মানুষের মুখ- ক্যানসার ও এক বিচারকের গল্প
আবদুল কুদ্দুস একজন বিচারক, এক সন্তানের জনক। অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা এবং স্ত্রীর শেষ আশা-ভরসা ও আশ্রয়ের নাম আবদুল কুদ্দুস। পটুয়াখালীর জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ তিনি। আজ তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন আবদুল কুদ্দুস।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন আবদুল কুদ্দুস।
বৃদ্ধ মা-বাবা দেখেছিলেন সুখের আলো। কিন্তু বিধি বাম। মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে আবদুল কুদ্দুস এখন অসহায়। তাঁর এই বিপদে এগিয়ে এসেছেন সহকর্মী ও কিছু বন্ধবান্ধব; যাঁরা অধিকাংশই জুডিশিয়াল সার্ভিসে আছেন। এই বন্ধুরাই ইতিপূর্বে বিচারক মুজাহিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক মুজাহিদকে নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকার খোলা কলমে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর এগিয়ে আসে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, আইনজীবী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ অনেক অজানা মানুষ। সবার ভালোবাসায় মুজাহিদ মরণব্যাধি ক্যানসারকে জয় করেছেন। বিচারক মুজাহিদ ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। যোগ দিয়েছেন বিচারকাজে।
আবদুল কুদ্দুস রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার শাহ মীরপুর গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র থাকাবস্থায় জীবিকার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। গরিব মা-বাবার টানাটানির সংসারে তাঁর লক্ষ্য ছিল বিচারক হওয়া। পাশাপাশি ছোট তিন ভাই ও দুই বোনকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁর পথ ছিল একটাই—টিউশনি। নিজের পড়া আর ছাত্র পড়ানোর বাইরে তাঁর আর কোনো কাজ ছিল না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করে ২০০৮ সালের ২২ মে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নারায়ণগঞ্জে যোগদান করেন। প্রায় মাস খানেক আগে পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। সেখানে চার বছর মেয়াদের বিচারকাজে তিনি সততা, নৈতিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর অসুস্থতার সংবাদে নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী সমিতি ও বেঞ্চ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই নারায়ণগঞ্জে কর্মরত অবস্থাতেই আবদুল কুদ্দুস প্রায় বছর খানেক আগে ঠান্ডা-কাশিতে আক্রান্ত হন। সাধারণ কাশির ওষুধে উপশম না হওয়ায় চিকিৎসক সন্দেহ করেন যক্ষ্মার। ল্যাব এইডে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক যে সত্যটি বললেন, তা আবদুল কুদ্দুসের অবুঝ সন্তান বোঝেনি। কিন্তু তা আঁচড়ে পড়েছে তাঁর মা-বাবা, স্ত্রী, ভাইবোনসহ আত্মীয়-বন্ধুদের হূদয়ে। গত ৯ জুলাই যখন এই রিপোর্টটি চিকিৎসক জানালেন, তত দিনে প্রাণঘাতী এই ব্যাধি কুদ্দুসের প্রাণ সংহারে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে।
