দেহের জাকাত সিয়াম by সৈয়দ গোলাম মোরশেদ
ইসলামী সমাজব্যবস্থায় জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে বহুবার সালাতের সঙ্গে জাকাতের কথা উল্লেখ আছে। ইসলামের পাঁচটি ফরজের মধ্যে জাকাত প্রদান অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। সালাত আদায়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাকাত আদায় করা। যার জাকাত আদায় হয়নি, তার সালাতও আদায় হয়নি।
ইসলামে জাকাত আদায়ের নির্দেশ আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব বহন করে।
সাধারণত জাকাত বলতে আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে, রমজান মাসে বছরের নিসাব পরিমাণ সম্পদ হিসাব করে তার শতকরা আড়াই ভাগ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান করা। পবিত্র কোরআনে জাকাত আদায়ের নির্দেশ বারবার থাকলেও তার পরিমাণের কথা উল্লেখ নেই। সম্ভবত জাকাত শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমস্ত চিন্তা-চেতনা এবং কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় এর অর্থনৈতিক পরিমাণ উল্লিখিত হয়নি। যেমন, হাদিস শরিফে সিয়ামকে দেহের জাকাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত 'জাকাত' একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ; এবং এর তাৎপর্য ব্যাপক ও দর্শননির্ভর। পবিত্র কোরআনে জাকাত কাকে কাকে দিতে হবে তার উল্লেখ যেখানে আছে, সেখানে 'জাকাত' শব্দটি নেই, আছে 'সদকাহ' শব্দটি। যেমন, 'সদকাহ তো নিঃস্বদের জন্য- এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান।' (সুরা আত-তাওবা, আয়াত-৬০)। এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা সদকাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সেই নির্ধারিত সংখ্যা কত? সদকাহ কী? জাকাত সদকাহ কি না? শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা এলো কোত্থেকে?
পূর্ববর্তী নবীদের আমলেও জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তারও কোনো পরিমাণের কথা কোরআনে উল্লেখ নেই। পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে বোঝা যায়, জাকাত একটি চিরন্তন, সর্বজনীন ও সর্বকালীন ব্যবস্থা, যা অবশ্যই আদায় করতে হবে। অন্যথায় মুমিন হওয়া যায় না। জাকাত অনাদায়ে সমস্ত ইবাদত পণ্ডশ্রম মাত্র। শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ লাভ করে খোলাফায়ে রাশেদার আমলে। রাসুল (সা.)-এর জমানায় মুমিনরা তাঁদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ তাঁর (রাসুলের) খিদমতে পেশ করতেন। রাসুল (সা.) সেখান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক অভাবী, গরিব-দুঃখীদের দান করতেন। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ওই ব্যবস্থাই জাকাত প্রদানের সংগত ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয়। যেমন, পবিত্র কোরআনের সুরা আল-বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'মানুষ যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, কী পরিমাণ সম্পদ তারা দান করবে, তখন আপনি বলে দিন, যা কিছু উদ্বৃত্ত, তা-ই।' মুফতি শফি তাঁর 'কোরআন মে নেজামে জাকাত' কিতাবে এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। এভাবে দান করাটাকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় জাকাত প্রদান বলে মনে হয়। কেননা, সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার কোনো বিধান কোরআনে নেই, নিষিদ্ধ। কোরআনে সুরা আন-নিসার ৩৭ নম্বর আয়াতে যারা সম্পদ জমা করে, তাদেরকে কাফির এবং তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সুরা মুহাম্মাদের ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্র রাস্তায় সমুদয় সম্পদ ব্যয় না করে পুঞ্জীভূত করাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুরা হুমাজার ২ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে যারা সম্পদ জমা করে, তাদের 'হুতামাহ' নামক দোজখে নিক্ষেপ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ রকম আরো অনেক আয়াত এবং রাসুল (সা.)-এর অনেক হাদিসের ভাষ্যমতে সম্পদ জমা করা এবং তা আল্লাহর পথে (জনকল্যাণে) ব্যয় না করে গণনা করা মুসলমানদের জন্য হারাম ঘোষিত হয়েছে।
এই পৃথিবীর বিশাল সম্পদরাশি আল্লাহর সৃষ্টিজীবের কল্যাণার্থে ব্যবহৃত না হয়ে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে অব্যবহৃত এবং অপচয় হওয়ার বিধান সব জীবের মহিমাময় দয়াল প্রভু দিতে পারেন না।
জাকাতব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য, অভাব, বৈষম্য ইত্যাদি দূর করে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বর্তমানে ইসলামী সমাজে জাকাত প্রদানের যে ব্যবস্থা, তাতে দারিদ্র্য, অভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য তো দূর হচ্ছেই না, বরং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে! এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, পবিত্র কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক (২ : ২১৯) জাকাত প্রদান না করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
