ করা বা না-করাও এখন আর কোনো বিষয় নয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আর ফিরছে না। সংস্থাটির সদর দপ্তর ওয়াশিংটন থেকে এ দুঃসংবাদটি আসার পর প্রধানমন্ত্রীকে তা জানানোর জন্য গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী ছুটে যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।


বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না আসার বিষয়টি বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করলেও সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দু-এক দিনের মধ্যেই সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী তাঁর বাসভবনে ফিরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আর কোনো সুসংবাদ নেই। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আশা করার মতো কোনো বার্তা নেই। দুই বছর ধরে যা করা হলো তার সবই প্রায় বৃথা। মসিউর রহমান সরে গেলেও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন পাওয়া যাবে- এমনও বলা যাবে না।'
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পর্যাপ্ত সাড়া মেলেনি- এ কারণ দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করার পর থেকে সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হয়। এ নিয়ে সরকার একসময় শক্ত অবস্থান নিয়ে বিকল্প অর্থায়নের প্রক্রিয়াও শুরু করে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মনোভাব বদলানোর জন্য নানামুখী তৎপরতাও চালাতে থাকে।
দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে বিশ্বব্যাংকের সব শর্তই সরকার একে একে মেনে নিতে শুরু করে। এর আগে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের এক মাসের মধ্যে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকেই বিদায় নিতে হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল। বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার পথ সুগম করতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও যেতে হবে- এমন কথাও সম্প্রতি শোনা যাচ্ছিল। গতকাল ড. মসিউর জানান, পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি সুরাহা হলে তিনি একবার নয়, দশবার পদত্যাগ করতেও রাজি।
বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুরোধের চিঠিও তৈরি করে রেখেছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থায়নের নিশ্চয়তা পেলেই সে চিঠি ওয়াশিংটনে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের প্যানেল অন্তর্ভুক্ত করা সংস্থাটির অন্যতম শর্ত। এর আগে এটি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানালেও শেষ পর্যন্ত তাতেও সম্মত হয়েছিল সরকার। শনিবারই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, 'সমঝোতার সব বাধাই দূর হচ্ছে। আশা করি, এক সপ্তাহের মধ্যেই সমাধান হবে।' তার এক দিন পরই শোনা গেল উল্টো কথা।
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক যে পদ্মা সেতুতে আর অর্থায়ন করবে না, সে তথ্য শনিবার রাতেই জানতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে গতকাল সকাল ১১টা ২০ মিনিটে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংক আর পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না। আমরা সংস্থাটির বিভিন্ন দাবি মেনে নিলেও তা কোনো কাজেই আসছে না।' এ সময় প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে জানান, আদতে বিশ্বব্যাংক শুধু সময়ক্ষেপণ করছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ওই বৈঠকে জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী ও অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
ওই সূত্র আরো জানান, আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবেন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান গতকাল নিজের বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ভাষ্য দেবেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, পূর্ব-নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী গতকাল রবিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে অফিস করার কথা ছিল। সকাল ১০টায় একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎসূচি ছাড়াও বিকেল ৩টায় নিজের দপ্তরে অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করার কথা ছিল পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেতিবাচক বার্তা পাওয়ার পর সকালে অর্থমন্ত্রী আর সচিবালয়ে যাননি। তিনি চলে যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে দুপুর ২টার দিকে চলে আসেন তাঁর হেয়ার রোডের বাসভবনে। খবর পেয়ে সাংবাদিকরা সচিবালয় থেকে অর্থমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে ভিড় করলেও মন্ত্রী সামনে আসেননি। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব আ স ম রাশেদ সাংবাদিকদের জানান, 'মন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।'
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অর্থায়ন স্থগিত রাখে। এ নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে। এরপর গত ২৩ জুলাই মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বিদায় দেওয়া হয় সরকারের দুই কর্মকর্তাকেও। অন্য দুই দাতাসংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ বাড়ায়। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করে সরকার। এডিবি ও জাইকাও বিশ্বব্যাংকের মন গলানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া যাবে- এমন ইঙ্গিত পাওয়ার পরই গত ২২ আগস্ট মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি। বিশ্বব্যাংকের শর্তের মধ্যে শুধু দুটি শর্তই অপূর্ণ থাকে। এর মধ্যে একটি হলো প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ ও অন্যটি দুদকের তদন্ত কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি সম্পৃক্ত করা। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এরই মধ্যে শেষ শর্তটি মেনে নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ড. মসিউর রহমানও বলেছেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া গেলে পদত্যাগ করতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় হতাশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগও (ইআরডি)। ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, ৩১ আগস্টের মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের সব দাবি মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আশা করছিল সরকার। এমনকি সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন এবং সম্পদ সংগ্রহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও সরকার বিশ্বব্যাংকসহ অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাবও মেনে নিচ্ছিল। এ সময় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেতিবাচক বার্তা দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। আর বিশ্বব্যাংক না থাকলে এডিবি ও জাইকার অর্থায়ন নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মা নদীর ওপর যেখানে সেতু নির্মাণ হওয়ার কথা, সেখানে 'ভাষা শহীদ বরকত' ফেরির ওপর সাজানো মঞ্চে সরকারের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলার অর্থায়নের ঋণচুক্তি করে বিশ্বব্যাংক। এটি সেতু নির্মাণের মোট ব্যয়ের প্রায় ৫২ শতাংশ। প্রয়োজনে আরো ৩০ কোটি ডলার দেওয়ারও অঙ্গীকার করে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া এডিবির ৬০ কোটি, জাইকার ৪১ কোটি ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক আইডিবির ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল।

No comments

Powered by Blogger.