অলিম্পিক খেলার গল্প by নাদিরা মজুমদার
(শেষাংশ) ঠা-াযুদ্ধের ঝাপ্টাও অলিম্পিককে সইতে হয়েছে। তবে এই প্রসঙ্গে আসার আগে, মিউনিখ ম্যাসাকার নামে পরিচিত হত্যাকা-টির কথা বলা যাক। মিউনিখ অলিম্পিকের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘটনাটি ঘটে; ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে ফিলিস্তিনীদের একটি দল অলিম্পিক গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং ইসরাইলী টিমের খেলোয়াড়, ক্রীড়ক, কোচ, কর্মচারী-
সবাইকে জিম্মি হিসেবে আটক করে। বাধা দিলে, ঘটনাস্থলে দুই ক্রীড়ক মারা যায়। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলের দাবি ছিল: ইসরাইলী জেলে আটককৃত ২৩৪ ফিলিস্তিনিসহ আন্ড্রিয়াস বাদের ও উলরিকে মাইনহফকে মুক্তি দাও। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর তাদের অপারেশনের নাম দেয় ‘ইক্রিট’ ও ‘বিরাম’ নামে খ্রীস্টান অধ্যুষিত দুইটি ফিলিস্তিনী গ্রামের নামে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল এই গ্রাম দুটো থেকে সবাইকে উচ্ছেদ করেছিল। ঘটনার পরিণতিÑসব পক্ষের জন্যই ছিল মর্মান্তিক। জার্মানি যদি ব্যর্থ অ্যামবুশের চেষ্টা না করত, হয়ত ১১ খেলোয়াড় ও ক্রীড়কসহ তাদের কোচরা ও ৫জন ফিলিস্তিনীর মৃত্যু এড়ানো যেত। অবশ্য ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের বাকি যে কয়জন ফিলিস্তিনী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, তাদের কেউই মোসাদের রোষ দৃষ্টি ঠেকাতে পারেনি। এমনকি মোসাদের শিকার সন্ধানী রোষের হাতে নিছক সন্দেহভাজনও প্রাণ হারায়। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি অলিম্পিকের নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর সুদূরপ্রসারী গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত আটলান্টা (জর্জিয়া-যুক্তরাষ্ট্র) অলিম্পিকের সময়ে ‘গৃহপালিত’ এক আমেরিকান সন্ত্রাসী খোলামেলা সেন্টেনিয়াল অলিম্পিক পার্কে যে বোমা ফাটায়, তার ফলে দু’জন নিহত হয় ও ১১১জন আহত হয়। তবে নাইন-ইলেভেনের পর পরই অনুষ্ঠিত ২০০২ সালের সল্ট লেকের শীতকালীন অলিম্পিকের মেজাজ ছিল একেবারেই ভিন্ন মেজাজের; নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ‘আফটারম্যাথ অব দ্যাট ডে’জ ইভেন্টস’ বা গ্রাউন্ড জিরোতে উড্ডীয়মাণ পতাকা বা ‘গড ব্লেস আমেরিকা’ গাওয়া- আমাদেরকে আপ্লুত করেছিল। হয়ত এই স্মৃতি কারও জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। কারণ, ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনীতে, নিহত ইসরাইলী খেলোয়াড় ও ক্রীড়কদের স্মরণে এক মিনিটের মৌনতা পালনের একটি প্রস্তাব এসেছিল, তবে প্রতিবাদ ও যুক্তিতর্কের ঝড়ে বাতিল হয়ে যায়।
ঠা-াযুদ্ধকালীন অলিম্পিক প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আতিথ্যকর্তা হিসেবে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূখ-ে অনুষ্ঠিত প্রথম অলিম্পিক খেলা। আনুষ্ঠানিক খেলা উদ্বোধনের মাত্র কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও বন্ধুদেশ মস্কো অলিম্পিক বয়কটের কথা ঘোষণা করে। মূল কারণ হিসেবে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত কর্তৃক আফগানিস্তান আক্রমণের কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮১টি দেশ মস্কো অলিম্পিকে অংশ নেয়; ১৯৫৬ সালের পরে এটাই ছিল সবচেয়ে কম অংশগ্রহণকারীর খেলা। ফলে, ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকের সময়ে ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’-এর দৃষ্টান্ত পাই আমরা; খেলোয়াড় ও ক্রীড়কদের নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বন্ধুদেশগুলো অলিম্পিক বয়কট করে। সত্যিকার অর্র্থে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অলিম্পিকে যোগ দেয়া শুরু“ করে ১৯৫২ সাল থেকে। তবে সোভিয়েত শিবির অলিম্পিকের বিকল্প হিসেবে ‘স্পার্র্তাকিয়াডা’ নামে যে খেলার প্রবর্তন করেছিল, সেটি বাস্তবিকই অলিম্পিকের জৌলুস, জাঁকজমক, গ্লামার থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। ১৯৮৫ সালে সর্র্বশেষ ‘স্পার্তাকিয়াডা’টি অনুষ্ঠিত হয় প্রাগে, এবং সেটি দেখার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল।
আবার ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকের সময়ে আমাদেরকে অন্য মেজাজের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। একে সহিংসতার কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়, বলা মুশকিল। যেমন, সশ¯ত্র যুদ্ধের কারণে প্রথম মহাযুদ্ধের জন্য ১৯১৬ সালে, ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ১৯৪০ ও ১৯৪৪ সালে অলিম্পিক খেলা হয়নি; এই সহিংসতার সর্র্বজনীনতা বোধগম্য। বেজিং-এর ঘটনা ছিল অন্য ধরনের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন যখন পরস্পরের কাছ থেকে সামান্য দূরে বসে খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগে মগ্ন, (এমনকি লাঞ্চের সময়ে দু’জনের মধ্যে কথার লেনদেনও হয়) সেই সময়টায় জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখায়েল সাকাশভিলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘দক্ষিণ ওসেতিয়া যুদ্ধ’ নামে পরিচিত যুদ্ধটি বাঁধিয়ে দেন। অবশ্য যুদ্ধটি দ্রুত থেমেও যায়; তবে যুদ্ধের দিনগুলো অলিম্পিকের আনন্দ উৎফুল্লতার রস কিছুটা মিইয়ে দিয়েছিল হয়ত। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয় সাকাশভিলির, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চিরকালের জন্য নস্যাত হয়ে যায়। তবে জর্জিয়ার বর্তমান সরকার আগেভাগেই বলে রেখেছে যে ২০১৪ সালের সোচির (রাশিয়া) শীতকালীন অলিম্পিক তারা বয়কট করছে। অলিম্পিকের হাত ধরে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচারের লোভ কমবেশি প্রায় সব অলিম্পিকেই দেখা যায়।
হিটলারের আগ্রাসী পরিকল্পনাটি কমবেশি সবাই জানত। ফলে, খেলা শুরুর আগে এবং খেলা চলাকালীন প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে কি নাকচ করা হবে-তা নিয়ে বিষম বয়কট পলেমিক চলতে থাকে। কিন্তু শেষ র্পযন্ত একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের সব ক’টি বড় দেশসহ বৃহত্তমসংখ্যক দেশ বার্লিন অলিম্পিকে অংশ নেয়। যদিও বয়কট বিবাদের একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল যে বার্লিন খেলায় অংশগ্রহণের ব্যাখ্যা হবে যে যুক্তরাষ্ট্র নাৎসি শাসন ও হিটলারের ইহুদী-বিরোধী নীতির সমর্থক, কিন্তু খেলাধুলার মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য বাঞ্ছনীয় নয়। এর প্রবক্তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্বে বিজয়ী হন। যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে, মিল্টন গ্রীন ও নর্ম্যান কাহ্নারস নামের দুই আমেরিকান ইহুদী ক্রীড়ক অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