সাধারণত জাকাত বলতে আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে, রমজান মাসে বছরের নিসাব পরিমাণ সম্পদ হিসাব করে তার শতকরা আড়াই ভাগ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান করা। পবিত্র কোরআনে জাকাত আদায়ের নির্দেশ বারবার থাকলেও তার পরিমাণের কথা উল্লেখ নেই। সম্ভবত জাকাত শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমস্ত চিন্তা-চেতনা এবং কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় এর অর্থনৈতিক পরিমাণ উল্লিখিত হয়নি। যেমন, হাদিস শরিফে সিয়ামকে দেহের জাকাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত 'জাকাত' একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ; এবং এর তাৎপর্য ব্যাপক ও দর্শননির্ভর। পবিত্র কোরআনে জাকাত কাকে কাকে দিতে হবে তার উল্লেখ যেখানে আছে, সেখানে 'জাকাত' শব্দটি নেই, আছে 'সদকাহ' শব্দটি। যেমন, 'সদকাহ তো নিঃস্বদের জন্য- এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান।' (সুরা আত-তাওবা, আয়াত-৬০)। এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা সদকাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সেই নির্ধারিত সংখ্যা কত? সদকাহ কী? জাকাত সদকাহ কি না? শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা এলো কোত্থেকে?
পূর্ববর্তী নবীদের আমলেও জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তারও কোনো পরিমাণের কথা কোরআনে উল্লেখ নেই। পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে বোঝা যায়, জাকাত একটি চিরন্তন, সর্বজনীন ও সর্বকালীন ব্যবস্থা, যা অবশ্যই আদায় করতে হবে। অন্যথায় মুমিন হওয়া যায় না। জাকাত অনাদায়ে সমস্ত ইবাদত পণ্ডশ্রম মাত্র। শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত প্রদানের ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ লাভ করে খোলাফায়ে রাশেদার আমলে। রাসুল (সা.)-এর জমানায় মুমিনরা তাঁদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ তাঁর (রাসুলের) খিদমতে পেশ করতেন। রাসুল (সা.) সেখান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক অভাবী, গরিব-দুঃখীদের দান করতেন। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ওই ব্যবস্থাই জাকাত প্রদানের সংগত ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয়। যেমন, পবিত্র কোরআনের সুরা আল-বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'মানুষ যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, কী পরিমাণ সম্পদ তারা দান করবে, তখন আপনি বলে দিন, যা কিছু উদ্বৃত্ত, তা-ই।' মুফতি শফি তাঁর 'কোরআন মে নেজামে জাকাত' কিতাবে এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। এভাবে দান করাটাকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় জাকাত প্রদান বলে মনে হয়। কেননা, সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার কোনো বিধান কোরআনে নেই, নিষিদ্ধ। কোরআনে সুরা আন-নিসার ৩৭ নম্বর আয়াতে যারা সম্পদ জমা করে, তাদেরকে কাফির এবং তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সুরা মুহাম্মাদের ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্র রাস্তায় সমুদয় সম্পদ ব্যয় না করে পুঞ্জীভূত করাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুরা হুমাজার ২ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে যারা সম্পদ জমা করে, তাদের 'হুতামাহ' নামক দোজখে নিক্ষেপ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ রকম আরো অনেক আয়াত এবং রাসুল (সা.)-এর অনেক হাদিসের ভাষ্যমতে সম্পদ জমা করা এবং তা আল্লাহর পথে (জনকল্যাণে) ব্যয় না করে গণনা করা মুসলমানদের জন্য হারাম ঘোষিত হয়েছে।
এই পৃথিবীর বিশাল সম্পদরাশি আল্লাহর সৃষ্টিজীবের কল্যাণার্থে ব্যবহৃত না হয়ে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে অব্যবহৃত এবং অপচয় হওয়ার বিধান সব জীবের মহিমাময় দয়াল প্রভু দিতে পারেন না।
জাকাতব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য, অভাব, বৈষম্য ইত্যাদি দূর করে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বর্তমানে ইসলামী সমাজে জাকাত প্রদানের যে ব্যবস্থা, তাতে দারিদ্র্য, অভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য তো দূর হচ্ছেই না, বরং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে! এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, পবিত্র কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক (২ : ২১৯) জাকাত প্রদান না করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
No comments