সপ্তাহের হালচাল-জলবায়ু পরিশোধনের একটি ব্যতিক্রমী প্রস্তাব by আব্দুল কাইয়ুম

প্রতীকী জলবায়ু আদালত বসেছিল ঢাকায়, ৮ নভেম্বর। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে সেখানে উপস্থিত থেকে আমার প্রথম উপলব্ধি হলো, জলবায়ু-ন্যায়বিচার থেকে যেন আমাদের দেশের বিপন্ন মানুষ বঞ্চিত না হয়, সে জন্য এই প্রতীকী আদালতের রায় যথার্থ। জলবায়ুর বিপর্যয়ের শিকার বরগুনার চারজন নারী-পুরুষের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।


জুরি বোর্ডের সদস্যরা মতামত দিয়েছেন। সবদিক বিবেচনা করে প্রদত্ত রায়ে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়ী করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতীকী আদালতের বিচারক তাঁর রায়ে আরেকটি আদেশ দিতে পারতেন। বলতে পারতেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিশোধনের উপায় উদ্ভাবনে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনার জন্য আরও বেশি হারে অর্থায়ন করতে হবে। গবেষণা এখনো হচ্ছে, কিন্তু আরও দরকার। এবং সেই গবেষণার উদ্দেশ্য হবে মানব প্রজাতির কল্যাণ, কার্বন-বাণিজ্যের স্বার্থ রক্ষা নয়। সেটা কী রকম?
আমরা বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধের দাবিতে সোচ্চার হই। ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধনে কঠোর আইনের কথা বলি। ঠিক তেমনিভাবে কেন জলবায়ু পরিশোধনের কথা চিন্তা করি না? কয়লা, পেট্রল, ডিজেল পুড়িয়ে সভ্যতা গড়ে তুলতে গিয়ে বায়ুমণ্ডলে এত বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিন হাউস গ্যাস জমা হয়েছে যে এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মানব সভ্যতাই বিপর্যয়ের মুখে। এর প্রতিকারের জন্য এখন সবাই মিলে ভাবছি কীভাবে জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে, অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। এটা করা সম্ভব হলে হয়তো বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে। অর্থাৎ, উষ্ণায়ন রোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপর। সেটা ঠিকই আছে।
কিন্তু পাশাপাশি আমরা কেন এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কারের কথা ভাবছি না, যা হবে এক ধরনের যন্ত্র, যেটা বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে বাতাসে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেবে, আর কার্বন আলাদা রূপে জমা করবে? অর্থাৎ, সেটা হবে বায়ুমণ্ডলের কার্বন পরিশোধন যন্ত্র, এককথায় কার্বন ডাই-অক্সাইড পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের (রি-সাইক্লিন) একটি ব্যবস্থা।
গাছপালা ঠিক এই কাজটিই করে। সে মাটি থেকে সংগৃহীত পানি ও বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে সূর্যের আলোর সাহায্যে গাছের খাদ্য তৈরি করে। সালোক সংশ্লেষণ (ফটো সিনথিসিস) নামে পরিচিত এ প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করে সবুজ পাতায় সঞ্চিত রাসায়নিক পদার্থ ক্লোরোফিল। কাজটি প্রাকৃতিক উপায়ে চলে। এ জন্যই এখন বন ধ্বংস বন্ধ ও নতুন বনায়নের ওপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বনের জন্য প্রচুর জমি দরকার। কয়েক দশক আগেও বিশ্বের মোট বনাঞ্চল প্রায় চার কোটি বর্গকিলোমিটার জমিতে বিস্তৃত ছিল, যার পরিমাণ পৃথিবীর শুকনো ভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এখন অনেক কমে গেছে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এত জমি বনের জন্য সংরক্ষণ করা কঠিন। আর তা ছাড়া বন কেটে গাছের কাঠ ব্যবহার করার হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ঠেকিয়ে রাখাও সহজ নয়। সুতরাং কার্বন পরিশোধনের স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক উপায়টির ওপর নির্ভর করা যায় না, যদিও বনায়ন বাড়ানোর চেষ্টা করে যেতে হবে।
এ অবস্থায় গবেষণা করে কার্বন রি-সাইক্লিনিংয়ের বিকল্প ব্যবস্থা বের করার ওপর জোর দিতে হবে। গাছ যে কাজটি হাজার হাজার একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে থেকে করে, সে কাজটি কি ল্যাবরেটরির কয়েক শ বর্গফুটের কক্ষে করা সম্ভব নয়? এমন একটি ব্যবস্থা কেন করা যাবে না, গাছ থাকবে না, থাকবে শুধু পাতার ক্লোরোফিল, যা পানি ও আলো ব্যবহার করে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে কার্বনটুকু রেখে অক্সিজেন বাতাসে ফিরিয়ে দেবে?
