একটি অসমাপ্ত গল্প by হেনা সুলতানা
বাঁশীর দুই মেয়ে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, প্রথমটি মেয়ে, পরেরটি কন্যা। তার ধারণা এ রকম বললে মানুষের কান একটু স্বস্তি পায়। মেয়ে দুটোই বাপের ধারা পেয়েছে। একবার একটা আচারের বয়াম ভেঙ্গেছিল বলে পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটাকে খুব বকেছিল তার মা।
বকাঝকা শুনে মেয়েটা না উত্তর দিয়েছিল অমন করে বকছ কেন, তার চাইতে আমাকে কেটে কুটে রান্না করে আচার দিয়ে খেয়ে ফেল। কী ভয়াবহ ব্যাপার। বড় ভাবি চা খাচ্ছিলেন। ব্যস, এই শুনেই হাসতে হাসতে চায়ের কাপ থেকে চা ছলকে পড়ে তার সুন্দর শাড়িটার বারোটা বেজে গেল। ভাবি হাসতে হাসতে গিয়ে শাড়ি পাল্টে এলেন।
তখন আর এক দফা চায়ের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠেছে। টিভি চলছে আপন মনে। জনসংখ্যা বিষয়ে প্রামাণ্যচিত্র। পর্দাজুড়ে মানুষজন কেঁচোর মতো কিলবিল করছে। খুব সম্ভব রিমোটটা হাতের কাছে নেই। আড্ডার চোখ এসে থমকে গেছে এই অদ্ভুত দৃশ্যের ওপর। আমি ছিলাম পাশের ঘরে। এক কাপ চা নিতে এসে ব্যাপারটা আমারও দেখা হলো। একেকজন নিজস্ব মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে। উঃ! এরা কী মানুষ, কীভাবে বেঁচে আছে? বাঁচা বলছ কাদের আর মানুষই বা বলছ কাদের? দেখ, এই তো সোনার বাংলার চেহারা। দেশ কীভাবে চলবে? এত মানুষ থাকলে কারো পক্ষেই দেশ চালানো সম্ভব নয়। ঠিক বলেছ। দেশ কি আর আছে, দেশ তো গোল্লায় গেছে। দেখছ না কী সব কা- ঘটছে? না বাবা এসব চোখে দেখা যায় না। এই জন্যই তো আমার দেশে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি মনে মনে বললাম দেশে তোমরা থাকোই ক’দিন।
মেজভাইয়া হৈচৈ করে পটলকে ডাকল। ওর আসল নাম হাসান আলী। এ বাড়িতে যেই কাজ করতে আসে তার নাম পটল হয়ে যায়। আসল পটল যে ছিল সে কাজে খুব পটু ছিল। বিশ্বস্তও ছিল। সে চলে যাওয়ার পর থেকেই এই নিয়ম হয়েছে। বর্তমান পটল বিশ্বস্ত বটে কিন্তু কোন কথা মনে রাখতে পারে না। ফলে কাজকর্ম প্রায়ই উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। পটল এলে তাকে বলা হলো ড্রাইভারকে খবর দিতে। শুক্রবার হলেই বাড়ি ছোটে ছেলেটা। আমরা কাল সাভারে বেড়াতে যাব। নির্দেশ পেয়ে পটল চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। বড় ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন কি রে খবর দিয়েছিস? তেলটেল ভরে গাড়িটা ওকে আছে কি না জানিয়ে ও যেখানে খুশি সেখানে যাক।
পরদিন সকালের নাস্তা সেরে আমরা সাভার যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। সাভারে বড় ফুফুর বাড়িতে পিকনিকের জম্পেশ আয়োজন হয়েছে। বেড়াতে যাওয়ার সময় নিজে ড্রাইভ করতে ভালবাসেন বড় ভাইয়া।
গাড়ি গেট পেরিয়ে আসতেই ভাবির মনে পড়ল পানির বোতল আনা হয়নি। ভাইয়া নিজেই নেমে গেলেন। যেতে যেতে বললেন ক্যামেরাটাও নিশ্চয় ফেলে এসেছো। যা ভুলো মন তোমাদের। বাঁশীদা এই ফাঁকে ভুলো মন নিয়ে একটা রসিকতা করে ফেললেন। শুনে সবাই হেসে লুটোপুটি।
হাতে বোতল কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ভাইয়া আটকে গেলেন গেটের কাছে। দু’জন তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। দু’জনারই গায়ের কাপড়চোপড় বড় মলিন। মহিলার মুখটি দেখা যায় না, ঘোমটা টানা। হাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি। দেখেই বোঝা যায় গ্রাম থেকে এসেছে। কী কথা হলো গাড়ির ভেতর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে ভাইয়া তার ব্যস্ততা বোঝাতে পেরেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানিব্যাগ বের করে লোকটির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়িতে এসে বসলেন ভাইয়া। গাড়ি চলছে হু হু করে। আবার আড্ডা জমে উঠল। বাঁশীদা রাজনীতি, মিছিল, ভাংচুর হরতাল এই সব নিয়ে কৌতুক বলছেন।
ছাগলের পাল
যায় রাম পাল
পথে বাধে হরতাল
হয়ে যায় গোলমাল।Ñমুখে মুখে ছড়া বানিয়ে ফেলল মেজভাবি। শুনে হাসির তুফান উঠল। ছোট ভাবি খুব চুপচাপ ধরনের। সেও শব্দ করে হেসে উঠল। আমাদের গ্রামের বাড়ি রামপাল। এ কারণেই ছড়াটা বাজার পেল।
শহর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ি চলছে একেবারে ফাঁকা রাস্তায়। দু’ধারে অবারিত ধানের মাঠ। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ ধরনের নরম শান্তিতে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে আমার। ঘন নীল আকাশ জমিতে একঝাঁক বালিহাঁস উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? মনটা হঠাৎ খারাপ ঠিক হঠাৎ নয়। মন খারাপ হয়েছিল আমার সেই যাত্রা শুরুতেই। চেষ্টা করা সত্ত্বেও কারো চেহারা মনে করতে না পারলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। গেটের কাছে একজন পুরুষ একজন মহিলা বড় ভাইয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করল। মহিলাটির মুখ ছিল ঘোমটার আড়ালে। ওরা হয়ত স্বামী-স্ত্রী। লোকটিকে মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি। গাড়িটা দ্রুত ছেড়ে দেয়াতে চেহারা ভাল দেখা গেল না। কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগছিল। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। যে কোন ব্যর্থতার সঙ্গে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। মেজ ভাবির রসিকতায় সবাই হাসলেও আমি হাসতে পারিনি। এ ধরনের রসিকতা আমার একদম ভাল লাগে না। রামপাল শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা আরো বেশি ঢিপ ঢিপ করতে থাকল। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া সবারই জন্ম রামপালে। ওরা কেউ গ্রামের বাড়িতে যেতে চায় না। কারণে অকারণে গ্রামে আসা যাওয়া কেবল আমারই। মার কবর আছে ওখানে। বছর কয়েক আগে একবার বড় ভাইয়া নিজের ইচ্ছেতেই গ্রামে গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে। তার অবশ্যি উদ্দেশ্য ছিল ফেরার পথে সুন্দরবন বেড়ানো। পাখি শিকারÑ এই সব আর কি। ভাবলাম বেশ মজা হবে। কিন্তু মজা করা মাথায় থাকল, দেখা গেল শেষটায় জীবন নিয়ে টানাটানি।
গ্রামে পৌঁছেই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নূর আলীর সঙ্গে। নূর আলী আমাদের গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করে। সঙ্গে তার শ্যালক নয়ন মিয়া। থাকে কাঁটাখালি। বাড়ি যেতে যেতে কাঁটাখালির গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো সব গল্প বলতে লাগল নূর আলী আর নয়ন মিয়া। বড় ভাইয়া হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন সেসব।
Ñকি যে সব আষাঢ়ে গল্প কর নূর আলী। বাঘ গ্রামে ঢুকে মানুষ ধরে নিয়ে যায়Ñ আজকের দিনে এটা কোন কথা হলো?
Ñগল্প কতিছি না মিয়া ভাই। এক্কেবারে সত্যি কথা কলাম। প্রতিবাদ করে ওঠে নূর আলী।
Ñসভ্যতা মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে তা কি জান? আকাশ, পাতাল, স্বর্গমর্ত যাই বল সবই এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। আর এই যুগে বাস করে তুমি কিনা বলছ বাঘের ভয়ে মানুষ গ্রামে টিকতে পারছে না!
নূর আলীর ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ভাইয়া গোঁ ধরলেন কাঁটাখালি যাবেন। কাঁটাখালির কাছেই হলদে বুনিয়া, বরইতলা, সুন্দরবন। আমাকেও যেতে হলো তার সঙ্গে। নূর আলীর শ্বশুরবাড়ি কাঁটাখালি। নয়ন মিয়া কিছুতেই শুনবে না, আমাদের নিয়ে তুলল তার বাড়িতে। রাস্তায় দেখলাম দল বেঁধে কিছু লোক সদাইপাতি নিয়ে হাট থেকে ফিরছে বাড়ির দিকে।
এ অঞ্চলের মানুষ বড় একটা একা চলাফেরা করে না। কিন্তু ধেড়ুমাঝির ছিল বড় সাহস। গায়ে গতরে অসীম বল। বিশাল দেহটা তমাল গাছের মতো শক্ত সমর্থ আর কালো। সেই কালো দেহটা ঘামে চক চক করত জাল মেরে মাছ ধরে যখন সে বাড়ি ফিরত। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো যেমন সামনের দিকে ঝুঁকে চলে ধেড়ুমাঝি তেমন ছিল না। বুক-পিঠ টান করে হাঁটত। সবাই তাকে একটু সমঝেই চলত। একবার তার সামনে এক বাঘ এসে পড়েছিল। বাঘ গর্জন করবার আগেই ধেড়ুমাঝি গর্জে উঠেছিল এমনভাবে যে সেই গর্জন শুনে বাঘ চুপচাপ নিজের ঠিকানায় চলে গিয়েছিল। তো সেই ধেড়ুমাঝি আক্রান্ত হলো এক সন্ধ্যায়। এ এলাকায় সন্ধ্যা মানেই রাত। জমাট বাঁধা রাত। হাট থেকে ফিরছিল। চেনা পথ। আপন মনে হন হন করে হাঁটছিল সে। হঠাৎ কী একটা শব্দে চকিত হয়ে ওঠে। খানিক থেমে আবার হাঁটা ধরে। এবার স্পষ্ট একটা ভারি নিশ্বাসের শব্দ। রাস্তার দু’ধারে বনেবাদাড়ে কত রকমেরই তো শব্দ হয়, কিন্তু না এবার কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দমকা এক ধাক্কায় রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। চলে মানুষ আর অসুরের ধস্তাধস্তি। আততায়ী পারবে কেন ধেড়ুমাঝির সঙ্গে। সমানে সমান। আচমকা ঝলসে ওঠে ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইট। ধেড়ুমাঝি মুহূর্তের জন্য বেখেয়ালী হয়ে পড়ে। এই সুযোগে আততায়ী তাকে কুপোকাত করে ফেলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত লড়ে যায় সে। ততক্ষণে ছয় ব্যাটারি লাইটের দল এসে পড়ে সেখানে। দেখে ধেড়ুমাঝি ও একটা বাঘ রক্তারক্তি অবস্থায় জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে সমস্ত গ্রাম ভেঙ্গে পড়ল সেখানে। সেবার গ্রামের লোক দেখল ধেড়ুমাঝি বাঘকে ছাড়েনি, বাঘও ধেড়ুমাঝিকে ছাড়েনি। গ্রামের লোক দেখল দুটো লাশ পড়ে আছে এমনভাবে অন্তিম মুহূর্তে দুজনে দুজনের কাছ থেকে যেন মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। লোকে এখনও বলাবলি করে ধেড়ুমাঝির রক্তে নাকি বিষ ছিল।
আর একবার কী হলো, নদী পার হয়ে বাঘ ঢুকল একেবারে ভরা বাজারের মধ্যে। একবাজার লোকের মধ্যে থাবা মেরে মেরে ফেলল তিন মানুষ। তারপর গ্রামের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল বাঘটা গ্রামবাসী কি আর এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? পরদিন ভোরে ফাঁদ পেতে বাঘটাকে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলল। বাঘ মারার পর শুরু হলো আর এক বিপদ। তা নিয়ে কত যে হুলস্থ’ূল সরকারের লোকের সঙ্গে। নয়ন মিয়া বলল, বুঝলেন ভাইজান, সরকারের লোকজন সব বাঘের পক্ষে। আমাদের পক্ষে কেউ নেই।
এইসব গল্প শুনতে শুনতে আমরা এসে উঠলাম নয়ন মিয়ার বাড়িতে। একেবারে সুনসান গ্রাম। তার উপর সুন্দরবন কাছেই। হাঁটা পথের দূরত্ব। গায়ে গায়ে গাছপালা। খর খরে দুপুরেই মনে হচ্ছে সব ঝিম মেরে আছে। ভারি অদ্ভুত সুরে ঘুঘু ডাকছে থেকে থেকে। তাতেই ছম ছম করছে চারদিক। খাওয়া-দাওয়ার পর নয়ন মিয়া আমাদের নিয়ে গেল গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে। সারাগ্রাম ঘুরেও একটা ইটের বাড়ি দেখা গেল না। সবই কাঁচাঘর। হোগলার বেড়া, গোল পাতার চাল। এই গ্রামে নয়ন মিয়াদেরই যা একটু অবস্থা ভাল।
আচ্ছা নয়ন মিয়া! তুমি বলছিলে এখানে একটা নদী আছে?
