রোদের হাসি কেড়ে নিল চিকিৎসক পরিবারচক্র! by তৌফিক মারুফ

ইবনে সিনা ডেন্টাল সেন্টারের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. খোন্দকার আবদুল আজিম ও তাঁর ছেলে-মেয়ের 'অপচিকিৎসা' কেড়ে নিয়েছে রোদের হাসি। অন্তত পরিবারের এমনটাই অভিযোগ। "হাসিখুশি সদা চঞ্চল ১৬ বছরের দুরন্ত ছেলে আমার। নাম রোদ। দাঁতে-মুখে কোনো ব্যথা নেই।


এক্স-রেতে ধরা পড়ল, তার নিচের চোয়ালের ডানদিকে দুটি অতিরিক্ত দাঁত। সাধারণ দাঁতের নিচে, চোয়ালের মধ্যে। স্থানীয় ডাক্তার পরামর্শ দিলেন ভালো কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। ছুটে গেলাম ভালো ডাক্তারের খোঁজে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে অধ্যাপক খোন্দকার আবদুল আজিমের কাছে। কিন্তু ওই 'ভালো ডাক্তার' আমার ছেলেটার ভালো রকম সর্বনাশ করে দিল।" কালের কণ্ঠের কাছে এমন অভিযোগ করেন নারায়ণগঞ্জের জামতলা এলাকার জুলেখা পারভীন।
জুলেখার অভিযোগ, ডাক্তার আজিম ও তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে চিকিৎসার নামে ফাঁদ পেতে অনেক অর্থ তো নিয়েছেনই, তাঁর একমাত্র সন্তানের জীবনও বিপন্ন করে তুলেছেন। তিনি বলেন, 'বারবার ক্যান্সারের ভয় দেখিয়ে অপারেশনের নাম করে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে সবই আসলে টাকার জন্য ফন্দি ছিল। এখন আমার ছেলের মুখ অবশ হয়ে যাচ্ছে।' তিনি জানান, এ ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন 'জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ' ও ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম লালা বলেন, অপচিকিৎসার সূত্রপাত হয় ইবনে সিনার ধানমণ্ডির ডেন্টাল সেন্টার থেকে, অপচিকিৎসাগুলো দেওয়া হয়েছে বাইরে। এর মধ্যে আবার বেশি লাভবান হওয়ার জন্য অধ্যাপক তাঁর নিজের মেয়ে ও ছেলেকে এ কাজে যুক্ত করেছেন। এটা এক ধরনের সিন্ডিকেটের মতো। ট্রাস্ট পরিচালিত একটি হাসপাতাল থেকে কেউ এভাবে রোগী ভাগিয়ে অপচিকিৎসা দিতে পারে তা এখন জানা গেল। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকিৎসার নামে রোগীর সঙ্গে কোনো রকম প্রতারণা করা হয়ে থাকলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
অভিযুক্ত অধ্যাপক ডা. খোন্দকার আবদুল আজিম তাঁর ও তাঁর ছেলে-মেয়ের কাছে বালক রোদের চিকিৎসা গ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তাঁর দাবি, এ ক্ষেত্রে তাঁরা কেউই প্রতারণা বা ভুল চিকিৎসা করেননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন 'ওই রোগী আমার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে যাওয়ার পর তো আর আমার কাছে আসেনি, তাই তার এখন কী হয়েছে না হয়েছে সেটা আমার জানার কথা নয়।' একপর্যায়ে তিনি বলেন, 'ওই রোগীকে আমার কাছে নিয়ে এলে আবার চিকিৎসা করে দেব।'
বিএমডিসি ও জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগ ও সংযুক্ত কাগজপত্রে দেখা যায়, রোগী রোদের সাধারণ দাঁতের নিচে দুটি অতিরিক্ত দাঁত ওঠে। এ জন্য গত বছরের শুরুর দিকে নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে ওপিজি এক্স-রে করা হয়। এরপর রোদকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে। গত বছরের ১১ মে ডা. আজিম তাঁদের জানান, অপারেশন করাতে হবে; না হলে চোয়ালে অচিরেই পুঁজ হয়ে ক্যান্সার হবে। এ ছাড়া অপারেশনটাও জটিল। বোর্ড করে অপারেশন করতে হবে। তবে অপারেশন ইবনে সিনায় না করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় 'সিএমএইচ' হাসপাতালে করাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কচুক্ষেত এলাকার একটি নির্দিষ্ট ল্যাবরেটরিতে করাতে নির্দেশ দেন। রোদের পরিবারের লিখিত অভিযোগে বলা হয়, রোগীকে ভর্তির আগে চিকিৎসক বললেন চোয়ালের মধ্যে টিউমার আছে। এক্স-রে প্লেটে অস্পষ্ট একটা জায়গা দেখালেন। বললেন, ভেতরের দাঁত অপারেশন করে বের করার সময় টিউমারও অপারেশন করবেন।
