স্মরণ-সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী
আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রয়াত সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের যথার্থ মূল্যায়ন দুরূহ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, দিগ্বিজয়ী আইনজ্ঞ, সার্থক সংগঠক এবং সফল কূটনীতিবিদ; যাঁর কাছ থেকে আমার শুধু পাওয়ারই ছিল, দেওয়ার কিছুই ছিল না। ভাগ্যগুণে তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম এবং কখনো কখনো তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ
হয়েছে। অত্যন্ত বড় মাপের এ মানুষটির সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণাই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া, সেই সময়ের লাখ লাখ উদ্বাস্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর সেই সময়ের অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে রইবে। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতা বিমানবন্দরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে সেদিন দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল যাচ্ছিল। আমি তার সদস্য ছিলাম। সিদ্ধার্থ বাবু কলকাতায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন এবং একই বিমানে তিনিও দিল্লিতে গেলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকার পথে লন্ডন থেকে দিল্লি এলেন। সেদিনের ঘটনা এখন সর্বজনবিদিত এবং তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
সত্তরের দশকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হলেও অব্যাহত ছিল। ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
এই শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যক্ত করব, যা তাঁর চরিত্রের মাহাত্ম্যকে কিছুটা হলেও তুলে ধরবে। আশির দশকে আমি যখন দিল্লিতে রাষ্ট্রদূত ছিলাম মানুদা (সেই নামেই তখন তাঁকে সম্বোধন করতাম) পাঞ্জাব রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন। এক দিন চান্দিগড় থেকে তাঁর টেলিফোন পেলাম। বিষণ্ন তাঁর কণ্ঠস্বর। ‘ফারুক, শাজাহান নাকি বেঁচে নেই।’ বললেন মানুদা। প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীকে তিনি সেই নামেই ডাকতেন। তাঁরা ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী এবং বন্ধু। দীর্ঘ সময় তিনি কাটালেন তাঁর বন্ধু শাজাহানের স্মৃতিচারণায়। বুঝতেই পারছিলাম যে টেলিফোন লাইনের অপর প্রান্তের মানুষটি, তাঁর বন্ধুর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। কত তাঁর কথা, কত স্মৃতি। আর তা ধরে রাখার জন্য কত আন্তরিক একজন বন্ধু।
রাজ্যপালের পাট চুকিয়ে দিল্লিতে তাঁদের ছিমছাম ফ্ল্যাটে গুছিয়ে বসলেন মানুদা আর তাঁর ব্যারিস্টার স্ত্রী মায়াদি। নিতান্ত আগ্রহ-উদ্দীপক না হলে কোনো মামলাই তাঁরা হাতে নিতেন না। সন্ধ্যায় টেলিফোন পেয়েছি। ‘কি করছ আজ রাতে? চলে এসো। ভালো বাঙালি খাবার আছে।’ ছুটে যেতাম। ভালো বাঙালি খাবার পছন্দ করি বলে নয়, দুজন ভালো মানুষের জন্য তত দিনে আমার এবং আমার স্ত্রী জীনার ভালোবাসা জন্মে গেছে বলে। আমার স্ত্রী জীনার লেখাপড়া মূলত দার্জিলিং, কলকাতা আর লন্ডনে। অতএব পরিচিত মানুষের আর গুরুত্বপূর্ণ কত ঘটনার কথা বলতে বলতেই সময় কেটে যেত। এখনো মনে আছে, তাঁর হলঘরের সামনে টানানো ছিল বাংলাদেশের অনেক পুরোনো একটি নকশি কাঁথা। এত সুন্দর কাঁথা আর কোনো দিন চোখে পড়েনি। মানুদা যখন কথা বলতেন, (কী চমৎকার ছিল তাঁর বাচনভঙ্গি, কি বাংলায়, কি ইংরেজিতে) উপমহাদেশের রাজনীতির বিবর্তনের কথা, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কোনো বইয়ে এত সুন্দরভাবে, এমন প্রাঞ্জলতায় কেউ তো তা