Ñহ’ভাইজান। ঐ যে খালের মতো দেখতিছেন। খড়মা নদী। খুব সোরত ছিল এক সময়। নদী এত বড় ছিল যে এপার থেকে ওপার দেখা যেত না। আর এখন সেই নদীর এই হাল। কলি তো বিশ্বাস যাবেন না।
Ñমানুষজন তো দেখলাম না তেমন।
Ñদেখবেন কি! মানুষজন দুপুরে খাওয়ার পর আর তেমন বের হয় না। যদিও এ গ্রামে এখন পর্যন্ত বাঘ ঢোকেনি। আশপাশের গ্রামে বাঘ ঢুকে গরু, ছাগল, মানুষ নিয়ে গেছে। আমরা মাঝে মাঝে চিৎকার হট্টগোল শুনি। তখন সবাই মিলে চিৎকার করি। থালা বাসন পিটাই, টিন পিটাই। মশাল জ্বালাই। টিন পিটানির শব্দ শুনলি বাঘ ভয়ে চলে যায়।
বড় ভাইয়ার মুখ বেশ শুকনো দেখাচ্ছে। কাঁটাখালি আসার আগে তার ভেতরে যে একটা তেজী স্রোত দেখেছিলাম তা একেবারে থিতিয়ে গেছে। নয়ন মিয়ার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন সেই আদিম যুগে ফিরে গেছি। সন্ধ্যা লাগার অনেক আগেই আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
নয়ন মিয়ার মা ঘরে পোষা মুরগি জবাই করে ভাটেল চালের ভাত রান্না করেছে। ভাটেল চালের ভাতের সুগন্ধে সারাবাড়ি ম ম করছে। নয়নের মা নিজে পরিবেশন করে আমাদের খাওয়ালো। বয়সের তুলনায় তাকে একটু বেশি বয়সী দেখায়। মহিলার স্বামী ছিল গুণীন। লোকে বড় মানতো তাকে। কিন্তু সেই এত বড় গুণীনই বাঘের পেটে চলে গেল। খেতে খেতে সেই সব গল্পই শুনলাম। এইসব শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসছে।
আগে তারা থাকত বৈদ্যমারি। সেইখানে তখন খুব বাঘের উৎপাত চলছিল। ধুলোপড়া দিয়ে বাড়ি বন্ধ করে পরিবার নিয়ে গুণীন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। রাতের বেলা বাঘ এসে থাবা মারল গুণীনের কাঁধে। কিছু বুঝে উঠবার আগে কলজের ওপর পড়ল আর এক থাবা। জোয়ান তাগড়া মানুষটা ছটফট করতে লাগল বাঁচার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। নয়নের মা সেই থেকে বাঘবিধবা। সুন্দরবনে মাছ ধরতে অথবা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা বাঘের কবলে পড়ে মারা যায় তাদের স্ত্রীদের ‘বাঘবিধবা’ বলে। সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে অসংখ্য বাঘবিধবা পরিবার বাস করে।
এদিকে রাত যতই বাড়তে লাগল ততই ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। নয়ন মিয়া বলেছে, এখন পর্যন্ত এ গ্রামে বাঘ ঢোকেনি। কিন্তু তাতে কী! ঢুকতে কতক্ষণ! এখানে আসার পেছনে এ রকম সাহস দেখানোর জন্য বড় ভাইয়ার ওপর আমার ভীষণ রাগ হতে লাগল।
ঘুম আসছে না কিছুতেই। এমনিতেই আমার অচেনা জায়গায় ঘুম আসতে চায় না। তার ওপর চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরে অবশ্যি একটা হারিকেন জ্বলছে টিম টিম করে। সেই টিম টিমে আলোতেই পরিবেশটা আরো ভৌতিক হয়ে উঠেছে। পেঁচা ডাকছে খুব কাছ থেকে কোথাও। ভয়ে চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না। আমার শরীর ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে আর থেকে থেকে মেরুদ- দিয়ে শির শির করে কী যেন নেমে যাচ্ছে।
আমার পাশেই শুয়ে আছে বড় ভাইয়া। ঘুম এসেছে তার অনেকক্ষণ। এখন নাক ডাকছে ভীষণভাবে। তাতেই রাতটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। পাশেই লম্বা করে রেখে দিয়েছে তার পাখি শিকার করা ইয়ারগানটা। রাত কত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে রাত যে বেশ ভারি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। এক সময় চোখের পাতা একটু ভারি হয়ে আসে, বুঝি তন্দ্রা আসে। এমন সময় দূর থেকে একটা তীক্ষè শব্দে দ্রুত তন্দ্রাটা ছুটে গেল। চোখের পাতা খুলতেই মনে হলো হাজারটা জোনাকি জ্বলছে চোখের ভেতর। কানে আসছে লক্ষ ঢ্যাটরার শব্দ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে তুললাম। কিছু না বুঝেই গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুতে লাগল তার। প্রচ- ভয়ে হয়ত এ রকম করছেন। বিকেল বেলায় চোখমুখ শুকনো দেখা গেলেও কোথায় যেন একটু ভরসা দেখেছিলাম তার চেহারায়। অকারণে হাতের ইয়ারগানটা নাড়াচাড়া করছিলেন তখন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সত্যিই অকূল দরিয়ার মধ্যে পড়েছেন। ছটফট করতে করতে হঠাৎ পাশে রাখা ইয়ারগানটার ওপর হাত পড়তেই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। এর ভেতরেই নয়নের মা ঘরে ঢুকেছে। হারিকেনের আলো সতেজ করে দিয়েছে। নয়ন এসে জাপটে ধরেছে বড় ভাইয়াকে। আর পাগলের মতো চিৎকার করছেÑ ভাইজান আপনে বন্দুক নিছেন ক্যান হাতে? ঘরে চলেন, ঘরের ভিতরে চলেন। বলতে বলতে ঘরের ভেতরে টেনে-হিঁচড়ে ভাইয়াকে নিয়ে আসে।
Ñআরে পাগল হলে না কি? এ রকম করছ কেন? ছেড়ে দাও আমাকে। কোন ভয় নেই। আমার হাতে বন্দুক আছে।
নয়ন মিয়া সে কথায় কান দেয় না। ভাইয়াকে জাপটে ধরে বিছানায় বসাল। হারিকেনের আলোয় দেখা গেল নয়নের মা ভাইয়ার একটা হাত চেপে ধরে বসে আছে আর ঠক ঠক করে কাঁপছে। আমি ভয়ে জড়সড়, এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে চিৎকার, কান্নার শব্দ, কাঁসার থালা, টিন পিটানোর সম্মিলিত বিকট আওয়াজ কিছুটা দূরে সরে গেছে।
Ñতোমরা এ রকম করছ কেন? বড় ভাইয়া ধমকে উঠল। দরজায় আরও একটা খিল এঁটে নয়ন মিয়া বলল, ফুলি এক ঘটি পানি খাওয়া।
