বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল আর নেই
বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শাফায়াত জামিল আর নেই। শুক্রবার গভীর রাতে উত্তরায় নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে এ্যাপোলো হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলে রেখে গেছেন। শনিবার বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদে
শাফায়াত জামিলের জানাজা শেষে শাফায়াত জামিলকে বনানীর সেনাবাহিনী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে বীর বিক্রম খেতাব দেয়া হয়েছিল। বিনয়ী ও সাহসী কর্নেল শাফায়াত জামিল জীবদ্দশাতেই অনেক ইতিহাস গড়েছেন। আবার অনেক নিষ্ঠুর ও নির্মম ইতিহাসের সাক্ষীও ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ঘনিষ্ঠজনরা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম আবেগ জড়িত ভাষায় জনকন্ঠকে বলেন, তিনি ছিলেন একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান পাহাড় সমান। ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শুধু একজন সামরিক কর্মকর্তাই ছিলেন না-ছিলেন একজন স্নেহশীল অসাধারণ মানুষ। তাঁর অধীনে আমি চাকরি করেছি। তিনি আমাদের পিতৃস্নেহ দিয়েছেন। বিশেষ করে আমার স্বল্পকালীন চাকরি জীবনে তার স্নেহই শুধু নয়-চাকরি জীবন শেষেও তিনি আমাকে পিতৃস্নেহ দিয়ে এসেছেন। আমরা যারা তাঁর খুব কাছের ছিলাম তারা সকলেই তাঁকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিতার মতোই শ্রদ্ধা করেছেন। মেজর ইকবাল, মেজর হাফিজ (বর্তমানে বিএনপি নেতা) ও আমি বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাককে গ্রেফতার করতে যাই। তাকে গ্রেফতার করার মুহূর্তের মধ্যে কর্নেল শাফায়াত জামিল হাজির হন। ওই সময় মোশতাকের সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি কর্নেল শাফায়াত জামিলের কাছে জানতে চান কোন আইনে প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করা হলো? সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল শাফায়াত জামিল জবাব দেন যে আইনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে-সেই আইনেই এই খুনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (এবিএম তাজুল ইসলাম) তাজ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, তাঁকে নিয়ে সারা দিন বললেও কথা শেষ হবে না। তাঁর জানাজা আমিসহ স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, সামরিক বেসামরিক ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মহান এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ বিদায় জানানো হয় পূর্ণ সামরিক মর্যাদায়। পরে রাষ্ট্রীয় সম্মানও দেয়া হয়। বনানীর সেনাবাহিনী কবরস্থানের দাফনের পর সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক সম্পাদক নানক ও আহমদ হোসেন শ্রদ্ধা জানান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। প্রথা অনুযায়ী জাতীয় পতাকা ও সেনাবাহিনীর পতাকা মরহুমে ছেলে শাহরিয়ার শাফায়াতের হাতে তুলে দেন সেনাপ্রধান। জানাজা ও দাফনের সময় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান কে এম শফিউল্লাহ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন, বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল ফারুক খান উপস্থিত ছিলেন। শাফায়াত জামিলের দীর্ঘদিনের অনেক সহকর্মী জানাজা ও দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের সঙ্গী ছিলেন শাফায়াত জামিল। খালেদ মোশাররফ নিহত হওয়ার পর আটক হন শাফায়াত জামিল। ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ শাফায়াত জামিল সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। অবসরের পর নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন তিনি। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বড় ছেলে শাফকাত শাফায়াত ও মেজ ছেলে শাহরিয়ার শাফায়াত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। ছোট ছেলে সাব্বির আশরার শাফায়াত সেনাবাহিনীর মেজর। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শফিউল্লাহ বলেন, পাকিস্তানী বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট যখন শুরু হয়, শাফায়াত জামিল তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। ২৭ মার্চ ওই ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের আটকের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের কথা বলে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা এই রেজিমেন্টের দু’টি কোম্পানিকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া পাঠায়। এর একটি কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের খবর পেয়ে শাফায়াত জামিল অনুগত সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
দুই নম্বর সেক্টরের অধীন আশুগঞ্জ-ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া-গঙ্গাসাগর এলাকায় যুদ্ধ করেন শাফায়াত জামিল। পরে জিয়াউর রহমান নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে সিলেটের ছাতক যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর পরিচালিত এই যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বাধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৩৬৪ পাকিস্তানী সেনাকে হত্যা করে। এরপর রাধানগর অপারেশনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানী সেনাদের অবস্থান দখল করে নেন। এই এলাকাটি এর আগে আগে ভারতের বিখ্যাত গোর্খা রেজিমেন্টও দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। শাফায়াত জামিলের সহযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই এম নুরুন্নবী খান বীর বিক্রমও তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সিলেটের তামাবিলে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে শাফায়াত জামিল আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর শাফায়াত জামিল রংপুরে ৭২ ব্রিগেডের দায়িত্ব পান। এরপর তিনি ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টও ৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাফায়াত জামিলের ব্রিগেড সক্রিয় হলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ৩ নবেম্বরের অভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে চেয়েছিলেন।
শাফায়াত জামিলের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার খড়গমারা গ্রামে। তার বাবা এ এইচ এম করিমুল¬াহ পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর কাবুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ১৯৬৪ সালে কমিশন লাভ করেন শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তাঁর কোর্সমেট ছিলেন।
এদিকে, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১ এক শোক বাণীতে বলেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য সম্মানসূচক বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। এক প্রাণোচ্ছ্বল অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী কর্নেল জামিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে থাকাকালীন ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। পরবর্তীতে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। জেড ফোর্সের অধীনে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বীর এই মুক্তিযোদ্ধা যতদিন বেঁচে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার মৃত্যুতে সেক্টর কমান্ডাস ফোরাম গভীর শোক প্রকাশ করছে। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে। নব মুক্তিসেনা নামের আরও একটি সংগঠন কর্নেল শাফায়াত জামিলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে।
No comments