বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাঃ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ ও আমাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব by মাহরুফ চৌধুরী
সাম্প্রতিক সরকার বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার আনুমতি দিতে ‘বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা বিধিমালা প্রণয়ন কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদানের ঊদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে যে দেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও উচ্চশিক্ষার মানবৃদ্ধির জন্য নাকি এটা জরুরী।
এঊদ্দেশ্য বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বিধিমালা প্রণয়ন করতে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একমিটি ‘বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’-এর আলোকে এবিধিমালা তৈরী করবে বলে বলা হয়েছে। যাই হোক, সরকার উচ্চশিক্ষার মানবৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিতে এবিধিমালা প্রণয়ন করছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে (যায়যায়দিন, ০৭.০৬.২০১২)।
খবরে প্রকাশ, গত ৬ই জুন ২০১২ তারিখে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মেলন কক্ষে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের ঊদ্দেশ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐসভায় বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদ্স্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান আকন্দ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শফি সামি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য আতফুল হাই শিবলী এবং আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর কমিটির সদস্য সচিব। কমিটিকে গত ৫ই জুলাইয়ের মধ্যে খসড়া বিধিমালা উপস্থাপন করার জন্য বলা হয়েছিল। কমিটি হয়তো খসড়াও জমা দিয়েছে, কিন্তু এবিষয়ে জনসন্মুখে এখনো কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
যদিও আমরা এই বিধিমালা সম্পর্কে কিছুই জানি না, তবু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলতে চায় যে, দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে তুলে দেয়া হবে আমাদের দেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের জন্য আত্মঘাতী। সে যাই হোক, এখানে এবিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশে নির্ঘাত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীভুক্ত হবে। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, আমরা যেখানে আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, তবে আমরা কিভাব বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করব? তাছাড়া আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য কেন আমাদেরকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে? আমাদের দেশের বেসরকারী ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই তো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে সেটা করা সম্ভব। আর দৃষ্টিগোচর না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠছে তাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমবিকাশমান আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া জরুরী। বাংলাদেশের মতো ব্যাপক জনসংখ্যার ভারে ভারক্রান্ত একটা দেশের পক্ষে রাতারাতি কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মানউন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষায় প্রতিভাবানদের জায়গা করে দেয়া, উন্নত শিক্ষাক্রম ও উন্নত শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন এবং উন্নত শিক্ষাউপকরণ ব্যবহার করা। আর এটা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিভাবানদেরকে স্থান করে দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের নানারকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে।