প্রিয় পাঠক, আজ যেখানে কুদ্দুস দাঁড়িয়ে আছেন, কাল সেখানে আমাদেরই কারও ভাই, কারও মা-বাবা কিংবা প্রাণপ্রিয় সন্তান থাকবে না—এমন কথা আগবাড়িয়ে আমরা কেউই বলতে পারব না। মানবিকতা আর মানসিকতার ঔদার্য দিয়ে মৃত্যুকে জয় করার নজির আমরাই স্থাপন করেছি বারবার। আমরাই বিচারক মুজাহিদসহ অন্যান্যের মুখে ফিরিয়ে এনেছি মৃত্যুঞ্জয়ী হাসি। আবদুল কুদ্দুসকে ১৯ জুলাই পাঠানো হয়েছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর চিকিৎসা চলছে। কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাভাবে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আর বিঘ্নিত হওয়ার অর্থ মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পথে ক্রমেই দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁকে যখন আমরা দেখতে যাই, তখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো কুদ্দুস অসহায়ভাবে কাঁদলেন, আমাদের কাঁদালেন। আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বললেন, ‘আমি বাঁচতে চাই।’
হায়রে মা-বাবা! ছোটবেলা থেকে যাকে দিয়ে তিল তিল করে বুনেছেন নিজেদের স্বপ্নের নকশিকাঁথা, আজ যখন তার উষ্ণ স্নেহার্দ্র শরীরে জড়াবেন, ঠিক তখনই তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটল যেন। সন্তানের রোজগারে এই বৃদ্ধ বয়সে যখন তাঁদের আয়েশ করার কথা, ঠিক তখনই তাঁরা চিন্তার চিতায় দগ্ধ, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছেন অবশিষ্ট আবাদি জমির ক্রেতার সন্ধানে...।
আবদুল কুদ্দুসের স্ত্রী রুনার চোখ দিয়ে আর অশ্রু ঝরে না। স্বামীর জীবনের জন্য বাস্তবতার কঠিন রণপ্রান্তরের প্রচণ্ড দাবদাহে অশ্রু তাঁর বাষ্পায়িত। ছোট ভাইবোনেরা সামর্থ্যহীনতার অনুতাপে আত্মদগ্ধ। কুদ্দুসের নিষ্পাপ সন্তান মায়াময় সরল দুটি চোখে যখন তাকায়, তখন তার সে চাহনি সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রিয় পাঠক, আমরা কি আরও একবার আমাদের সামর্থ্য, উদারতা আর ভালোবাসার সম্মিলিত শক্তি দিয়ে আবদুল কুদ্দুসের পাশে দাঁড়াতে পারি না? পারি না আরেকবার মানবতা দিয়ে ক্যানসারকে জয় করতে?
সহযোগিতার জন্য: মিসেস রহিমা খাতুন রুনা, হিসাব নম্বর-১০৫.১০১.৫২১৫৮১ ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, ঢাকা।
যোগাযোগ: ০১৭২২১৪০১৭২, ০১৭২২৭৩৪২৬৬
কেশব রায় চৌধুরী, মো. হাসিবুল হক, শাহরিয়ার মাহমুদ, তারেক মইনুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আতাউল হক, রেজাউল করিম, এরফান উল্লাহ, তৈয়বুল হাসান, সৈয়দ মাশফিকুল ইসলাম, মুস্তাফিজুর রহমান।
(লেখকেরা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তা) ও আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার।
আবদুল কুদ্দুস রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার শাহ মীরপুর গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র থাকাবস্থায় জীবিকার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। গরিব মা-বাবার টানাটানির সংসারে তাঁর লক্ষ্য ছিল বিচারক হওয়া। পাশাপাশি ছোট তিন ভাই ও দুই বোনকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁর পথ ছিল একটাই—টিউশনি। নিজের পড়া আর ছাত্র পড়ানোর বাইরে তাঁর আর কোনো কাজ ছিল না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করে ২০০৮ সালের ২২ মে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নারায়ণগঞ্জে যোগদান করেন। প্রায় মাস খানেক আগে পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। সেখানে চার বছর মেয়াদের বিচারকাজে তিনি সততা, নৈতিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর অসুস্থতার সংবাদে নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী সমিতি ও