১১ মন্ত্রী, ৪৮ সাংসদকে সংরক্ষিত কোটায় প্লট

মহাজোট সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী মিলে ১১ জনকে সংরক্ষিত কোটায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট দিয়েছে সরকার। একই কোটায় অন্তত ৪৮ জন সাংসদকেও প্লট দেওয়া হয়েছে।রাজউকের বরাদ্দবিধির ১৩/এ ধারায় এই সংরক্ষিত কোটা সৃষ্টি করা হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সময়ে।


জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন, কিন্তু রাজধানীতে থাকার মতো বাড়ি বা জমি নেই—এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্লট দিতে এই ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দপ্রাপ্ত এই মন্ত্রী-সাংসদদের অনেকেরই নিজের ও স্ত্রীর নামে ঢাকায় জমি বা বাড়ি আছে। যেমন, ১১ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অন্তত চারজন আগে থেকেই ঢাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট-প্লটের মালিক। এঁদেরকে ১০ কাঠার একটি করে প্লট দেওয়া হয়েছে।
সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রীরা হচ্ছেন: দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রী পদমর্যাদা) মসিউর রহমানও ১০ কাঠার প্লট পেয়েছেন পূর্বাচল প্রকল্পে। প্লট পাওয়া প্রতিমন্ত্রীরা হচ্ছেন: আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আফছারুল আমীন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন। অন্যজন হচ্ছেন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
একই কোটায় ৪৮ জন সাংসদকেও প্লট দেওয়া হয়েছে। এঁদের অনেকেরই আগে থেকে ঢাকায় বাড়ি-ফ্ল্যাট আছে। যাঁদের তা নেই, তাঁরা প্লটের জন্য আবেদন করলেই মন্ত্রী-সাংসদদের কোটায় প্লট পেতেন। তা সত্ত্বেও সংরক্ষিত কোটায় এই মন্ত্রী-সাংসদদের প্লট দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
রাজউকের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, ওই মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে অনেকেরই নিজের অথবা পরিবারের অন্য কারও নামে উত্তরা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি প্রভৃতি এলাকায় আগেও প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাট থাকলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্লট পাওয়ার জন্য আবেদন করা যায় না। প্লট পেতে হলে আবেদনের সঙ্গে ঢাকায় নিজের অথবা পরিবারের অন্য কারও নামে জমি বা ফ্ল্যাট নেই—এই মর্মে ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি হলফনামা দিতে হয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সময়ে ১৩/এ ধারায় প্রথম ৪৫ জনের নামে প্লট বরাদ্দ করা হয়। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩৬ জন ছিলেন যেকোনো বিবেচনায় রাজউকের প্লট পাওয়ার উপযুক্ত। বাকি নয়জন তেমন ছিলেন না। এমনকি তাঁদের অনেকের নাম-পরিচয়ও সমাজে সুবিদিত ছিল না। এই কারণে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপির সরকার ওই প্লটগুলোর বরাদ্দ স্থগিত রাখে এবং একটি মামলা রুজু করে। এখন পর্যন্ত সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। তবে ইতিমধ্যে বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের অনেকে আলাদাভাবে হাইকোর্টে রিট করে প্লট বুঝে নিয়েছেন।
এরপর ১৩/এ ধারায় জাতীয় দলের ক্রিকেটার এবং জাতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য কয়েকজনকে প্লট দেওয়া হয়। এবারই কেবল মন্ত্রী-সাংসদদের এই সংরক্ষিত কোটায় রাজউকের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
যাঁদের আগে থেকেই আছে: সংরক্ষিত কোটায় ১০ কাঠার প্লট পাওয়া মন্ত্রীদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, ঢাকার ৪৬/৩ নম্বর জিগাতলায় তাঁর নিজস্ব বাড়ি আছে। গতকাল প্লট পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমি এমপি হিসেবে আবেদন করেছি এবং প্লট পেয়েছি। এর আগে কোনো প্লট আমি পাইনি।’
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের হলফনামায় স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে ১০ কাঠা এবং আনন্দনগরে দেড় কাঠা জমি থাকার তথ্য দেওয়া আছে। গত রাতে যোগাযোগ করা হলে নৌমন্ত্রী বলেন, এমপি কোটায় তিনি প্লট পেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, ঢাকায় তাঁর কোনো প্লট-ফ্ল্যাট নেই।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের হলফনামায় ঢাকায় তাঁর বাড়িঘর সম্পর্কে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই।