পানি নিয়ে এলো একটি মেয়েÑ অল্প বয়স, নথ পরা মুখে ছোট একটা ঘোমটা। ঘোমটার ভেতর থেকে তার আধখানা মুখ যেন রক্তশূন্য এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ। খুব ভয় পেয়েছে মেয়েটা। নয়ন মিয়ার বৌ ফুলি। গোলগাল দেখতে। পেটে বোধহয় সন্তান আছে। নয়ন মিয়ার যে বৌ আছে, বৌ এই বাড়িতেই থাকেÑ এতটা সময় তার কোন আভাসই পাওয়া যায়নি। গ- গ্রামের বৌঝিরা অচেনা মানুষের সামনে সহজে বের হয় না। কিন্তু আজ এই রাতের মুহূর্তের ঘটনা সব পর্দা টেনে তুলে ফেল দিল।
পানি খেয়ে সবাই কিছুটা ঠা-া হলো। নয়নের বৌ ফুলি অন্য ঘরে চলে গেল না। গায়ে মাথায় আরো বেশি করে কাপড় টানার প্রয়োজন বোধটাও যেন লোপ পেয়েছে তার। ঘরে দু’জন অপরিচিত মানুষ কিন্তু সে নির্লিপ্ত।
Ñভাইজান বন্দুক দিয়া কী করবেন? বাঘ মারবেন? বাঘ মারা নিষেধ আছে। সরকারের কড়া নিষেধ। বাঘ মারা দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু মানুষের জীবনের কী কোন মূল্য নাই? বাঘ যে মানুষ মারছে সেটা কেউ দেখবে না? বড় ভাইয়া রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। Ñনা, এইটা কোন অপরাধ না। বন বিভাগের সাহেবরা কইছে গ্রামে বাঘ ঢুকলি তাড়ায়ে দিতি হবে। মারা চলবে না। মারলি কোর্ট কাছারি হবে। শাস্তি হবে। শাস্তির ভয়ে আমরা হাত-পা গুটায়ে থাকি।
কটমট করে তাকিয়ে আছেন বড় ভাইয়া নয়ন মিয়ার দিকে যেন সব দোষ তার।
পরদিন স্থানীয় বনকর্তাদের সঙ্গে কথা হলো এই নিয়ে। তারা অবলীলায় জানাল বনে হরিণ, শূকর বা অন্য পশু শিকার করার চাইতে লোকালয়ে মানুষ ও গরু-ছাগল শিকার করা অনেক সহজ। খাওয়ার অভাবেই সহজ শিকারের লোভেই শুকনো নদী পার হয়ে বাঘ গ্রামে চলে আসে।
আর একজন জানালেন খুব আয়েশি ভঙ্গিতে সুন্দরবনের বাঘ সারাবিশ্বে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে পরিচিত করেছে। এই টাইগার তো আমাদের সংরক্ষণ করতেই হবে যে কোন মূল্যে।
Ñবাঘ মূল্যবান কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তার মূল্যটা কী মানুষের জীবন দিয়ে দিতে হবে? দিনের পর দিন জনপদ কী এইভাবে নিরাপদহীন হয়ে পড়বে? এর কি কোন প্রতিকার নেই? সরকার কোন ব্যবস্থা নেবে না? বড় ভাইয়ার শরীরের প্রায় অর্ধেকটাই ঝুঁকে আছে টেবিলের ওপর।
একজন অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন, সরকার ব্যবস্থা নেয়নি কে বলল? সরকার তো ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই ব্যবস্থা কাজে লাগানোর উপযুক্ত মানুষ নেই। সরকারী ভাষায় যাকে বলে ‘দক্ষ জনবল।’ বলতে বলতে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। হাসবারই কথা।
গ্রামে বাঘ ঢুকলে বাঘ অচেতন করার জন্য সেই মান্ধাতার আমলের দুইটা ট্রাংকুলাইজার গান আছে। কিন্তু তা চালানোর মতো দক্ষ মানুষ নেই। বুঝলেন ভাই সেই গান চালানোও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বনকর্তা ভদ্রলোক আমাদের চা অফার করলেন। চা খেতে খেতে আমরা জানতে চাইলাম কেমন ঝুঁকিপূর্ণ? এই ধরেন গিয়ে ৫০ ফুট দূরত্ব থেকে এই গান ব্যবহার করতে হয়। তা ছাড়া বাঘের বয়স, শক্তি, ওজন অনুমান করে এ্যাম্পুলের ডোজ ব্যবহার করতে হয়। তা না হলে বাঘের জ্ঞান ফিরবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। বুঝলেন ভাই সাহেব এই এ্যাম্পুলের দামও খুব চড়া। সবচেয়ে বড় কথা, এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা আর কাজে লাগে না। আমরা সরকারী লোক, আমাদেরও তো হাত-পা বাঁধা। তাই গ্রামের লোকদের বলিÑ বাঘ আসার আলামত পাইলে সবাই মিলে টিন, থালা-বাসন পিটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে বাঘকে বনে পাঠাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে।
আমরা বনকর্তার অফিস থেকে যখন বের হলাম, দেখি সূর্য মাথার ওপর। অফিসের সামনে অনেকটা জায়গা মাঠের মতো পড়ে আছে। তার এক দিকে একটা কালো বড় সাইনবোর্ডে লেখা ‘জঙ্গলের বাঘকে স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির সুযোগ দানই আইন। অহেতুক তাকে মারা বা বিরক্ত করা সম্পূর্ণ বেআইনী ও দ-নীয় অপরাধ।’ চমৎকার আইন। মানুষের অসহায়ত্বের কী প্রতিকার জানি না।
বাঘের কবলে পড়ে গত রাতে এক মা ও তার শিশু মারা গেছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে সেই বাড়িতে। পিতৃহারা অপর শিশু দুটি এবার মা হারা হলো। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে কিন্তু কোথায় কীভাবে তা পাওয়া যায় এদের জানা নেই। একটা মানুষের শূন্যতা কোন্ ক্ষতিপূরণে পূর্ণতা পায় তা আমার জানা নেই। একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস বুকটাকে আরো ভারি করে তুলল।
সব দেখেশুনে বড় ভাইয়া সহ্য করতে পারছিল না। পারলে এখনই নয়ন মিয়াকে সাথে নিয়ে চলে আসে ঢাকায়। নয়নের কাঁধে হাত রেখে বললেন, এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। তুমি মা বৌকে নিয়ে চলে আসো। আমি তোমার ব্যবস্থা করব। কোন চিন্তা করো না। আমাদের ঢাকার বাড়ির ঠিকানা দেয়া হলো তাকে। ১৯৯৯ সাল, সে আজ কত দিন হলো। তারপর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। কাঁটাখালির আর কোন খবর পাইনি। না কি নেইনি!