রোদের মা জুলেখা পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ডা. আজিমের দেওয়া ঠিকানা অনুসারে গিয়ে দেখা যায় সেটা আসল 'সিএমএইচ' হাসপাতাল নয়, 'ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতাল'। জুলেখা ওই হাসপাতালের রিসেপশন থেকে ডা. আজিমকে ফোন করে বলেন, তিনি সেখানে ভর্তি করাবেন না। ডা. আজিম পাল্টা ধমক দিয়ে বলেন, 'এটা আসল সিএমএইচের শাখা, এখানেই ভর্তি হতে হবে।' নিরুপায় জুলেখা ওই বছরের ৬ জুন রোদকে সেখানেই ভর্তি করান। পরদিন অপারেশনের আগে তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া হয় বিশ হাজার টাকা। মেডিক্যাল বোর্ড করে অপারেশন করার কথা বললেও অপারেশন করেন ডা. আজিম ও তাঁর মেয়ে। এ সময় জানানো হয়, চোয়ালের ডান দিক থেকে বাঁ দিকের শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের টিস্যু চেঁছে ফেলে দেওয়া হয়েছে; ফলে এখন আর কোনো ভয় নেই। তবে পাঁচ-ছয় দিন রোগীকে ওই হাসপাতালে থাকতে হবে। থাকার জন্য বিল পরিশোধ করতে হলো আরো ৫৬ হাজার টাকা।
অধ্যাপক ডা. খোন্দকার আবদুল আজিম কালের কণ্ঠকে জানান, 'ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতাল' একটি সরকারি হাসপাতাল। তিনি মাঝেমধ্যে সেখানে রোগী দেখেন, অপারেশন করেন। তাঁর মেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগে ইন্টার্নশিপ করছেন। ওই অপারেশনের সময় মেয়েকে তিনি সঙ্গে রেখেছিলেন মাত্র। ইবনে সিনার চেয়ে ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতালে খরচ কম বলেই সহানুভূতি থেকে রোদকে সেখানে পাঠানো হয় বলে তিনি দাবি করেন। ডা. আজিম তাঁর মেয়ের নাম জানাতে অস্বীকার করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, 'ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতাল' স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষের একটি জেনারেল হাসপাতাল।
জুলেখা বলেন, কয়েক দিন পর আবার চেকআপের জন্য রোদকে নিয়ে যাওয়া হয় ডা. আজিমের কাছে। এবার অধ্যাপক আজিম রোদের মাকে জানান, নিচের চোয়ালের ১২টি দাঁত ক্যানেলিং-ক্যাপিং করতে হবে। জুলেখার হাতে একটা ঠিকানা দিয়ে তিনি বললেন, 'এলিফ্যান্ট রোডে এই ক্যানেলিং বিশেষজ্ঞের কাছে যান দ্রুত।' তখন রোদের নিচের কোনো দাঁতেই কোনো গর্ত বা ব্যথা ছিল না। এর পরও কেন ওই চিকিৎসা লাগবে তা জানতে চাইলে ডা. আজিম আবারও ক্যান্সারের ভয় দেখান। সন্তানের জীবনের কথা চিন্তা করে জুলেখা গেলেন এলিফেন্ট রোডে ডা. খোন্দকার নাঈমের ক্লিনিকে। একটি ব্যথাবিহীন সম্পূর্ণ ভালো দাঁতে ক্যানেলিং করা হলো। বাকি আরো ১১টি দাঁতে ক্যানেলিং এবং ১২টি দাঁতে ক্যাপিংয়ের জন্য ৭০ হাজার টাকা দাবি করা হলো। এ সময় রোদের পরিবারের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হলে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, নতুন এই ডাক্তার নাঈম আসলে ডা. আজিমের ছেলে। পরে তাঁরা আর ওই চিকিৎসকের কাছে যাননি।
জুলেখা পারভীন বলেন, 'অপারেশনের পর থেকে রোদের নিচের ঠোঁট অবশ হয়ে গেছে। কোনো অনুভূতি নেই। ছেলে খাবার খাওয়ার সময় ঠোঁটে কামড় দেয়। টের পায় না, কিন্তু রক্ত পড়ে।'
পরে রোদের চিকিৎসা করেছেন এমন একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অতিরিক্ত ইম্প্যাকটেড দাঁত বহু লোকের থাকে। কোনো ঝামেলা বা অসুবিধা হয় না। কখনো দু-একটা দাঁত বের হয়ে আসতে পারে। বেশি এলোমেলো বা ক্রাউডিং হলে কেউ কেউ তুলে ফেলেন। অপারেশন করে বের করার কোনোই প্রয়োজন হয় না। এতে ক্যান্সার হওয়ার কোনো রেকর্ড জানা নোই।'
ওই চিকিৎসক জানান, যে দাঁতটিতে ক্যানেলিং করা হয়েছে, সেটি অযথা করা হয়েছে। অন্য দাঁতগুলোতে ক্যানেলিং চিকিৎসা করার কোনো রকম ইন্ডিকেশন নেই। ঠোঁট অবশ হওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে অপারেশনের সময় দুই দিকেরই নার্ভ কেটে ফেলা অথবা জখম করা। ওই চিকিৎসক আরো জানান, ফলোআপ এক্স-রে করে দেখা গেছে, দুটি ইম্প্যাকটেড দাঁতের একটি বের করা হয়েছে। আরেকটি থেকে গেছে। ফলে দুটি দাঁতই অপারেশন করে বের করা হয়েছে বলে আগের চিকিৎসকের দাবি ঠিক নয়। একইভাবে টিউমার অপারেশন করে ফেলে দেওয়ার দাবিটিও মিথ্যা বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে ডা. আজিমের ছেলে ডা. নাঈমের সঙ্গে কথা বলার জন্য গতকাল শুক্রবার ফোন করা হলে ডা. নাঈম এ প্রতিবেদকের পরিচয় শুনে ফোন বাবার কাছে দিয়ে দেন। পরে ডা. আজিম নিজেই তাঁর ছেলে ও মেয়ের পক্ষে কথা বলেন।
ডা. আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি ইবনে সিনায় যোগদানের আগে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মেয়ে ও ছেলেও ভালো চিকিৎসক। তাঁরা কোনো ভুল করেননি। এর পরও প্রয়োজনে ওই রোগীকে তাঁর কাছে নিয়ে এলে আবার চিকিৎসা করে দেবেন। তিনি দাবি করেন, 'কোনো একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ অভিযোগ তুলেছে।'

No comments

Powered by Blogger.