ইতিহাসের উপাদান মানবিক দলিল by আনিসুজ্জামান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি।সম্প্রতি প্রকাশিত অসমাপ্ত সেই আত্মজীবনী নিয়ে বিশেষ আয়োজন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, এমন গুঞ্জন উঠলে বাংলাদেশে কারো কারো ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এই আত্মকাহিনির কথা শোনা যায়নি, তাই এর অকৃত্রিমতায় তাঁরা আস্থা রাখতে পারেননি। এখন জানা যাচ্ছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তখনো বঙ্গবন্ধু না-হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন, সে-সময়ে বেগম ফজিলতুননেসা মুজিব তাঁকে তাঁর জীবনের কাহিনি লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি কয়েকটি খাতা কিনেও জেলগেটে জমা দেন। দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে দুটি খাতা জেল-কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে ছাড় করেছিলেন ১৯৬৭ সালের ৯ জুন ও একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বরে। আত্মজীবনী লেখার প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রথমে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি লিখতে পারেন না বলে, তার উপর, তা লিখে কী হবে, এমন ভেবে। শেষে স্ত্রীর পুনরায় অনুরোধে একদিন তিনি কারাগারে বসেই আত্মকথা লিখতে শুরু করেন। চারটি খাতায় তা লেখা হয়েছিল। তাঁর আরো কিছু স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও ভ্রমণকাহিনি এবং নিজের হিসেবের খাতার সঙ্গে বেগম মুজিব এ-চারটি খাতা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন শোবার ঘরের আলমারির মাথায় এক কোণে। ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারেরা যখন তাঁদের বাড়ি লুটপাট করে, তখন বিবর্ণ মলাটের এই পুরোনো খাতাগুলি সম্ভবত তারা লুণ্ঠনযোগ্য মনে করেনি। মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের বেশ পরে, শেখ ফজলুল হক মণিকে বঙ্গবন্ধু খাতাগুলো দিয়েছিলেন — হয়তো ছাপার হরফে রূপান্তর করতে। সে-সুযোগ করে ওঠার আগেই বোধহয় আততায়ীরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ মণি উভয়কেই হত্যা করে। বাংলার বাণী পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরের টেবিলের দেরাজে খাতাগুলি রক্ষিত ছিল। লেখকের আরেক ভাগনে সেগুলো উদ্ধার করেন কোনো এক সময়ে এবং শেখ হাসিনার কাছে তা হস্তান্তরিত করেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে সংঘটিত তাঁকে হত্যাচেষ্টার পরে। প্রথমে শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ এবং পরে শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁরা দুজন মিলে পাণ্ডুলিপি সংশোধন ও সম্পাদনা, মুদ্রণ ও প্রুফ দেখা এবং টীকা সংযোজন ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করেন। শেখ রেহানাও তাতে সাহায্য করেন এবং অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের পক্ষে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদ ২০১২ সালের ১৯ জুনে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার ভূমিকা-সংবলিত শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি এবং ফকরুল আলমকৃত এর ইংরেজি অনুবাদ রচয়িতার দুই কন্যার হাতে তুলে দেন। মূল বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৮৮, সেইসঙ্গে ভূমিকা, টীকা, বইতে উল্লিখিত বহুজনের পরিচিতি, নির্ঘণ্ট, আলোকচিত্র ও পাণ্ডুলিপির চিত্রলিপি প্রভৃতি আছে আরো ৫৩ পৃষ্ঠা জুড়ে। এর একটি উর্দু অনুবাদও অচিরে পাকিস্তানে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
আত্মজীবনীমাত্রই অসমাপ্ত জীবনকথা। তবে এই বই বিশেষভাবে অসমাপ্ত এই অর্থে যে, এতে শেখ মুজিব মাত্র ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে পেরেছেন। বইটি শুরু হয়েছে তাঁর বংশপরিচয় ও বাল্যকথা দিয়ে, তারপর ১৯৩৯ সাল থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এতে কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির উল্লেখ থাকলেও তার বিস্তৃত পরিচয় নেই কিংবা তেভাগার মতো আন্দোলনের কথা নেই, তবে বিস্তারিতভাবে আছে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কথা এবং তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের নানা তথ্য। বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে ১৯৪৬এর সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭এর দেশভাগ ও স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গ গঠনের ব্যর্থ প্রয়াস, ১৯৪৮এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৪৯এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও তার ভাঙনের বিষয় এবং তাঁর নিজের কারাজীবনের কথা। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমউদ্দীন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) প্রমুখ রাজনৈতিক নেতা এবং আবদুল ওয়াসেক, শাহ আজিজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন ও নূরুদ্দীন আহমদের মতো ছাত্রনেতার যে-চরিত্রচিত্রণ লেখক করেছেন, তা মূল্যবান।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঘটনাধারা মুসলিম লীগের একজন উৎসর্গীকৃত কর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণিত। তাই হিন্দুমুসলমানের দ্বন্দ্বের কথা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে এবং প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কলকাতা ও বিহারের দাঙ্গার কথা যত বলা হয়েছে, নোয়াখালির কথা তত বলা নেই। ১৯৪৭ সালের পর একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির জন্যে তাঁর উৎকণ্ঠা গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু — তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা তিনি নিবেদন করেছেন। তারপরও বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি অনেক কিছু দেখার প্রয়াস পেয়েছেন।
প্রথম জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব যখন ফজলুল হকের সমালোচনা করতে যান, তখন তাঁর পিতামাতা উভয়েই হক সাহেবকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে তাঁকে নিষেধ করেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন — দাঁড়িয়ে বললেন, “যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।” এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে।
পরে, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে তিক্ততা দেখা দিলে, তিনি ফজলুল হক সম্পর্কে বলছেন :
বৃদ্ধলোক, তাঁকে আর কি বলব, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতে শুরু করেছেন। দরকার না হলেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন। তিনি খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের বলেছেন, “আমি বুড়া আর মুজিব গুড়া, তাই ওর আমি নানা ও আমার নাতি।” আমি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট। আর হক সাহেব সকলের চেয়ে বয়সে বড়। তিনি আমাকে যে কাজই করতে বলতেন, আমি করতে লাগলাম। তাঁর মনটা উদার ছিল, যে কারণে তাঁকে আমি ভক্তি করতে শুরু করলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকত তখন তিনি উদার ও অমায়িক। খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই এদের উপর তাঁর নির্ভর করতে হত। কিন্তু যেভাবে তিনি আমাকে স্নেহ করতে আরম্ভ করেছিলেন আমার বিশ্বাস হয়েছিল এদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যাবে।
শামসুল হককে নিয়ে ছোটো একটা ঘটনায় মওলানা ভাসানীর প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবের মনে হয় :
এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই — এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে।
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তির অন্ত ছিল না। কিন্তু সেই তিনি যখন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন, তখন শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যথেষ্ট বিরূপ :
আমাদের নেতারা কি পরামর্শ শহীদ সাহেবকে দিয়েছিলেন জানি না, তবে শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে। ... আমরা জেলের ভিতরে বসে খুবই কষ্ট পেলাম এবং আমাদের মধ্যে একটা হতাশার ভাব দেখা দিল। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেছিল শহীদ সাহেব রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম “না, কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই।”
জেল থেকে মুক্তিলাভ করে শেখ মুজিব করাচি গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম রাতে সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেননি। পরদিন যখন দেখা করেছিলেন, তখন তাঁকে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন এবং মওলানা ভাসানীর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিলাভের আগে তাঁকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করেছিলেন।
