গোপন পাগলামি by আতাউর রহমান
শেক্সপিয়র সম্পর্কে আমাকে পরপর দুটো টিভি অনুষ্ঠানে বলতে হয়েছে। শেক্সপিয়রকে সর্বকালের সেরা নাট্যকার বলা হয়। এই ধরনের উক্তি আমার কাছে অতিশয়োক্তি মনে হয়। কারণ আমি মনে করি, শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কোনো তুলনা না করাই ভালো। আমি কখনও বলতে চাইব না যে, রবীন্দ্রনাথ জার্মান কবি গ্যেটের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন, যদিও রবীন্দ্রনাথের কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক বেশি বিস্তৃত।
শেক্সপিয়রের একাধিক নাটকে আমরা যে জীবন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াই, তাতে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। শেক্সপিয়রের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। লর্ড ব্যারনসহ উচ্চবিত্তের মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-হতাশা তিনি যেমন জানতেন, তেমনি নিম্নবিত্তের কর্মজীবী মানুষদের মানসিকতাও তিনি সমভাবে জানতেন। সেজন্যই তিনি শক্তিমান নাট্যকার, যার নাটক তার তিরোধানের চারশ’র বেশি বছর পরে বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যমঞ্চে নিয়মিতভাবে অভিনীত হচ্ছে। আমাদের দেশের মঞ্চে তার ১০টির মতো নাটক বঙ্গানুবাদে অভিনীত হয়েছে। আমি ‘হ্যামলেট’ ও ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটক দুটির প্রসঙ্গ টেনে কথা বলছিলাম টিভির পর্দায়। আমাকে এই দুই নাটকের প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উত্থাপন করতে বলা হয়েছিল। পাঠক এই দুই নাটক সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞাত আছেন। কারণ দুটোই অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় নাটক। পরোক্ষভাবে ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’র ট্র্যাজেডি মানব মিলনের সপক্ষে কাজ করেছে। নায়ক-নায়িকা মৃত্যুর ভেতর দিয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, তাদের বিবদমান দুই গোত্রের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলিয়ে মিলন ঘটিয়েছেন। মূল্যটা অনেক বড়; কিন্তু মহেক অর্জন করতে হলে মানুষকে অনেক সময় এভাবে মূল্য দিতে হয়। এ কোনো আপ্তবাক্য নয়, জীবন সত্যেরই অঙ্গীভূত। প্রেমের বহু সংজ্ঞা আমরা জানি, কিন্তু শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে এ যুগল-প্রেমের এক অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়; যার তুল্য সংজ্ঞা আজকের আধুনিক যুগেও বিরল।
Love is smoke rais'd with the fume of
sighs;
Being purg'd, a fire sparkling in lovers'
eyes;
Being vex'd, a sea nourish'd with loving
tears.
What is it else? A madness most discreet,
A Choking gall and a preserving sweet.
গোপন পাগলামি! গূঢ়, গাঢ় ও রহস্যমণ্ডিত পাগলামি! এক অপূর্ব সংজ্ঞা।
দু’জন সৃজনশীল ব্যক্তি আমাকে কাঁদায়। এই দু’জনের জীবন উপাখ্যান দু’ধরনের; কিন্তু জীবনের পরিণতি বিয়োগান্তক। এদের একজন চিত্রকর ভিনসেন্ট ভেনগঘ। এই অনন্য শিল্পী বিত্তহীন ও প্রেমহীন অবস্থায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। আরেকজন হলেন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ভেনগঘের জীবনে তার জীবদ্দশায় কোনো জাগতিক প্রাপ্তি ছিল না, কিন্তু হেমিংওয়ের জীবনে জাগতিক প্রাপ্তির কোনো অভাব ছিল না। তিনি টগবগে দুরন্ত জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু ভেনগঘের মতো তিনিও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার জীবনের শেষ বছরগুলো বেদনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তার জীবন-সংঘাতগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করা যায়—একাধারে মানুষ ও লেখক, সাহসী এবং বোকা, প্রেমিক পুরুষ এবং রাগী স্বামী। হেমিংওয়ের লেখক জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ছিল সবচেয়ে সুফলা। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ লিখে পেলেন পুলিত্জার পুরস্কার। অক্টোবর ২৮, ১৯৫৪ সালে উনি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসটি পড়ে আমরা যেমন কম্পিত হয়েছি, তেমনি এই উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেখেও শিহরিত হয়েছি। বৃদ্ধের ভূমিকায় স্পেনসার ট্রেসির অভিনয় আজও মনে আছে। জীবন-সংগ্রাম ও জঙ্গমতার এমন সবল চিত্র পৃথিবীর কম উপন্যাসে পাওয়া যায়। আমাদের নাট্যকার সেলিম আল দীনকে সম্ভবত এই উপন্যাস প্রভাবিত করেছিল। তার নাটক ‘হাত হদাই’-এ আমরা জীবনযুদ্ধের চিত্র রূপকভাবে পাই এক বৃহত্ কচ্ছপের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। ১৯৪০ সালে লেখা ‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’ হেমিংওয়েকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে, উপন্যাসটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হাতে তুলে নেই; উপন্যাসের ওপর মুদ্রিত বিলেতের কবি জন ডানের কবিতার চারটি লাইন পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কবির কাব্যাংশেও ‘ফর হোম দ্য বেল টোলসে’র প্রসঙ্গ আছে। হেমিংওয়ের ছোট গল্পের সংখ্যাও কম নয়। তার লেখা আরেকটি বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়, যার চলচ্চিত্র রূপায়ণও দেখেছি। নাম—‘অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’। কবিতা, ছোট গল্প, চিঠিপত্র সঙ্কলন এবং সর্বোপরি ঔপন্যাসিক হিসেবে হেমিংওয়ে ছিলেন পেশাজীবী লেখক। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে এই বিশ্বখ্যাত লেখকের মানসিক বিকার ঘটে। ১৯৬১ সালের ২ জুলাই তিনি তার প্রিয় শর্টগান দিয়ে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। একজন আমেরিকানের প্রিয় দেশ ছিল কিউবা, এটাও তার ভালোলাগার একটি বৈশিষ্ট্যময় দিক। ‘ডেথ ইন দ্য আফটারনুন’ উপন্যাসের এক জায়গায় হেমিংওয়ে লিখেছেন—‘যে মানুষটি বহু বছর বেঁচেছে তার লক্ষ্মী স্ত্রীর সঙ্গে ঘর বেঁধে, তাকে ছেড়ে মানুষটি একাকিত্বের জগতে প্রবেশ করতে পারে সাধারণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে নয়, কেবল আত্মহননের ভেতর দিয়ে।’ সম্ভবত এই বিশ্বখ্যাত লেখক সব খ্যাতি ও প্রাপ্তিকে আত্মহননের মুহূর্তে অর্থহীন মনে করেছিলেন। হেমিংওয়ে আমাদের কীভাবে প্রিয় বস্তুকে প্রাণবাজি রেখে রক্ষা করতে হয় তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র বৃদ্ধ ও বালক তাদের ধৃত মাছকে হাঙ্গরের হাত থেকে রক্ষা করতে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। যে মহান লেখক একাধিক অপঘাতে মৃত্যুকে অতিক্রম করেছিলেন, তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন—এই হচ্ছে জীবনের প্রহসন।
লেখক : অভিনেতা-নাট্যকার
Love is smoke rais'd with the fume of
sighs;
Being purg'd, a fire sparkling in lovers'
eyes;
Being vex'd, a sea nourish'd with loving
tears.
What is it else? A madness most discreet,
A Choking gall and a preserving sweet.