কোনো দিন আমার জন্য লেখেনি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আমি তখন ব্র্যাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ছুটি কাটাতে আমরা দুজন ওয়াশিংটন গেছি। মানুদা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত—ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ভারতীয় দূতাবাসে টেলিফোন করে জানলাম, তিনি শিকাগোতে (খুব সম্ভবত) রয়েছেন। ভাবলাম, সেই যাত্রায় আর দেখা হলো না। কিন্তু কই। দুই ঘণ্টা পরই ভারতীয় দূতাবাস থেকে টেলিফোন। রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থ শংকর রায় আমাদের দুজনকে অমুক সন্ধ্যায় দাওয়াত করেছেন। সুন্দর আরও একটি সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি। প্রত্যাখ্যান তো কিছুতেই করা যায় না। গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের ওয়াশিংটন সফরের কত বড় একটি পাওয়া।
মানুদার সঙ্গে শেষ দেখা ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে তাঁর ২ বেলতলার বাড়িতে। পুরোনো বিরাট এই বাড়িটিতেই তাঁর জন্ম এবং পরে তা তিনি কিনে নিয়েছিলেন। কলকাতায় সেটাই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। ট্যাক্সিওয়ালাকে ঠিকানাটি ছাড়া আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। মানুদা আর মায়াদি দুজনেরই তখন বয়স হয়েছে। মানুদার বয়স তখন ৮৮। তাঁরা বাড়ি থেকে বেরুনই না। মানুদার ডায়াবেটিক নিউরোপেথি বলে একটি দুরারোগ্য রোগ। ভয় ছিল, সেটাই হয়তো হবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। তাই হোটেলে ফিরে এসে কিংছু নোট রেখেছিলাম। নেহাতই ব্যক্তিগত মন্তব্য বাদ দিয়ে তা সংক্ষেপে স্মরণ করছি এই জন্য যে তা থেকে হয়তো বা তাঁর মাহাত্ম্যের কিছু আভাস পাওয়া যাবে।
দোতলা বাড়ির প্রথম তলায় বই আর বই। অনেক বই-ই দুর্লভ, তাঁর নানা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কেনা। ওপরের দোতলার বসার ঘরের মূল সোফাটি তাঁর নানা চিত্তরঞ্জন দাশের বিয়ের উপহার—তাঁকে আর মায়াদিকে। সে তো বেশ কটি দশকের কথা। সোফার স্টাইল কতই না এখন পাল্টেছে, কিন্তু তাঁদের দুজনের কাছে সোফাটি যে অমূল্য স্মৃতি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আমরা কামরায় প্রবেশ করে দেখি তিনি কোরআন শরিফের পাতা ওল্টাচ্ছেন। তিনি বললেন, কই, কোরআনে তো সর্বত্রই রয়েছে আল্লা ক্ষমাশীল। রাহমানুর রাহিম। তবে কেন কিছু কিছু লেখক-লেখিকা (বিশেষ করে একজনের কথা তিনি স্মরণ করেছিলেন) গায়ে পড়ে ধর্মের অবমাননা করেন। প্রত্যেকের কাছেই তো তার ধর্মের মূল্য রয়েছে। বুঝলাম, কোরআন শরিফ তাঁর নতুন পড়া নয়। তাঁর বসার ঘরের প্রধান চিত্রকর্ম হলো জয়নুল আবেদিনের; বসার ঘরে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর উপহার একটি রুপার নৌকা। মানুদা বললেন যে তাঁর ওয়ালেটে সংরক্ষিত রয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর একটি ছবি—১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ দিল্লিতে তোলা ভারতের (উপমহাদেশ) ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা তাঁকে এখনো পীড়া দেয়, বললেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বেঁচে থাকলে ভারতের রাজনীতি ভিন্নতর খাতে প্রবাহিত হতো। তাঁর দাদামশায়ের সঙ্গে জিন্নাহ সাহেবের ‘সখ্য’ ছিল। তাঁরা দুজনই হুইস্কি ভালোবাসতেন, হেসে বললেন তিনি। তিনি বললেন যে জমিদারি উচ্ছেদ মামলার মাধ্যমেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ১৯৫৬ সালে যখন কলকাতায় কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল, তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়া। কিন্তু বিধান রায় তাঁকে আইনমন্ত্রী করলেন, যেখানে তাঁর দায়িত্বের পরিধি ছিল ব্যাপকতর। তখন থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু।
