অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের রেলপথ by এসএম শফিউদ্দিন মিয়া
সামাজিক খাতে গত এক দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ২০০০ সালের পর থেকে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে আসছে এবং কর্মসংস্থান খাত বর্তমানে বেশ ইতিবাচক। কৃষি, শিল্প অর্থনীতিকে সচল রাখছে আর এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হচ্ছে গতিশীল পরিবহন খাতের উন্নয়ন।
পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। ঘন ঘন জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি, সড়ক দুর্ঘটনা এবং সুষ্ঠু পরিবহন অবকাঠামো অপ্রতুল্যতার দরুন সড়ক পরিবহন থেকে রেল পরিবহন বেশ জনপ্রিয় ও সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম। ১৮৬২ সালে বিট্রিশ ভারতের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রথম রেল পরিবহনের আবির্ভাব ঘটে।
কম পরিবেশ দূষণ ও স্বল্প জ্বালানি ব্যবহার কমে অধিক যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে বিশ্বব্যাপী রেলের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ২০০৭ - ২০০৮ অর্থবছরে ৫৪ মিলিয়ন এবং ২০০৮ - ২০০৯ অর্থবছরে ৬৫ মিলিয়ন যাত্রী রেলের মাধ্যমে পরিবহন হয়েছে। অথচ রেলের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ, রেল স্টেশন, মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ১৯৬৯ - ১৯৭০ থেকে ২০০৯ - ২০১০ সাল পর্যন্ত কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। যদিও বর্তমান সরকার রেলের মন্ত্রণালয় গঠন এবং বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে, ২০১০ - ২০১১ অর্থবছরে রেলখাতে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল ৩৬০০ কোটি টাকা যা ২০১২ - ২০১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯০০ কোটি টাকা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে সেখানে আমাদের দেশে বিপরীত অবস্থা বিরাজমান। অদূরদর্শী পরিকল্পনা, সীমাহীন দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো ও যন্ত্রাংশের দরুন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে।
অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার তুলনায় রেল ভ্রমণ আরামদায়ক, নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে রেল। আন্তর্জাতিক বাজারে ঘন ঘন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি যেখানে পৃথিবীর পরিবহন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে সেখানে রেল পরিবহন জ্বালানি সাশ্রয়ী এক ভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থা। ২০০৭ সালের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি কি.মি. যাত্রী পরিবহনে রেলে খরচ হয় ০.৩৮ পয়সা, নৌপথে ০.৪২ পয়সা ও সড়কে ০.৮৭ পয়সা। রেলে যাত্রী প্রতি ০.৯৫ - ১.০৬ লিটার তেল খরচ হয় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে এবং এই একই দূরত্বে বাসে যাত্রীপ্রতি ৪ থেকে ৬.২২ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন অথচ ১টি মালগাড়ি ট্রেন, ২১০ টি ৫ টন ট্রাকের সমপরিমাণ মালামাল বহন করে থাকে।
পরিবেশ দূষণের দিক থেকে বিচার করলে রেল পরিবহন ব্যবস্থায় সড়ক, নৌ ও বিমান পথের চেয়ে কম পরিবেশ দূষিত হয়। সড়ক, নৌ ও বিমান পথে বায়ু দূষণ ভীষণ মাত্রায় দেখা যায়। এছাড়াও পানি ও উচ্চ শব্দ দূষণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে রেলের ক্ষেত্রে এ দূষণের পরিমাণ খুবই নগণ্য। আমাদের দেশে রেল পরিবহন ব্যবস্থায় শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যারূপে বর্তমানে প্রতিয়মান হয়েছে। ট্রেনের লোকোমটিভ, হর্ন / ভেঁপু, সিøপার থেকে উৎপন্ন অতি উচ্চ শব্দ মানবদেহ এবং পারিপার্শি¦ক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেন চলাচলরত অবস্থায় গড় শব্দের পরিমাণ দিনেরবেলা (৮.০০ - ১২.০০ টা) ১০৫ ডেসিবেল এবং বিকেলবেলা (৪.৩০ - ৫.৩০ টা) ১০৪ ডেসিবেল, সিলেট রেলস্টেশনে এর পরিমাণ দিনেরবেলা ১০০ ডেসিবেল এবং বিকেলবেলা ৯৮ ডেসিবেল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে শব্দ দূষণের পরিমাণ ১০৪ ডেসিবেল গড়ে প্রায় সব সময়। যেখানে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক নির্ধারিত শব্দের সহনীয় মাত্রা বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকায় ৭০-৭৫ ডেসিবেল এবং মিক্সড জোনে ৬০ ডেসিবেল সেখানে এত উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ অনাকাক্সিক্ষত এবং তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এত উচ্চ শব্দ দূষণের জন্য মূলত দায়ী দুর্বল অবকাঠমো, পুরনো লোকোমটিভ, বগি, সিøপার ও পুরনো যন্ত্রাংশ যা প্রায় ৫০ বছরের পুরনো এবং অব্যবস্থাপনা। বর্তমানে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন রেললাইন স্থাপন, লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ, মালবাহী ওয়াগন ও অন্যান্য অবকাঠামো বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা আশানুরূপ নয়।