যাই হোক, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়ার আগে আমাদেরকে লাভ-ক্ষতির অংকটা ভালোভাবেই কষে দেখা উচিত, নচেত একটি সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় দেশের যে ক্ষতি সাধিত হবে তার দায়ভার নিতে হবে বর্তমান সরকারকে। অতএব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে আমরা সরকারকে নিচে আলোচিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্রথমত, আমরা যদি এবিষয়টাকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে দেখি, তাহলেও বাংলাদেশকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজার হিসেবে ছেড়ে দিলে আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। আর এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা আমাদের মতো একটা স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে যখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে তখন বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের স্রোতে ব্যাপক ভাটা পড়ে। বাংলাদেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে মূলত শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববতী রাষ্ট্র ভারতসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার জন্য যেত। এসব শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে একটা বিরাট অংকের টাকা বিদেশে চলে যেত। দেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুবাধে দেশের বিপুল অংকের টাকা বিদেশে যাওয়ার হাত থেকে রেহায় পায়। কিন্তু এখন যদি বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা খোলার অনুমতি দেয়া হয়, তবে অবাক হব না ভারতের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ আমেরিকাভিত্তিক নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সুযোগকে লুফে নিলে এবং এব্যবস্থা শিক্ষার বেসরকারীকরণের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজার অর্থনীতির পণ্যে পরিণত করবে। বস্তুত আমাদের দেশেরই এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীরা সেই সুযোগকে কাজে লাগাবে এবং শিক্ষাবানিজ্যের জন্য নব্য-উপনিবেশবাদীদেরকে স্বাগত জানাবে।
আমরা যদি এবিষয়টিকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে বিবেচনা করে দেখি তবে সহজে বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই আমাদের দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা যদি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের দেশে অবাধে শিক্ষা-ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেই তবে তারা শিক্ষা বানিজ্যের মাধ্যমে আমাদের বিপুল অর্থ বিদেশে নিয়ে যাবে। তখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিরূপ দাঁড়াবে সেটা আমাদের অর্থনীতিবিদেরা ও প্রজাতন্ত্রের কর্ণধারেরা এখনই ভাবা উচিত।
দ্বিতীয়ত, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব বিদেশী শিক্ষক কাজ করবেন তারা সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকেরা নন যাদের জন্য সেই সব বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হবে তাদেরকেই যাদেরকে সেইসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ক্যাম্পাসে জায়গা দিতে চাইবে না কোন মতে। অর্থের প্রয়োজনেই তারা নিয়োগ দিবে সেই সব বিদেশীদেরকে তাদের বাংলাদেশী ক্যাম্পাসে। শুধু ইংরেজী ভাষা জানা ও বিদেশী হওয়ার কল্যাণেই তারা পার পেয়ে যাব এবং শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হবে। তাই এসব শাখায় ‘বিদেশী ডিগ্রি’র নামে যেসব মাকাল ফল বিক্রয় হবে তা আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির জন্য কি পরিণাম বয়ে আনবে তা আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদেরা এখনই বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে যেসব বিদেশী কাজ করেন, আমরা কি তাদের কাছ থেকে কোন আয়কর পায়? এবিষয়ে আমরা কোন জ্ঞান নেই। যদি পেয়ে থাকি, কতটুকু পাই? আমাদের আয়কর কর্মকর্তারা কি বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন? আর আমরা যারা বিদেশে চাকুরী করি তাদেরকে আয়করের টাকা কেটেই বেতন প্রদান করা হয়ে থাকে। তাছাড়া এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা যদি সেসব দেশের হন, যেসব দেশের সাথে আমাদের দেশের আয়কর বিষয়ক চুক্তি আছে, তাহলে তো তারা তাদের দেশে আয়কর প্রদান করবে এবং আমাদের দেশে তাদের কোন কর প্রদান করতে হবে না। ফলে আমরা হারাব তাদের আয়করের সম্পূর্ণটাই যারা এদেশে বসবাসের কল্যাণে তুলনামূলক স্বল্প জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করবে। তাহলে এক্ষেত্রে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে ই্উরোপসহ পাশ্চাত্যের যেসব দেশে বাংলাদেশীরা কাজ করছে তাদের সেসব দেশেই আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে। আর ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের দেশসমূহের যেসব নাগরিকেরা বাংলাদেশে কাজ করছেন তারা তাদের নিজ নিজ দেশই আয়কর প্রদান করছেন। এভাবে আমাদের দেশ যে বিরাট অংকের আয়কর হতে বঞ্চিত হচ্ছে এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যে দিয়ে দেশ থেকে চলে যাবে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারী সরকার কি বিষয়টা বিবেচনায় নিয়েই এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে?
চতুর্থত, আমাদের সংস্কৃতির একটি আত্মঘাতী উপাদান হলো- আমরা আমাদের কোন কিছুকেই ভালো মনে করি না। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার হলো হীনমন্যতা, যা আমাদের রক্তমাংসে মিশে আছে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি যে বিদেশী সব কিছুই ভালো, বিদেশী জিনিসই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। বিভিন্ন পালা পার্বণে আমরা বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতে পাগলপ্রায় এবং দিগ্বিক জ্ঞানশূণ্য। অথচ বাঙালী সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সংরক্ষণে আমাদের কোন প্রচেষ্টাই নেই। যখনই আমাদের পকেটে বিদেশী টাকা পড়ে তখনই আমরা বিদেশীদের জয়গানে মুখর হয়ে উঠি। তাইতো নীরদচন্দ্র চৌধুরী আমাদেরকে বলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালী’। আমাদের মনোজাগতিক এধন্যদশা হতে বের হয়ে আসা উচিত। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং দেশবাসী আশা করে দেশের সিংহভাগ মানুষের আশা আকাঙ্খার যেন প্রতিফলন ঘটে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে। সে যাই হোক, সরকারের মনে রাখা উচিত যে দেশের জনতার আদালতে একদিন তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচিত হবে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের দেশে আসবে অর্থের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক মুক্তির জন্য নয়; প্রকারান্তে বিজাতীয় চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের সংক্রমণে। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীরা বিষয়গুলো এখনই ভেবে দেখবেন, নচেত জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের নাগরিকেরা, যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়বে দেশের ইতিহাস-ঐতিজ্য-সংস্কৃতির সাথে ক্রমাগত তাদের দূরত্ব বেড়ে যাবে। যেটা এখনই দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে অহরহ বৈষম্য তৈরী করে চলেছি, বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি সেটাকে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চনার সৃষ্টি করবে। অপর দিকে আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক হাঙ্গামা আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেড়ে উঠার সংগ্রামের ফাঁকে এসব বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নিবে উচ্চশিক্ষার বিশাল বাংলাদেশী বাজার। তখন এসব সরকারী আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ আর অধ্যাপকেরা ঘুরে বেড়াবেন শিক্ষার সওদা নিয়ে কিংবা উপদেষ্টা আর পরামর্শক হওয়া ধান্দায়- সেদিন হয়ত বেশী দূরে নয়। অবাক করা বিষয় হলো, কমিটিতে সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন উপাচার্য রয়েছেন। তাঁরা কিভাবে এমন একটি কমিটিতে কাজ করেন যেটা সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হবে চরম ক্ষতিকর পদক্ষেপ! তাছাড়া আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী একজন সমাজবাদী রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী, যিনি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করার অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি কিভাবে শিক্ষার এমন ব্যাপক বাণিজ্যিকিকরণের সনদ দানে তাঁর সম্মতি দিচ্ছেন তা অনেকের মতই আমার বোধগম্য নয়। আমরা আশা করব, এবিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির মতোই এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করবে, খতিয়ে দেখবে এর উপযোগিতা। জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই হুট করে বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের প্ররোচনায় দেশের সর্বনাশ করতে এবং বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের এধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আমরা আশা করব বর্তমান সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরবে যাতে করে গণতান্ত্রিক পন্থায় আলোচনা-সমালোচনা আর পর্যালোচনা মধ্যে দিয়ে এবিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পথ অবারিত হয়।
লেখক: গবেষক, ওপেন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য। Email: mahruf@ymail.com
খবরে প্রকাশ, গত ৬ই জুন ২০১২ তারিখে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মেলন কক্ষে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের ঊদ্দেশ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐসভায় বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদ্স্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান আকন্দ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শফি সামি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য আতফুল হাই শিবলী এবং আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর কমিটির সদস্য সচিব। কমিটিকে গত ৫ই জুলাইয়ের মধ্যে খসড়া বিধিমালা উপস্থাপন করার জন্য বলা হয়েছিল। কমিটি হয়তো খসড়াও জমা দিয়েছে, কিন্তু এবিষয়ে জনসন্মুখে এখনো কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
যদিও আমরা এই বিধিমালা সম্পর্কে কিছুই জানি না, তবু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলতে চায় যে, দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে তুলে দেয়া হবে আমাদের দেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের জন্য আত্মঘাতী। সে যাই হোক, এখানে এবিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশে নির্ঘাত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীভুক্ত হবে। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, আমরা যেখানে আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, তবে আমরা কিভাব বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করব? তাছাড়া আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য কেন আমাদেরকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে? আমাদের দেশের বেসরকারী ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই তো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে সেটা করা সম্ভব। আর দৃষ্টিগোচর না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠছে তাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমবিকাশমান আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া জরুরী। বাংলাদেশের মতো ব্যাপক জনসংখ্যার ভারে ভারক্রান্ত একটা দেশের পক্ষে রাতারাতি কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মানউন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষায় প্রতিভাবানদের জায়গা করে দেয়া, উন্নত শিক্ষাক্রম ও উন্নত শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন এবং উন্নত শিক্ষাউপকরণ ব্যবহার করা। আর এটা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিভাবানদেরকে স্থান করে দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের নানারকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে।