সকালে দুটো মানুষ বড় ভাইয়ার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তিনি হয়ত ভাল করে ওদের মুখের দিকে তাকানওনি। মনে হয় পোশাক-আশাক, গ্রাম থেকে আসা চেহারা দেখেই চট করে কিছু টাকা বের করে দিয়েছে পকেট থেকে সাহায্য হিসেবে।
কারণ ওরা তো সাহায্য মানে টাকা ছাড়া আর কিছু চায় না। এর চেয়ে বেশি ভাববার সময়ও তখন তার হাতে ছিল না তখন তার প্রচ- তাড়া। কথা বলবার সময় নেই। যেতে হবে সাভার। সেখানে পিকনিক, হৈহল্লা, আড্ডা, আনন্দ এইসব অপেক্ষা করছে।
আমাদের গাড়িটা একটা বাজে জায়গায় এসে জ্যামে আটকে গেল। সামনের সিট পকেট থেকে আজকের পেপারটা বের করলাম। দৃশ্যটা কিছুতেই চোখ থেকে সরাতে পারছি না। লোকটার চেহারা এক ঝলক দেখলেও খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাঁ মনে পড়ছে। নয়ন মিয়া। সঙ্গে নিশ্চয় তার বৌ ফুলি। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তাদের। একটা শুকিয়ে যাওয়া কলাগাছে কাপড় পেঁচানো। গোলগাল চেহারার যে ফুটফুটে বৌটির হাতের পানি খেয়ে এক ভয়াল রাতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া আমাদের বুকে আবার প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। এই কী সেই মেয়েটি! আমি আর ভাবতে পারছি না।
বড় ভাইয়া ওদের কথা দিয়ে এসেছিলেন কোন চিন্তা করো না। চলে এসো ওরা এসেছে। সেই কাঁটাখালি থেকে শহরের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে। আমার ভেতরের অস্থিরতা কাটানোর জন্য খবরের কাগজটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। এলোমেলো চোখ বুলাতে লাগালাম কাগজের ওপর। একটা জায়গায় নিজের অজান্তেই চোখ স্থির হয়ে গেল। ‘গত সন্ধ্যায় সুন্দরবনের বাঘ নদীপার হয়ে বনসংলগ্ন শ্যামনগরে চলে আসে। বাঘের আক্রমণে এক গৃহবধূসহ তিনজন নিহত ও একজন আহত হন। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে।’
তখন আর এক দফা চায়ের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠেছে। টিভি চলছে আপন মনে। জনসংখ্যা বিষয়ে প্রামাণ্যচিত্র। পর্দাজুড়ে মানুষজন কেঁচোর মতো কিলবিল করছে। খুব সম্ভব রিমোটটা হাতের কাছে নেই। আড্ডার চোখ এসে থমকে গেছে এই অদ্ভুত দৃশ্যের ওপর। আমি ছিলাম পাশের ঘরে। এক কাপ চা নিতে এসে ব্যাপারটা আমারও দেখা হলো। একেকজন নিজস্ব মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে। উঃ! এরা কী মানুষ, কীভাবে বেঁচে আছে? বাঁচা বলছ কাদের আর মানুষই বা বলছ কাদের? দেখ, এই তো সোনার বাংলার চেহারা। দেশ কীভাবে চলবে? এত মানুষ থাকলে কারো পক্ষেই দেশ চালানো সম্ভব নয়। ঠিক বলেছ। দেশ কি আর আছে, দেশ তো গোল্লায় গেছে। দেখছ না কী সব কা- ঘটছে? না বাবা এসব চোখে দেখা যায় না। এই জন্যই তো আমার দেশে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি মনে মনে বললাম দেশে তোমরা থাকোই ক’দিন।
মেজভাইয়া হৈচৈ করে পটলকে ডাকল। ওর আসল নাম হাসান আলী। এ বাড়িতে যেই কাজ করতে আসে তার নাম পটল হয়ে যায়। আসল পটল যে ছিল সে কাজে খুব পটু ছিল। বিশ্বস্তও ছিল। সে চলে যাওয়ার পর থেকেই এই নিয়ম হয়েছে। বর্তমান পটল বিশ্বস্ত বটে কিন্তু কোন কথা মনে রাখতে পারে না। ফলে কাজকর্ম প্রায়ই উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। পটল এলে তাকে বলা হলো ড্রাইভারকে খবর দিতে। শুক্রবার হলেই বাড়ি ছোটে ছেলেটা। আমরা কাল সাভারে বেড়াতে যাব। নির্দেশ পেয়ে পটল চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। বড় ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন কি রে খবর দিয়েছিস? তেলটেল ভরে গাড়িটা ওকে আছে কি না জানিয়ে ও যেখানে খুশি সেখানে যাক।
পরদিন সকালের নাস্তা সেরে আমরা সাভার যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। সাভারে বড় ফুফুর বাড়িতে পিকনিকের জম্পেশ আয়োজন হয়েছে। বেড়াতে যাওয়ার সময় নিজে ড্রাইভ করতে ভালবাসেন বড় ভাইয়া।
গাড়ি গেট পেরিয়ে আসতেই ভাবির মনে পড়ল পানির বোতল আনা হয়নি। ভাইয়া নিজেই নেমে গেলেন। যেতে যেতে বললেন ক্যামেরাটাও নিশ্চয় ফেলে এসেছো। যা ভুলো মন তোমাদের। বাঁশীদা এই ফাঁকে ভুলো মন নিয়ে একটা রসিকতা করে ফেললেন। শুনে সবাই হেসে লুটোপুটি।
হাতে বোতল কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ভাইয়া আটকে গেলেন গেটের কাছে। দু’জন তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। দু’জনারই গায়ের কাপড়চোপড় বড় মলিন। মহিলার মুখটি দেখা যায় না, ঘোমটা টানা। হাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি। দেখেই বোঝা যায় গ্রাম থেকে এসেছে। কী কথা হলো গাড়ির ভেতর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে ভাইয়া তার ব্যস্ততা বোঝাতে পেরেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানিব্যাগ বের করে লোকটির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়িতে এসে বসলেন ভাইয়া। গাড়ি চলছে হু হু করে। আবার আড্ডা জমে উঠল। বাঁশীদা রাজনীতি, মিছিল, ভাংচুর হরতাল এই সব নিয়ে কৌতুক বলছেন।
ছাগলের পাল
যায় রাম পাল
পথে বাধে হরতাল
হয়ে যায় গোলমাল।Ñমুখে মুখে ছড়া বানিয়ে ফেলল মেজভাবি। শুনে হাসির তুফান উঠল। ছোট ভাবি খুব চুপচাপ ধরনের। সেও শব্দ করে হেসে উঠল। আমাদের গ্রামের বাড়ি রামপাল। এ কারণেই ছড়াটা বাজার পেল।
শহর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ি চলছে একেবারে ফাঁকা রাস্তায়। দু’ধারে অবারিত ধানের মাঠ। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ ধরনের নরম শান্তিতে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে আমার। ঘন নীল আকাশ জমিতে একঝাঁক বালিহাঁস উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? মনটা হঠাৎ খারাপ ঠিক হঠাৎ নয়। মন খারাপ হয়েছিল আমার সেই যাত্রা শুরুতেই। চেষ্টা করা সত্ত্বেও কারো চেহারা মনে করতে না পারলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। গেটের কাছে একজন পুরুষ একজন মহিলা বড় ভাইয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করল। মহিলাটির মুখ ছিল ঘোমটার আড়ালে। ওরা হয়ত স্বামী-স্ত্রী। লোকটিকে মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি। গাড়িটা দ্রুত ছেড়ে দেয়াতে চেহারা ভাল দেখা গেল না। কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগছিল। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। যে কোন ব্যর্থতার সঙ্গে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। মেজ ভাবির রসিকতায় সবাই হাসলেও আমি হাসতে পারিনি। এ ধরনের রসিকতা আমার একদম ভাল লাগে না। রামপাল শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা আরো বেশি ঢিপ ঢিপ করতে থাকল। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া সবারই জন্ম রামপালে। ওরা কেউ গ্রামের বাড়িতে যেতে চায় না। কারণে অকারণে গ্রামে আসা যাওয়া কেবল আমারই। মার কবর আছে ওখানে। বছর কয়েক আগে একবার বড় ভাইয়া নিজের ইচ্ছেতেই গ্রামে গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে। তার অবশ্যি উদ্দেশ্য ছিল ফেরার পথে সুন্দরবন বেড়ানো। পাখি শিকারÑ এই সব আর কি। ভাবলাম বেশ মজা হবে। কিন্তু মজা করা মাথায় থাকল, দেখা গেল শেষটায় জীবন নিয়ে টানাটানি।
গ্রামে পৌঁছেই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নূর আলীর সঙ্গে। নূর আলী আমাদের গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করে। সঙ্গে তার শ্যালক নয়ন মিয়া। থাকে কাঁটাখালি। বাড়ি যেতে যেতে কাঁটাখালির গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো সব গল্প বলতে লাগল নূর আলী আর নয়ন মিয়া। বড় ভাইয়া হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন সেসব।
Ñকি যে সব আষাঢ়ে গল্প কর নূর আলী। বাঘ গ্রামে ঢুকে মানুষ ধরে নিয়ে যায়Ñ আজকের দিনে এটা কোন কথা হলো?