রেলওয়ে সম্পর্র্কে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। যেমন-সময়মতো ট্রেন না ছাড়া বা শিডিউল না মানা, টিকেট পাওয়া যায় না, অল্পসংখ্যক যাত্রী কোচ, ট্রেনের ভেতরের নোংরা পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা, রেল স্টেশনসমূহের অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের বসার ব্যবস্থার অপ্রতুল্যতা। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্য, রেলওয়ের সম্পদ দখল, টিকেট কালোবাজারি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দুর্র্নীতির ফলে রেলের প্রতি সাধারণ যাত্রীদের আস্থা দিন দিন কমছে। সারাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সম্প্রসারিত সড়ক নেটওয়ার্ক এখন যেন মৃত্যুজাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে রেলের একটি চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার। কেননা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উচ্চ ভাড়া এবং ব্যাপক সড়ক দুর্ঘটনা দরুন যাত্রীসাধারণের দৃষ্টি রেলের দিকে নিয়ে আসা সম্ভব। তাই দ্রুত রেলের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন এবং যুগোপযোগী, আধুনিক এবং বাস্তবসম্মত নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী। রেললাইনের সম্প্রসারণ, নতুন লোকোমটিভ, কোচ, সিøপার, বগি এবং মালবাহী ওয়াগন ক্রয় ও অবকাঠমোগত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে রেলকে গতিশীল ও আধুনিকায়ন করা সম্ভব। এছাড়াও রেলের বার্ষিক আয়ের পরিসংখ্যান দেখলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রেলের সেবার মান দিন দিন তুলনামূলকভাবে কমলেও রেলের আয় তার তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে আশানুরূপ হারে। লোকস্বল্পতার কারণে গত কয়েক বছরে রেলের ১১৭ টি স্টেশন বন্ধ করে দিতে হলেও ২০০৭ - ২০০৮ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ৫৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা যা ২০০৯ - ২০১০ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৬২০ কোটি টাকা। এবং ক্রমান্বয়ে রেলের আয় বেড়ে চলছে। বিশ্বে অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের আধুনিকায়ন সম্ভবপর হলে এদেশের পরিবহন খাতে তা যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত এবং জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন খুবই জরুরী। রেল ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হলে আপামর জনসাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সর্বজনীনতা অর্জন করবে। দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে, শহরের সঙ্গে গ্রামের সমন্বয় সাধন হবে এবং আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা হবে নিরাপদ, স্বাচ্ছ্যন্দময় ও পরিবেশবান্ধব। বিগত বছরগুলোতে যাতায়াত ব্যবস্থায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদানের ফলে সড়ক ব্যবস্থাপনার খরচের পাশাপাশি যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়কে যানজট বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ দূষণ, দুর্ঘটনাসহ নানাবিধ সমস্যা সৃিষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন সড়ক বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি জমি হ্রাস, বিভিন্ন নদ-নদীতে ব্রিজ বা বাঁধ নির্মাণের ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়া হলে স্বল্প সময়ে আরামদায়ক ভ্রমণ, কম জ্বালানি ব্যবহার ও কম পরিবেশ দূষণ করে অধিক যাত্রী ও মাল পরিবহন সম্ভব। ভবিষ্যত জ্বালানি সঙ্কট মোকবেলা, কৃষি জমি রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও পরিবেশ দূষণের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থায় রেলকে অগ্রাধিকার প্রদান করা প্রয়োজন। রেলের উন্নয়নের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই উদ্যোগী হতে হবে। সবাইকেই উপলব্ধি করতে হবে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য সড়কপথ ও নদীপথের উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন,রেলের উন্নয়নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি রেলপথকে আধুনিকায়ন করা যায় তবে রেলপথ সুবিধার জন্য আরও অনেক শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। পণ্য পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত হলে দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রেল পরিবহন খাত থেকে দেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি, রেলের উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা তথা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাই রেলের উন্নয়নের প্রতি সরকারের আরও বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
