বন্দরে বর্জ্য তেল-দূষণমুক্ত উপকূল চাই
মংলা বন্দর সংলগ্ন এলাকার নদী ও সাগরে কথিত পোড়া তেল কতটা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, বৃহস্পতিবার সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আলোকচিত্রটিতেই তা স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা যথার্থই বলেছেন যে, মংলা ও পশুর নদীতে ভাসতে থাকা ওই রাসায়নিক আস্তরণ ওই এলাকার প্রাণী,
উদ্ভিদ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এভাবে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া তো বটেই, বন্দর এলাকায় পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ সামান্য মাত্রায় দীর্ঘদিন ধরে পানিতে দ্রবীভূত হলেও তা জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে হুমকি। জোয়ার-ভাটার অন্তর্ভুক্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষতির মাত্রা ও বিস্তৃতি আরও বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সতর্কতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাই তার প্রমাণ। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মংলা বন্দরের জেটিতে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজ এমভি বার্ন্ড থেকে গত মঙ্গলবার রাতে বিপুল পরিমাণ পোড়া তেল খালাস করে কয়েকটি নৌকায় তোলা হয়। মংলা শহরে আসার পথে ওইসব নৌকার একটি ডুবে গেলে কয়েক টন পোড়া তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, ওই রাসায়নিক পদার্থ এখন জোয়ার-ভাটায় সাগর ও নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, অরক্ষিত অবস্থায় এভাবে তেল খালাসে কি অনুমোদন ছিল? আমরা জানি, জাহাজে ব্যবহৃত তেলসহ যে কোনো ধরনের বর্জ্য বাংলাদেশের জলসীমায় খালাস করা বেআইনি। সেখানে খোদ জেটিতে 'পোড়া তেল' কীভাবে জাহাজ থেকে নামানো হলো আমাদের বোধগম্য নয়। পরিবহনের ক্ষেত্রেও যে সতর্কতার বালাই ছিল না, নিশ্চিত করেই বলা যায়। তা না হলে পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ পরিবহনে কীভাবে বিশেষ ধরনের জলযানের বদলে খোলা দেশীয় নৌকা ব্যবহৃত হয়। অবশ্য রাতের বেলায় যেভাবে ওই তরল রাসায়নিক খালাস ও পরিবহন করা হয়েছে, তাতে করে পুরো প্রক্রিয়ার বেআইনি চেহারাই স্পষ্ট। বন্দর ও উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের দূষণ প্রতিরোধে যে নজরদারি থাকা দরকার, সেটার অনুপস্থিতিও প্রকট। আমাদের মনে আছে, গত বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম উপকূলের সীতাকুণ্ড এলাকাতেও কমবেশি তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ও চারশ' ফুট প্রশস্ত একটি তৈলাক্ত স্তর ভাসতে দেখা গিয়েছিল। পরে গবেষণাগারে পরীক্ষা ও পরিবেশ অধিদফতরের তদন্তে বিদেশি একটি জাহাজ থেকে ৩৩০ টন বর্জ্য তেল সাগরে অবমুক্ত করার অঘটন আবিষ্কৃত হয়েছিল। আমরা মনে করি, ওই ঘটনার পর যদি উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হতো, তাহলে এবারের তেল দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো সম্ভব ছিল। বস্তুত আমাদের সমুদ্রসীমাকে পরিচ্ছন্ন ও জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ রাখতে হলে তরল দূষণ ঠেকানোর বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে দূষণের কারণে সাগরে মৎস্য সম্পদে টান পড়ছে বলে কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে। পরিস্থিতির আরও অবনতির আগেই সমুদ্র দূষণবিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বিদেশ থেকে আনা জাহাজের পাশাপাশি সীতাকুণ্ড এলাকায় গড়ে ওঠা জাহাজভাঙা ইয়ার্ড থেকেও উপকূলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তেল নির্গত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারেও সচেতনতা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি। সে কাজটি মংলায় সাম্প্রতিক দূষণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হবে বলে প্রত্যাশা।
No comments