Ñগল্প কতিছি না মিয়া ভাই। এক্কেবারে সত্যি কথা কলাম। প্রতিবাদ করে ওঠে নূর আলী।
Ñসভ্যতা মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে তা কি জান? আকাশ, পাতাল, স্বর্গমর্ত যাই বল সবই এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। আর এই যুগে বাস করে তুমি কিনা বলছ বাঘের ভয়ে মানুষ গ্রামে টিকতে পারছে না!
নূর আলীর ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ভাইয়া গোঁ ধরলেন কাঁটাখালি যাবেন। কাঁটাখালির কাছেই হলদে বুনিয়া, বরইতলা, সুন্দরবন। আমাকেও যেতে হলো তার সঙ্গে। নূর আলীর শ্বশুরবাড়ি কাঁটাখালি। নয়ন মিয়া কিছুতেই শুনবে না, আমাদের নিয়ে তুলল তার বাড়িতে। রাস্তায় দেখলাম দল বেঁধে কিছু লোক সদাইপাতি নিয়ে হাট থেকে ফিরছে বাড়ির দিকে।
এ অঞ্চলের মানুষ বড় একটা একা চলাফেরা করে না। কিন্তু ধেড়ুমাঝির ছিল বড় সাহস। গায়ে গতরে অসীম বল। বিশাল দেহটা তমাল গাছের মতো শক্ত সমর্থ আর কালো। সেই কালো দেহটা ঘামে চক চক করত জাল মেরে মাছ ধরে যখন সে বাড়ি ফিরত। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো যেমন সামনের দিকে ঝুঁকে চলে ধেড়ুমাঝি তেমন ছিল না। বুক-পিঠ টান করে হাঁটত। সবাই তাকে একটু সমঝেই চলত। একবার তার সামনে এক বাঘ এসে পড়েছিল। বাঘ গর্জন করবার আগেই ধেড়ুমাঝি গর্জে উঠেছিল এমনভাবে যে সেই গর্জন শুনে বাঘ চুপচাপ নিজের ঠিকানায় চলে গিয়েছিল। তো সেই ধেড়ুমাঝি আক্রান্ত হলো এক সন্ধ্যায়। এ এলাকায় সন্ধ্যা মানেই রাত। জমাট বাঁধা রাত। হাট থেকে ফিরছিল। চেনা পথ। আপন মনে হন হন করে হাঁটছিল সে। হঠাৎ কী একটা শব্দে চকিত হয়ে ওঠে। খানিক থেমে আবার হাঁটা ধরে। এবার স্পষ্ট একটা ভারি নিশ্বাসের শব্দ। রাস্তার দু’ধারে বনেবাদাড়ে কত রকমেরই তো শব্দ হয়, কিন্তু না এবার কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দমকা এক ধাক্কায় রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। চলে মানুষ আর অসুরের ধস্তাধস্তি। আততায়ী পারবে কেন ধেড়ুমাঝির সঙ্গে। সমানে সমান। আচমকা ঝলসে ওঠে ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইট। ধেড়ুমাঝি মুহূর্তের জন্য বেখেয়ালী হয়ে পড়ে। এই সুযোগে আততায়ী তাকে কুপোকাত করে ফেলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত লড়ে যায় সে। ততক্ষণে ছয় ব্যাটারি লাইটের দল এসে পড়ে সেখানে। দেখে ধেড়ুমাঝি ও একটা বাঘ রক্তারক্তি অবস্থায় জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে সমস্ত গ্রাম ভেঙ্গে পড়ল সেখানে। সেবার গ্রামের লোক দেখল ধেড়ুমাঝি বাঘকে ছাড়েনি, বাঘও ধেড়ুমাঝিকে ছাড়েনি। গ্রামের লোক দেখল দুটো লাশ পড়ে আছে এমনভাবে অন্তিম মুহূর্তে দুজনে দুজনের কাছ থেকে যেন মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। লোকে এখনও বলাবলি করে ধেড়ুমাঝির রক্তে নাকি বিষ ছিল।
আর একবার কী হলো, নদী পার হয়ে বাঘ ঢুকল একেবারে ভরা বাজারের মধ্যে। একবাজার লোকের মধ্যে থাবা মেরে মেরে ফেলল তিন মানুষ। তারপর গ্রামের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল বাঘটা গ্রামবাসী কি আর এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? পরদিন ভোরে ফাঁদ পেতে বাঘটাকে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলল। বাঘ মারার পর শুরু হলো আর এক বিপদ। তা নিয়ে কত যে হুলস্থ’ূল সরকারের লোকের সঙ্গে। নয়ন মিয়া বলল, বুঝলেন ভাইজান, সরকারের লোকজন সব বাঘের পক্ষে। আমাদের পক্ষে কেউ নেই।
এইসব গল্প শুনতে শুনতে আমরা এসে উঠলাম নয়ন মিয়ার বাড়িতে। একেবারে সুনসান গ্রাম। তার উপর সুন্দরবন কাছেই। হাঁটা পথের দূরত্ব। গায়ে গায়ে গাছপালা। খর খরে দুপুরেই মনে হচ্ছে সব ঝিম মেরে আছে। ভারি অদ্ভুত সুরে ঘুঘু ডাকছে থেকে থেকে। তাতেই ছম ছম করছে চারদিক। খাওয়া-দাওয়ার পর নয়ন মিয়া আমাদের নিয়ে গেল গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে। সারাগ্রাম ঘুরেও একটা ইটের বাড়ি দেখা গেল না। সবই কাঁচাঘর। হোগলার বেড়া, গোল পাতার চাল। এই গ্রামে নয়ন মিয়াদেরই যা একটু অবস্থা ভাল।
আচ্ছা নয়ন মিয়া! তুমি বলছিলে এখানে একটা নদী আছে?
Ñহ’ভাইজান। ঐ যে খালের মতো দেখতিছেন। খড়মা নদী। খুব সোরত ছিল এক সময়। নদী এত বড় ছিল যে এপার থেকে ওপার দেখা যেত না। আর এখন সেই নদীর এই হাল। কলি তো বিশ্বাস যাবেন না।
Ñমানুষজন তো দেখলাম না তেমন।
Ñদেখবেন কি! মানুষজন দুপুরে খাওয়ার পর আর তেমন বের হয় না। যদিও এ গ্রামে এখন পর্যন্ত বাঘ ঢোকেনি। আশপাশের গ্রামে বাঘ ঢুকে গরু, ছাগল, মানুষ নিয়ে গেছে। আমরা মাঝে মাঝে চিৎকার হট্টগোল শুনি। তখন সবাই মিলে চিৎকার করি। থালা বাসন পিটাই, টিন পিটাই। মশাল জ্বালাই। টিন পিটানির শব্দ শুনলি বাঘ ভয়ে চলে যায়।
বড় ভাইয়ার মুখ বেশ শুকনো দেখাচ্ছে। কাঁটাখালি আসার আগে তার ভেতরে যে একটা তেজী স্রোত দেখেছিলাম তা একেবারে থিতিয়ে গেছে। নয়ন মিয়ার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন সেই আদিম যুগে ফিরে গেছি। সন্ধ্যা লাগার অনেক আগেই আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
নয়ন মিয়ার মা ঘরে পোষা মুরগি জবাই করে ভাটেল চালের ভাত রান্না করেছে। ভাটেল চালের ভাতের সুগন্ধে সারাবাড়ি ম ম করছে। নয়নের মা নিজে পরিবেশন করে আমাদের খাওয়ালো। বয়সের তুলনায় তাকে একটু বেশি বয়সী দেখায়। মহিলার স্বামী ছিল গুণীন। লোকে বড় মানতো তাকে। কিন্তু সেই এত বড় গুণীনই বাঘের পেটে চলে গেল। খেতে খেতে সেই সব গল্পই শুনলাম। এইসব শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসছে।
আগে তারা থাকত বৈদ্যমারি। সেইখানে তখন খুব বাঘের উৎপাত চলছিল। ধুলোপড়া দিয়ে বাড়ি বন্ধ করে পরিবার নিয়ে গুণীন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। রাতের বেলা বাঘ এসে থাবা মারল গুণীনের কাঁধে। কিছু বুঝে উঠবার আগে কলজের ওপর পড়ল আর এক থাবা। জোয়ান তাগড়া মানুষটা ছটফট করতে লাগল বাঁচার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। নয়নের মা সেই থেকে বাঘবিধবা। সুন্দরবনে মাছ ধরতে অথবা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা বাঘের কবলে পড়ে মারা যায় তাদের স্ত্রীদের ‘বাঘবিধবা’ বলে। সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে অসংখ্য বাঘবিধবা পরিবার বাস করে।
এদিকে রাত যতই বাড়তে লাগল ততই ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। নয়ন মিয়া বলেছে, এখন পর্যন্ত এ গ্রামে বাঘ ঢোকেনি। কিন্তু তাতে কী! ঢুকতে কতক্ষণ! এখানে আসার পেছনে এ রকম সাহস দেখানোর জন্য বড় ভাইয়ার ওপর আমার ভীষণ রাগ হতে লাগল।
ঘুম আসছে না কিছুতেই। এমনিতেই আমার অচেনা জায়গায় ঘুম আসতে চায় না। তার ওপর চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরে অবশ্যি একটা হারিকেন জ্বলছে টিম টিম করে। সেই টিম টিমে আলোতেই পরিবেশটা আরো ভৌতিক হয়ে উঠেছে। পেঁচা ডাকছে খুব কাছ থেকে কোথাও। ভয়ে চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না। আমার শরীর ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে আর থেকে থেকে মেরুদ- দিয়ে শির শির করে কী যেন নেমে যাচ্ছে।
আমার পাশেই শুয়ে আছে বড় ভাইয়া। ঘুম এসেছে তার অনেকক্ষণ। এখন নাক ডাকছে ভীষণভাবে। তাতেই রাতটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। পাশেই লম্বা করে রেখে দিয়েছে তার পাখি শিকার করা ইয়ারগানটা। রাত কত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে রাত যে বেশ ভারি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। এক সময় চোখের পাতা একটু ভারি হয়ে আসে, বুঝি তন্দ্রা আসে। এমন সময় দূর থেকে একটা তীক্ষè শব্দে দ্রুত তন্দ্রাটা ছুটে গেল। চোখের পাতা খুলতেই মনে হলো হাজারটা জোনাকি জ্বলছে চোখের ভেতর। কানে আসছে লক্ষ ঢ্যাটরার শব্দ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে তুললাম। কিছু না বুঝেই গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুতে লাগল তার। প্রচ- ভয়ে হয়ত এ রকম করছেন। বিকেল বেলায় চোখমুখ শুকনো দেখা গেলেও কোথায় যেন একটু ভরসা দেখেছিলাম তার চেহারায়। অকারণে হাতের ইয়ারগানটা নাড়াচাড়া করছিলেন তখন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সত্যিই অকূল দরিয়ার মধ্যে পড়েছেন। ছটফট করতে করতে হঠাৎ পাশে রাখা ইয়ারগানটার ওপর হাত পড়তেই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। এর ভেতরেই নয়নের মা ঘরে ঢুকেছে। হারিকেনের আলো সতেজ করে দিয়েছে। নয়ন এসে জাপটে ধরেছে বড় ভাইয়াকে। আর পাগলের মতো চিৎকার করছেÑ ভাইজান আপনে বন্দুক নিছেন ক্যান হাতে? ঘরে চলেন, ঘরের ভিতরে চলেন। বলতে বলতে ঘরের ভেতরে টেনে-হিঁচড়ে ভাইয়াকে নিয়ে আসে।
Ñআরে পাগল হলে না কি? এ রকম করছ কেন? ছেড়ে দাও আমাকে। কোন ভয় নেই। আমার হাতে বন্দুক আছে।
নয়ন মিয়া সে কথায় কান দেয় না। ভাইয়াকে জাপটে ধরে বিছানায় বসাল। হারিকেনের আলোয় দেখা গেল নয়নের মা ভাইয়ার একটা হাত চেপে ধরে বসে আছে আর ঠক ঠক করে কাঁপছে। আমি ভয়ে জড়সড়, এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে চিৎকার, কান্নার শব্দ, কাঁসার থালা, টিন পিটানোর সম্মিলিত বিকট আওয়াজ কিছুটা দূরে সরে গেছে।
Ñতোমরা এ রকম করছ কেন? বড় ভাইয়া ধমকে উঠল। দরজায় আরও একটা খিল এঁটে নয়ন মিয়া বলল, ফুলি এক ঘটি পানি খাওয়া।
পানি নিয়ে এলো একটি মেয়েÑ অল্প বয়স, নথ পরা মুখে ছোট একটা ঘোমটা। ঘোমটার ভেতর থেকে তার আধখানা মুখ যেন রক্তশূন্য এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ। খুব ভয় পেয়েছে মেয়েটা। নয়ন মিয়ার বৌ ফুলি। গোলগাল দেখতে। পেটে বোধহয় সন্তান আছে। নয়ন মিয়ার যে বৌ আছে, বৌ এই বাড়িতেই থাকেÑ এতটা সময় তার কোন আভাসই পাওয়া যায়নি। গ- গ্রামের বৌঝিরা অচেনা মানুষের সামনে সহজে বের হয় না। কিন্তু আজ এই রাতের মুহূর্তের ঘটনা সব পর্দা টেনে তুলে ফেল দিল।
পানি খেয়ে সবাই কিছুটা ঠা-া হলো। নয়নের বৌ ফুলি অন্য ঘরে চলে গেল না। গায়ে মাথায় আরো বেশি করে কাপড় টানার প্রয়োজন বোধটাও যেন লোপ পেয়েছে তার। ঘরে দু’জন অপরিচিত মানুষ কিন্তু সে নির্লিপ্ত।
