তিন লাখ ৩০ হাজার টনের বেশি ইলিশ থাকার কথা। কিন্তু দেশের বাজারগুলোতে ইলিশের হাহাকার, দামও আকাশছোঁয়া -এত ইলিশ যায় কোথায়? by আবুল হাসনাত ও মনিরুল ইসলাম

সরকারি হিসাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে আনুমানিক তিন লাখ ৪০ হাজার টন। আর মে পর্যন্ত ইলিশ রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ১৭৩ টন। এই হিসাবে দেশের ভেতর তিন লাখ ৩০ হাজার টনের বেশি ইলিশ থাকার কথা। কিন্তু দেশের বাজারগুলোতে ইলিশের হাহাকার, দামও আকাশছোঁয়া।


গত ৩১ জুলাই সরকার চিংড়ি ছাড়া সব ধরনের কাঁচা মাছ (ইলিশসহ) রপ্তানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাজারে ইলিশের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বছরে ছয় মাস ধরে যে তিন লাখ ৪০ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ে তা যায় কোথায়?
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি পরিসংখ্যানে ইলিশ রপ্তানির যে পরিসংখ্যান দেখানো হয়, বাস্তবে তার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ গুণ ইলিশ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাদা মাছ রপ্তানির আড়ালে ইলিশ যাচ্ছে। প্রতি কেজি ইলিশ মাছের রপ্তানিমূল্য ছিল ছয় ডলার আর সাদা মাছ আড়াই ডলার। যে কারণে বাড়তি লাভের আশায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাদা মাছের কার্টনে ইলিশ মাছ পাচার করেছে। গত বছর এমন কয়েকটি চালানও আটক করে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আবার গভীর সমুদ্র থেকেও ইলিশ বিক্রি করে দিচ্ছেন জেলেরা।
জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ দেশ থেকে তিন হাজার ৬৮০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়। এতে আয় হয়েছিল ১৪৯ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তিন হাজার ১০০ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১২৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন তিন লাখ ৪০ হাজার টন, রপ্তানি সাড়ে আট হাজার টন (৩৫২ কোটি টাকা)। আর গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত রপ্তানি সাড়ে ছয় হাজার ১৭৩ টন, যা টাকার অঙ্কে ২৯৪ কোটি টাকা।
পাচার হচ্ছে ইলিশ: স্থল ও নৌ—দুই পথেই পাচার হচ্ছে ইলিশ। স্থলপথের মধ্যে বেশি পাচার হয় বেনাপোল দিয়ে। আখাউড়া ও সিলেটের দু-একটি স্থান দিয়েও ইলিশ পাচার হয়। আর নৌপথে গভীর সাগর থেকেই আহরিত ইলিশ বিক্রি করে দিচ্ছেন জেলেরা, যার তথ্য সরকারি হিসাবেই আসে না।
২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর বরিশালের রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ থেকে পাঁচ টন সাদা মাছ রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে তার মধ্যে ইলিশ ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টমস তল্লাশি চালিয়ে সাদা মাছের ভেতর ৬০০ কেজি ইলিশ উদ্ধার করে। বেনাপোলে এমন আরও তিনটি চালান ধরা পড়ে গত বছর। এর মধ্যে পাঁচ টন মাছের একটি চালান নিলাম করা হয়।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে এই স্থলবন্দর দিয়ে চার হাজার ৭৮৩ টন ইলিশ ও চার হাজার ২৯৩ টন সাদা মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। আর জুলাই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৮৫ টন ইলিশ ও ১৩ টন সাদা মাছ।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক টনের কথা বলে রপ্তানি করা হচ্ছে ১০ টন। সরকারি হিসাবে থাকছে এক টন।’
ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে আগে আলাদা এইচএস কোড ছিল না। তবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন এইচএস কোড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নতুন কোডের কারণে চলতি অর্থবছর থেকে ইলিশের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া এবং তদারকি জোরদার করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এদিকে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি ইলিশ উৎপাদন মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয় জেলেরা ঢুকে মাছ শিকার, জেলেদের ওপর হামলা ও লুটপাট করছে। সুন্দরবনসংলগ্ন সোনারচর, হিরণ পয়েন্ট, ফেয়ারওয়েবয়া, চালনারবয়া ও পশ্চিম সুন্দরবন এলাকায় এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবিতে গত ১৬ জুলাই বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতি পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দেয়।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বাংলাদেশি কিছু জেলে সুন্দরবনের ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙ্গা ও কালিন্দী নদী দিয়ে ভারতীয়দের হাতে ইলিশ তুলে দিচ্ছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর মৎস্যবন্দর আড়তদার সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের জলসীমার যেসব স্থানে ইলিশ ধরা পড়ে, সেসব জায়গা ভারতীয় শত শত ট্রলারের দখলে। তারা চার স্তরের জাল দিয়ে মাছ ধরে নিচ্ছে। এসব ঠেকানো না গেলে অবৈধ পথে ভারতে ইলিশ পাচার কখনো বন্ধ হবে না।’
রপ্তানিমূল্য: জানা যায়, সরকার ৬০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশের রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ছয় ডলার (৪৯২ টাকা)। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের কেজিপ্রতি মূল্য আট ডলার (৬৫৬ টাকা) এবং দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশের কেজিপ্রতি মূল্য ১২ ডলার (৯৮৪ টাকা)।
ইলিশ রপ্তানিকারক, বড় মাছ ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ভালো ইলিশগুলোই আসলে বিদেশে রপ্তানি হয়। সেই ইলিশ ভারতের ব্যবসায়ীরা বিদেশেও রপ্তানি করছেন। অথচ উৎপাদনকারী হওয়ার পরও দেশে ইলিশ কিনে খেতে হয় ১২০০-১৪০০ টাকা কেজি।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন এম জসীম উদ্দীন, বরগুনা}

No comments

Powered by Blogger.