এই যে কোনো মানুষের বা ঘটনার দুদিক দেখার ক্ষমতা, এটা সামান্য নয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক প্রয়োজনীয় ও অজ্ঞাতপূর্ব উপাদান আছে। বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের আপত্তি সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং সেই যুক্তফ্রন্ট ভাঙার নেপথ্য কাহিনি অতি চমকপ্রদ। বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্পর্কে এতে অনেক তথ্য আছে এবং বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনীতিসহায়ক ভূমিকার পরিচয় আছে। তবে, বইটিতে মানুষ মুজিবের যে-পরিচয় ধরা পড়েছে, আমার কাছে, তা সবচেয়ে আকর্ষণীয়; তা-ই, আমার মতে, বইটিকে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছে।
ধরা যাক, গোপালগঞ্জ সম্পর্কে তাঁর আবেগাপ্লুত উক্তি। ঢাকা জেলে তখন একইসঙ্গে তিনি নিরাপত্তা বন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁকে অন্য মামলায় গোপালগঞ্জের আদালতে আনা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিয়েছেন তাঁকে থানায় নিয়ে যেতে।
কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। কারণ, তখন গোপালগঞ্জে রিকশাও চলত না। অনেক লোক আমার সাথে চলল। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে। বাল্যস্মৃতি কেউ সহজে ভোলে না। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমার পরিচয়। এই শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে। নদীর পাড়েই কোর্ট ও মিশন স্কুল। এখন একটা কলেজ হয়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে বের হয়ে পড়ল, আমাকে দেখতে। কিছুদূর পরেই দু’পাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের আমি নাম জানতাম। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।
১৯৫০ সালের শেষদিকে এই যেসব কথা তিনি বললেন, দশ-পনেরো বছর পরে সারা পূর্ব বাংলা সম্পর্কে এরকম দাবি তিনি করতে পারতেন।
মাটি ও মানুষের প্রতি এই ভালোবাসার ফলেই, দেখা যায়, যারা সামান্য, শেখ মুজিবের লেখায় তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলী আমজাদ খানের বাড়ি থেকে তাঁকে যখন পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তখন খান সাহেবের ছোটো ছেলে শাজাহান — বোধহয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র — সেখানে উপস্থিত ছিল।
শাহজাহান আমাকে খুব ভালবাসত, সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে যাই, শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। শাজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই।
কিংবা ১৯৪৮ সালে ভাষা-আন্দোলনের কালে যখন পাঁচদিন বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তখন, তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে অনেক স্কুল-ছাত্রও ছিল।
নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, “তোকে আজই বের করে নিব।” ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, “অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না।” সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে।
যিনি দেশের অবিসংবাদিত নেতা হতে যাচ্ছেন, তাঁর কি দরকার এসব তুচ্ছ কথা মনে রাখার? যে-অবাঙালি সেপাই তাঁকে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী বলে জানত এবং তাই পাকিস্তানের জেলে তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল, তার কথা তিনি মনে রেখেছেন। পুলিশের যে-ইনসপেক্টর আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে চাকরির ভয় না করে সত্য কথা বলেছিল, তাকে তিনি ভোলেননি। বন্দি অবস্থায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময়ে অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নিত, এতে যেন তাঁর প্রহরায় নিযুক্ত গোয়েন্দাদের কর্মক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে না হয়, সেদিকে তিনি নজর রেখেছেন।
ফরিদপুর জেলে একই ওয়ার্ডে তাঁর সহবন্দি ছিলেন মাদারিপুরের ফণি মজুমদার এবং গোপালগঞ্জের চন্দ্র ঘোষ।
চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মত একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোন ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারি কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্য সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তাঁর শাস্তি হয়।
জেলে চন্দ্র ঘোষ অসুস্থ হন, মরণাপন্ন হয়ে পড়েন, তাঁর জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সিভিল সার্জন তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে সম্মত করান। হাসপাতালে রওনা হওয়ার আগে তিনি শেখ মুজিবকে একবার দেখতে চাইলেন — আর তো তাঁর কেউ নেই। লেখককে জেলগেটে নেওয়া হলো।
চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সামপ্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।” এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।” আর কথা বলার শক্তি আমার ছিল না। শেষবারের মত বললাম, “আল্লাহ করলে আপনি ভাল হয়ে যেতে পারেন।” তাঁকে নিয়ে গেল।
চন্দ্র ঘোষের অপারেশন সফল হয়, তিনি মুক্তিলাভ করেন, তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং তাঁকে যা বলেছিলেন, তারপর তাঁর পক্ষে আর পাকিস্তানে থাকা সম্ভবপর হয়নি।
বইতে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা আছে স্বাভাবিকভাবে। তাঁর বেশি বয়সে পড়াশোনা, ডানপিটে স্বভাব, মারামারির দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়া। অল্পবয়সে বিয়ে, নিজের সংসার করতে না পারা, পিতার ওপরে আর্থিকভাবে নির্ভর করা, প্রেমময়ী স্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ নেওয়া। বারেবারে জেলে যাওয়ায় পিতামাতাস্ত্রীর উদেবগ ও হয়রানি, ছেলেমেয়ের সঙ্গে দূরত্ব-সৃষ্টি। অনেকদিন কারাগারে কাটিয়ে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পর
একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।”
এখানে আর কোনো মন্তব্যের অবকাশ নেই।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব যে-আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে দিল্লি-আগ্রার দুর্গ, প্রাসাদ ও স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীর কথা লিখেছেন এবং যে-অনুরাগ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের গানের কথা বলেছেন (‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’), তা তাঁর জীবনের একটি অনালোকিত দিককে উদ্ঘাটন করেছে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসের উপকরণে পূর্ণ নয়, তা একটি মানবিক দলিলও। রচনাশৈলী সরল ও সাবলীল। বইটি আমাদের সকলেরই পড়া উচিত।
আত্মজীবনীমাত্রই অসমাপ্ত জীবনকথা। তবে এই বই বিশেষভাবে অসমাপ্ত এই অর্থে যে, এতে শেখ মুজিব মাত্র ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে পেরেছেন। বইটি শুরু হয়েছে তাঁর বংশপরিচয় ও বাল্যকথা দিয়ে, তারপর ১৯৩৯ সাল থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এতে কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির উল্লেখ থাকলেও তার বিস্তৃত পরিচয় নেই কিংবা তেভাগার মতো আন্দোলনের কথা নেই, তবে বিস্তারিতভাবে আছে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কথা এবং তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের নানা তথ্য। বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে ১৯৪৬এর সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭এর দেশভাগ ও স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গ গঠনের ব্যর্থ প্রয়াস, ১৯৪৮এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৪৯এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও তার ভাঙনের বিষয় এবং তাঁর নিজের কারাজীবনের কথা। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমউদ্দীন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) প্রমুখ রাজনৈতিক নেতা এবং আবদুল ওয়াসেক, শাহ আজিজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন ও নূরুদ্দীন আহমদের মতো ছাত্রনেতার যে-চরিত্রচিত্রণ লেখক করেছেন, তা মূল্যবান।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঘটনাধারা মুসলিম লীগের একজন উৎসর্গীকৃত কর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণিত। তাই হিন্দুমুসলমানের দ্বন্দ্বের কথা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে এবং প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কলকাতা ও বিহারের দাঙ্গার কথা যত বলা হয়েছে, নোয়াখালির কথা তত বলা নেই। ১৯৪৭ সালের পর একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির জন্যে তাঁর উৎকণ্ঠা গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু — তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা তিনি নিবেদন করেছেন। তারপরও বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি অনেক কিছু দেখার প্রয়াস পেয়েছেন।
প্রথম জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব যখন ফজলুল হকের সমালোচনা করতে যান, তখন তাঁর পিতামাতা উভয়েই হক সাহেবকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে তাঁকে নিষেধ করেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন — দাঁড়িয়ে বললেন, “যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।” এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে।