তবে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ ইসিতে দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, উত্তরা মডেল টাউনে তাঁর চার কাঠার একটি প্লট আছে। বনানীতে তিনি পৈতৃক বাড়ির অংশীদার। তাঁর স্ত্রী গুলশান, ধানমন্ডি ও এলিফ্যান্ট রোডে তিনটি পৈতৃক বাড়ির অংশীদার।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের হলফনামার তথ্য, ঢাকায় তিনি পৈতৃক বাড়ির অংশীদার।
প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা জনপ্রতিনিধি না হওয়ায় ঢাকায় নিজস্ব বাড়িঘর সম্পর্কে তাঁদের কোনো হলফনামা নেই নির্বাচন কমিশনে।
শিল্পমন্ত্রীর পরিবারে তিনটি প্লট: শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া উত্তরায় পাঁচ কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আবেদন করে। তবে তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি বড়ুয়ার নামে পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি এবং তাঁদের আমেরিকাপ্রবাসী মেয়ে উপমা বড়ুয়ার (বিবাহিত) নামে তিন কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে ১৩/এ ধারায়, সংরক্ষিত কোটায়।
জানতে চাইলে দিলীপ বড়ুয়া তিনি ও তাঁর পরিবারের তিনটি প্লট পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বিবেকের তাড়নায় আমার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ করা প্লটটি ফেরত দিয়েছি। এখন আমার প্লট পাওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমারটাও দিয়ে দেব।’
এ ছাড়া, শিল্পমন্ত্রীর ভাই ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া এবং ভাইয়ের ছেলে ডা. অলক বড়ুয়ার নামেও সরকার সংরক্ষিত কোটায় দুটি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। প্রথমটি পাঁচ কাঠার ও পরেরটি তিন কাঠার।
সাংসদ: পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম মুক্তাদির চৌধুরী সাংসদ হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুনের নামে উত্তরা ও গাজীপুরে আট কাঠা ১১ ছটাক জমি আছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে মুক্তাদির চৌধুরী এই তথ্য উল্লেখ করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি পূর্বাচলে প্লট পেয়েছেন।
মুক্তাদির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বরাদ্দ পেয়েছি। তবে এটা নেব কি না, তা এখনো ভাবিনি। আমার মনে হচ্ছে, এটা নেব না।’
ঝালকাঠির সাংসদ বজলুল হক হারুণের বনানীতে ছয়তলা বাড়ি আছে। এ ছাড়া বনানীতে ২৩২ বর্গফুটের দোকান, মিরপুরে পাঁচ কাঠা জমি, বারিধারায় ছয় কাঠা জমি এবং বনানীতে তাঁর স্ত্রীর নামে অনাবাসিক ইমারত আছে। এই সাংসদও পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি নিয়েছেন।
রাজশাহীর সাংসদ এনামুল হকের আদাবরে পাঁচ কাঠা জমির ওপর ভবন আছে। একই এলাকায় তাঁর আরও চার কাঠা জমি আছে। তিনি আবাসন ব্যবসাও করেন। তিনিও পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠা জমি বরাদ্দ নিয়েছেন।
বরগুনার সাংসদ গোলাম সবুরের মগবাজার এলাকায় ৪ দশমিক ৩৯ কাঠার জমির ওপর ভবন আছে। তিনি সাড়ে সাত কাঠার প্লট নিয়েছেন। নীলফামারীর সাংসদ মারুফ সাকলানের নিউ ডিওএইচএসে চারতলা বাড়ি আছে। তিনি পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠা জমি নিয়েছেন।
১৩/এ ধারায় ১০ কাঠার প্লট পেয়েছেন যে সাংসদেরা
আবদুল মান্নান, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, জহিরুল হক ভূঁইয়া, বজলুল হক হারুন, তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং, মুজিবুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান, শওকত মোমেন শাহজাহান, এম এ জব্বার, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, র. আ. ম. উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, ফজিলাতুননেসা বাপ্পী, আবদুল মতিন খসরু, আলহাজ মমতাজ বেগম।
সাড়ে সাত কাঠা পেয়েছেন যে সাংসদেরা
সানজীদা খানম, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, এ কে এম ফজলুল হক, মীর শওকত আলী বাদশা, জাকির হোসেন, বেগম নাসরিন জাহান রত্না, এথিন রাখাইন, এনামুল হক, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, এ বি এম আনোয়ারুল হক, সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, মিসেস আমেনা আহমেদ, কবিরুল হক, কে এইচ রশীদুজ্জামান, মোস্তাক আহমেদ রুহি, মিসেস চেমন আরা বেগম, শাহীন মনোয়ারা হক, গোলাম সবুর, আ. মজিদ খান, ওমর ফারুক চৌধুরী, মারুফ সাকলান, শেখ মুজিবুর রহমান, আলী আশরাফ, তাজুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, রওশন জাহান সাথী, এম এস আকবর, এম আবদুল লতিফ, সোহরাব আলী খান, শেখ আফিল উদ্দিন, মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী, নূরুন্নবী চৌধুরী, হাবিবুর রহমান মোল্লা, বেগম শবনম জাহান।

No comments

Powered by Blogger.