আসলে অলিম্পিককে কেন্দ্র করে অনেক অনেক বিবাদ, বিতর্ক, সহিংসতা, বয়কট, ঘুষের ঘটনা রয়েছে। বলা চলে যে প্রতিটি অলিম্পিককে ঘিরেই এসবের কিছু না কিছু নমুনা পাওয়া যাবেই যাবে। এমনকি খোদ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও সমালোচনার বাইরে নেই। যেমন, ১৯৯৮ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আতিথ্যকর্তা নাগানো’র (জাপান) গবর্নর ২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলেন যে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সদস্যদের পেছনে ‘যুক্তিহীন ও অতিরিক্ত মাপের খায়খাতিরবাবদ’ জাপানী শহরটি ৪.৪ মিলিয়ন ডলার খামোখাই খরচা করেছে।
অলিম্পিক নামক বিশ্ব খেলার সমারোহকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানাবিধ প্রথাগত অনুষ্ঠান, প্রতীক যেমন, অলিম্পিক পতাকা, টর্চ জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদি। আতিথ্যকর্তা অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিচালনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য; অলিম্পিক কমিটির দায়দায়িত্ব হলো শহর নির্বাচন করা, খেলায় কোন কোন ইভেন্ট খেলা হবে - ইত্যাদি ঠিকঠাক করে দেয়া। আরেকটি গুরুত্বপূূর্ণ বিষয় হলো: নির্দিষ্ট ইভেন্ট শেষে মহাসমারোহে, সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখলকারীকে যথাক্রমে স্বর্ণ, রূপা ও ব্রোঞ্জের অলিম্পিক পদক অর্পণ করা। পদক অর্পণের সময় বিজয়ীর জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে জাতীয় পতাকার উত্তোলন, অনুষ্ঠানটিকে আরও চমৎকারিত্ব, আরও সাড়ম্বরতার পরশ বুলিয়ে দেয়। বিগত সব ক’টি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিকে কম করে ১৩০০০ ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছেন। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকে পৃথিবীর প্রায় ২০৪টি দেশের প্রায় ১০৫০০ ক্রীড়ক ও ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকেও দেশ এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা মোটামুটি একই রয়েছে। দুই বছর অন্তর অন্তর কত কত অপরিচিত ক্রীড়ক ও ক্রীড়াবিদ জাতীয় এবং কখনওবা আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করছেন। দেশ ও অংশগ্রহণকারীর ক্রমবৃদ্ধি থেকে বলা যায় যে বিশ্বখেলার এই মহোৎসবটির গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে; বলতে গেলে পৃথিবীর প্রায় সব ক’টি জাতিই অলিম্পিক নামক মহাসম্মিলনের শরিক হচ্ছে। অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে খেলাধুলার ক্ষেত্রে ‘আহামরি’ সাফল্যের তালিকায় নতুন নতুন জাতি বা দেশের আবির্ভাব ও সংযোজন খুব একটা দেখা যায় না। বিগত এক শ’ বছরেরও অধিককাল ধরে হাতেগোনা কিছু দেশ অলিম্পিকে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে; এমনকি গাদাগাদা পদক না পেলেও অন্তত তাদের প্রতিযোগিতামূলক ‘স্পিরিট’ বিজয়ীকে সহজ বিজয় হতে দেয় না। কারণ বোধহয় যে সফল দেশগুলোতে অর্থনীতি, রাজনীতির মতো খেলাধুলাও সমগুরুত্ব পেয়ে থাকে। সব সম্ভাব্য ক্রীড়াবিদই বেসরকারী স্পনসরশিপের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠে। পশ্চিমের এই ‘স্পিরিট’ ও মনমানসিকতা তুলনাহীন, অনুকরণীয়। আসলে কৌশলগত সামর্থ্য অর্জনে ক্রীড়ার মতো অতি বিশ্বস্ত কৌশলগত স্ট্র্যাটেজিক মাধ্যম আর হয় না!