মানুদা তাঁর ১৯৭১-৭২-এর ভূমিকার কথা স্মরণ করলেন। বললেন, তিনি যখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠা প্রত্যয় তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল যে ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ অচিরেই স্বাধীন হবে। তিনি ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর কথা স্মরণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলাকাতায় ভাষণ দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি ছোট কাগজ গুঁজে দিলেন। কাগজটি ইন্দিরা গান্ধী পড়ে তাঁর হাতেই রেখে দিলেন। রাজভবনে পৌঁছেই তিনি মানুদাকে বললেন, ‘ওরা আক্রমণ করেছে।’ কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথেই ওয়্যারলেসে কেবিনেট মিটিং ডাকা হলো, ডাকা হলো পুরো মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং তারপর বৈঠক বিরোধী দলের সঙ্গে। সেই বৈঠকটা কিছুটা সময় নেওয়ার জন্য ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু পরই ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণ দিয়েছিলেন।
‘সে তো পুরোনো কথা। এখন সবাই মিলে যেন উপমহাদেশে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ কাজটি আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।’ বললেন তিনি।
মানুদা পরিণত বয়সেই তো গেলেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তাঁর নানা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধির কাছেই সম্পন্ন হয়েছে। মায়াদিকে আর তাঁর পরিবারের পরিচিত অন্যদের সমবেদনা জানিয়েছি। মনে পড়ে, কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করে মনে হয়েছিল, কিছু মানুষের জীবন কেন অনন্ত হয় না? মানুদার বেলায়ও তা-ই মনে হয়। তিনি এবং তাঁর মতো দশ-পাঁচটা মানুষ তো আমাদের উপমহাদেশের চিত্র বদলে দিতে পারেন। হয়তো বা একদিন তা আমরা অর্জন করব। সেই বিচারে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের মতো মানুষ অমরত্বই তো লাভ করবেন।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া, সেই সময়ের লাখ লাখ উদ্বাস্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর সেই সময়ের অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে রইবে। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতা বিমানবন্দরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে সেদিন দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল যাচ্ছিল। আমি তার সদস্য ছিলাম। সিদ্ধার্থ বাবু কলকাতায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন এবং একই বিমানে তিনিও দিল্লিতে গেলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকার পথে লন্ডন থেকে দিল্লি এলেন। সেদিনের ঘটনা এখন সর্বজনবিদিত এবং তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
সত্তরের দশকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হলেও অব্যাহত ছিল। ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
এই শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যক্ত করব, যা তাঁর চরিত্রের মাহাত্ম্যকে কিছুটা হলেও তুলে ধরবে। আশির দশকে আমি যখন দিল্লিতে রাষ্ট্রদূত ছিলাম মানুদা (সেই নামেই তখন তাঁকে সম্বোধন করতাম) পাঞ্জাব রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন। এক দিন চান্দিগড় থেকে তাঁর টেলিফোন পেলাম। বিষণ্ন তাঁর কণ্ঠস্বর। ‘ফারুক, শাজাহান নাকি বেঁচে নেই।’ বললেন মানুদা। প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীকে তিনি সেই নামেই ডাকতেন। তাঁরা ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী এবং বন্ধু। দীর্ঘ সময় তিনি কাটালেন তাঁর বন্ধু শাজাহানের স্মৃতিচারণায়। বুঝতেই পারছিলাম যে টেলিফোন লাইনের অপর প্রান্তের মানুষটি, তাঁর বন্ধুর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। কত তাঁর কথা, কত স্মৃতি। আর তা ধরে রাখার জন্য কত আন্তরিক একজন বন্ধু।
