ঈদের কেনাকাটা ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের শপিংমলগুলো ঈদ উপলক্ষে সেজেছে নানা সাজে। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আর বাহারি পোশাক, জুতা আর ক্রেতা-বিক্রেতাদের ব্যস্ততা দেখলে সহজে বুঝা যায়, রোজার ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ও মহা আনন্দের উৎসব।


ঈদ উপলক্ষে রমজান মাস শুরু হওয়ার বেশ আগে থেকে ব্যবসায়ীরা নিয়েছে নানা প্রস্তুতি। ক্রেতারাও প্রস্তুতি নিয়েছে সাধ্যমতো কেনাকাটায়। ঈদের কেনাকাটার প্রশ্ন এলে নতুন পোশাকের কথাই আগে আসে। তারপর আসে জুতার প্রসঙ্গ। তাছাড়া জুয়েলারি, কসমেটিকস ইত্যাদি কেনাকাটা তো আছেই। আসলে ঈদের বাজারে কেনাকাটার মতো অনেক সামগ্রীই আছে। এর কমবেশি কেনাকাটার বিষয় নির্ভর করে ক্রেতার সাধ্যের ওপর। তাছাড়া যে হারে জিনিসের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব এসেছে জামা-কাপড় জুতা ইত্যাদির ওপরও। তারপরও তো বড়দের প্রসঙ্গ না আনলেও ছোটদের জন্য ঈদে নতুন জামা-কাপড়, জুতা যেন চাই-ই চাই।
রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ফ্যাশন হাউস এবং অর্ধশত শপিং মল। ঈদকে সামনে রেখে এরা বাজারে এনেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার নতুন ডিজাইনের পোশাক সামগ্রী। বড় ফ্যাশন হাউসগুলোর প্রতিটির রয়েছে গড়ে সর্বোচ্চ প্রায় ১২টি শোরুম। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রত্যেকটি শোরুমে পোশাক তোলার প্রস্তুতি নেয়া হয় কোটি টাকার ওপরে। ক্রেতা ধরতে নেয়া হয়েছে নানা কৌশলও। অনেক স্থানে দেয়া হচ্ছে দামের ওপর আকর্ষণীয় ছাড় বা ডিসকাউন্ট। নানা পুরস্কার। কেনাকাটার ক্ষেত্রে র‌্যাফেল ড্রর মাধ্যমে ঘোষণা দেয়া হয়েছে বাহারি পুরস্কার দেয়ারও। এসব স্থানেই ক্রেতাদের বেশি ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার অভিযোগের কথাও জানা যায়।
এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতি, দর্জি, বুটিক হাউসের কর্মী, ধোপা, আয়রনম্যান প্রভৃতি পেশার লোক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনও চলছে নতুন কাপড় তৈরি, সুতা, পুঁতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রতিযোগিতা। যারা পোশাকে বাড়তি ডিজাইন দিতে পারছে তাদের পণ্য একটু বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ফ্যাশন হাউসগুলো তাদের মনোলোভা পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়াতে দ্বারস্থ হচ্ছে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোতে। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস পোশাকের পাশাপাশি বিক্রি করে জুতা, বেল্ট, ফিতা, ব্যাগ, অলঙ্কার ইত্যাদি। সারা বছর যে পরিমাণে পণ্য বিক্রি হয় তার থেকে বেশি বিক্রি হয় ঈদের সময়েই। এবারেও ঈদের বাজারে দেশজ পোশাকের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে বিদেশী বিশেষ করে ভারত ও চীনের তৈরি পোশাক। পুরুষ ও শিশুদের পোশাকের প্রায় ৬০ শতাংশই চীনের। আর শাড়ি ও সালোয়ার কামিজের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে ভারত। অবৈধ পথের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে বিদেশী বিশেষ করে ভারত ও চীনের তৈরি পোশাক। পুরুষ ও শিশুদের পোশাকের প্রায় ৬০ শতাংশই চীনের। আর শাড়ি ও সালোয়ার কামিজের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে ভারত। অবৈধ পথের পাশাপাশি বৈধ পথেও আসছে এসব পণ্য। জানা গেছে, বৈধপথে এসেছে প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকার পণ্য। তাতে সরকার পেয়েছে রাজস্ব। আর অবৈধ পথে যেসব পণ্য আসছে তাতে বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে।
এবার বাজেটে আমদানি করা পোশাকের ওপর চড়া মাত্রায় করারোপ করায় অনেক ব্যবসায়ী অবৈধ পথে পোশাক আমদানি করছেন। চড়া করের কারণে এবার ঈদের পোশাকসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের দাম অনেক বেশি। গত রোজার সময় যে শার্ট বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। অর্থাৎ পোশাকের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অভিজাত এলাকার বিপণি বিতানগুলোতে দাম অনেক বেশি। এসব দোকানে কেনাকাটা করতে আসেন ধনীরা। আর অল্প আয়ের মানুষের কেনাকাটার জন্য রয়েছে ফুটপাথের দোকানসহ সাধারণ মানের মার্কেট। তবে নিউমার্কেট, চাঁদনিচক, গাউছিয়া প্রভৃতির মতো মার্কেটে আসেন সব শ্রেণীর ক্রেতা। ঈদ উপলক্ষে জুতার বিক্রিও বেড়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে দেশীয় জুতার পাশাপাশি বিদেশী জুতাও।