চারদিক-তালা-চাবির কারিগর by কিঙ্কর আহ্সান
মুক্তাগাছা শহরে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। মাঝদুপুরেও মানুষের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে আছে শহরের বাজারটি। খাবারের দোকানগুলোয় দারুণ ভিড়। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে পাওয়া যায় মুক্তাগাছার বিখ্যাত মণ্ডার দোকান।
গোপাল পালের বিখ্যাত মণ্ডা দিয়েই হবে দুপুরের পেটপুজো—এমনটা ঠিক করেই মাঝদুপুরে মুক্তাগাছায় আসা।
কিন্তু তা হয় না। শুধু মণ্ডা খেয়ে দুপুর পার করা মুশকিল। অনেক কিছু খাওয়ার পরও ভাত না খেলে মনে হয়, দিনটা বুঝি উপোসেই গেল। সস্তা, ভাঙাচোরা একটা হোটেলে গিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত, কুমড়ো ভাজি আর কচি মুরগির রান চিবোতে গিয়েই পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে। ভালো খাবারের দোকানের হদিস দিয়ে তিনি সাহায্য করছিলেন আমাদের। সুমন তালা-চাবির কারিগর। বাজারের ফুটপাত নয়, একদম ঠিক পথের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসে তিনি করেন তাঁর ব্যবসা। পথ দিয়ে যানবাহন গেলেও তাঁর দোকানের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এ পথের তিনিই রাজা।
ব্যবসাটা বহু দিনের। এলাকায় ভালো ছেলে বলে পরিচিত, তাই পথের মাঝখানে বসা দোকান নিয়ে নেই কারও কোনো অভিযোগ। ‘গরিব মানু। আমারে সবাই ভালা পায়। ভালা জায়গায় দোহান দেহার ট্যাকা কই পামু। রাশ্তাই ভরসা।’ পথের মাঝখানে কেন দোকান দেওয়া—এ প্রশ্নের জবাব এভাবেই দিলেন সুমন। সংসারে অভাব আছে তাঁর। তবে এ নিয়ে সারাক্ষণ দুঃখ করার মতো মানুষ নন তিনি। বিয়ে করেছেন অল্প বয়সেই। সংসারে আছে মা-বাবা, স্ত্রী আর এক ভাই। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব তাঁর। নিজে পড়াশোনা করেননি তেমন একটা। ভাইটা পড়াশোনা করে বড় চাকুরে হবে—এমনটাই স্বপ্ন সুমনের। একটু ভালো থাকার জন্য, একটু বেশি উপার্জনের জন্য রোদের ভেতরেও অনেকক্ষণ বসে থাকেন তিনি খদ্দেরের আশায়। তালা-চাবি নিয়ে কাজ করার নেশাটা হুট করেই পেয়ে বসে তাঁকে। এটাই যে জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠবে, এমনটা ভাবেননি কখনো। অল্প সময়ের ভেতরেই ঝানু হয়ে উঠেছিলেন তালা-চাবির কাজে। প্রথম দিকে দোকান ছিল না। তাঁর কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় বিপদে পড়লেই লোকজন ডাকত তাঁকে। লোকজনের উপকার করে ভালো লাগত খুব। কেউ কেউ তাঁর কাজে খুশি হয়ে বকশিশ দিত। বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের সবকিছু বাবাই দেখত। চৌপর দিনভর পরিশ্রম করে সংসারটা চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন সুমনই দেখছেন সব। বিয়ে করার পর মাথায় চেপে বসেছে অনেক দায়িত্ব। বাবারও বয়স হয়েছে বিশ্রাম করার। তাই নিজে থেকেই সুমন ধরেছেন সংসারের হাল। পথের ওপর দোকান দিয়ে শুরু করেছেন তালা-চাবির কারবার। আয় নেহাত মন্দ নয় সুমনের। তবে এ টাকায় পাঁচজনের সংসার চালানো খুব কঠিন। আগাগোড়া সুখী মানুষ সুমন জানান, বাড়ির সামনে অল্প একটু জায়গায় সবজির বাগান করেছেন তিনি। বউই করেন বাগান পরিচর্যার কাজ। অভাব কেটে যাবে একদিন, অভাবী কিন্তু আশাবাদী সুমনের মুখে এমন কথা শুনে ভালো লেগে যায় খুব। এমন অভাবে থেকেও তাঁর সুখী থাকার দারুণ ক্ষমতা দেখে হিংসাও হয় কিছুটা। আমরা কি ওর মতো অল্পতে তুষ্ট হতে পারি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় একসময়। পড়ে যায় রোদ। বিদায় নেন সুমন। অল্প কিছু টাকা তাঁর হাতে তুলে দিতে চাইতেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। শুধু দোয়া করতে বলেন। ভাইটা বড় চাকুরে হবে তার জন্য দোয়া, ঘরে নয়া অতিথি আসবে তার জন্য দোয়া, অসুস্থ মা-বাবার জন্য দোয়া। দোয়া করব এমন নিশ্চয়তা দিয়েই ফেরার পথ ধরি। ফেরার পথে চোখে পড়ে মুক্তাগাছার মস্ত নীল আকাশ। তার বুকে ঠাঁই নিয়েছে কচি-বুড়ো মেঘেদের দল। মুক্তাগাছার গুটিকয়েক ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আকাশে। মেঘ কেটে কেটে উড়ছে ঘুড়িগুলো। নীলের পশ্চাদপটে তাদের দেখতে লাগছে বেশ। আকাশের এ নীল যেমন-তেমন নীল নয়, ময়ূরকণ্ঠী নীল। রাজধানীটা ছেড়ে বেরোলেই বড় বেশি চোখে পড়ে আকাশের এমন রং। পরিচিত হওয়া যায় সুমনের মতো সহজ-সরল কিছু মানুষের সঙ্গে।
কিঙ্কর আহ্সান
কিন্তু তা হয় না। শুধু মণ্ডা খেয়ে দুপুর পার করা মুশকিল। অনেক কিছু খাওয়ার পরও ভাত না খেলে মনে হয়, দিনটা বুঝি উপোসেই গেল। সস্তা, ভাঙাচোরা একটা হোটেলে গিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত, কুমড়ো ভাজি আর কচি মুরগির রান চিবোতে গিয়েই পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে। ভালো খাবারের দোকানের হদিস দিয়ে তিনি সাহায্য করছিলেন আমাদের। সুমন তালা-চাবির কারিগর। বাজারের ফুটপাত নয়, একদম ঠিক পথের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসে তিনি করেন তাঁর ব্যবসা। পথ দিয়ে যানবাহন গেলেও তাঁর দোকানের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এ পথের তিনিই রাজা।
ব্যবসাটা বহু দিনের। এলাকায় ভালো ছেলে বলে পরিচিত, তাই পথের মাঝখানে বসা দোকান নিয়ে নেই কারও কোনো অভিযোগ। ‘গরিব মানু। আমারে সবাই ভালা পায়। ভালা জায়গায় দোহান দেহার ট্যাকা কই পামু। রাশ্তাই ভরসা।’ পথের মাঝখানে কেন দোকান দেওয়া—এ প্রশ্নের জবাব এভাবেই দিলেন সুমন। সংসারে অভাব আছে তাঁর। তবে এ নিয়ে সারাক্ষণ দুঃখ করার মতো মানুষ নন তিনি। বিয়ে করেছেন অল্প বয়সেই। সংসারে আছে মা-বাবা, স্ত্রী আর এক ভাই। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব তাঁর। নিজে পড়াশোনা করেননি তেমন একটা। ভাইটা পড়াশোনা করে বড় চাকুরে হবে—এমনটাই স্বপ্ন সুমনের। একটু ভালো থাকার জন্য, একটু বেশি উপার্জনের জন্য রোদের ভেতরেও অনেকক্ষণ বসে থাকেন তিনি খদ্দেরের আশায়। তালা-চাবি নিয়ে কাজ করার নেশাটা হুট করেই পেয়ে বসে তাঁকে। এটাই যে জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠবে, এমনটা ভাবেননি কখনো। অল্প সময়ের ভেতরেই ঝানু হয়ে উঠেছিলেন তালা-চাবির কাজে। প্রথম দিকে দোকান ছিল না। তাঁর কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় বিপদে পড়লেই লোকজন ডাকত তাঁকে। লোকজনের উপকার করে ভালো লাগত খুব। কেউ কেউ তাঁর কাজে খুশি হয়ে বকশিশ দিত। বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের সবকিছু বাবাই দেখত। চৌপর দিনভর পরিশ্রম করে সংসারটা চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন সুমনই দেখছেন সব। বিয়ে করার পর মাথায় চেপে বসেছে অনেক দায়িত্ব। বাবারও বয়স হয়েছে বিশ্রাম করার। তাই নিজে থেকেই সুমন ধরেছেন সংসারের হাল। পথের ওপর দোকান দিয়ে শুরু করেছেন তালা-চাবির কারবার। আয় নেহাত মন্দ নয় সুমনের। তবে এ টাকায় পাঁচজনের সংসার চালানো খুব কঠিন। আগাগোড়া সুখী মানুষ সুমন জানান, বাড়ির সামনে অল্প একটু জায়গায় সবজির বাগান করেছেন তিনি। বউই করেন বাগান পরিচর্যার কাজ। অভাব কেটে যাবে একদিন, অভাবী কিন্তু আশাবাদী সুমনের মুখে এমন কথা শুনে ভালো লেগে যায় খুব। এমন অভাবে থেকেও তাঁর সুখী থাকার দারুণ ক্ষমতা দেখে হিংসাও হয় কিছুটা। আমরা কি ওর মতো অল্পতে তুষ্ট হতে পারি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় একসময়। পড়ে যায় রোদ। বিদায় নেন সুমন। অল্প কিছু টাকা তাঁর হাতে তুলে দিতে চাইতেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। শুধু দোয়া করতে বলেন। ভাইটা বড় চাকুরে হবে তার জন্য দোয়া, ঘরে নয়া অতিথি আসবে তার জন্য দোয়া, অসুস্থ মা-বাবার জন্য দোয়া। দোয়া করব এমন নিশ্চয়তা দিয়েই ফেরার পথ ধরি। ফেরার পথে চোখে পড়ে মুক্তাগাছার মস্ত নীল আকাশ। তার বুকে ঠাঁই নিয়েছে কচি-বুড়ো মেঘেদের দল। মুক্তাগাছার গুটিকয়েক ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আকাশে। মেঘ কেটে কেটে উড়ছে ঘুড়িগুলো। নীলের পশ্চাদপটে তাদের দেখতে লাগছে বেশ। আকাশের এ নীল যেমন-তেমন নীল নয়, ময়ূরকণ্ঠী নীল। রাজধানীটা ছেড়ে বেরোলেই বড় বেশি চোখে পড়ে আকাশের এমন রং। পরিচিত হওয়া যায় সুমনের মতো সহজ-সরল কিছু মানুষের সঙ্গে।
কিঙ্কর আহ্সান
No comments