nadirahmajumdar@gmail.com
ঠা-াযুদ্ধকালীন অলিম্পিক প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আতিথ্যকর্তা হিসেবে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূখ-ে অনুষ্ঠিত প্রথম অলিম্পিক খেলা। আনুষ্ঠানিক খেলা উদ্বোধনের মাত্র কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও বন্ধুদেশ মস্কো অলিম্পিক বয়কটের কথা ঘোষণা করে। মূল কারণ হিসেবে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত কর্তৃক আফগানিস্তান আক্রমণের কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮১টি দেশ মস্কো অলিম্পিকে অংশ নেয়; ১৯৫৬ সালের পরে এটাই ছিল সবচেয়ে কম অংশগ্রহণকারীর খেলা। ফলে, ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকের সময়ে ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’-এর দৃষ্টান্ত পাই আমরা; খেলোয়াড় ও ক্রীড়কদের নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বন্ধুদেশগুলো অলিম্পিক বয়কট করে। সত্যিকার অর্র্থে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অলিম্পিকে যোগ দেয়া শুরু“ করে ১৯৫২ সাল থেকে। তবে সোভিয়েত শিবির অলিম্পিকের বিকল্প হিসেবে ‘স্পার্র্তাকিয়াডা’ নামে যে খেলার প্রবর্তন করেছিল, সেটি বাস্তবিকই অলিম্পিকের জৌলুস, জাঁকজমক, গ্লামার থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। ১৯৮৫ সালে সর্র্বশেষ ‘স্পার্তাকিয়াডা’টি অনুষ্ঠিত হয় প্রাগে, এবং সেটি দেখার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল।
আবার ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকের সময়ে আমাদেরকে অন্য মেজাজের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। একে সহিংসতার কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়, বলা মুশকিল। যেমন, সশ¯ত্র যুদ্ধের কারণে প্রথম মহাযুদ্ধের জন্য ১৯১৬ সালে, ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ১৯৪০ ও ১৯৪৪ সালে অলিম্পিক খেলা হয়নি; এই সহিংসতার সর্র্বজনীনতা বোধগম্য। বেজিং-এর ঘটনা ছিল অন্য ধরনের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন যখন পরস্পরের কাছ থেকে সামান্য দূরে বসে খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগে মগ্ন, (এমনকি লাঞ্চের সময়ে দু’জনের মধ্যে কথার লেনদেনও হয়) সেই সময়টায় জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখায়েল সাকাশভিলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘দক্ষিণ ওসেতিয়া যুদ্ধ’ নামে পরিচিত যুদ্ধটি বাঁধিয়ে দেন। অবশ্য যুদ্ধটি দ্রুত থেমেও যায়; তবে যুদ্ধের দিনগুলো অলিম্পিকের আনন্দ উৎফুল্লতার রস কিছুটা মিইয়ে দিয়েছিল হয়ত। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয় সাকাশভিলির, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চিরকালের জন্য নস্যাত হয়ে যায়। তবে জর্জিয়ার বর্তমান সরকার আগেভাগেই বলে রেখেছে যে ২০১৪ সালের সোচির (রাশিয়া) শীতকালীন অলিম্পিক তারা বয়কট করছে। অলিম্পিকের হাত ধরে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচারের লোভ কমবেশি প্রায় সব অলিম্পিকেই দেখা যায়।
হিটলারের আগ্রাসী পরিকল্পনাটি কমবেশি সবাই জানত। ফলে, খেলা শুরুর আগে এবং খেলা চলাকালীন প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে কি নাকচ করা হবে-তা নিয়ে বিষম বয়কট পলেমিক চলতে থাকে। কিন্তু শেষ র্পযন্ত একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের সব ক’টি বড় দেশসহ বৃহত্তমসংখ্যক দেশ বার্লিন অলিম্পিকে অংশ নেয়। যদিও বয়কট বিবাদের একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল যে বার্লিন খেলায় অংশগ্রহণের ব্যাখ্যা হবে যে যুক্তরাষ্ট্র নাৎসি শাসন ও হিটলারের ইহুদী-বিরোধী নীতির সমর্থক, কিন্তু খেলাধুলার মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য বাঞ্ছনীয় নয়। এর প্রবক্তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্বে বিজয়ী হন। যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে, মিল্টন গ্রীন ও নর্ম্যান কাহ্নারস নামের দুই আমেরিকান ইহুদী ক্রীড়ক অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