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান জুতা বিক্রি করছে মূল্যহ্রাসে। তাতে ক্রেতার ভিড় বেড়েছে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে জুতার দাম অনেক বেড়েছে। জুতার দাম বাড়ার প্রধান কারণ কাঁচামালের দাম বাড়া, দোকান ভাড়া বৃদ্ধি ,শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। তবে ফুটপাথে বা ছোট বিপণি বিতানে পাদুকার দাম অপেক্ষাকৃত কম। অনেক স্থানে দেদার বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল পাদুকা। এরদাম একটু কম বলে অনেকেই না জেনে তা কিনে ঠকছেন। তাতে লাভবান হচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
ঈদ উপলক্ষে অলঙ্কারের বিক্রিও বেড়েছে। ঢাকার বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন মার্কেটে এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঈদের আমেজ। ঈদ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা নতুন ডিজাইনের অলঙ্কার রাজারে এনেছে। এসবের প্রতি ক্রেতা বিশেষ করে নারীদের ঝোঁক বেশি। সোনা, রূপার পাশাপাশি হীরার অলঙ্কারের বিক্রিও বেড়েছে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি বা বাজুস জানিয়েছে, দেশে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা গড়ে প্রায় এক লাখ ভরি। বেশি বিক্রি হয় ঈদের সময়। দেশে ছোট বড় স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে রয়েছে। প্রায় ১০ হাজার। এসব দোকানের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। আর স্বণালঙ্কার খাতে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে দাম অত্যন্ত বেশি বলে অনেকে এখন স্বর্ণ না কিনে ইমিটেশনের গহনা, রূপা ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছেন। ঈদ উপলক্ষে কমবেশি বেড়েছে হীরার অলঙ্কার বিক্রিও। বাংলাদেশে হীরার আমদানি হয় সাধারণত ভারত থেকে। কিছু হীরা আসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, বেলজিয়াম ও হংকং থেকে। হীরা আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় প্রায় ১৩৫ শতাংশ। যে কারণে এর অলঙ্কারের দাম বেশি। ঈদ এলে বিক্রি বাড়ে প্রায় ২০ শতাংশ। একটি ভাল মানের হীরার নাকফুল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার টাকায়। আংটি ১৫-১৬ হাজার টাকা। এক জোড়া কানের দুলের দাম পায় ১৯-২০ হাজার টাকা। চুড়ি ৮০-৯০ হাজার টাকা। অনেক সময় অলঙ্কার তৈরি করা হয় সোনা রূপা মিলিয়ে। এমন অলঙ্কারের চাহিদাও এখন বেশি। এখন কসমেটিকস বিক্রি হচ্ছে দেদার। নানারকম কসমিটিকসের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা কসমিটিকস বিক্রি করছেন। এখন কোন কোন স্থানে ঈদের শপিং করলে বোনাস হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় পণ্য। মানুষ যত বাড়ছে ঈদের বাজারও ততো বড় হচ্ছে অন্যান্য বাজারের মতো। তবে ঈদের বাজারের বিড়ম্বনাও কম নয়। যানজট, ছিনতাই, ছুরি ইত্যাদি এখন বড় ধরনের সমস্যা। সরকার যথাযথভাবে এগিয়ে এলে এ ধরনের সমস্যা দূর হতে পারে। এদিকে কেনাকাটায়ও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। এখন ঘরে বসেই ফেসবুকের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে কেনাকাটার নানা খবর।
কিন্তু র্দুভাগ্যর বিষয় হলো দেশের ৯ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের ঈদের কেনাকাটার সামর্থ্য নেই। পনের কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ধনী ৪১ লাখ যারা মূলত ঈদ বাজারের ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা করে থাকে। এর বাইরে স্বত:স্ফূর্ত কেনাকাটায় অংশ নেয় আরও ২ কোটি ১৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৭০ লাখ উচ্চ মধ্যবিত্ত, ১ কোটি ৪৬ লাখ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। আর বাকিদের অধিকাংশরই ঈদের কেনাকাটার করার সামর্থ্য থাকে না। তবে তারাও যাকাত বা উপহার হিসেবে ঈদের কেনাকাটার শামিল হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের থোক হিসেব থেকে জানা যায় ,এবার ঈদে মোট লেনদেন ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে ,প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে ঈদকে কেন্দ্র করে এক হাজার কোটি টাকার উপর লেনদেন হচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদের আয় বেড়ে গেছে। এছাড়া অন্যান্য পেশাজীবীদেরও আয় বেড়ে গেছে।এভাবে ঈদের কেনাকাটা ও লেনদেন আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলছে।
মোঃ আবদুল হালিম

No comments

Powered by Blogger.