যাই হোক, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়ার আগে আমাদেরকে লাভ-ক্ষতির অংকটা ভালোভাবেই কষে দেখা উচিত, নচেত একটি সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় দেশের যে ক্ষতি সাধিত হবে তার দায়ভার নিতে হবে বর্তমান সরকারকে। অতএব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে আমরা সরকারকে নিচে আলোচিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্রথমত, আমরা যদি এবিষয়টাকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে দেখি, তাহলেও বাংলাদেশকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজার হিসেবে ছেড়ে দিলে আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। আর এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা আমাদের মতো একটা স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে যখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে তখন বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের স্রোতে ব্যাপক ভাটা পড়ে। বাংলাদেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে মূলত শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববতী রাষ্ট্র ভারতসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার জন্য যেত। এসব শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে একটা বিরাট অংকের টাকা বিদেশে চলে যেত। দেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুবাধে দেশের বিপুল অংকের টাকা বিদেশে যাওয়ার হাত থেকে রেহায় পায়। কিন্তু এখন যদি বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা খোলার অনুমতি দেয়া হয়, তবে অবাক হব না ভারতের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ আমেরিকাভিত্তিক নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সুযোগকে লুফে নিলে এবং এব্যবস্থা শিক্ষার বেসরকারীকরণের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজার অর্থনীতির পণ্যে পরিণত করবে। বস্তুত আমাদের দেশেরই এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীরা সেই সুযোগকে কাজে লাগাবে এবং শিক্ষাবানিজ্যের জন্য নব্য-উপনিবেশবাদীদেরকে স্বাগত জানাবে।
আমরা যদি এবিষয়টিকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে বিবেচনা করে দেখি তবে সহজে বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই আমাদের দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা যদি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের দেশে অবাধে শিক্ষা-ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেই তবে তারা শিক্ষা বানিজ্যের মাধ্যমে আমাদের বিপুল অর্থ বিদেশে নিয়ে যাবে। তখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিরূপ দাঁড়াবে সেটা আমাদের অর্থনীতিবিদেরা ও প্রজাতন্ত্রের কর্ণধারেরা এখনই ভাবা উচিত।
দ্বিতীয়ত, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব বিদেশী শিক্ষক কাজ করবেন তারা সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকেরা নন যাদের জন্য সেই সব বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হবে তাদেরকেই যাদেরকে সেইসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ক্যাম্পাসে জায়গা দিতে চাইবে না কোন মতে। অর্থের প্রয়োজনেই তারা নিয়োগ দিবে সেই সব বিদেশীদেরকে তাদের বাংলাদেশী ক্যাম্পাসে। শুধু ইংরেজী ভাষা জানা ও বিদেশী হওয়ার কল্যাণেই তারা পার পেয়ে যাব এবং শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হবে। তাই এসব শাখায় ‘বিদেশী ডিগ্রি’র নামে যেসব মাকাল ফল বিক্রয় হবে তা আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির জন্য কি পরিণাম বয়ে আনবে তা আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদেরা এখনই বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে যেসব বিদেশী কাজ করেন, আমরা কি তাদের কাছ থেকে কোন আয়কর পায়? এবিষয়ে আমরা কোন জ্ঞান নেই। যদি পেয়ে থাকি, কতটুকু পাই? আমাদের আয়কর কর্মকর্তারা কি বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন? আর আমরা যারা বিদেশে চাকুরী করি তাদেরকে আয়করের টাকা কেটেই বেতন প্রদান করা হয়ে থাকে। তাছাড়া এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা যদি সেসব দেশের হন, যেসব দেশের সাথে আমাদের দেশের আয়কর বিষয়ক চুক্তি আছে, তাহলে তো তারা তাদের দেশে আয়কর প্রদান করবে এবং আমাদের দেশে তাদের কোন কর প্রদান করতে হবে না। ফলে আমরা হারাব তাদের আয়করের সম্পূর্ণটাই যারা এদেশে বসবাসের কল্যাণে তুলনামূলক স্বল্প জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করবে। তাহলে এক্ষেত্রে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে ই্উরোপসহ পাশ্চাত্যের যেসব দেশে বাংলাদেশীরা কাজ করছে তাদের সেসব দেশেই আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে। আর ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের দেশসমূহের যেসব নাগরিকেরা বাংলাদেশে কাজ করছেন তারা তাদের নিজ নিজ দেশই আয়কর প্রদান করছেন। এভাবে আমাদের দেশ যে বিরাট অংকের আয়কর হতে বঞ্চিত হচ্ছে এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যে দিয়ে দেশ থেকে চলে যাবে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারী সরকার কি বিষয়টা বিবেচনায় নিয়েই এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে?
