বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৩৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ সিদ্দিক, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অন্তর্গত লাতুমুড়া। সীমান্ত এলাকা। ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২২ তারিখ।
সীমান্তের ওপারে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের দলনেতা লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির চৌধুরী (বীর প্রতীক, পরে ক্যাপ্টেন) রাতে খবর পেলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল চন্দ্রপুর-লাতুমুড়ার দিকে আসছে। খবর পেয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই দলকে অ্যামবুশের।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নির্দেশে দ্রুত প্রস্তুত হলেন। তিনটি উপদলে বিভক্ত তাঁরা। একটি দলে থাকলেন মোহাম্মদ সিদ্দিক। পরদিন ভোর হওয়ার আগেই তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে অবস্থান নিলেন লাতুমুড়ার কাছে ইয়াকুবপুর-কুয়াপাইনা এবং খৈনলে।
পাকিস্তানিরা পথে এক স্থানে রাত যাপন করে সকালে এসে উপস্থিত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশ এলাকায়। ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে আসামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা। তারা কল্পনাও করেনি এমন আক্রমণের। দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে গেল। আটজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও তিনজন আহত হলো।
পাকিস্তানি সেনারা পেছনে সংগঠিত হওয়ার পর পুনরায় অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ চালাল। মোহাম্মদ সিদ্দিক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণ প্রতিহত করলেন। তাঁদের বীরত্বে পাকিস্তানিদের অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।
এরপর সারা দিনই দুই পক্ষে গোলাগুলি চলল। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল তাদের আক্রমণ করে বেশ ক্ষতিসাধন করে।
পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে লাতুমুড়ার উত্তরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পরদিন ২৪ জুন পাকিস্তানিরা যখন নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরিতে ব্যস্ত, তখন মোহাম্মদ সিদ্দিক ও তাঁর সহযোদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। ওই আক্রমণে নিহত হয় আরও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুজন আহত হন।
চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া অ্যাম্বুশে মোহাম্মদ সিদ্দিক যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মূলত তাঁদের দলের হাতেই পাকিস্তানি সেনাদের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মোহাম্মদ সিদ্দিক চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি এই রেজিমেন্টের বেশির ভাগ সদস্যকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। কিছু সদস্য থাকেন সেনানিবাসে। তিনি সেনানিবাসে ছিলেন। ২৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোহাম্মদ সিদ্দিক ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন এম এ মতিনের (বীর প্রতীক, পরে ব্রিগেডিয়ার) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলার মাস্তাননগর ও মিরসরাইয়ে যুদ্ধ করেন। ২০ এপ্রিল মিরসরাইয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মদ সিদ্দিককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৬।
মোহাম্মদ সিদ্দিক স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। ২০০৫ সালে তিনি মারা যান।
মোহাম্মদ সিদ্দিকের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলায়। বর্তমান ঠিকানা গ্রাম চরনোয়াবাদ, উপজেলা সদর, জেলা ভোলা। তাঁর বাবার নাম গোলাম রহমান, মা উম্মে কুলসুম। স্ত্রী হাসিনা বেগম ও খাদিজা বেগম। তাঁদের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নির্দেশে দ্রুত প্রস্তুত হলেন। তিনটি উপদলে বিভক্ত তাঁরা। একটি দলে থাকলেন মোহাম্মদ সিদ্দিক। পরদিন ভোর হওয়ার আগেই তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে অবস্থান নিলেন লাতুমুড়ার কাছে ইয়াকুবপুর-কুয়াপাইনা এবং খৈনলে।
পাকিস্তানিরা পথে এক স্থানে রাত যাপন করে সকালে এসে উপস্থিত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশ এলাকায়। ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে আসামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা। তারা কল্পনাও করেনি এমন আক্রমণের। দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে গেল। আটজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও তিনজন আহত হলো।
পাকিস্তানি সেনারা পেছনে সংগঠিত হওয়ার পর পুনরায় অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ চালাল। মোহাম্মদ সিদ্দিক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণ প্রতিহত করলেন। তাঁদের বীরত্বে পাকিস্তানিদের অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।
এরপর সারা দিনই দুই পক্ষে গোলাগুলি চলল। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল তাদের আক্রমণ করে বেশ ক্ষতিসাধন করে।
পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে লাতুমুড়ার উত্তরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পরদিন ২৪ জুন পাকিস্তানিরা যখন নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরিতে ব্যস্ত, তখন মোহাম্মদ সিদ্দিক ও তাঁর সহযোদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। ওই আক্রমণে নিহত হয় আরও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুজন আহত হন।
চন্দ্রপুর-লাতুমুড়া অ্যাম্বুশে মোহাম্মদ সিদ্দিক যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মূলত তাঁদের দলের হাতেই পাকিস্তানি সেনাদের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মোহাম্মদ সিদ্দিক চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি এই রেজিমেন্টের বেশির ভাগ সদস্যকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। কিছু সদস্য থাকেন সেনানিবাসে। তিনি সেনানিবাসে ছিলেন। ২৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোহাম্মদ সিদ্দিক ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন এম এ মতিনের (বীর প্রতীক, পরে ব্রিগেডিয়ার) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলার মাস্তাননগর ও মিরসরাইয়ে যুদ্ধ করেন। ২০ এপ্রিল মিরসরাইয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মদ সিদ্দিককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৬।
মোহাম্মদ সিদ্দিক স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। ২০০৫ সালে তিনি মারা যান।
মোহাম্মদ সিদ্দিকের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলায়। বর্তমান ঠিকানা গ্রাম চরনোয়াবাদ, উপজেলা সদর, জেলা ভোলা। তাঁর বাবার নাম গোলাম রহমান, মা উম্মে কুলসুম। স্ত্রী হাসিনা বেগম ও খাদিজা বেগম। তাঁদের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments