অন দ্য ওয়াটার ফ্রন্ট ॥ ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ- ঈদে ঘরে ফেরা-ভাঙ্গাচোরা লঞ্চ, জোড়াতালি দিয়ে মেরামত ও রং করে নামানো হচ্ছে॥ ডকইয়ার্ডে রাতদিন ব্যস্ততা by রাজন ভট্টাচার্য ও সালাহউদ্দিন মিয়া

কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের ডকইয়ার্ডগুলোতে এখন রাতদিন ব্যস্ত। দম ফেলার সময় নেই শ্রমিকদের। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ। ঈদ আসন্ন। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে লঞ্চ মেরামত শেষ করতে হবে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় অর্ধশত লক্কর মার্কা লঞ্চ নদীতে নামানোর অপেক্ষায়।


ঈদে বিভিন্ন রুটে যাত্রী পরিবহনে এসব লঞ্চ প্রস্তুত করা হচ্ছে। যার একটিরও ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। লঞ্চগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম। দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী নিয়ে ছাড়ছে লঞ্চ। ডেকেও ঠাসা মানুষে। সবমিলিয়ে এবারের ঈদে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত নৌসেবা অনিশ্চিত। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ।
এদিকে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৩৮/৪৫টি নৌরুটে ৬০ লাখের বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। প্রতিদিন প্রায় দেড় শতাধিক দ্বিতল লঞ্চ বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করছে। বেশিরভাগ লঞ্চের কেবিনের টিকেট বিক্রি শেষ। ১৯ আগস্টের টিকেট রয়েছে পর্যাপ্ত। তবে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের। মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, অতিরিক্ত নয়, সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ঈদ মৌসুম ছাড়া অন্যান্য সময়ে যাত্রী কম হওয়ায় নির্ধারিত ভাড়া নেয়া হয় না।
সরেজমিন ॥ কেরানীগঞ্জ এলাকার কালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, মীরেরবাগ এলাকার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। এসব স্থানের পুরো অংশজুড়েই ডকইয়ার্ড। বিভিন্ন রুটের লঞ্চ মেরামতের কাজ চলছে রাত দিন। টুং-টাং শব্দে কান ঝালাপালা। কথা বলার ফুরসত নেই ডকইয়ার্ডের শ্রমিকদের কারও। এমভি শহীদ-৩, মিতালী-২, অগ্রদূত প্লাস, পারাবাত-৭, সৈকত-৮, টিপু-৬, ফারহান-২, টিপু-১সহ কয়েকটি লঞ্চ মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন কোম্পানির এসব লঞ্চ ঈদ উপলক্ষে মেরামতের কাজ চলছে। কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে কাজ শেষ করছেন তারা। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে এসব লক্কর মার্কা লঞ্চগুলো নদীতে নামানো হবে। কোন কোন লঞ্চ মেরামত শেষে চলছে রংয়ের কাজ। রং করা মানেই একেবারে নতুনের মতো। এই কৌশল মানেই- বোঝার উপায় নেই লঞ্চটি মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা পুরনো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেরামতে থাকা কয়েকটি লঞ্চের সারেং জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে কিছু লঞ্চ জোড়াতালির মেরামত শেষে নামানো হয়েছে।
অনেক লঞ্চ ট্রিপ শেষে সদরঘাটে ফিরে আসার পর ডকে এনে রাতভর কাজ হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, জোড়াতালির মেরামতে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রাণহানি হতে পারে যাত্রীদের। তাছাড়া লঞ্চে লাইফ জ্যাকেট, টিউবসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপত্তা সরঞ্জামও নেই। এ অবস্থায় এবারের ঈদ ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যেই হওয়ার সম্ভাবনা। আবার মাঝ নদীতে নোঙ্গর করে অনেক লঞ্চে দেয়া হচ্ছে রং। মেরামত করা হচ্ছে আসনও। কোথাও কোথাও দেয়া হচ্ছে ঝালাই।