চতুর্থত, আমাদের সংস্কৃতির একটি আত্মঘাতী উপাদান হলো- আমরা আমাদের কোন কিছুকেই ভালো মনে করি না। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার হলো হীনমন্যতা, যা আমাদের রক্তমাংসে মিশে আছে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি যে বিদেশী সব কিছুই ভালো, বিদেশী জিনিসই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। বিভিন্ন পালা পার্বণে আমরা বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতে পাগলপ্রায় এবং দিগ্বিক জ্ঞানশূণ্য। অথচ বাঙালী সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সংরক্ষণে আমাদের কোন প্রচেষ্টাই নেই। যখনই আমাদের পকেটে বিদেশী টাকা পড়ে তখনই আমরা বিদেশীদের জয়গানে মুখর হয়ে উঠি। তাইতো নীরদচন্দ্র চৌধুরী আমাদেরকে বলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালী’। আমাদের মনোজাগতিক এধন্যদশা হতে বের হয়ে আসা উচিত। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং দেশবাসী আশা করে দেশের সিংহভাগ মানুষের আশা আকাঙ্খার যেন প্রতিফলন ঘটে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে। সে যাই হোক, সরকারের মনে রাখা উচিত যে দেশের জনতার আদালতে একদিন তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচিত হবে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের দেশে আসবে অর্থের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক মুক্তির জন্য নয়; প্রকারান্তে বিজাতীয় চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের সংক্রমণে। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীরা বিষয়গুলো এখনই ভেবে দেখবেন, নচেত জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের নাগরিকেরা, যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়বে দেশের ইতিহাস-ঐতিজ্য-সংস্কৃতির সাথে ক্রমাগত তাদের দূরত্ব বেড়ে যাবে। যেটা এখনই দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে অহরহ বৈষম্য তৈরী করে চলেছি, বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি সেটাকে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চনার সৃষ্টি করবে। অপর দিকে আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক হাঙ্গামা আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেড়ে উঠার সংগ্রামের ফাঁকে এসব বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নিবে উচ্চশিক্ষার বিশাল বাংলাদেশী বাজার। তখন এসব সরকারী আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ আর অধ্যাপকেরা ঘুরে বেড়াবেন শিক্ষার সওদা নিয়ে কিংবা উপদেষ্টা আর পরামর্শক হওয়া ধান্দায়- সেদিন হয়ত বেশী দূরে নয়। অবাক করা বিষয় হলো, কমিটিতে সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন উপাচার্য রয়েছেন। তাঁরা কিভাবে এমন একটি কমিটিতে কাজ করেন যেটা সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হবে চরম ক্ষতিকর পদক্ষেপ! তাছাড়া আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী একজন সমাজবাদী রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী, যিনি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করার অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি কিভাবে শিক্ষার এমন ব্যাপক বাণিজ্যিকিকরণের সনদ দানে তাঁর সম্মতি দিচ্ছেন তা অনেকের মতই আমার বোধগম্য নয়। আমরা আশা করব, এবিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির মতোই এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করবে, খতিয়ে দেখবে এর উপযোগিতা। জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই হুট করে বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের প্ররোচনায় দেশের সর্বনাশ করতে এবং বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের এধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আমরা আশা করব বর্তমান সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরবে যাতে করে গণতান্ত্রিক পন্থায় আলোচনা-সমালোচনা আর পর্যালোচনা মধ্যে দিয়ে এবিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পথ অবারিত হয়।
লেখক: গবেষক, ওপেন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য। Email: mahruf@ymail.com
No comments