চারদিক-রমনা-নিসর্গের স্থপতি by মোকারম হোসেন

আমাদের রমনা-নিসর্গের কথা বলতে গেলেই লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলকের নাম অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১০০ বছর আগে তিনি রাজধানী শহর ঢাকাকে উদ্যানের নগর হিসেবে গড়ে তুলতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, সেই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি আমাদের কাছে নমস্য হয়ে থাকবেন।


কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মাত্র ১০০ বছরের ব্যবধানেই তিনি আমাদের কাছে বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন। হারিয়ে গেছে তাঁর অনেক সবুজ সন্তান। এই মহান উদ্যানকর্মীকে ইতিহাসের অন্তরাল থেকে তুলে এনে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি পুরানা পল্টনের বাসিন্দা অশীতিপর বৃদ্ধ শ্রী অখিল চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে সর্বপ্রথম প্রাউডলকের কথা জানতে পারেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে উদ্যান-নগরের আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মকাণ্ডে প্রাউডলক ছিলেন বৃক্ষশোভিত সরণি ও উদ্যান নির্মাণের দায়িত্বে। অখিল বাবু তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। পঞ্চাশের দশকের আগেকার রমনা ও সংলগ্ন এলাকার বৃক্ষসজ্জার সবটুকুই তখনকার সৃষ্টি। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় ঢাকায় রাজধানী নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং সম্ভবত প্রাউডলক পূর্ণাঙ্গ উদ্যান নির্মাণের অবকাশ পাননি। বর্তমান রমনা পার্ক ৫০ দশকের শেষদিকে তৈরি। প্রাউডলকের লাগানো তরুবীথির কিছু কিছু এখন আর নেই: রমনা পার্কের লাগোয়া সেগুন, নিউমার্কেটের পাশের বট, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পাকুড় ও দেবদারু, সচিবালয়ের সামনের পাদাউক এবং বহু রেইনট্রি, কৃষ্ণচূড়া ও অর্জুন, বেলি রোডের নাগলিঙ্গম, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সিলভার ওকের বীথি এবং বাওবাব গাছটিও। তবে রমনা অঞ্চলে এখনো যেসব শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী গাছ দেখা যায়, তার অধিকাংশই প্রাউডলকের লাগানো বলে ধারণা করা হয়। অখিল বাবুর সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনে চিঠি লিখলে কর্তৃপক্ষ প্রাউডলক-সম্পর্কিত জনৈক আর্নেস্ট ডাঙ্কের লেখা একটি প্রবন্ধ তাঁকে পাঠান। সেখানে অবশ্য তাঁর ঢাকায় অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ নেই। আকর প্রবন্ধটি Journal of the Kew Guild পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে, প্রাউডলক তখন এ সংস্থার সভাপতি (১৯৩৫-৩৬), বয়স ৭৪।
আর এল প্রাউডলকের জন্ম ১৮৬২ সালের ১০ নভেম্বর নর্থ উম্বারল্যান্ডের হেপসকট শহরে। ১৮৮৬ সালে তিনি লন্ডনের কিউ উদ্যানে শিক্ষার্থী উদ্যানী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে তিনি উষ্ণমণ্ডলীয় গাছপালার প্রজনন বিভাগে সহকারী ফোরম্যান পদে উন্নীত হন। পরের বছর তিনি কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে সহকারী কিউরেটর ও ১৯১১ সালে পরিপূর্ণ কিউরেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৮৯২ সালে প্রাউডলক দক্ষিণ মিয়ানমারে একটি উদ্ভিদ সংগ্রহ অভিযানে শরিক হন এবং শিবপুর ওষুধিশালার জন্য পাঁচ শতাধিক নমুনা সংগ্রহ করেন। স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি উত্তর ভারত ও দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে কয়েকবারই ছুটি কাটানোর সুযোগ পান এবং সেখানকার উদ্ভিদ-জগতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। ১৯০৮ সালে ছয় মাসের জন্য তাঁকে পার্ক ও বাগান তৈরির জন্য ইয়াঙ্গুন পাঠানো হয়। এখন যেখানে সুরম্য নয়নশোভন উদ্যান, সেদিন সেখানে ছিল শূন্য হতশ্রী মাঠ। প্রাউডলকের এই কাজ আজও বহুল প্রশংসিত। ১৯০৯ সালে বোম্বে অঞ্চলে রাবার চাষের সম্ভাবনা জরিপের ন্যস্ত দায়িত্ব শেষ হলে তিনি সে বছর জুলাই মাসে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের উদ্যানবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে ঢাকায় আসেন। ঢাকার সদর দপ্তর থেকে শিলং, দার্জিলিং, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তাঁর যাতায়াত ছিল এবং এসব অভিযানে উদ্ভিদ সংগ্রহ ছাড়াও অর্থকরী গাছপালা চাষের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করেন। তাঁর জীবনের শেষ কীর্তি শ্যামলী-রমনা, যেখানে উপমহাদেশীয় গাছপালার সঙ্গে এখন সহবাস করছে আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলের বৃক্ষরাজি। রমনা অবশ্যই সেদিন ইয়াঙ্গুনের মতোই বিরান ও হতশ্রী মাঠ ছিল, তাকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছেন, আমাদের জন্য উদ্যান-নগরের একটি খুদে নকশা রেখে গেছেন।
১৯১৮ সালে প্রাউডলক অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যান। কিন্তু এই উপমহাদেশে রেখে যাওয়া কর্মজীবনের স্মৃতি তাঁকে বারবার এ দেশে ফিরিয়ে আনে। ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ভারতে আসেন এবং কিছুদিন কলকাতা ও ঢাকায় থাকার পর নীলগিরি যান এবং বন্ধুদের সঙ্গে অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কয়েকটি সংগ্রহ-অভিযানে শরিক হন। ১৯২১ সালের জুন মাসে তিনি দেশে ফেরেন। ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি সস্ত্রীক ভারতে আসেন এবং ১৯৩২ সালের মে মাস পর্যন্ত এ দেশে থাকেন। ধারণা করা হয়, ১৯৩২ সালে ফিরে যাওয়ার পর তিনি আবার কর্মজীবনের শেষ ও শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি শ্যামলী ও রমনাকে আরেকবার দেখার জন্যই সস্ত্রীক ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর রোপিত বৃক্ষরাজির বয়স তত দিনে দুই দশক উত্তীর্ণ এবং রমনা উদ্ভিন্নযৌবনা। অখিল বাবু জানিয়েছেন, আপন মানসসন্তানের রূপশ্রী দেখে তিনি সেদিন মুগ্ধই হয়েছিলেন।
দেশে ফিরে ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে প্রাউডলক কিউ উদ্যানের ওষুধিশালার জন্য আইসল্যান্ড থেকে ২০৩টি এবং ১৯৩৫ সালে জের্সি ও চ্যানেল আয়ল্যান্ড থেকে ১৭৮টি উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন। স্বভাবজাত বলেই প্রকৃতির সান্নিধ্য ও নিরীক্ষা থেকে নিসর্গীর মুক্তি নেই। তিনি কত সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, সে সম্পর্কে আর কোনো কিছু জানা যায় না।
দ্বিজেন শর্মার প্রস্তাব দিয়ে শেষ করছি। তিনি নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে লিখেছেন, ইতিহাসের দায় হিসেবে অপ্রিয় সত্ত্বেও আমরা ব্রিটিশ শাসকদের বহু স্মৃতি আজও রক্ষা করে চলেছি ভবনে, সড়কে, স্মৃতিস্তম্ভে। কিন্তু শাসকদেশের যেসব প্রতিনিধি আমাদের সংস্কৃতি ও অর্জনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, বলা বাহুল্য তাঁরা প্রকটভাবেই অন্তরালবর্তী। কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন ব্রিটিশ আমলের উদ্ভিদ-সংগ্রাহক ও উদ্ভিদবিদদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানকার কিছু পথ ও পুকুরের সঙ্গে তাঁদের নাম যুক্ত করেছে। আমরা কি প্রাউডলকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখানোর জন্য অন্তত মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন বা রমনা পার্কে সেই ধরনের একটি স্মারণিক প্রতিষ্ঠা করতে পারি না?

No comments

Powered by Blogger.