শাফায়াত জামিল আর নেই- বিদ্রোহী প্রতিবাদী যোদ্ধার বিদায়

একাত্তরে যাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, পঁচাত্তরে সেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন ৩ নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যুত্থান করে। যুদ্ধে যুদ্ধে যেন নিজের পরিচয় নির্মাণ করেছিলেন এই সেনা কর্মকর্তা। ঘটনাবহুল কর্মজীবনের শেষে এসে হয়ে পড়েছিলেন নিভৃতচারী। চলেও গেলেন নীরবে।


কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম শুক্রবার গভীর রাতে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
শাফায়াত জামিলের ছোট ভাই সাদাকাত জামিলের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, শুক্রবার রাত দুইটা ১০ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উত্তরার বাড়িতে কর্নেল জামিলের বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু পথে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে দ্রুত অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হয়।
কর্নেল জামিল স্ত্রী রাশিদা শাফায়াত ও তিন ছেলে রেখে গেছেন। ছেলেদের মধ্যে দুজন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাঁদের একজন প্রকৌশলী ও একজন ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে সাব্বির আশরার শাফায়াত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর।
শাফায়াত জামিলের প্রথম জানাজা উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের একটি মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাঁর মরদেহ ঢাকা সেনানিবাসে নেওয়া হয়। সেখানে ‘আল্লাহু’ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বনানীর সেনা কবরস্থানে সামরিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তাঁকে।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়া, সাবেক সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। দাফনের পর কবরে শ্রদ্ধা জানান তিন বাহিনীর প্রধানেরাসহ জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা।
কর্মজীবন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এ এইচ করিমুল্লাহর ছেলে শাফায়াত জামিল ১৯৪০ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে কমিশন পান।
শাফায়াত জামিল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাসদস্যদের নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। আটক করেন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে। মে মাসে তিনি তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব পান। ১০ অক্টোবর পর্যন্ত জেড ফোর্সের অধীনে ১১ নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। এর পর থেকে যুদ্ধ করেন সিলেট অঞ্চলে। বিজয়ের আগমুহূর্তে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে রাধানগর-ছোটোখেল দখলের সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত হন।
স্বাধীনতার পর শাফায়াত জামিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এবং বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন।
পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহ: শাফায়াত জামিল ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সহায়তা করেন। ওই বছরেরই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সেনা সহায়তায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরিচালনা, খোন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দী করা, নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তবে ৭ নভেম্বর আরেক অভ্যুত্থানে খালেদ-শাফায়াতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং খালেদ মোশাররফ নিহত হন। কর্নেল জামিলকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ ছাড়া পাওয়ার পরপরই সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে।
স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর-এ শাফায়াত জামিল দেশের ইতিহাসের এই তিনটি পর্বের অনেক ঘটনা তুলে ধরেছেন।
শোক: শাফায়াত জামিলের মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় তিনি মরহুমের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের শোকবার্তায় বলা হয়, শাফায়াত জামিলের মৃত্যুতে দেশ একজন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হারাল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

No comments

Powered by Blogger.