ভঁধফ.ভঁঃঁৎব১৯@মসধরষ.পড়স
কম পরিবেশ দূষণ ও স্বল্প জ্বালানি ব্যবহার কমে অধিক যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে বিশ্বব্যাপী রেলের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ২০০৭ - ২০০৮ অর্থবছরে ৫৪ মিলিয়ন এবং ২০০৮ - ২০০৯ অর্থবছরে ৬৫ মিলিয়ন যাত্রী রেলের মাধ্যমে পরিবহন হয়েছে। অথচ রেলের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ, রেল স্টেশন, মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ১৯৬৯ - ১৯৭০ থেকে ২০০৯ - ২০১০ সাল পর্যন্ত কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। যদিও বর্তমান সরকার রেলের মন্ত্রণালয় গঠন এবং বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে, ২০১০ - ২০১১ অর্থবছরে রেলখাতে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল ৩৬০০ কোটি টাকা যা ২০১২ - ২০১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯০০ কোটি টাকা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে সেখানে আমাদের দেশে বিপরীত অবস্থা বিরাজমান। অদূরদর্শী পরিকল্পনা, সীমাহীন দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো ও যন্ত্রাংশের দরুন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে।
অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার তুলনায় রেল ভ্রমণ আরামদায়ক, নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে রেল। আন্তর্জাতিক বাজারে ঘন ঘন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি যেখানে পৃথিবীর পরিবহন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে সেখানে রেল পরিবহন জ্বালানি সাশ্রয়ী এক ভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থা। ২০০৭ সালের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি কি.মি. যাত্রী পরিবহনে রেলে খরচ হয় ০.৩৮ পয়সা, নৌপথে ০.৪২ পয়সা ও সড়কে ০.৮৭ পয়সা। রেলে যাত্রী প্রতি ০.৯৫ - ১.০৬ লিটার তেল খরচ হয় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে এবং এই একই দূরত্বে বাসে যাত্রীপ্রতি ৪ থেকে ৬.২২ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন অথচ ১টি মালগাড়ি ট্রেন, ২১০ টি ৫ টন ট্রাকের সমপরিমাণ মালামাল বহন করে থাকে।
পরিবেশ দূষণের দিক থেকে বিচার করলে রেল পরিবহন ব্যবস্থায় সড়ক, নৌ ও বিমান পথের চেয়ে কম পরিবেশ দূষিত হয়। সড়ক, নৌ ও বিমান পথে বায়ু দূষণ ভীষণ মাত্রায় দেখা যায়। এছাড়াও পানি ও উচ্চ শব্দ দূষণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে রেলের ক্ষেত্রে এ দূষণের পরিমাণ খুবই নগণ্য। আমাদের দেশে রেল পরিবহন ব্যবস্থায় শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যারূপে বর্তমানে প্রতিয়মান হয়েছে। ট্রেনের লোকোমটিভ, হর্ন / ভেঁপু, সিøপার থেকে উৎপন্ন অতি উচ্চ শব্দ মানবদেহ এবং পারিপার্শি¦ক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেন চলাচলরত অবস্থায় গড় শব্দের পরিমাণ দিনেরবেলা (৮.০০ - ১২.০০ টা) ১০৫ ডেসিবেল এবং বিকেলবেলা (৪.৩০ - ৫.৩০ টা) ১০৪ ডেসিবেল, সিলেট রেলস্টেশনে এর পরিমাণ দিনেরবেলা ১০০ ডেসিবেল এবং বিকেলবেলা ৯৮ ডেসিবেল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে শব্দ দূষণের পরিমাণ ১০৪ ডেসিবেল গড়ে প্রায় সব সময়। যেখানে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক নির্ধারিত শব্দের সহনীয় মাত্রা বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকায় ৭০-৭৫ ডেসিবেল এবং মিক্সড জোনে ৬০ ডেসিবেল সেখানে এত উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ অনাকাক্সিক্ষত এবং তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এত উচ্চ শব্দ দূষণের জন্য মূলত দায়ী দুর্বল অবকাঠমো, পুরনো লোকোমটিভ, বগি, সিøপার ও পুরনো যন্ত্রাংশ যা প্রায় ৫০ বছরের পুরনো এবং অব্যবস্থাপনা। বর্তমানে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন রেললাইন স্থাপন, লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ, মালবাহী ওয়াগন ও অন্যান্য অবকাঠামো বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা আশানুরূপ নয়।