পরে, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে তিক্ততা দেখা দিলে, তিনি ফজলুল হক সম্পর্কে বলছেন :
বৃদ্ধলোক, তাঁকে আর কি বলব, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতে শুরু করেছেন। দরকার না হলেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন। তিনি খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের বলেছেন, “আমি বুড়া আর মুজিব গুড়া, তাই ওর আমি নানা ও আমার নাতি।” আমি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট। আর হক সাহেব সকলের চেয়ে বয়সে বড়। তিনি আমাকে যে কাজই করতে বলতেন, আমি করতে লাগলাম। তাঁর মনটা উদার ছিল, যে কারণে তাঁকে আমি ভক্তি করতে শুরু করলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকত তখন তিনি উদার ও অমায়িক। খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই এদের উপর তাঁর নির্ভর করতে হত। কিন্তু যেভাবে তিনি আমাকে স্নেহ করতে আরম্ভ করেছিলেন আমার বিশ্বাস হয়েছিল এদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যাবে।
শামসুল হককে নিয়ে ছোটো একটা ঘটনায় মওলানা ভাসানীর প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবের মনে হয় :
এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই — এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে।
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তির অন্ত ছিল না। কিন্তু সেই তিনি যখন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন, তখন শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যথেষ্ট বিরূপ :
আমাদের নেতারা কি পরামর্শ শহীদ সাহেবকে দিয়েছিলেন জানি না, তবে শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে। ... আমরা জেলের ভিতরে বসে খুবই কষ্ট পেলাম এবং আমাদের মধ্যে একটা হতাশার ভাব দেখা দিল। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেছিল শহীদ সাহেব রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম “না, কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই।”
জেল থেকে মুক্তিলাভ করে শেখ মুজিব করাচি গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম রাতে সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেননি। পরদিন যখন দেখা করেছিলেন, তখন তাঁকে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন এবং মওলানা ভাসানীর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিলাভের আগে তাঁকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করেছিলেন।
এই যে কোনো মানুষের বা ঘটনার দুদিক দেখার ক্ষমতা, এটা সামান্য নয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক প্রয়োজনীয় ও অজ্ঞাতপূর্ব উপাদান আছে। বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের আপত্তি সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং সেই যুক্তফ্রন্ট ভাঙার নেপথ্য কাহিনি অতি চমকপ্রদ। বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্পর্কে এতে অনেক তথ্য আছে এবং বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনীতিসহায়ক ভূমিকার পরিচয় আছে। তবে, বইটিতে মানুষ মুজিবের যে-পরিচয় ধরা পড়েছে, আমার কাছে, তা সবচেয়ে আকর্ষণীয়; তা-ই, আমার মতে, বইটিকে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছে।
ধরা যাক, গোপালগঞ্জ সম্পর্কে তাঁর আবেগাপ্লুত উক্তি। ঢাকা জেলে তখন একইসঙ্গে তিনি নিরাপত্তা বন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁকে অন্য মামলায় গোপালগঞ্জের আদালতে আনা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিয়েছেন তাঁকে থানায় নিয়ে যেতে।
কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। কারণ, তখন গোপালগঞ্জে রিকশাও চলত না। অনেক লোক আমার সাথে চলল। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে। বাল্যস্মৃতি কেউ সহজে ভোলে না। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমার পরিচয়। এই শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে। নদীর পাড়েই কোর্ট ও মিশন স্কুল। এখন একটা কলেজ হয়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে বের হয়ে পড়ল, আমাকে দেখতে। কিছুদূর পরেই দু’পাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের আমি নাম জানতাম। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।
১৯৫০ সালের শেষদিকে এই যেসব কথা তিনি বললেন, দশ-পনেরো বছর পরে সারা পূর্ব বাংলা সম্পর্কে এরকম দাবি তিনি করতে পারতেন।