রাজ্যপালের পাট চুকিয়ে দিল্লিতে তাঁদের ছিমছাম ফ্ল্যাটে গুছিয়ে বসলেন মানুদা আর তাঁর ব্যারিস্টার স্ত্রী মায়াদি। নিতান্ত আগ্রহ-উদ্দীপক না হলে কোনো মামলাই তাঁরা হাতে নিতেন না। সন্ধ্যায় টেলিফোন পেয়েছি। ‘কি করছ আজ রাতে? চলে এসো। ভালো বাঙালি খাবার আছে।’ ছুটে যেতাম। ভালো বাঙালি খাবার পছন্দ করি বলে নয়, দুজন ভালো মানুষের জন্য তত দিনে আমার এবং আমার স্ত্রী জীনার ভালোবাসা জন্মে গেছে বলে। আমার স্ত্রী জীনার লেখাপড়া মূলত দার্জিলিং, কলকাতা আর লন্ডনে। অতএব পরিচিত মানুষের আর গুরুত্বপূর্ণ কত ঘটনার কথা বলতে বলতেই সময় কেটে যেত। এখনো মনে আছে, তাঁর হলঘরের সামনে টানানো ছিল বাংলাদেশের অনেক পুরোনো একটি নকশি কাঁথা। এত সুন্দর কাঁথা আর কোনো দিন চোখে পড়েনি। মানুদা যখন কথা বলতেন, (কী চমৎকার ছিল তাঁর বাচনভঙ্গি, কি বাংলায়, কি ইংরেজিতে) উপমহাদেশের রাজনীতির বিবর্তনের কথা, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কোনো বইয়ে এত সুন্দরভাবে, এমন প্রাঞ্জলতায় কেউ তো তা কোনো দিন আমার জন্য লেখেনি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আমি তখন ব্র্যাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ছুটি কাটাতে আমরা দুজন ওয়াশিংটন গেছি। মানুদা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত—ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ভারতীয় দূতাবাসে টেলিফোন করে জানলাম, তিনি শিকাগোতে (খুব সম্ভবত) রয়েছেন। ভাবলাম, সেই যাত্রায় আর দেখা হলো না। কিন্তু কই। দুই ঘণ্টা পরই ভারতীয় দূতাবাস থেকে টেলিফোন। রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থ শংকর রায় আমাদের দুজনকে অমুক সন্ধ্যায় দাওয়াত করেছেন। সুন্দর আরও একটি সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি। প্রত্যাখ্যান তো কিছুতেই করা যায় না। গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের ওয়াশিংটন সফরের কত বড় একটি পাওয়া।
মানুদার সঙ্গে শেষ দেখা ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে তাঁর ২ বেলতলার বাড়িতে। পুরোনো বিরাট এই বাড়িটিতেই তাঁর জন্ম এবং পরে তা তিনি কিনে নিয়েছিলেন। কলকাতায় সেটাই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। ট্যাক্সিওয়ালাকে ঠিকানাটি ছাড়া আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। মানুদা আর মায়াদি দুজনেরই তখন বয়স হয়েছে। মানুদার বয়স তখন ৮৮। তাঁরা বাড়ি থেকে বেরুনই না। মানুদার ডায়াবেটিক নিউরোপেথি বলে একটি দুরারোগ্য রোগ। ভয় ছিল, সেটাই হয়তো হবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। তাই হোটেলে ফিরে এসে কিংছু নোট রেখেছিলাম। নেহাতই ব্যক্তিগত মন্তব্য বাদ দিয়ে তা সংক্ষেপে স্মরণ করছি এই জন্য যে তা থেকে হয়তো বা তাঁর মাহাত্ম্যের কিছু আভাস পাওয়া যাবে।
