ধর্ম- লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম by আবদুস সবুর খান
মাহে রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমত বা অনুগ্রহের, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত বা ক্ষমার, শেষ ১০ দিন দোজখের আগুন থেকে মুক্তির। এ মাসে মহান আল্লাহ্ রোজাদার মুমিন মুসলমানদের জন্য ‘লাইলাতুল কদর’ নামে এমন এক মহিমান্বিত রাত দান করেছেন, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।
মহান রাব্বুল আলামিন এ রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের একটি স্বতন্ত্র সূরায় তিনি এরশাদ করেন, ‘আমি একে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাঈল) তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই শান্তি ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সূরা কদর, আয়াত ১-৫)
এই সূরার শানে নুজুল সম্পর্কে হজরত ইবনে হাতেম (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) বনি-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেনি। সাহাবিরা এ কথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে রাসুল (সা.)-এর উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। হজরত ইবনে জরির (রহ.) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন, বনি-ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতেন এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকতেন। তিনি এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তাআলা সূরা কদর নাজিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
কদরের এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণেই একে ‘লাইলাতুল কদর’ তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। কদরের আরেক অর্থ তকদির এবং আদেশও হয়ে থাকে। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদের লিখে দেওয়া হয়। এমনকি, এ বছর কে হজ করবে, তা-ও লিখে দেওয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উক্তি অনুযায়ী চারজন ফেরেশতাকে এসব কাজে সোপর্দ করা হয়। তাঁরা হলেন: ইসরাফিল, মিকাঈল, আজরাঈল ও জিবরাঈল। (কুরতুবি)
হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, এই রাতে জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজ অথবা জিকিরে মশগুল থাকেন, তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, সারা জমিনে কাঁকর কুচি যত—তার চেয়েও অধিক ফেরেশতা এই রাতে অবতরণ করেন। (ইবনে খুযায়মা)
কোরআন পাকের সুস্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে লাইলাতুল কদর রমজান মাসেই। তবে এর সঠিক তারিখ সম্পর্কে আলেমদের বিভিন্ন উক্তি বা মত রয়েছে, যা সংখ্যায় ৪০ পর্যন্ত পৌঁছে। তাফসিরে মাজহারির ভাষ্যমতে, এসব উক্তির নির্ভুল তথ্য এই যে লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে আসে কিন্তু এরও কোনো তারিখ নির্দিষ্ট নেই। বরং যেকোনো রাতেই হতে পারে। প্রত্যেক রমজানে তা পরিবর্তিতও হয়। সহিহ্ হাদিসদৃষ্টে এই ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন ও পরিবারবর্গকেও জাগাতেন এবং কোমর কষে বাঁধতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) অনেকে রমজান মাসের ২৭তম রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ইমাম আবু হানিফার (র.) অবস্থান এই মতের পক্ষে। তবে যদি লাইলাতুল কদরকে রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে ঘূর্ণায়মান এবং প্রতি রমজানে পরিবর্তনশীল মেনে নেওয়া যায়, তাহলে এর দিন-তারিখ সম্পর্কিত হাদিসগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না।
আপাতদৃষ্টিতে লক্ষ করলে দেখা যায়, চান্দ্রমাসের শেষ ১০ দিন কৃষ্ণপক্ষ; লগ্ন হিসেবে এটি তেমন শুভ নয়। অপর দিকে জাহেলি যুগেও আরব দেশে এসব মাস ধরেই বর্ষ গণনা করা হতো। তখনো রমজান মাস ছিল। তবে আরবদের কাছে এর তেমন গুরুত্ব ছিল না। তারা জাহেলি যুগে মহরম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ—এই চার মাসকে শাহরুল হারাম বা পবিত্র মাস হিসেবে গণনা করত। এই মাসগুলোতে তারা কোনো প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ আরম্ভ করত না। এমনকি চলমান যুদ্ধও এই মাসগুলোতে স্থগিত ঘোষণা করা হতো। পবিত্র কোরআন নাজিলের পরই রমজান মাসের এবং লাইলাতুল কদরের এত গুরুত্ব বেড়েছে। পবিত্র কোরআন নাজিলই এর মূল কারণ। কোরআনের সংস্পর্শে এসে কৃষ্ণপক্ষের একটি রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেয়েছে। পবিত্র কোরআনের সংস্পর্শে এসে আরবের সবচেয়ে বর্বর জাতি বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য, পরিশীলিত ও শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। আজও যদি আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষাগুলো অনুশীলন করতে পারি, তাহলে মহান আল্লাহ্ও আমাদের লাইলাতুল কদরের মতো শ্রেষ্ঠ মানবগোষ্ঠীতে পরিণত করবেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদরের সেই সৌভাগ্য নসিব করুন।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
