সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নাকি দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য by মিলু শামস
পঞ্চাশ বছর আগের ‘হুজুর কেবলা’ যখন দু’হাজার বারোয় দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন করে তখন এক বিস্মিত জিজ্ঞাসা আমাদের তাড়িয়ে ফেরেÑআবার কি সমাজে সংক্রমিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভাইরাস? সে জিজ্ঞাসা শঙ্কায় রূপ নেয় যখন চিরিরবন্দরে মন্দির বনাম মসজিদের সেই পুরনো পালা নতুন করে মঞ্চায়িত হয়।
প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঘটনার পটভূমি দু’হাজার ছয় সালের। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমিতে সে সময় কয়েকটি দোকান নির্মাণ করেন স্থানীয় এক নারী। সেখানে পুরনো শিবস্থান থাকায় সে জায়গা বাদ দিয়েই তিনি দোকান নির্র্মাণ করেছিলেন। ছ’বছর পর সেই শিবস্থানে মসজিদ বানানোর উদ্যোগ নিলে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দু’পক্ষকে নিয়ে বসে বিষয়টি প্রায় মিটিয়ে ফেলেছিলেন। শেষ সিদ্ধান্ত নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে জরুরী বৈঠকে বসতে চাইলে তিনি একটু ঢিলেঢালাভাবে সময় দেন। এই ফাঁকে স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও তিনি চিরিরবন্দরসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যাপকহারে লিফলেট বিলি ও উপজেলা এলাকায় মাইকিং করেন। যার বক্তব্য ছিল ‘হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা দিচ্ছে, তা প্রতিরোধে মুসল্লিরা এগিয়ে আসুন’ এবং ‘কতিপয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মসজিদ নির্মাণে বাধা প্রদানে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় শুক্রবার রাত বারোটা থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এলাকায় এক শ’ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হলো।’ ফল যা হওয়ার তাই হলো। প্রকাশিত ওই খবরেই জানা যায়, সকাল ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আশপাশের কয়েকটি উপজেলার দু’থেকে আড়াই হাজার মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে সংঘবদ্ধ হয় এবং এক শ‘ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙ্গে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে দু’গ্রামের তিরিশটি হিন্দু বাড়িতে সন্ত্রসী তা-ব চালায়। লুটে নেয় টাকাপয়সাসহ মূল্যবান সামগ্রী,শস্য ও গৃহপালিত পশু। ওই তিরিশ বাড়ির মানুষ আতঙ্কে দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটে। নিহত না হলেও অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাঁরা।
কি বলা যায় একেÑসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা? দাঙ্গায় তো দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ থাকে। একে দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন বলাই বোধহয় বেশি সঙ্গত। সাম্প্রদায়িক উষ্কানির আগুনে ঘি ঢেলে মাঝ থেকে লাভবান হতে চেয়েছে তৃতীয় পক্ষ। সেই যে ব্রিটিশরা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বীজ বুনে সযতœ পরিচর্যায় মহীরুহ করে তার ফল ভোগ করে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিল এ অঞ্চলের দু’সম্প্রদায়ের ঘাড়ে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আজও মাঝে মাঝেই তা তীব্র ব্যথার ক্ষত তৈরি করে, নাড়িয়ে দেয় সুস্থ চিন্তাকে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তবতা গ্রহণযোগ্যতা হারালেও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের ধারাবাহিকতা সমানভাবেই অক্ষুন্ন রয়েছে।