রেলওয়ে সম্পর্র্কে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। যেমন-সময়মতো ট্রেন না ছাড়া বা শিডিউল না মানা, টিকেট পাওয়া যায় না, অল্পসংখ্যক যাত্রী কোচ, ট্রেনের ভেতরের নোংরা পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা, রেল স্টেশনসমূহের অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের বসার ব্যবস্থার অপ্রতুল্যতা। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্য, রেলওয়ের সম্পদ দখল, টিকেট কালোবাজারি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দুর্র্নীতির ফলে রেলের প্রতি সাধারণ যাত্রীদের আস্থা দিন দিন কমছে। সারাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সম্প্রসারিত সড়ক নেটওয়ার্ক এখন যেন মৃত্যুজাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে রেলের একটি চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার। কেননা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উচ্চ ভাড়া এবং ব্যাপক সড়ক দুর্ঘটনা দরুন যাত্রীসাধারণের দৃষ্টি রেলের দিকে নিয়ে আসা সম্ভব। তাই দ্রুত রেলের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন এবং যুগোপযোগী, আধুনিক এবং বাস্তবসম্মত নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী। রেললাইনের সম্প্রসারণ, নতুন লোকোমটিভ, কোচ, সিøপার, বগি এবং মালবাহী ওয়াগন ক্রয় ও অবকাঠমোগত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে রেলকে গতিশীল ও আধুনিকায়ন করা সম্ভব। এছাড়াও রেলের বার্ষিক আয়ের পরিসংখ্যান দেখলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রেলের সেবার মান দিন দিন তুলনামূলকভাবে কমলেও রেলের আয় তার তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে আশানুরূপ হারে। লোকস্বল্পতার কারণে গত কয়েক বছরে রেলের ১১৭ টি স্টেশন বন্ধ করে দিতে হলেও ২০০৭ - ২০০৮ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ৫৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা যা ২০০৯ - ২০১০ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৬২০ কোটি টাকা। এবং ক্রমান্বয়ে রেলের আয় বেড়ে চলছে। বিশ্বে অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের আধুনিকায়ন সম্ভবপর হলে এদেশের পরিবহন খাতে তা যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত এবং জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন খুবই জরুরী। রেল ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হলে আপামর জনসাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সর্বজনীনতা অর্জন করবে। দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে, শহরের সঙ্গে গ্রামের সমন্বয় সাধন হবে এবং আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা হবে নিরাপদ, স্বাচ্ছ্যন্দময় ও পরিবেশবান্ধব। বিগত বছরগুলোতে যাতায়াত ব্যবস্থায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদানের ফলে সড়ক ব্যবস্থাপনার খরচের পাশাপাশি যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়কে যানজট বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ দূষণ, দুর্ঘটনাসহ নানাবিধ সমস্যা সৃিষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন সড়ক বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি জমি হ্রাস, বিভিন্ন নদ-নদীতে ব্রিজ বা বাঁধ নির্মাণের ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়া হলে স্বল্প সময়ে আরামদায়ক ভ্রমণ, কম জ্বালানি ব্যবহার ও কম পরিবেশ দূষণ করে অধিক যাত্রী ও মাল পরিবহন সম্ভব। ভবিষ্যত জ্বালানি সঙ্কট মোকবেলা, কৃষি জমি রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও পরিবেশ দূষণের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থায় রেলকে অগ্রাধিকার প্রদান করা প্রয়োজন। রেলের উন্নয়নের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই উদ্যোগী হতে হবে। সবাইকেই উপলব্ধি করতে হবে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য সড়কপথ ও নদীপথের উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন,রেলের উন্নয়নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি রেলপথকে আধুনিকায়ন করা যায় তবে রেলপথ সুবিধার জন্য আরও অনেক শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। পণ্য পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত হলে দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রেল পরিবহন খাত থেকে দেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি, রেলের উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা তথা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাই রেলের উন্নয়নের প্রতি সরকারের আরও বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
ভঁধফ.ভঁঃঁৎব১৯@মসধরষ.পড়স
No comments