আসলে অলিম্পিককে কেন্দ্র করে অনেক অনেক বিবাদ, বিতর্ক, সহিংসতা, বয়কট, ঘুষের ঘটনা রয়েছে। বলা চলে যে প্রতিটি অলিম্পিককে ঘিরেই এসবের কিছু না কিছু নমুনা পাওয়া যাবেই যাবে। এমনকি খোদ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও সমালোচনার বাইরে নেই। যেমন, ১৯৯৮ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আতিথ্যকর্তা নাগানো’র (জাপান) গবর্নর ২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলেন যে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সদস্যদের পেছনে ‘যুক্তিহীন ও অতিরিক্ত মাপের খায়খাতিরবাবদ’ জাপানী শহরটি ৪.৪ মিলিয়ন ডলার খামোখাই খরচা করেছে।
অলিম্পিক নামক বিশ্ব খেলার সমারোহকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানাবিধ প্রথাগত অনুষ্ঠান, প্রতীক যেমন, অলিম্পিক পতাকা, টর্চ জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদি। আতিথ্যকর্তা অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিচালনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য; অলিম্পিক কমিটির দায়দায়িত্ব হলো শহর নির্বাচন করা, খেলায় কোন কোন ইভেন্ট খেলা হবে - ইত্যাদি ঠিকঠাক করে দেয়া। আরেকটি গুরুত্বপূূর্ণ বিষয় হলো: নির্দিষ্ট ইভেন্ট শেষে মহাসমারোহে, সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখলকারীকে যথাক্রমে স্বর্ণ, রূপা ও ব্রোঞ্জের অলিম্পিক পদক অর্পণ করা। পদক অর্পণের সময় বিজয়ীর জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে জাতীয় পতাকার উত্তোলন, অনুষ্ঠানটিকে আরও চমৎকারিত্ব, আরও সাড়ম্বরতার পরশ বুলিয়ে দেয়। বিগত সব ক’টি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিকে কম করে ১৩০০০ ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছেন। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকে পৃথিবীর প্রায় ২০৪টি দেশের প্রায় ১০৫০০ ক্রীড়ক ও ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকেও দেশ এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা মোটামুটি একই রয়েছে। দুই বছর অন্তর অন্তর কত কত অপরিচিত ক্রীড়ক ও ক্রীড়াবিদ জাতীয় এবং কখনওবা আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করছেন। দেশ ও অংশগ্রহণকারীর ক্রমবৃদ্ধি থেকে বলা যায় যে বিশ্বখেলার এই মহোৎসবটির গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে; বলতে গেলে পৃথিবীর প্রায় সব ক’টি জাতিই অলিম্পিক নামক মহাসম্মিলনের শরিক হচ্ছে। অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে খেলাধুলার ক্ষেত্রে ‘আহামরি’ সাফল্যের তালিকায় নতুন নতুন জাতি বা দেশের আবির্ভাব ও সংযোজন খুব একটা দেখা যায় না। বিগত এক শ’ বছরেরও অধিককাল ধরে হাতেগোনা কিছু দেশ অলিম্পিকে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে; এমনকি গাদাগাদা পদক না পেলেও অন্তত তাদের প্রতিযোগিতামূলক ‘স্পিরিট’ বিজয়ীকে সহজ বিজয় হতে দেয় না। কারণ বোধহয় যে সফল দেশগুলোতে অর্থনীতি, রাজনীতির মতো খেলাধুলাও সমগুরুত্ব পেয়ে থাকে। সব সম্ভাব্য ক্রীড়াবিদই বেসরকারী স্পনসরশিপের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠে। পশ্চিমের এই ‘স্পিরিট’ ও মনমানসিকতা তুলনাহীন, অনুকরণীয়। আসলে কৌশলগত সামর্থ্য অর্জনে ক্রীড়ার মতো অতি বিশ্বস্ত কৌশলগত স্ট্র্যাটেজিক মাধ্যম আর হয় না!
nadirahmajumdar@gmail.com
No comments