সাদাসিধে কথা-কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

লেখাপড়া নিয়ে এ দেশের মানুষের অনেকেরই একটা ভুল ধারণা রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা হচ্ছে, লেখাপড়ার অর্থ হচ্ছে মাথার মাঝে একগাদা তথ্য ঠেসে রাখা, যে যত বেশি তথ্য ঠেসে রাখতে পারে, সে লেখাপড়ায় তত ভালো। তথ্য ঠিকমতো মাথায় ঠেসে রাখতে পেরেছে কি না, সেটা যাচাই করা হয় পরীক্ষার হলে, যে যত


নিখুঁতভাবে মাথার মাঝে ঠেসে রাখা তথ্যটা উগলে দিতে পারে, সে তত ভালো গ্রেড পায়, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন তাকে ধন্য ধন্য করে।
অথচ মোটেও এটা লেখাপড়া হওয়ার কথা ছিল না, লেখাপড়ার পুরো বিষয়টিই হচ্ছে নতুন কিছু করার ক্ষমতা। একজন ছাত্র যে বিষয়টি আগে কখনো দেখেনি, যদি সেটাকেও সে বিশ্লেষণ করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, সে খানিকটা হলেও লেখাপড়া শিখেছে। আইনস্টাইন তো আর শুধু শুধু বলেননি। কল্পনাশক্তি জ্ঞান থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ধাক্কাধাক্কি করে খানিকটা জ্ঞান অর্জন করেই ফেলতে পারি, কিন্তু যদি কল্পনাশক্তি না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানটুকু হবে একেবারেই ক্ষমতাহীন দুর্বল জ্ঞান। কল্পনাশক্তি যদি থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানটুকু হতে পারে অনেক বেশি কার্যকর। আমরা চোখ, কান খোলা রাখলেই তার এক শ একটা উদাহরণ দেখতে পাই। বড় বড় বই মুখস্থ করে বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এসি ঘরে বসে ফাইলের পর ফাইল সই করছেন অথচ খেটে খাওয়া মানুষ আনুষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা না করেই নৌকার মাঝে শ্যালো ইঞ্জিন লাগিয়ে ট্রলার তৈরি করে ফেলেছেন। খেতের মাঝে নতুন রকম ধান দেখে সেটা থেকে ধানের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ধোলাইখালে এমন যন্ত্রাংশ তৈরি করে ফেলেছেন, যেটা দেশ-বিদেশের বাঘা বাঘা ইঞ্জিনিয়ারও ডিজাইন করার সাহস পান না।
তাই ঘুরেফিরে আমরা দেখতে পাই, একজন মানুষকে আমরা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় একটা মানুষ তৈরি করতে পারব কি না, সেটি নির্ভর করে আমরা তাঁর কল্পনাশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব কি না তার ওপর। সেটাকে সাহায্য করার জন্য দরকার খানিকটা লেখাপড়া।
আমাদের দেশের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া চলে গিয়েছে বড়লোকের হাতে। তাদের ছেলেমেয়েরা খুব ভালো লেখাপড়া করে, আরও ভালো লেখাপড়া করার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ আর ফিরে আসছে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আমাদের দেশটি চালাচ্ছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানেরা। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তারা ভালোই চালাচ্ছে।
তাই আমাদের দরকার দ্রুত জনশক্তি তৈরি করা, যাদের কল্পনাশক্তি নষ্ট হয়নি, দ্রুত তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে দেওয়ার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তার একটা আয়োজন রয়েছে। যেটাকে আমরা বলে থাকি কারিগরি শিক্ষা, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে এটা আসলে গরিব মানুষের লেখাপড়া, সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অতীতের কোনো একটা ‘শিক্ষানীতিতে’ স্পষ্ট করে এটা লেখা হয়েছিল যে গরিব মানুষেরাই এটা পড়বে। দেশের বড়লোকদের জন্য একধরনের লেখাপড়া থাকবে, গরিবদের জন্য অন্য ধরনের লেখাপড়া থাকবে, সেটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? শিক্ষানীতিতে সেটা ছাপার অক্ষরে লেখা থাকবে, সেটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। এটি মোটেও গরিব মানুষের লেখাপড়া নয়, এটি হচ্ছে দ্রুত জনশক্তি তৈরি করার একটা উপায়, পৃথিবীর সব দেশে এটি আছে, পৃথিবীর অনেক দেশে এভাবেই বেশির ভাগ মানুষ লেখাপড়া করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে এবারে যে কমিটি হয়েছিল, আমি তার একজন সদস্য ছিলাম। আমার খুব ভালো লাগছে, এবার আমরা সবাই