গোপন পাগলামি! গূঢ়, গাঢ় ও রহস্যমণ্ডিত পাগলামি! এক অপূর্ব সংজ্ঞা।
দু’জন সৃজনশীল ব্যক্তি আমাকে কাঁদায়। এই দু’জনের জীবন উপাখ্যান দু’ধরনের; কিন্তু জীবনের পরিণতি বিয়োগান্তক। এদের একজন চিত্রকর ভিনসেন্ট ভেনগঘ। এই অনন্য শিল্পী বিত্তহীন ও প্রেমহীন অবস্থায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। আরেকজন হলেন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ভেনগঘের জীবনে তার জীবদ্দশায় কোনো জাগতিক প্রাপ্তি ছিল না, কিন্তু হেমিংওয়ের জীবনে জাগতিক প্রাপ্তির কোনো অভাব ছিল না। তিনি টগবগে দুরন্ত জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু ভেনগঘের মতো তিনিও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার জীবনের শেষ বছরগুলো বেদনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তার জীবন-সংঘাতগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করা যায়—একাধারে মানুষ ও লেখক, সাহসী এবং বোকা, প্রেমিক পুরুষ এবং রাগী স্বামী। হেমিংওয়ের লেখক জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ছিল সবচেয়ে সুফলা। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ লিখে পেলেন পুলিত্জার পুরস্কার। অক্টোবর ২৮, ১৯৫৪ সালে উনি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসটি পড়ে আমরা যেমন কম্পিত হয়েছি, তেমনি এই উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেখেও শিহরিত হয়েছি। বৃদ্ধের ভূমিকায় স্পেনসার ট্রেসির অভিনয় আজও মনে আছে। জীবন-সংগ্রাম ও জঙ্গমতার এমন সবল চিত্র পৃথিবীর কম উপন্যাসে পাওয়া যায়। আমাদের নাট্যকার সেলিম আল দীনকে সম্ভবত এই উপন্যাস প্রভাবিত করেছিল। তার নাটক ‘হাত হদাই’-এ আমরা জীবনযুদ্ধের চিত্র রূপকভাবে পাই এক বৃহত্ কচ্ছপের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। ১৯৪০ সালে লেখা ‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’ হেমিংওয়েকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে, উপন্যাসটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হাতে তুলে নেই; উপন্যাসের ওপর মুদ্রিত বিলেতের কবি জন ডানের কবিতার চারটি লাইন পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কবির কাব্যাংশেও ‘ফর হোম দ্য বেল টোলসে’র প্রসঙ্গ আছে। হেমিংওয়ের ছোট গল্পের সংখ্যাও কম নয়। তার লেখা আরেকটি বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়, যার চলচ্চিত্র রূপায়ণও দেখেছি। নাম—‘অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’। কবিতা, ছোট গল্প, চিঠিপত্র সঙ্কলন এবং সর্বোপরি ঔপন্যাসিক হিসেবে হেমিংওয়ে ছিলেন পেশাজীবী লেখক। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে এই বিশ্বখ্যাত লেখকের মানসিক বিকার ঘটে। ১৯৬১ সালের ২ জুলাই তিনি তার প্রিয় শর্টগান দিয়ে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। একজন আমেরিকানের প্রিয় দেশ ছিল কিউবা, এটাও তার ভালোলাগার একটি বৈশিষ্ট্যময় দিক। ‘ডেথ ইন দ্য আফটারনুন’ উপন্যাসের এক জায়গায় হেমিংওয়ে লিখেছেন—‘যে মানুষটি বহু বছর বেঁচেছে তার লক্ষ্মী স্ত্রীর সঙ্গে ঘর বেঁধে, তাকে ছেড়ে মানুষটি একাকিত্বের জগতে প্রবেশ করতে পারে সাধারণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে নয়, কেবল আত্মহননের ভেতর দিয়ে।’ সম্ভবত এই বিশ্বখ্যাত লেখক সব খ্যাতি ও প্রাপ্তিকে আত্মহননের মুহূর্তে অর্থহীন মনে করেছিলেন। হেমিংওয়ে আমাদের কীভাবে প্রিয় বস্তুকে প্রাণবাজি রেখে রক্ষা করতে হয় তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র বৃদ্ধ ও বালক তাদের ধৃত মাছকে হাঙ্গরের হাত থেকে রক্ষা করতে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। যে মহান লেখক একাধিক অপঘাতে মৃত্যুকে অতিক্রম করেছিলেন, তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন—এই হচ্ছে জীবনের প্রহসন।
লেখক : অভিনেতা-নাট্যকার
No comments