মূল্যবৃদ্ধির থাবায় ঈদের আনন্দ by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

অন্যান্যবারের মতো এবারও ঈদ সামনে রেখে বাজার আগুন হয়েছে। রোজার শুরু থেকেই ছোলা, সয়াবিন- এসবের দর চড়চড় করে চড়েছে। যে শার্ট গত বছর ৮০০ টাকায় কেনা গেছে, সে শার্ট এবার দাম বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৬০০ টাকা।


এ কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমাদের অর্থমন্ত্রীর! আমদানি পোশাকের ওপর ৩০ শতাংশ কর আরোপ করায় পোশাকের দাম প্রবল চড়ে গেছে। আলুর কিলো ইতিমধ্যে ২৫ টাকা ছুঁয়েছে। কালের কণ্ঠ খবর প্রকাশ করেছে যে ঈদ সামনে রেখে দূরপাল্লার বাসগুলো তাদের ভাড়া ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। গত বছর যে সেমাই ছিল ৫৫ টাকা; সে একই সেমাই এবার দাম বেড়ে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নারিকেল, কিশমিশসহ যেসব পণ্য ঈদে দরকারি, সেসবের দাম গড়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর এর পাশাপাশি মাছ-মাংসের চড়া দাম তো রয়েছেই।
মুসলমানদের এ পবিত্র ঈদের উৎসবে তাই মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের অনেকের সাধ যা-ই থাকুক না কেন, সাধ্যতে কুলোচ্ছে না। এ অবশ্য শুধু যে এ বছরের চিত্র, তা নয়। প্রতিবছরই এ উৎসবের সময় আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের পকেট অনেকটাই কাটা যায়।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় দেখেছি এর অন্যরূপ। প্রতিবছর ক্রিসমাসের সময় এলে দোকানগুলোতে মূল্য হ্রাসের প্রতিযোগিতা শুরু হয় : কে কার চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারে। প্রতিযোগিতা শুরু হয় যানবাহন কম্পানিগুলোয়। যেমন- বাস সার্ভিস, ট্রেন, স্পিড ট্রেন ও এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে কে কার চেয়ে কম দামে মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দেবে- সে প্রতিযোগিতা। বেসরকারি পরিবহন এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি পরিবহনগুলো ক্রিসমাস উৎসবের শুভেচ্ছাস্বরূপ ক্রিসমাসের আগে আগে এক সপ্তাহজুড়ে যাত্রীদের বিনা ভাড়ায় বাড়িতে পৌঁছে দেয়। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে, গরিব-ধনী সবাই মিলে যাতে আনন্দ করতে পারে, উৎসবে শরিক হতে পারে- রাষ্ট্র এখানে সে ব্যাপারে সদা তটস্থ। আর আমাদের দেশে ব্যাপারটা উল্টো। ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক, অর্থ মন্ত্রণালয়- সবাই ব্যস্ত টাকা বানানোর ধান্ধায়।
তবে এ বছরের ঈদ সামনে রেখে মূল্যবৃদ্ধির যে থাবা বিস্তৃত হয়েছে। তা সবচেয়ে বেশি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে এ জন্য যে কয়েক মাস ধরেই বিদ্যুৎ, এলপি গ্যাস আর পরিবহনের ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বাড়ছেই। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। গরিব মানুষের তো কথাই নেই; কয়েক মাস ধরে বাজারে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের। আর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা, যেকোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে সেটির দাম আর কখনো কমে না। এর ভেতর আবার প্রতিবছর ঈদ এলে তো কথাই নেই। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের পকেট কাটার এমন মওকা যেন বছরে একবারই আসে। যে যেভাবে পারে জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নামে! ফলে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যায়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মূল্যবৃদ্ধির কারণটা কী? কালের কণ্ঠে এক সপ্তাহজুড়ে লেখালেখি হচ্ছে এসব বিষয় নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ আমদানিমূল্য যেখানে ১০৫ টাকা, সেখানে পাঁচ লিটারের একটি সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে বাজারে ৬৭০ টাকা দামে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সয়াবিন তেল আমদানির মূল্যভেদে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ও শিল্প-মালিকের লাভ- সব মিলিয়ে সয়াবিন তেলের বাজারমূল্য হতে পারে ১০০ থেকে ১১১ টাকা। অথচ বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৩০ থেকে ১৩৬ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে শিল্প-মালিকরা লাভ করছেন ২০ থেকে ২৫ টাকা। আইনকানুন আছে, এমন কোনো দেশে বিষয়টি কি কল্পনা করা যায়?
যা হোক, গত সপ্তাহে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের পেছনে এই অবিশ্বাস্য লাভের ঘটনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিস্ময় প্রকাশ করেছে এবং সয়াবিন তেল বাজারজাতকরণ কম্পানিগুলোকে কারণ দর্শাও নোটিশও দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কারণ দর্শাও নোটিশের জবাবে সয়াবিন তেল বাজারজাতকরণ কম্পানিগুলো জবাব দিয়েছে এই বিপুল পরিমাণ লাভ করার জন্য তারা দুঃখিত। এই হচ্ছে অবস্থা!
রমজানের শুরুতে সয়াবিন তেল, ছোলা, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে সে জন্য সরকারি তরফে একটা টাস্কফোর্স গড়া হয়েছিল। দু-তিন দিন লম্ফঝম্ফ দেওয়ার পর সে টাস্কফোর্সের এখন আর কোনো খবর-বার্তা নেই। তিন দিনেই সে টাস্কফোর্স বাজারে নজরদারি করে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই টাস্কফোর্স গত এক মাসে কোনো একজন অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীকে ধরতে পারেনি। আর অন্যায্যভাবে দাম বাড়ানোর জন্য সরকারও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
আসলে দু-তিন দিন বাজার নজরদারি করে, সাময়িক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ৩৬৫ দিনই নজরদারি চালাতে হবে। অভিযান চালিয়ে মজুদ উদ্ধার করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই তার ফল সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছবে।
যা হোক, ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজার থেকে আরো ঋণ সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নগদ টাকার অভাব বলে পত্রপত্রিকাগুলো জানিয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেবে সরকার। অভিজ্ঞমহল মনে করছে, এর ফলে দ্রব্যমূল্যের আরো বৃদ্ধি ঘটবে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে!
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.