অসম্ভবকে সম্ভব করাই বিজ্ঞানের কাজ। আজকাল মানুষের স্টেমসেল ব্যবহার করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে গাছের কোনো স্টেমসেল তার কোন অঙ্গ তৈরি করে, সে বিষয়ে গবেষণায় অগ্রগতি হয়েছে (দেখুন, সায়েন্স ডেইলি, জানুয়ারি ২, ২০০৬)। তাহলে উদ্ভিদের স্টেমসেল বিকশিত করে গাছ ছাড়াই গাছের স্টেমসেল ল্যাবরেটরিতে কোনো যন্ত্রে ব্যবহার করা যাবে না কেন? আর সেটা যদি হয়, তাহলে ল্যাবরেটরিতেই জলবায়ুর বর্জ্য-শোধন তথা কার্বন পরিশোধনের কাজটি করা সম্ভব হতে পারে।
অবশ্য এর একটি সমস্যা আছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গ্লোবাল এডিটরস ফোরাম সম্মেলনের এক আলোচনায় আমি এ রকম প্রস্তাব করলে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফান রামসটরফ প্রশ্ন তোলেন, ল্যাবরেটরিতে এত কার্বন রাখবে কোথায়? গাছ তো বাতাসের কার্বন জমা করে তার কাঠে, আর এ জন্যই তো বনভূমি এত বিশাল জায়গা দখল করে রাখে। আমি বললাম, ল্যাবরেটরিতে তো গাছ থাকবে না, থাকবে শুধু তার ক্লোরোফিল, তাই গাছের মতো বিশাল জায়গার দরকার হবে না। আর সেখানে কাঠের আকারে যে কার্বন জমা হবে, তা আসবাবপত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করলে ক্ষতি কী? অথবা সেই কাঠ পোড়ালেই বা ক্ষতি কী। কারণ, বাতাসের কার্বন তো অনবরত পরিশোধিত হবেই। সেই বিজ্ঞানী অবশ্য এ রকম প্রকল্প অবাস্তব বলে মনে করেন। কিন্তু এটা বিজ্ঞানের অসাধ্য বলে ধরে নিতে হবে কেন?
তেল-গ্যাস পোড়ানোর হার কমাতে হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সমস্যা হলো, এতে বিশ্বের মোট উৎপাদন কমে যাবে। কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার নামক থিংক ট্যাংকের পরিচালক বিয়র্ন লমবর্গ (Bjorn Lomborg) তাঁর লেখা স্মার্টার থিংকিং অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (জলবায়ু পরিবর্তনসম্পর্কিত আরও চৌকস চিন্তাভাবনা) নিবন্ধে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। থিংক ট্যাংকের উদ্যোগে একদল সেরা অর্থনীতিবিদ গবেষণা করছেন। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস তাঁদের গবেষণাভিত্তিক বই প্রকাশ করছে। নাম, স্মার্টার সলিউশনস টু ক্লাইমেট চেঞ্জ (জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার অধিকতর চৌকস সমাধান)। তাঁরা বলছেন, উষ্ণায়ন বৃদ্ধি যদি প্রতিশ্রুত ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখতে হয়, তাহলে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৮০ শতাংশ কমাতে হবে। এতে প্রায় এক লাখ কোটি (১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন) ডলারের সমপরিমাণ জলবায়ু-ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা যাবে। কিন্তু এর জন্য যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে, তার পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে ৪০ লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এক লাখ কোটি ডলার সমমূল্যের জলবায়ু-বিপর্যয় রোধে এ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রতিবছর কার্যত ৪০ লাখ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। উৎপাদন কমবে, মানুষ চাকরি হারাবে, উন্নয়ন ধীরগতিতে চলবে। পৃথিবীকে বাঁচাতে আমাদের এই পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো এর চেয়ে আর কোনো ভালো বিকল্প আছে কি না?
সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পদ্ধতি বেশি হারে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ব্যাপারেও নতুন চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে। যেমন, মহাশূন্যে উপগ্রহে সৌরশক্তি সঞ্চয় করে ‘জ্বালানি-রশ্মি’র আকারে পৃথিবীতে প্রেরণের বিশেষ ব্যবস্থা করা যায় কি না, ইত্যাদি। তাহলে বর্তমানে প্রচলিত সৌরবিদ্যুৎ সেল ব্যবহার না করে, আকাশ থেকে পাঠানো বিদ্যুৎ বাড়ির ছাদে এন্টেনার সাহায্যে গ্রহণ করে বাসার বিদ্যুতের কাজ চালানো যাবে। এগুলো এখনো স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কত কিছুই তো আবিষ্কার করা সম্ভব।
প্রতীকী জলবায়ু আদালত যে আদর্শ কাজটি করেছে, তা হলো আমাদের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিতে আক্রান্ত দেশের ভাগ্যহত মানুষের স্বার্থের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ। এ ধরনের কার্যক্রম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, শুধু ক্ষতিপূরণ আদায় করে হয়তো কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে, কিন্তু জলবায়ুর কার্বনদূষণ বন্ধ করতে না পারলে হয়তো আগামী শতকে শিল্পোন্নত দেশগুলোও বিপন্ন হবে। তখন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে কি না সেই মৌলিক প্রশ্ন উঠবে। তাই শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না, শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দূরদৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ যাবৎ অভাবনীয় উপায় উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনায় তারা আরও বেশি হারে বিনিয়োগ করুক। শুধু বেসরকারি খাতে গবেষণার (আর অ্যান্ড ডি) বিষয়টি ছেড়ে দিলে হবে না। কারণ, তারা যতটা না মানব জাতি রক্ষার কথা চিন্তা করে, তার চেয়ে বেশি চিন্তা করে সংস্থার মুনাফার কথা। মানব প্রজাতির অস্তিত্বের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে ধনী-নির্ধননির্বিশেষে বিশ্বসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে।
কার্বন রি-সাইক্লিং সে রকমই প্রায় অসম্ভব একটি প্রকল্প হতে পারে। এ রকম ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা গেলে নিশ্চয়ই একটি অভাবনীয় অগ্রগতি হবে। জ্বালানি পোড়ানো না কমিয়েও বায়ুমণ্ডলের কার্বনবর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো হয়তো সম্ভব।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.