দোতলা বাড়ির প্রথম তলায় বই আর বই। অনেক বই-ই দুর্লভ, তাঁর নানা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কেনা। ওপরের দোতলার বসার ঘরের মূল সোফাটি তাঁর নানা চিত্তরঞ্জন দাশের বিয়ের উপহার—তাঁকে আর মায়াদিকে। সে তো বেশ কটি দশকের কথা। সোফার স্টাইল কতই না এখন পাল্টেছে, কিন্তু তাঁদের দুজনের কাছে সোফাটি যে অমূল্য স্মৃতি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আমরা কামরায় প্রবেশ করে দেখি তিনি কোরআন শরিফের পাতা ওল্টাচ্ছেন। তিনি বললেন, কই, কোরআনে তো সর্বত্রই রয়েছে আল্লা ক্ষমাশীল। রাহমানুর রাহিম। তবে কেন কিছু কিছু লেখক-লেখিকা (বিশেষ করে একজনের কথা তিনি স্মরণ করেছিলেন) গায়ে পড়ে ধর্মের অবমাননা করেন। প্রত্যেকের কাছেই তো তার ধর্মের মূল্য রয়েছে। বুঝলাম, কোরআন শরিফ তাঁর নতুন পড়া নয়। তাঁর বসার ঘরের প্রধান চিত্রকর্ম হলো জয়নুল আবেদিনের; বসার ঘরে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর উপহার একটি রুপার নৌকা। মানুদা বললেন যে তাঁর ওয়ালেটে সংরক্ষিত রয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর একটি ছবি—১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ দিল্লিতে তোলা ভারতের (উপমহাদেশ) ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা তাঁকে এখনো পীড়া দেয়, বললেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বেঁচে থাকলে ভারতের রাজনীতি ভিন্নতর খাতে প্রবাহিত হতো। তাঁর দাদামশায়ের সঙ্গে জিন্নাহ সাহেবের ‘সখ্য’ ছিল। তাঁরা দুজনই হুইস্কি ভালোবাসতেন, হেসে বললেন তিনি। তিনি বললেন যে জমিদারি উচ্ছেদ মামলার মাধ্যমেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ১৯৫৬ সালে যখন কলকাতায় কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল, তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়া। কিন্তু বিধান রায় তাঁকে আইনমন্ত্রী করলেন, যেখানে তাঁর দায়িত্বের পরিধি ছিল ব্যাপকতর। তখন থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু।
মানুদা তাঁর ১৯৭১-৭২-এর ভূমিকার কথা স্মরণ করলেন। বললেন, তিনি যখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠা প্রত্যয় তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল যে ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ অচিরেই স্বাধীন হবে। তিনি ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর কথা স্মরণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলাকাতায় ভাষণ দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি ছোট কাগজ গুঁজে দিলেন। কাগজটি ইন্দিরা গান্ধী পড়ে তাঁর হাতেই রেখে দিলেন। রাজভবনে পৌঁছেই তিনি মানুদাকে বললেন, ‘ওরা আক্রমণ করেছে।’ কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথেই ওয়্যারলেসে কেবিনেট মিটিং ডাকা হলো, ডাকা হলো পুরো মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং তারপর বৈঠক বিরোধী দলের সঙ্গে। সেই বৈঠকটা কিছুটা সময় নেওয়ার জন্য ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু পরই ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণ দিয়েছিলেন।
‘সে তো পুরোনো কথা। এখন সবাই মিলে যেন উপমহাদেশে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ কাজটি আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।’ বললেন তিনি।
মানুদা পরিণত বয়সেই তো গেলেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তাঁর নানা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধির কাছেই সম্পন্ন হয়েছে। মায়াদিকে আর তাঁর পরিবারের পরিচিত অন্যদের সমবেদনা জানিয়েছি। মনে পড়ে, কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করে মনে হয়েছিল, কিছু মানুষের জীবন কেন অনন্ত হয় না? মানুদার বেলায়ও তা-ই মনে হয়। তিনি এবং তাঁর মতো দশ-পাঁচটা মানুষ তো আমাদের উপমহাদেশের চিত্র বদলে দিতে পারেন। হয়তো বা একদিন তা আমরা অর্জন করব। সেই বিচারে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের মতো মানুষ অমরত্বই তো লাভ করবেন।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments