তামাকজাত দ্রব্য- সংশোধিত ও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন চাই by ফরিদা আখতার
কিছু পরিসংখ্যান খুব কষ্ট দেয়, যেমন—তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রতিবছর ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে এবং তিন লাখ ৮২ হাজার জন পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। এই সংখ্যা প্রতিবছরের। ১০ বছরের হিসাব নিলে মাথা ঘুরে যাবে।
আবার নিজে ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপানের কারণে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এক কোটি ১৫ লাখ মানুষ। বাড়িঘর, রাস্তাঘাটের হিসাব নিলে এই সংখ্যা দু-তিন গুণ বেড়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এর শিকার প্রধানত নারী।
বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করে। এই তথ্য ভয়াবহ! যে বয়সে মানুষ সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম থাকবে, সেই বয়স থেকে তামাক সেবন শুরু করে অতি অল্প বয়সে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে। একটি পরিবারে একজনের মৃত্যু হলে সেই পরিবারের সব সদস্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বছরে ৫৭ হাজারকে পাঁচ দিয়ে গুণ দিলে দেখতে পাই, দুই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একইভাবে পঙ্গুত্ব বরণকারীদের পরিবারের ভোগান্তি কোনো অংশে কম নয়।
তামাক সেবন মানে আমরা প্রায়ই সিগারেট ও বিড়ি খাওয়াকেই ধরে নিই। ধনী ও মধ্যবিত্ত ব্যক্তিরা নানা ব্র্যান্ডের সিগারেট টান দেয় আর গরিব মানুষ ফুঁকে বিড়ি। উভয়কেই আমরা ধূমপায়ী বলে চিনি। পরিসংখ্যান দেখে অবাক হই যে যারা ১৫ বছর বয়স পার করেছে, এমন পুরুষের ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ ধূমপান করে আর মেয়েরা করে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ—যারা এই পণ্যের ব্যবসা করেন, তাঁদের চোখ এখন আধুনিক ও শিক্ষিত মেয়েদের দিকে। এই ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। তবে আশার কথা যে ধূমপানের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন সচেতনতা বেড়েছে যে কেউ আর প্রকাশ্যে বলে না যে সে ধূমপান করে, বরং যারা ধূমপান ছেড়েছে এবং যারা কোনো দিন একটি সিগারেটও হাতে নেয়নি, তাদের নৈতিক শক্তি অনেক বেশি। ড্রয়িং রুমে অ্যাশট্রে এখন থাকে না, উপহার হিসেবে লাইটার দেয়াও হয় না। ধূমপান করলে বাইরে গিয়ে করতে হয়। ধূমপান যে ভালো নয়, এমনকি ভদ্রতাও নয়, সে কারণেই এই লুকোচুরি। এক্সকিউজ মি!
অন্যদিকে, ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য, যেমন—জর্দা, গুল, সাদা পাতা বা আলাপাতা, নস্যি খৈনীসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে রয়েছে, তবে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার পুরুষের মধ্যে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর নারীর মধ্যে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বলা বাহুল্য, গরিব নারীর সংখ্যাই বেশি। তাঁরা জানতেও পারেন না যে পানের সঙ্গে জর্দা খেয়ে কী সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! কয়েক দিন আগে তামাকবিরোধী চিকিৎসক সংগঠন ‘উফাত’ আয়োজিত একটি সভায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসারত দুজন জর্দা ও গুল সেবনকারীকে আনা হয়েছিল। তাঁদের মুখের ক্যানসারের অবস্থা এবং তাঁদের কষ্টের কথা শুনে অংশগ্রহণকারীদের চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। সভায় প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, নীতিনির্ধারকদের কাছে তাঁদের নিতে পারলে হয়তো বিষয়টির প্রতি তাঁরাও মনোযোগী হতেন।
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে নানা রকম রোগ, যেমন—হূদেরাগ, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, ফুসফুসের ক্যানসার, ফুসফুসের যক্ষ্মা, মুখের, স্বরযন্ত্রের ও শ্বাসনালির ক্যানসার ও ক্ষতিগ্রস্ত মাড়ি এবং বিশেষ করে নারীদের নানা ধরনের প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে। গর্ভবতী নারী সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারছেন না। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া, কম ওজনসম্পন্ন শিশুর জন্ম দেওয়া—এমনকি গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যুও ঘটছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায়, ফুসফুসের ক্যানসারের ৮৫ শতাংশ কারণ ধূমপান এবং পুরুষের মধ্যে ক্যানসারসংক্রান্ত মৃত্যুর ২১ শতাংশ ঘটে এই কারণে। অন্যদিকে, নানা ধরনের ক্যানসারের মধ্যে মুখের ক্যানসারের পরিমাণ ১৩ শতাংশ, যা জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য সেবনের কারণে ঘটে। অন্য ধরনের ক্যানসারের সঙ্গেও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাওয়া তথ্য থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ ক্যানসার কমানো যাবে শুধু তামাকদ্রব্য সেবন বন্ধ করাতে পারলে।
বিড়ির কারখানায় যারা কাজ করে, সেই ৬৫ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুশ্রমিক যেন মৃত্যুকূপের মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। ‘বাংলাদেশে বিড়ি: মিথ ও বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই শ্রমিকেরা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারখানার ভেতরের পরিবেশ তামাকের ধুলায় আচ্ছাদিত আর নারী, শিশুসহ বিড়িশ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কাশি, যক্ষ্মা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি রোগে তারা আক্রান্ত হতে থাকে।
আরও আছে তামাকচাষের কথা। কৃষিজমিতে তামাকপাতার চাষ কুষ্টিয়া ও এর আশপাশের জেলায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে খাদ্যসংকট সৃষ্টি করেছে, বন ধ্বংস করেছে, মাটি ও পানি নষ্ট হচ্ছে—সামগ্রিকভাবে কৃষকেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি আইন আছে, তার নাম, ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’। আইনটি হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কনট্রোলে (এফসিটিসি) বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন, ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু আইন প্রণয়নের পর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর দুর্বল দিকগুলো ধরা পড়ে। তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও সংস্থায় দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত আলোচনা করে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে এই আইনে এফসিটিসির অনেকগুলো শর্ত পুরোপুরি পালন করা হয়নি। তাই এফসিটিসির আলোকে সংশোধন করে আইনটি আরও কার্যকর করা সম্ভব। বর্তমান আইনটির দুর্বলতা এমন পর্যায়ে আছে যে একে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন বলা যায়। নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ—উভয়ভাবেই ক্ষতির শিকার। তাই তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) জাতীয় সংসদের নারী সাংসদদের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছেও আমাদের প্রত্যাশা, নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য তারা উদ্যোগ নেবে। সংশোধনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা এই অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু বলতে চাই, তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা মনে করেন, সংশোধিত আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু একই সঙ্গে যাঁরা এই পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও তৎপর রয়েছেন আইনটিকে দুর্বল রেখে দেওয়ার জন্য। তাঁদের পক্ষ থেকে যুক্তির একটি মাত্র হাতিয়ার হচ্ছে, কোম্পানিগুলো বছরে একটি বড় অঙ্কের ভ্যাট রাজস্ব খাতে দেয়, এত রোগ সৃষ্টির বিনিময়ে! বাহ্, এই যুক্তি দেখিয়ে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে আইনের সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করে! তাই দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধনসহ প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ সভার অনুমোদন লাভ করতে পারছে না। আমরা আশা করব, আগামী যেকোনো সভায় প্রস্তাবিত সংশোধনী, যা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে, পরিবেশ রক্ষা হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে, তেমন সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পাওয়া যাবে, যেন আগামী সংসদ অধিবেশনে সংশোধিত আইনটি পাস হতে পারবে। দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? ঈদের আগে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য একটি সংশোধিত আইনের অনুমোদন আমাদের দারুণ অনুপ্রাণিত করবে, এটাই আমাদের ঈদের উপহার ধরে নেব।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী।
বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করে। এই তথ্য ভয়াবহ! যে বয়সে মানুষ সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম থাকবে, সেই বয়স থেকে তামাক সেবন শুরু করে অতি অল্প বয়সে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে। একটি পরিবারে একজনের মৃত্যু হলে সেই পরিবারের সব সদস্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বছরে ৫৭ হাজারকে পাঁচ দিয়ে গুণ দিলে দেখতে পাই, দুই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একইভাবে পঙ্গুত্ব বরণকারীদের পরিবারের ভোগান্তি কোনো অংশে কম নয়।
তামাক সেবন মানে আমরা প্রায়ই সিগারেট ও বিড়ি খাওয়াকেই ধরে নিই। ধনী ও মধ্যবিত্ত ব্যক্তিরা নানা ব্র্যান্ডের সিগারেট টান দেয় আর গরিব মানুষ ফুঁকে বিড়ি। উভয়কেই আমরা ধূমপায়ী বলে চিনি। পরিসংখ্যান দেখে অবাক হই যে যারা ১৫ বছর বয়স পার করেছে, এমন পুরুষের ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ ধূমপান করে আর মেয়েরা করে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ—যারা এই পণ্যের ব্যবসা করেন, তাঁদের চোখ এখন আধুনিক ও শিক্ষিত মেয়েদের দিকে। এই ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। তবে আশার কথা যে ধূমপানের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন সচেতনতা বেড়েছে যে কেউ আর প্রকাশ্যে বলে না যে সে ধূমপান করে, বরং যারা ধূমপান ছেড়েছে এবং যারা কোনো দিন একটি সিগারেটও হাতে নেয়নি, তাদের নৈতিক শক্তি অনেক বেশি। ড্রয়িং রুমে অ্যাশট্রে এখন থাকে না, উপহার হিসেবে লাইটার দেয়াও হয় না। ধূমপান করলে বাইরে গিয়ে করতে হয়। ধূমপান যে ভালো নয়, এমনকি ভদ্রতাও নয়, সে কারণেই এই লুকোচুরি। এক্সকিউজ মি!
অন্যদিকে, ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য, যেমন—জর্দা, গুল, সাদা পাতা বা আলাপাতা, নস্যি খৈনীসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে রয়েছে, তবে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার পুরুষের মধ্যে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর নারীর মধ্যে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বলা বাহুল্য, গরিব নারীর সংখ্যাই বেশি। তাঁরা জানতেও পারেন না যে পানের সঙ্গে জর্দা খেয়ে কী সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! কয়েক দিন আগে তামাকবিরোধী চিকিৎসক সংগঠন ‘উফাত’ আয়োজিত একটি সভায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসারত দুজন জর্দা ও গুল সেবনকারীকে আনা হয়েছিল। তাঁদের মুখের ক্যানসারের অবস্থা এবং তাঁদের কষ্টের কথা শুনে অংশগ্রহণকারীদের চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। সভায় প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, নীতিনির্ধারকদের কাছে তাঁদের নিতে পারলে হয়তো বিষয়টির প্রতি তাঁরাও মনোযোগী হতেন।
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে নানা রকম রোগ, যেমন—হূদেরাগ, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, ফুসফুসের ক্যানসার, ফুসফুসের যক্ষ্মা, মুখের, স্বরযন্ত্রের ও শ্বাসনালির ক্যানসার ও ক্ষতিগ্রস্ত মাড়ি এবং বিশেষ করে নারীদের নানা ধরনের প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে। গর্ভবতী নারী সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারছেন না। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া, কম ওজনসম্পন্ন শিশুর জন্ম দেওয়া—এমনকি গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যুও ঘটছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায়, ফুসফুসের ক্যানসারের ৮৫ শতাংশ কারণ ধূমপান এবং পুরুষের মধ্যে ক্যানসারসংক্রান্ত মৃত্যুর ২১ শতাংশ ঘটে এই কারণে। অন্যদিকে, নানা ধরনের ক্যানসারের মধ্যে মুখের ক্যানসারের পরিমাণ ১৩ শতাংশ, যা জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য সেবনের কারণে ঘটে। অন্য ধরনের ক্যানসারের সঙ্গেও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাওয়া তথ্য থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ ক্যানসার কমানো যাবে শুধু তামাকদ্রব্য সেবন বন্ধ করাতে পারলে।
বিড়ির কারখানায় যারা কাজ করে, সেই ৬৫ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুশ্রমিক যেন মৃত্যুকূপের মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। ‘বাংলাদেশে বিড়ি: মিথ ও বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই শ্রমিকেরা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারখানার ভেতরের পরিবেশ তামাকের ধুলায় আচ্ছাদিত আর নারী, শিশুসহ বিড়িশ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কাশি, যক্ষ্মা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি রোগে তারা আক্রান্ত হতে থাকে।
আরও আছে তামাকচাষের কথা। কৃষিজমিতে তামাকপাতার চাষ কুষ্টিয়া ও এর আশপাশের জেলায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে খাদ্যসংকট সৃষ্টি করেছে, বন ধ্বংস করেছে, মাটি ও পানি নষ্ট হচ্ছে—সামগ্রিকভাবে কৃষকেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি আইন আছে, তার নাম, ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’। আইনটি হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কনট্রোলে (এফসিটিসি) বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন, ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু আইন প্রণয়নের পর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর দুর্বল দিকগুলো ধরা পড়ে। তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও সংস্থায় দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত আলোচনা করে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে এই আইনে এফসিটিসির অনেকগুলো শর্ত পুরোপুরি পালন করা হয়নি। তাই এফসিটিসির আলোকে সংশোধন করে আইনটি আরও কার্যকর করা সম্ভব। বর্তমান আইনটির দুর্বলতা এমন পর্যায়ে আছে যে একে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন বলা যায়। নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ—উভয়ভাবেই ক্ষতির শিকার। তাই তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) জাতীয় সংসদের নারী সাংসদদের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছেও আমাদের প্রত্যাশা, নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য তারা উদ্যোগ নেবে। সংশোধনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা এই অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু বলতে চাই, তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা মনে করেন, সংশোধিত আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু একই সঙ্গে যাঁরা এই পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও তৎপর রয়েছেন আইনটিকে দুর্বল রেখে দেওয়ার জন্য। তাঁদের পক্ষ থেকে যুক্তির একটি মাত্র হাতিয়ার হচ্ছে, কোম্পানিগুলো বছরে একটি বড় অঙ্কের ভ্যাট রাজস্ব খাতে দেয়, এত রোগ সৃষ্টির বিনিময়ে! বাহ্, এই যুক্তি দেখিয়ে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে আইনের সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করে! তাই দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধনসহ প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ সভার অনুমোদন লাভ করতে পারছে না। আমরা আশা করব, আগামী যেকোনো সভায় প্রস্তাবিত সংশোধনী, যা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে, পরিবেশ রক্ষা হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে, তেমন সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পাওয়া যাবে, যেন আগামী সংসদ অধিবেশনে সংশোধিত আইনটি পাস হতে পারবে। দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? ঈদের আগে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য একটি সংশোধিত আইনের অনুমোদন আমাদের দারুণ অনুপ্রাণিত করবে, এটাই আমাদের ঈদের উপহার ধরে নেব।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী।
No comments