মিলে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিতে পেরেছি। আমরা লিখে দিতে পেরেছি, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের যে কারিগরি ও প্রযুক্তির মানুষ দরকার, খুব দ্রুত সে ধরনের মানুষ গড়ে তোলার এটি হচ্ছে সহজ উপায়। এখানে নানা ধরনের বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কারিগরি পড়তে পড়তে হঠাৎ যদি কারও ইচ্ছা হয় যে সে প্রচলিত এক শিক্ষা নেবে, তাহলেও যেন তার পথ রুদ্ধ না হয়, সে ব্যবস্থাটিও করে রাখা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কারিগরি শিক্ষা যে সত্যিকারের শিক্ষা, মোটেও গরিব মানুষের জন্য অবহেলার একটি দিক নয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটা কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার জন্যও সুপারিশ করেছি।
শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে, এখন সেটা বাস্তবায়ন করা শুরু হবে। আমরা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা আশা করছি, শিক্ষানীতির জন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারটি সরকার খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখবে। যারা কারিগরি শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের যেন সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যারা পড়তে চাইছে, তাদের যেন উৎসাহ দেওয়া হয়। আর যারা কী পড়বে, সেটা নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তির মাঝে আছে, তাদের যেন কারিগরি শিক্ষার খুঁটিনাটি জানিয়ে দেওয়া হয়।
বেশ কিছুদিন আগে একটি বিজ্ঞান মেলায় আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেখানে শহরের সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নানা ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে, আমি সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে একটি সত্য আবিষ্কার করেছি। একই বয়সের সাধারণ স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা যেখানে একটা ছেলেমানুষি বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে, সেখানে কারিগরি স্কুলের ছেলেমেয়েরা এনেছে অত্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞান প্রজেক্ট। যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তারা এমন চমকপ্রদ বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে যে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করে বুঝতে পেরেছি, তারা নিজেরা অনেক চিন্তাভাবনা করে সেগুলো দাঁড় করিয়েছে।
আমরা একটা নতুন বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এখন সত্যিকারের লেখাপড়া শিখিয়ে দাঁড় করাতে হবে—তার সবচেয়ে বড় অংশ হতে হবে বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর কারিগরি শিক্ষা। আমাদের ছেলেমেয়েদের বোঝাতে হবে, প্রচলিত শিক্ষায় মুখস্থ করে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে কোনো অফিসের কেরানি বা পিয়নের চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরার থেকে অনেক বেশি সম্মানের ব্যাপার কারিগরি শিক্ষা নিয়ে দক্ষ জনশক্তি হয়ে যাওয়া। দেশে এ ধরনের জনশক্তির খুব প্রয়োজন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। তাহলে আমরা সত্যিকারের দক্ষ জনশক্তিকে পাঠাতে পারব। এ দেশের অসংখ্য মানুষ বিদেশে কাজ করে, তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত, আমি কখনো ভালো করে জানতে পারিনি, ৬০ লাখ থেকে এক কোটি—সব ধরনের সংখ্যাই শুনেছি। এই জনশক্তির প্রায় পুরোটাই অদক্ষ। যদি তারা কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ হতো, তাহলে শুধু যে তাদের নিজেদের জীবনমান উঁচু হতো, তা নয়। পৃথিবীর যেসব দেশে আমাদের জনশক্তি কাজ করতে গেল, সেই দেশগুলোও তাদের সব ধরনের উন্নয়নের জন্য আমাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকত। জাতি হিসেবে আমরা বুদ্ধিমান আর মেধাবী। আমরা পরিশ্রম করতে পারি। এ জাতির সন্তানদের যদি প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতাম।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.