বেঞ্চ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই নারায়ণগঞ্জে কর্মরত অবস্থাতেই আবদুল কুদ্দুস প্রায় বছর খানেক আগে ঠান্ডা-কাশিতে আক্রান্ত হন। সাধারণ কাশির ওষুধে উপশম না হওয়ায় চিকিৎসক সন্দেহ করেন যক্ষ্মার। ল্যাব এইডে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক যে সত্যটি বললেন, তা আবদুল কুদ্দুসের অবুঝ সন্তান বোঝেনি। কিন্তু তা আঁচড়ে পড়েছে তাঁর মা-বাবা, স্ত্রী, ভাইবোনসহ আত্মীয়-বন্ধুদের হূদয়ে। গত ৯ জুলাই যখন এই রিপোর্টটি চিকিৎসক জানালেন, তত দিনে প্রাণঘাতী এই ব্যাধি কুদ্দুসের প্রাণ সংহারে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে।
প্রিয় পাঠক, আজ যেখানে কুদ্দুস দাঁড়িয়ে আছেন, কাল সেখানে আমাদেরই কারও ভাই, কারও মা-বাবা কিংবা প্রাণপ্রিয় সন্তান থাকবে না—এমন কথা আগবাড়িয়ে আমরা কেউই বলতে পারব না। মানবিকতা আর মানসিকতার ঔদার্য দিয়ে মৃত্যুকে জয় করার নজির আমরাই স্থাপন করেছি বারবার। আমরাই বিচারক মুজাহিদসহ অন্যান্যের মুখে ফিরিয়ে এনেছি মৃত্যুঞ্জয়ী হাসি। আবদুল কুদ্দুসকে ১৯ জুলাই পাঠানো হয়েছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর চিকিৎসা চলছে। কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাভাবে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আর বিঘ্নিত হওয়ার অর্থ মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পথে ক্রমেই দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁকে যখন আমরা দেখতে যাই, তখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো কুদ্দুস অসহায়ভাবে কাঁদলেন, আমাদের কাঁদালেন। আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বললেন, ‘আমি বাঁচতে চাই।’
হায়রে মা-বাবা! ছোটবেলা থেকে যাকে দিয়ে তিল তিল করে বুনেছেন নিজেদের স্বপ্নের নকশিকাঁথা, আজ যখন তার উষ্ণ স্নেহার্দ্র শরীরে জড়াবেন, ঠিক তখনই তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটল যেন। সন্তানের রোজগারে এই বৃদ্ধ বয়সে যখন তাঁদের আয়েশ করার কথা, ঠিক তখনই তাঁরা চিন্তার চিতায় দগ্ধ, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছেন অবশিষ্ট আবাদি জমির ক্রেতার সন্ধানে...।
আবদুল কুদ্দুসের স্ত্রী রুনার চোখ দিয়ে আর অশ্রু ঝরে না। স্বামীর জীবনের জন্য বাস্তবতার কঠিন রণপ্রান্তরের প্রচণ্ড দাবদাহে অশ্রু তাঁর বাষ্পায়িত। ছোট ভাইবোনেরা সামর্থ্যহীনতার অনুতাপে আত্মদগ্ধ। কুদ্দুসের নিষ্পাপ সন্তান মায়াময় সরল দুটি চোখে যখন তাকায়, তখন তার সে চাহনি সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রিয় পাঠক, আমরা কি আরও একবার আমাদের সামর্থ্য, উদারতা আর ভালোবাসার সম্মিলিত শক্তি দিয়ে আবদুল কুদ্দুসের পাশে দাঁড়াতে পারি না? পারি না আরেকবার মানবতা দিয়ে ক্যানসারকে জয় করতে?
সহযোগিতার জন্য: মিসেস রহিমা খাতুন রুনা, হিসাব নম্বর-১০৫.১০১.৫২১৫৮১ ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, ঢাকা।
যোগাযোগ: ০১৭২২১৪০১৭২, ০১৭২২৭৩৪২৬৬
কেশব রায় চৌধুরী, মো. হাসিবুল হক, শাহরিয়ার মাহমুদ, তারেক মইনুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আতাউল হক, রেজাউল করিম, এরফান উল্লাহ, তৈয়বুল হাসান, সৈয়দ মাশফিকুল ইসলাম, মুস্তাফিজুর রহমান।
(লেখকেরা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তা) ও আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার।
No comments