মাত্র এক দশক আগে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাদের স্মৃতিতে এখনো দগদগে। সিরাজ গঞ্জের সেইপুর্ণিমা কিংবা গফর গাঁওয়ের জ্যোৎস্নাকে কি ভোলা সম্ভব সুসহ্য বিবেকের পক্ষে? দুহাজার একের নির্বাচনের পরের বিভিষীকাময় ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিল দেশের রাজনীতিতে মৌলবাদ নামের অন্ধ উন্মাতাল উপদান সংযোজিত হতে যাচ্ছে। আজ দশ এগার বছর পর চারপাশে তাকালে তার অনেক স্বাক্ষরই দেখা যায়। শান্তি ও সমর্পণের জাগায় থেকে সরে র্ধম হয়েছে অনেক বেশি সহিংসও স্থুল। গ্রেনেড, বোমা হামলা ঘটেছে। । হুমায়ুন আজাদের মত মুক্ত চিন্তার মানুষদের জীবন বিপন্ন হয়েছিল । তবে দু’ হাজার একের সেই ভয়াবহ স্মৃতিতে খানিকটা হলেও মমতার প্রলেপ বুলিয়েছে বর্তমান সরকারের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংঘটিত খুন ধর্ষন লুন্ঠন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ সব ধরনের সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি। পুর্নিমা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত বছর। দশ বছর পর হলেও নৃশংতম ওই ঘটনার বিচারের রায় হওয়া নিসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ । ওই রায়ে এগার জনের যাবজীবন কারাদন্ড হয়েছিল।
এসব কিছুর পেছনেই তো রয়েছে আসলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা। দুর্বলের ওপর সবলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তা সংহত রাখার নিরলস প্রচেষ্টা। এ কাজ করতে গিয়ে যত ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় তার কোনটাই বাদ পড়ে না।
এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি করে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। নিজেদের শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থার সুবিধার জন্যই তারা ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিল দেশের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্যে। শিক্ষা, চাকরি, পার্লামেন্টের আসন ভাগ ইত্যাদি সব কিছুই এমনভাবে করেছিল যা সংঘাতের অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করেছিল। আঠার শ’ সাতান্ন সালের সিপাহী বিপ্লবের পর এই বৈষম্য ক্রমশ তীব্র হয়। যার ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে উনিশ শতকের বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর ভারত যতই বিভাজনের দিকে এগিয়েছে দাঙ্গার হার ও ব্যাপকতা ততই বেড়েছে। অথচ ব্রিটিশরা আসার আগে এদেশে হিন্দু- মসুলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ছোটখাটো মারামারি হয়ত মাঝে মাঝে হতো তবে তা সামাজিক পর্যায়েই সীমিত থাকত। তাকে রাজনীতির খেলায় পরিণত করে ফায়দা লোটার সাক্ষ্য ইতিহাস দেয় না। এ অবদান পুরোপুরি ব্রিটিশের। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ফারসী ঐতিহ্যের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নমনীয় ধারাটি উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে এমন এক নগর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল যা হিন্দু ও মসুলমান নির্বিশেষে সমাজের উচ্চস্তরের সকল মানুষকে প্রভাবিত করে। কিছুদিন আগেও উত্তর প্রদেশের কিছু কিছু কায়স্থ পরিবার নিত্যদিন তাদের পারিবারিক বিগ্রহ পুজোর সময় ফার্সি ভাষা ব্যবহার করতÑযেমন ‘ বাকানহা এক ফুলূুস বেদেহাম’ অর্থাৎ পুজোয় আমি কৃষ্ণকে একটি পয়সা নৈবেদ্য দেই। এই সেদিন পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভদ্রসমাজে দৈনন্দিনের ব্যবহৃত ভাষাটি ছিল উর্দু যা ফার্সি ভাষার দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। আর শিখ পরিবারগুলোর পুরুষরাও একই ভাষা ব্যবহার করত। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ হোলি ও রাস-এর মতো অতি প্রমোদময় কৃষ্ণলীলা বেগমদের সমভিব্যহারে উদযাপন করতেন। বঙ্গদেশে জনৈক মুসলসমান রচিত রাজশাহীর এক ইতিহাসে মুসলমানদের দুর্গা পুজো করার উপদেশ দেয়া হয়েছিল। অনেক হিন্দু পরিবার স্থানীয় পীর-আউলিয়ার মাজারে ঐতিহ্যগতভাবে শিরনী দিত এবং এখনও দেয়। আর আমাদের এ অঞ্চলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতামতের সারমর্ম হলো, এখানে কিছু মানুষ শরীয়ত অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তবে সম্ভবত বৃহত্তর অংশটা মুসলমান ও তাদের পীরদের সঙ্গে শ্রেফ দীর্ঘদিনের ওঠাবসার মধ্য দিয়ে মুসলমান হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। বঙ্গীয় সমাজের বঞ্চিত-অবহেলিতরা স্থানীয় পরিসরের অসংখ্য দেবদেবীর পুজো করত। যারা