মাটি ও মানুষের প্রতি এই ভালোবাসার ফলেই, দেখা যায়, যারা সামান্য, শেখ মুজিবের লেখায় তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলী আমজাদ খানের বাড়ি থেকে তাঁকে যখন পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তখন খান সাহেবের ছোটো ছেলে শাজাহান — বোধহয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র — সেখানে উপস্থিত ছিল।
শাহজাহান আমাকে খুব ভালবাসত, সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে যাই, শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। শাজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই।
কিংবা ১৯৪৮ সালে ভাষা-আন্দোলনের কালে যখন পাঁচদিন বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তখন, তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে অনেক স্কুল-ছাত্রও ছিল।
নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, “তোকে আজই বের করে নিব।” ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, “অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না।” সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে।
যিনি দেশের অবিসংবাদিত নেতা হতে যাচ্ছেন, তাঁর কি দরকার এসব তুচ্ছ কথা মনে রাখার? যে-অবাঙালি সেপাই তাঁকে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী বলে জানত এবং তাই পাকিস্তানের জেলে তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল, তার কথা তিনি মনে রেখেছেন। পুলিশের যে-ইনসপেক্টর আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে চাকরির ভয় না করে সত্য কথা বলেছিল, তাকে তিনি ভোলেননি। বন্দি অবস্থায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময়ে অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নিত, এতে যেন তাঁর প্রহরায় নিযুক্ত গোয়েন্দাদের কর্মক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে না হয়, সেদিকে তিনি নজর রেখেছেন।
ফরিদপুর জেলে একই ওয়ার্ডে তাঁর সহবন্দি ছিলেন মাদারিপুরের ফণি মজুমদার এবং গোপালগঞ্জের চন্দ্র ঘোষ।
চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মত একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোন ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারি কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্য সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তাঁর শাস্তি হয়।
জেলে চন্দ্র ঘোষ অসুস্থ হন, মরণাপন্ন হয়ে পড়েন, তাঁর জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সিভিল সার্জন তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে সম্মত করান। হাসপাতালে রওনা হওয়ার আগে তিনি শেখ মুজিবকে একবার দেখতে চাইলেন — আর তো তাঁর কেউ নেই। লেখককে জেলগেটে নেওয়া হলো।
চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সামপ্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।” এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।” আর কথা বলার শক্তি আমার ছিল না। শেষবারের মত বললাম, “আল্লাহ করলে আপনি ভাল হয়ে যেতে পারেন।” তাঁকে নিয়ে গেল।
চন্দ্র ঘোষের অপারেশন সফল হয়, তিনি মুক্তিলাভ করেন, তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং তাঁকে যা বলেছিলেন, তারপর তাঁর পক্ষে আর পাকিস্তানে থাকা সম্ভবপর হয়নি।
বইতে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা আছে স্বাভাবিকভাবে। তাঁর বেশি বয়সে পড়াশোনা, ডানপিটে স্বভাব, মারামারির দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়া। অল্পবয়সে বিয়ে, নিজের সংসার করতে না পারা, পিতার ওপরে আর্থিকভাবে নির্ভর করা, প্রেমময়ী স্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ নেওয়া। বারেবারে জেলে যাওয়ায় পিতামাতাস্ত্রীর উদেবগ ও হয়রানি, ছেলেমেয়ের সঙ্গে দূরত্ব-সৃষ্টি। অনেকদিন কারাগারে কাটিয়ে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পর
একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।”
এখানে আর কোনো মন্তব্যের অবকাশ নেই।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব যে-আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে দিল্লি-আগ্রার দুর্গ, প্রাসাদ ও স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীর কথা লিখেছেন এবং যে-অনুরাগ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের গানের কথা বলেছেন (‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’), তা তাঁর জীবনের একটি অনালোকিত দিককে উদ্ঘাটন করেছে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসের উপকরণে পূর্ণ নয়, তা একটি মানবিক দলিলও। রচনাশৈলী সরল ও সাবলীল। বইটি আমাদের সকলেরই পড়া উচিত।
No comments