লন্ডন অলিম্পিকের বর্ণিল সমাপনী আজ by জাহিদুল আলম জয়

সতেরো দিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতার মহাকাব্য শেষে আজ রবিবার পর্দা নামছে লন্ডন অলিম্পিকের। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসরকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত গোটা গ্রেট ব্রিটেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ন্যায় সমাপনীতেও চমক থাকছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।


সমাপনী অনুষ্ঠান হবে পূর্ব লন্ডনের স্ট্যার্টফোর্ডের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। প্রায় ৮০ হাজার দর্শক সরাসরি জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন বলে জানা গেছে। সমাপনীতে পালাক্রমে থাকছে চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন পর্ব। এর মধ্যে অন্যতম পরবর্তী আসরের আয়োজকদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। এই পর্বে লন্ডনকে বিদায় জানিয়ে স্বাগত জানানো হবে রিওডি জেনিরোকে। ২০১৬ সালে অলিম্পিকের ৩১তম আসর যে অনুষ্ঠিত হবে ব্রাজিলের এই শহরেই।
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বিদায়ের সুর বেজে উঠবে লন্ডন সময় রবিবার সন্ধ্যা থেকেই। অবশ্য গত ক’দিন থেকেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিদায়ের রাগিণী। সমাপনী অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টায়। তবে মূল অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে রাত পৌনে দু’টায়। কাগজে-কলমে শনিবারই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা পদকের লড়াই। কিন্তু লন্ডনের সঙ্গে সময়ের তারতম্যের কারণে বাংলাদেশ সময় আজও কিছু ইভেন্টে পদকের ফয়সালা হবে। পুরুষদের ওয়াটারপোলো দিয়ে শেষ হবে এবারের আসরের পদক যুদ্ধের লড়াই। এরপর শুরু হবে সমাপনী অনুষ্ঠান। শুরুর ন্যায় শেষের ক্ষণও স্মরণীয় করে রাখতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় রত আয়োজকরা। ২০০৫ সালের ৭ জুলাই সাবেক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন সেবাস্টিয়ান কো’র নেতৃত্বে স্বাগতিকের মর্যাদা পায় লন্ডন। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) ১১৭তম অধিবেশনে চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে প্যারিসকে ৫৪-৫০ ভোটে হারিয়ে ৩০তম অলিম্পিকের স্বাগতিক হয়েছিল লন্ডন। এর ফলে ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র শহর হিসেবে তৃতীয়বার অলিম্পিকের স্বাগতিক হওয়ার গৌরব অর্জন করে শহরটি। এর আগে লন্ডন আয়োজক হয়েছিল ১৯০৮ ও ১৯৪৮ সালে। এই হিসেবে এবার দীর্ঘ ৬৪ বছর পর অলিম্পিকের স্বাগতিকের মর্যাদা পায় গ্রেট ব্রিটেন।
গত ২৭ জুলাই মনোমুগ্ধকর, নয়নাভিরাম, জমকালো, বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠেছিল লন্ডন অলিম্পিকের। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ক্রীড়া আসরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনের পর টানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পদকের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় ২০৪টি দেশের সাড়ে দশ হাজার এ্যাথলেট। এ সময়ে লড়াই হয় ৯০৬টি পদক জয়ের জন্য। ২৬টি ক্রীড়ার ৩০২টি ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিশ্বের নানা প্রান্তের নামী-দামী, অখ্যাত ও বিখ্যাত এ্যাথলেটরা। শনিবার রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত যে অবস্থা ছিল, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার অনেকটাই নিশ্চিত। চার বছর আগে ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো পদক তালিকার শীর্ষস্থান পেয়েছিল এশিয়ার দেশ চীন। এবারও আসরের শুরু থেকেই কক্ষপথে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দিন পদক তালিকায় এক নম্বরে থাকার পরও তীরে এসে তরী ডুবতে বসেছে চীনাদের। বর্তমান প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে থেকে এবার হয়ত দ্বিতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে এশিয়ার দেশটিকে।
বরাবরের মতো এবারও বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করেন বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে তাবত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। বিচিত্র ভাষা, বিচিত্র পোষাক, আচার-আচরণ সবকিছুকে ছাপিয়ে এখানে উত্থিত হয় মিলনের সুর, ভালবাসা, ভাললাগার জয়গান। সতেরো দিন বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এই জয়গানে মুখরিত হয় গোটা গ্রেট ব্রিটেন। ইংলিশরা স্মরণকালের অন্যতম সেরা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সবাইকে এক সুতোয় গেঁথে রাখতে সক্ষম হয়। ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি, মান-অভিমান ছাড়া এবার সার্বিকভাবে সফল একটি আসর শেষ করতে চলেছে গ্রেট ব্রিটেন।
লন্ডন অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠান নিয়ে এখন সবার মধ্যেই বিরাজ করছে কৌতূহল। কেমন হতে পারে শেষ দৃশ্যের চিত্রনাট্য তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন। আয়োজকরা উদ্বোধনীর ন্যায় সমাপনী অনুষ্ঠানেও চমক দেয়ার প্রত্যাশা করছেন। এ নিয়ে তাঁরা কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতোই সমাপনীতে বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে গ্রেট ব্রিটেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতিতে জানা গেছে, ৩০তম অলিম্পিককে বিদায় জানানোর যজ্ঞে কোন কমতি রাখতে চান না আয়োজকরা। সমাপনী অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ডেভিড আর্নল্ডের হাতে ফুটে উঠবে ব্রিটিশ পপ মিউজিকের আদ্যোপান্ত। জেমস বন্ড সিরিজের পাঁচটি ছবির সঙ্গে যুক্ত থাকা আর্নল্ড জানিয়েছেন, সমাপনী অনুষ্ঠান হবে চোখ ধাঁধানো। রোমাঞ্চ জাগানো শিহরনে উদ্ভাসিত হবে সবাই। সমাপনী অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ডেভিড আর্নল্ড কিছুটা হলেও আভাস দিয়েছেন কি থাকতে পারে শেষ যজ্ঞে। তিনি বলেন, সমাপনীতে ব্রিটিশ পপ সঙ্গীতের ইতিহাস তুলে ধরা হবে চমৎকারভাবে। এছাড়া আডেল এবং পল ম্যাককার্টনির অংশগ্রহণের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। বিবিসি জানিয়েছে, সমাপনীতে চার হাজারের বেশি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক থাকবে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৪০০। এছাড়া অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হবে। তবে ক্রীড়াবিদরা দেশভেদে আলাদা নন, বরং সবাই একসঙ্গে শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন। অনুষ্ঠান শেষে লন্ডন অলিম্পিকের শুরুতে প্রজ্বলিত মশালটি নিভিয়ে ফেলা হবে।
সমাপনী অনুষ্ঠান ঘিরে এখন ব্রিটেনের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পীদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে এবং বিভিন্ন সাক্ষাতকারে তারকারা অল্প-বিস্তর জানাচ্ছেন তাঁদের পরিকল্পনা। আশির দশকের ব্রিটিশ পপ আইকন জর্জ মাইকেল টুইটারে জানিয়েছেন, অবশ্যই কিছুটা নার্ভাস। কারণ গত প্রায় এক বছর চর্চা করা হয়নি। তবে রিহার্সেল এখন পর্যন্ত খুব ভাল শোনাচ্ছে। ব্রিটিশ পপ ব্যান্ড ‘মিউজ’, যারা কিনা অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক ট্র্যাক বাজিয়েছে, তাদেরও সমাপনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার কথা ছিল। কিন্তু এই ব্যান্ডের এক সদস্যের পরিবারে বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে তারা সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছে বলে জানা গেছে।
সমাপনীতেও উদ্বোধনীর মতো আকর্ষণ থাকছে এটা নিশ্চিত। তাই শুরুর ন্যায় শেষটাও হয়ত স্মরণীয় হতে চলেছে। লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান টিভি পর্দায় দেখেছিলেন প্রায় নয় শ’ মিলিয়ন দর্শক। সমাপনী অনুষ্ঠানও সমপরিমাণ দর্শক উপভোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে স্বশরীরে ৮০ হাজার দর্শক তো থাকছেই।
গত মাসের শেষের দিকে পর্দা ওঠার পর লন্ডন অলিম্পিক রঙিন হয়েছে অনেক মহাতারকার উদ্ভাসিত নৈপুণ্যে। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা নাম মাইকেল ফেলপস ও উসাইন বোল্ট। দুর্দান্ত সাফল্য প্রদর্শন করে অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান হিসেবে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখেছেন ফেলপস। ২৭ বছর বয়সী এ মার্কিন জলদানব এবারও জয় করেন ৪টি স্বর্ণ ও ২টি রৌপ্যপদক। এর মধ্যে দু’টি স্বর্ণ ব্যক্তিগত ইভেন্টে। সবমিলিয়ে এবারের ৬টি পদকসহ অলিম্পিক ইতিহাসে ১৮টি স্বর্ণজয়ের অনন্য রেকর্ড গড়েন ফেলপস। এছাড়া ২টি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক জিতে অলিম্পকের ইতিহাসে ফেলপসের পদক জয়ের সংখ্যা ২২টি। ইতিহাস গড়া কীর্তিগাথার পর অবসর নিয়েছেন তিনি। ফেলপসের ন্যায় অলিম্পিকের ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন জ্যামাইকান গতিদানব উসাইন বোল্টও। টানা দুই অলিম্পিকে স্প্রিন্টের ডাবল জয়ী একমাত্র ও সর্বপ্রথম এ্যাথলেট এখন বোল্ট। বেজিংয়ের পর তিনি লন্ডনেও বাজিমাত করেছেন ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট। এমন কীর্তি নেই ইতিহাসে আর কারও।

No comments

Powered by Blogger.