আসলে ছিল নানা রকম শক্তি, রোগব্যাধি এবং সাপ, বাঘ, কুমিরের মতো হিংস্র প্রাণীর প্রতিনিধি। এসব শক্তির পুজো করা হতো তাদের প্রসন্ন রাখতে। অভিজাত ব্রাহ্মণরা এই নীচুশ্রেণীর দেবদেবী ও তাদের অনুগতদের হিন্দু ধর্মের বলে স্বীকার করেনি। পরে গরিব ব্রাহ্ম্ণরা নিজেদের রচিত পাঁচালীতে এদের বন্দনা করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এবং এদের ভক্তরাও হিন্দু হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলনে জাতপাতের বিধিনিষেধ আলগা হলে নিম্নবর্ণের এ মানুষরা হিন্দু সমাজের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত হয়।
অর্থাৎ এ অঞ্চলের সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতেভাবে জড়িয়ে ছিল। বাস্তবতা হলো যে কোন সাম্প্রদায়িক আক্রমণের প্রথম শিকার হতো এরাই। আজও তাই কেননা, এরা দুর্বল জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটি এরাই হয়। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু- মুসলমানদের গায়ে এর আঁচ লাগে খুব্ই কম।
অসম সমাজ ব্যবস্থায় এমনই হওয়াই স্বাভাবিক। এই যে ধর্মীয় উৎপীড়ন, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস, ধর্মের নানা মাত্রার অপব্যবহার সব কিছুর পেছনেই রয়েছে আসলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
কি বলা যায় একেÑসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা? দাঙ্গায় তো দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ থাকে। একে দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন বলাই বোধহয় বেশি সঙ্গত। সাম্প্রদায়িক উষ্কানির আগুনে ঘি ঢেলে মাঝ থেকে লাভবান হতে চেয়েছে তৃতীয় পক্ষ। সেই যে ব্রিটিশরা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বীজ বুনে সযতœ পরিচর্যায় মহীরুহ করে তার ফল ভোগ করে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিল এ অঞ্চলের দু’সম্প্রদায়ের ঘাড়ে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আজও মাঝে মাঝেই তা তীব্র ব্যথার ক্ষত তৈরি করে, নাড়িয়ে দেয় সুস্থ চিন্তাকে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তবতা গ্রহণযোগ্যতা হারালেও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের ধারাবাহিকতা সমানভাবেই অক্ষুন্ন রয়েছে।
মাত্র এক দশক আগে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাদের স্মৃতিতে এখনো দগদগে। সিরাজ গঞ্জের সেইপুর্ণিমা কিংবা গফর গাঁওয়ের জ্যোৎস্নাকে কি ভোলা সম্ভব সুসহ্য বিবেকের পক্ষে? দুহাজার একের নির্বাচনের পরের বিভিষীকাময় ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিল দেশের রাজনীতিতে মৌলবাদ নামের অন্ধ উন্মাতাল উপদান সংযোজিত হতে যাচ্ছে। আজ দশ এগার বছর পর চারপাশে তাকালে তার অনেক স্বাক্ষরই দেখা যায়। শান্তি ও সমর্পণের জাগায় থেকে সরে র্ধম হয়েছে অনেক বেশি সহিংসও স্থুল। গ্রেনেড, বোমা হামলা ঘটেছে। । হুমায়ুন আজাদের মত মুক্ত চিন্তার মানুষদের জীবন বিপন্ন হয়েছিল । তবে দু’ হাজার একের সেই ভয়াবহ স্মৃতিতে খানিকটা হলেও মমতার প্রলেপ বুলিয়েছে বর্তমান সরকারের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংঘটিত খুন ধর্ষন লুন্ঠন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ সব ধরনের সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি। পুর্নিমা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত বছর। দশ বছর পর হলেও নৃশংতম ওই ঘটনার বিচারের রায় হওয়া নিসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ । ওই রায়ে এগার জনের যাবজীবন কারাদন্ড হয়েছিল।
এসব কিছুর পেছনেই তো রয়েছে আসলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা। দুর্বলের ওপর সবলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তা সংহত রাখার নিরলস প্রচেষ্টা। এ কাজ করতে গিয়ে যত ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় তার কোনটাই বাদ পড়ে না।
এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি করে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। নিজেদের শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থার সুবিধার জন্যই তারা ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিল দেশের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্যে। শিক্ষা, চাকরি, পার্লামেন্টের আসন ভাগ ইত্যাদি সব কিছুই এমনভাবে করেছিল যা সংঘাতের অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করেছিল। আঠার শ’ সাতান্ন সালের সিপাহী বিপ্লবের পর এই বৈষম্য ক্রমশ তীব্র হয়। যার ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে উনিশ শতকের বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর ভারত যতই বিভাজনের দিকে এগিয়েছে দাঙ্গার হার ও ব্যাপকতা ততই বেড়েছে। অথচ ব্রিটিশরা আসার আগে এদেশে হিন্দু- মসুলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ছোটখাটো মারামারি হয়ত মাঝে মাঝে হতো তবে তা সামাজিক পর্যায়েই সীমিত থাকত। তাকে রাজনীতির খেলায় পরিণত করে ফায়দা লোটার সাক্ষ্য ইতিহাস দেয় না। এ অবদান পুরোপুরি ব্রিটিশের। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ফারসী ঐতিহ্যের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নমনীয় ধারাটি উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে এমন এক নগর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল যা হিন্দু ও মসুলমান নির্বিশেষে সমাজের উচ্চস্তরের সকল মানুষকে প্রভাবিত করে। কিছুদিন আগেও উত্তর প্রদেশের কিছু কিছু কায়স্থ পরিবার নিত্যদিন তাদের পারিবারিক বিগ্রহ পুজোর সময় ফার্সি ভাষা ব্যবহার করতÑযেমন ‘ বাকানহা এক ফুলূুস বেদেহাম’ অর্থাৎ পুজোয় আমি কৃষ্ণকে একটি পয়সা নৈবেদ্য দেই। এই সেদিন পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভদ্রসমাজে দৈনন্দিনের ব্যবহৃত ভাষাটি ছিল উর্দু যা ফার্সি ভাষার দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। আর শিখ পরিবারগুলোর পুরুষরাও একই ভাষা ব্যবহার করত। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ হোলি ও রাস-এর মতো অতি প্রমোদময় কৃষ্ণলীলা বেগমদের সমভিব্যহারে উদযাপন করতেন। বঙ্গদেশে জনৈক মুসলসমান রচিত রাজশাহীর এক ইতিহাসে মুসলমানদের দুর্গা পুজো করার উপদেশ দেয়া হয়েছিল। অনেক হিন্দু পরিবার স্থানীয় পীর-আউলিয়ার মাজারে ঐতিহ্যগতভাবে শিরনী দিত এবং এখনও দেয়। আর আমাদের এ অঞ্চলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতামতের সারমর্ম হলো, এখানে কিছু মানুষ শরীয়ত অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তবে সম্ভবত বৃহত্তর অংশটা মুসলমান ও তাদের পীরদের সঙ্গে শ্রেফ দীর্ঘদিনের ওঠাবসার মধ্য দিয়ে মুসলমান হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। বঙ্গীয় সমাজের বঞ্চিত-অবহেলিতরা স্থানীয় পরিসরের অসংখ্য দেবদেবীর পুজো করত। যারা আসলে ছিল নানা রকম শক্তি, রোগব্যাধি এবং সাপ, বাঘ, কুমিরের মতো হিংস্র প্রাণীর প্রতিনিধি। এসব শক্তির পুজো করা হতো তাদের প্রসন্ন রাখতে। অভিজাত ব্রাহ্মণরা এই নীচুশ্রেণীর দেবদেবী ও তাদের অনুগতদের হিন্দু ধর্মের বলে স্বীকার করেনি। পরে গরিব ব্রাহ্ম্ণরা নিজেদের রচিত পাঁচালীতে এদের বন্দনা করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এবং এদের ভক্তরাও হিন্দু হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলনে জাতপাতের বিধিনিষেধ আলগা হলে নিম্নবর্ণের এ মানুষরা হিন্দু সমাজের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত হয়।
অর্থাৎ এ অঞ্চলের সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতেভাবে জড়িয়ে ছিল। বাস্তবতা হলো যে কোন সাম্প্রদায়িক আক্রমণের প্রথম শিকার হতো এরাই। আজও তাই কেননা, এরা দুর্বল জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটি এরাই হয়। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু- মুসলমানদের গায়ে এর আঁচ লাগে খুব্ই কম।
অসম সমাজ ব্যবস্থায় এমনই হওয়াই স্বাভাবিক। এই যে ধর্মীয় উৎপীড়ন, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস, ধর্মের নানা মাত্রার অপব্যবহার সব কিছুর পেছনেই রয়েছে আসলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
No comments