Ñভাইজান বন্দুক দিয়া কী করবেন? বাঘ মারবেন? বাঘ মারা নিষেধ আছে। সরকারের কড়া নিষেধ। বাঘ মারা দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু মানুষের জীবনের কী কোন মূল্য নাই? বাঘ যে মানুষ মারছে সেটা কেউ দেখবে না? বড় ভাইয়া রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। Ñনা, এইটা কোন অপরাধ না। বন বিভাগের সাহেবরা কইছে গ্রামে বাঘ ঢুকলি তাড়ায়ে দিতি হবে। মারা চলবে না। মারলি কোর্ট কাছারি হবে। শাস্তি হবে। শাস্তির ভয়ে আমরা হাত-পা গুটায়ে থাকি।
কটমট করে তাকিয়ে আছেন বড় ভাইয়া নয়ন মিয়ার দিকে যেন সব দোষ তার।
পরদিন স্থানীয় বনকর্তাদের সঙ্গে কথা হলো এই নিয়ে। তারা অবলীলায় জানাল বনে হরিণ, শূকর বা অন্য পশু শিকার করার চাইতে লোকালয়ে মানুষ ও গরু-ছাগল শিকার করা অনেক সহজ। খাওয়ার অভাবেই সহজ শিকারের লোভেই শুকনো নদী পার হয়ে বাঘ গ্রামে চলে আসে।
আর একজন জানালেন খুব আয়েশি ভঙ্গিতে সুন্দরবনের বাঘ সারাবিশ্বে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে পরিচিত করেছে। এই টাইগার তো আমাদের সংরক্ষণ করতেই হবে যে কোন মূল্যে।
Ñবাঘ মূল্যবান কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তার মূল্যটা কী মানুষের জীবন দিয়ে দিতে হবে? দিনের পর দিন জনপদ কী এইভাবে নিরাপদহীন হয়ে পড়বে? এর কি কোন প্রতিকার নেই? সরকার কোন ব্যবস্থা নেবে না? বড় ভাইয়ার শরীরের প্রায় অর্ধেকটাই ঝুঁকে আছে টেবিলের ওপর।
একজন অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন, সরকার ব্যবস্থা নেয়নি কে বলল? সরকার তো ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই ব্যবস্থা কাজে লাগানোর উপযুক্ত মানুষ নেই। সরকারী ভাষায় যাকে বলে ‘দক্ষ জনবল।’ বলতে বলতে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। হাসবারই কথা।
গ্রামে বাঘ ঢুকলে বাঘ অচেতন করার জন্য সেই মান্ধাতার আমলের দুইটা ট্রাংকুলাইজার গান আছে। কিন্তু তা চালানোর মতো দক্ষ মানুষ নেই। বুঝলেন ভাই সেই গান চালানোও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বনকর্তা ভদ্রলোক আমাদের চা অফার করলেন। চা খেতে খেতে আমরা জানতে চাইলাম কেমন ঝুঁকিপূর্ণ? এই ধরেন গিয়ে ৫০ ফুট দূরত্ব থেকে এই গান ব্যবহার করতে হয়। তা ছাড়া বাঘের বয়স, শক্তি, ওজন অনুমান করে এ্যাম্পুলের ডোজ ব্যবহার করতে হয়। তা না হলে বাঘের জ্ঞান ফিরবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। বুঝলেন ভাই সাহেব এই এ্যাম্পুলের দামও খুব চড়া। সবচেয়ে বড় কথা, এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা আর কাজে লাগে না। আমরা সরকারী লোক, আমাদেরও তো হাত-পা বাঁধা। তাই গ্রামের লোকদের বলিÑ বাঘ আসার আলামত পাইলে সবাই মিলে টিন, থালা-বাসন পিটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে বাঘকে বনে পাঠাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে।
আমরা বনকর্তার অফিস থেকে যখন বের হলাম, দেখি সূর্য মাথার ওপর। অফিসের সামনে অনেকটা জায়গা মাঠের মতো পড়ে আছে। তার এক দিকে একটা কালো বড় সাইনবোর্ডে লেখা ‘জঙ্গলের বাঘকে স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির সুযোগ দানই আইন। অহেতুক তাকে মারা বা বিরক্ত করা সম্পূর্ণ বেআইনী ও দ-নীয় অপরাধ।’ চমৎকার আইন। মানুষের অসহায়ত্বের কী প্রতিকার জানি না।
বাঘের কবলে পড়ে গত রাতে এক মা ও তার শিশু মারা গেছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে সেই বাড়িতে। পিতৃহারা অপর শিশু দুটি এবার মা হারা হলো। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে কিন্তু কোথায় কীভাবে তা পাওয়া যায় এদের জানা নেই। একটা মানুষের শূন্যতা কোন্ ক্ষতিপূরণে পূর্ণতা পায় তা আমার জানা নেই। একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস বুকটাকে আরো ভারি করে তুলল।
সব দেখেশুনে বড় ভাইয়া সহ্য করতে পারছিল না। পারলে এখনই নয়ন মিয়াকে সাথে নিয়ে চলে আসে ঢাকায়। নয়নের কাঁধে হাত রেখে বললেন, এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। তুমি মা বৌকে নিয়ে চলে আসো। আমি তোমার ব্যবস্থা করব। কোন চিন্তা করো না। আমাদের ঢাকার বাড়ির ঠিকানা দেয়া হলো তাকে। ১৯৯৯ সাল, সে আজ কত দিন হলো। তারপর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। কাঁটাখালির আর কোন খবর পাইনি। না কি নেইনি!
সকালে দুটো মানুষ বড় ভাইয়ার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তিনি হয়ত ভাল করে ওদের মুখের দিকে তাকানওনি। মনে হয় পোশাক-আশাক, গ্রাম থেকে আসা চেহারা দেখেই চট করে কিছু টাকা বের করে দিয়েছে পকেট থেকে সাহায্য হিসেবে।
কারণ ওরা তো সাহায্য মানে টাকা ছাড়া আর কিছু চায় না। এর চেয়ে বেশি ভাববার সময়ও তখন তার হাতে ছিল না তখন তার প্রচ- তাড়া। কথা বলবার সময় নেই। যেতে হবে সাভার। সেখানে পিকনিক, হৈহল্লা, আড্ডা, আনন্দ এইসব অপেক্ষা করছে।
আমাদের গাড়িটা একটা বাজে জায়গায় এসে জ্যামে আটকে গেল। সামনের সিট পকেট থেকে আজকের পেপারটা বের করলাম। দৃশ্যটা কিছুতেই চোখ থেকে সরাতে পারছি না। লোকটার চেহারা এক ঝলক দেখলেও খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাঁ মনে পড়ছে। নয়ন মিয়া। সঙ্গে নিশ্চয় তার বৌ ফুলি। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তাদের। একটা শুকিয়ে যাওয়া কলাগাছে কাপড় পেঁচানো। গোলগাল চেহারার যে ফুটফুটে বৌটির হাতের পানি খেয়ে এক ভয়াল রাতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া আমাদের বুকে আবার প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। এই কী সেই মেয়েটি! আমি আর ভাবতে পারছি না।
বড় ভাইয়া ওদের কথা দিয়ে এসেছিলেন কোন চিন্তা করো না। চলে এসো ওরা এসেছে। সেই কাঁটাখালি থেকে শহরের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে। আমার ভেতরের অস্থিরতা কাটানোর জন্য খবরের কাগজটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। এলোমেলো চোখ বুলাতে লাগালাম কাগজের ওপর। একটা জায়গায় নিজের অজান্তেই চোখ স্থির হয়ে গেল। ‘গত সন্ধ্যায় সুন্দরবনের বাঘ নদীপার হয়ে বনসংলগ্ন শ্যামনগরে চলে আসে। বাঘের আক্রমণে এক গৃহবধূসহ তিনজন নিহত ও একজন আহত হন। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে।’
No comments