সদরঘাটে টিকেটের জন্য ভিড়
দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ নৌপথে যাতায়াতের ওপর নির্ভশীল। তাই ঈদে প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে লঞ্চের টিকেট সংগ্রহের যুদ্ধে নেমেছেন অনেকে। মালিবাগ থেকে বরগুনার টিকেট কাটতে সকালে যান আরিফ। দিনভর চেষ্টার পরও ১৬ আগস্টের কেবিনের কোন টিকেট সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা অতিরিক্ত টাকা দেইনি বলেই টিকেট পাইনি। যারা বাড়তি টাকা গুনেছেন তাদের হাতেই মিলেছে টিকেট নামের সোনার হরিণ। এরকম টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি পাওয়ার আনন্দ ছিল অনেকের চোখে মুখে। বেশি ভাড়া দিয়েও অনেকে টিকেট সংগ্রহ করেছেন। তবে অগ্রিম দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র কেবিনের টিকেট। কাকরাইলের বিপুল মিয়া জানালেন, প্রায় আট ঘণ্টা চেষ্টার পর শরীয়তপুরের টিকেট সংগ্রহ করেছেন তিনি। ভোর থেকে টার্মিনালে দেখা গেছে, ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় যেমন আছে, তেমনি অনেকে টিকেট কাটতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। আবার বিভিন্ন গন্তব্য থেকে লঞ্চ এসে ভিড়ছে সদরঘাটে। সবমিলিয়ে টার্মিনালজুড়েই বইছে উৎসবের আমেজ। হাজারো মানুষের ভিড় প্রতিদিনই।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ
আট আগস্ট থেকে ঈদ উপলক্ষে নৌ সার্ভিস শুরু হয়েছে। একই দিন থেকে চলছে চলতি ও আগ্রিম টিকেট বিক্রিও। ঢাকা-আমতলী রুটে চলা এম ভি সৈকত-৮ এর সুপারভাইজার সাখাওয়াত জানালেন, সিঙ্গেল এক হাজার ২০০, ডাবল কেবিন দুই হাজার ২০০ টাকা, ডেক ৩৩০ টাকা। ১০ তারিখ থেকে অগ্রিম টিকেট দেয়ার কথা জানান তিনি। কিন্তু শনিবার এই লঞ্চের যাত্রী ফারজানা করিম অভিযোগ করে বলেন, ঈদ উপলক্ষে প্রতি টিকেটে ৪০০/৫০০ টাকা অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে।
ঢাকা-বরগুনা রুটে চলা এম ভি বন্ধন-৭-এর সুপারভাইজার আবদুল লতিফ জনকণ্ঠকে জানান, সিঙ্গেল কেবিন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪০০ টাকা, ডাবল কেবিন দুই হাজার ৪০০ টাকা, ডেক ৩০০ টাকা। তিনি জানান, তিন দিন আগে থেকে অগ্রিম টিকেট ছাড়া হয়েছে। কিচু টিকেট এখনও অবিক্রতি রয়েছে। এই লঞ্চের যাত্রী ব্যবসায়ী রহমত আলী জানান, ঈদ উপলক্ষে মাল পরিবহনসহ যাত্রী ভাড়া অতিরিক্ত আদায় করছে লঞ্চ মালিকরা। ঢাকা-লালমোহন রুটে চলছে এম ভি পাতারহাট-৫। এর সুপারভাইজার রুপেশ চন্দ্র দেবনাথ জানান, সিঙ্গেল কেবিন-৮০০, ডাবল-এক হাজার ৬০০ ও ডেকের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫০টাকা। ২৭ রোজা পর্যন্ত সব টিকেট বিক্রি শেষ হওয়ার কথা জানান তিনি। মাই ওয়ান টিভির সুপারভাইজার আলমগীর জানান, এবারের ঈদ উপলক্ষে প্রতি ফ্রিজ পরিবহনে ২০০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় ৮০ টাকা বেশি।
সুরভী লঞ্চ কোম্পানির পরিচালক রিয়াজ-উল-কবির বলেন, বিশেষ সার্ভিসে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আবার খালি লঞ্চ নিয়ে ঢাকায় যেতে হয়। এ কারণে জ্বালানি ব্যয় হয় দ্বিগুণ। প্রতিবছরই আমরা ঈদের বিশেষ সার্ভিসে সরকার নির্ধারিত পুরো ভাড়া নেই, যা অন্য সময় নেয়া হয় না। এজন্য অনেকের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে বলে মনে হয়।

পাঁচ রুটে নামছে রকেট স্টিমার
এবারের ঈদে নৌ সেবায় যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৪ আগস্ট থেকে বিশেষ রকেট স্টিমার চলাচল করবে। ১২ আগস্ট থেকে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান কার্যালয় মতিঝিল থেকে চাঁদপুর, মোড়লগঞ্জ, খুলনা, রবিশাল, বাগেরহাট রুটে রকেট স্টিমারের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হবে।

No comments

Powered by Blogger.