এই সূরার শানে নুজুল সম্পর্কে হজরত ইবনে হাতেম (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) বনি-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেনি। সাহাবিরা এ কথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে রাসুল (সা.)-এর উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। হজরত ইবনে জরির (রহ.) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন, বনি-ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতেন এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকতেন। তিনি এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তাআলা সূরা কদর নাজিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
কদরের এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণেই একে ‘লাইলাতুল কদর’ তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। কদরের আরেক অর্থ তকদির এবং আদেশও হয়ে থাকে। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদের লিখে দেওয়া হয়। এমনকি, এ বছর কে হজ করবে, তা-ও লিখে দেওয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উক্তি অনুযায়ী চারজন ফেরেশতাকে এসব কাজে সোপর্দ করা হয়। তাঁরা হলেন: ইসরাফিল, মিকাঈল, আজরাঈল ও জিবরাঈল। (কুরতুবি)
হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, এই রাতে জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজ অথবা জিকিরে মশগুল থাকেন, তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, সারা জমিনে কাঁকর কুচি যত—তার চেয়েও অধিক ফেরেশতা এই রাতে অবতরণ করেন। (ইবনে খুযায়মা)
কোরআন পাকের সুস্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে লাইলাতুল কদর রমজান মাসেই। তবে এর সঠিক তারিখ সম্পর্কে আলেমদের বিভিন্ন উক্তি বা মত রয়েছে, যা সংখ্যায় ৪০ পর্যন্ত পৌঁছে। তাফসিরে মাজহারির ভাষ্যমতে, এসব উক্তির নির্ভুল তথ্য এই যে লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে আসে কিন্তু এরও কোনো তারিখ নির্দিষ্ট নেই। বরং যেকোনো রাতেই হতে পারে। প্রত্যেক রমজানে তা পরিবর্তিতও হয়। সহিহ্ হাদিসদৃষ্টে এই ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে তা অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন ও পরিবারবর্গকেও জাগাতেন এবং কোমর কষে বাঁধতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) অনেকে রমজান মাসের ২৭তম রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ইমাম আবু হানিফার (র.) অবস্থান এই মতের পক্ষে। তবে যদি লাইলাতুল কদরকে রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে ঘূর্ণায়মান এবং প্রতি রমজানে পরিবর্তনশীল মেনে নেওয়া যায়, তাহলে এর দিন-তারিখ সম্পর্কিত হাদিসগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না।
আপাতদৃষ্টিতে লক্ষ করলে দেখা যায়, চান্দ্রমাসের শেষ ১০ দিন কৃষ্ণপক্ষ; লগ্ন হিসেবে এটি তেমন শুভ নয়। অপর দিকে জাহেলি যুগেও আরব দেশে এসব মাস ধরেই বর্ষ গণনা করা হতো। তখনো রমজান মাস ছিল। তবে আরবদের কাছে এর তেমন গুরুত্ব ছিল না। তারা জাহেলি যুগে মহরম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ—এই চার মাসকে শাহরুল হারাম বা পবিত্র মাস হিসেবে গণনা করত। এই মাসগুলোতে তারা কোনো প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ আরম্ভ করত না। এমনকি চলমান যুদ্ধও এই মাসগুলোতে স্থগিত ঘোষণা করা হতো। পবিত্র কোরআন নাজিলের পরই রমজান মাসের এবং লাইলাতুল কদরের এত গুরুত্ব বেড়েছে। পবিত্র কোরআন নাজিলই এর মূল কারণ। কোরআনের সংস্পর্শে এসে কৃষ্ণপক্ষের একটি রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেয়েছে। পবিত্র কোরআনের সংস্পর্শে এসে আরবের সবচেয়ে বর্বর জাতি বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য, পরিশীলিত ও শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। আজও যদি আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষাগুলো অনুশীলন করতে পারি, তাহলে মহান আল্লাহ্ও আমাদের লাইলাতুল কদরের মতো শ্রেষ্ঠ মানবগোষ্ঠীতে পরিণত করবেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদরের সেই সৌভাগ্য নসিব করুন।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
No comments