মত দ্বিমত-ক্ষুদ্রঋণের জালে বিপর্যস্ত গরিব মানুষ by আনু মুহাম্মদ
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। বিতর্ক রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনে এর কার্যকারিতা নিয়েও। সরকার ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ২৭ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ক্ষুদ্রঋণ তথা দারিদ্র্য বিমোচনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে দুজন অর্থনীতিবিদের লেখা প্রকাশ করা হলো
দারিদ্র্য বিমোচনের দাবি নিয়েই ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং তার বিকাশ এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন ব্যাপক প্রচার হচ্ছে, সে সময় বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এর সাফল্য পর্যালোচনা করলে বড় হোঁচট খেতে হয়। যেহেতু দারিদ্র্য বিমোচনের নামেই তার যাত্রা শুরু এবং বিকাশ, তাই প্রথম থেকেই ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার-প্রক্রিয়ার বাইরে রাষ্ট্রীয় আর্থিক ও অন্যান্য সমর্থন, আন্তর্জাতিক তহবিলের জোগান ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়েছে। ক্রমে এটি পরিষ্কার হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণে বিনিয়োগ খুবই লাভজনক প্রকল্প এবং এ থেকে মুনাফার হার প্রাথমিক প্রক্ষেপণের চেয়েও বেশি। ক্রমে এটাও পরিষ্কার হয়, ক্ষুদ্রঋণের মডেল সংকটগ্রস্ত লগ্নিপুঁজির জন্য একটি নতুন এবং বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে। প্রচলিত ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় ঋণ দেওয়ার জন্য সাধারণত সচ্ছল ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করা হয়। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ মডেলে ঋণ দেওয়ার জন্য সচ্ছলতা আবশ্যক নয়, বরং দরিদ্র জনগণই তার লক্ষ্য। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এবং বিশ্বব্যাপী যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই গরিব, সেহেতু ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত।
ক্ষুদ্রঋণ মডেল প্রদর্শিত এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য মধ্য নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংক ও বহুজাতিক মূলধারার ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্রঋণের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। ১৯৯৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ইউএসএআইডি, ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং সিটিব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ খাতে বরাদ্দ দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৮ সালে ইউএনসিটিএডি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি এত দিনের অব্যবহূত এক বিশাল সম্ভাব্য বাজারের সন্ধান দিয়েছে।
২০০৫ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণে যুক্ত হয় এবং বলিভিয়ার বানকোসল ও কেনিয়া কেরেপ পৃথিবীর বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যাংকগুলোর চেয়েও অধিক মুনাফাযোগ্যতা দেখাতে সক্ষম হয়। মেক্সিকোর কমপার্তামস ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্য শুরু করার পর এখন বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। লন্ডনের ফিন্যানশিয়াল টাইমস-এর সূত্রমতে, ইউএসএআইডি-ও ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এর মুনাফার হার এখন প্রায় শতভাগ।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই মেরুকরণ একটি প্রবণতা। ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্যের মধ্যে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই একচেটিয়াকরণ ও কেন্দ্রীভবনই ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সংক্ষেপে কথাগুলো থেকে বিষয়টি স্পষ্ট, লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল খুবই সফল এবং এর বিস্তার অব্যাহত। মূলধারার ব্যাংকিংয়ে ক্ষুদ্রঋণ একটি শক্তিশালী অংশ। ক্ষুদ্রঋণের মধ্য দিয়ে যে বিপুল মূলধন সংবর্ধিত হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে, তা বৃহৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বহুজাতিক পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সফল মাধ্যম। বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোন, বীজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রমাণ আছে। কিন্তু যে মূল দাবি নিয়ে ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু, সেই দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্যের কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ কোনো সমীক্ষায়ই পাওয়া যায়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি শাখা মুনাফা অর্জন করে, শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ শাখা শতভাগ ঋণ আদায় করে। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে, এমন শাখার শতকরা হার মাত্র দুই ভাগের সামান্য ওপরে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত সমীক্ষার মাধ্যমে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও অন্যরা যে ফলাফল পেয়েছেন, তাতে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করে কিস্তি শোধ করতে অক্ষম। এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ উচ্চতর সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ করেছে এবং শতকরা ১০ ভাগ ছাগল বা অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করে কিস্তি শোধ করতে বাধ্য হয়েছে।
একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষুদ্রঋণ মডেলের অন্যতম দাবি হলেও এই সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, গৃহীত ঋণের ওপর শতকরা মাত্র ১০ ভাগ নারী ঋণগ্রহীতার নিয়ন্ত্রণ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ নারীকেই ঋণের টাকা তুলে দিতে হয় স্বামী, ভাই বা অন্য কোনো পুরুষ সদস্যের হাতে। ক্ষুদ্রঋণ এখন অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের বিকল্পও বটে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন গ্রামের ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় আমি নিজে দেখেছি, শতকরা মাত্র পাঁচ থেকে নয় ভাগ ঋণগ্রহীতা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পেরেছে। উল্লেখ্য, এই ঋণগ্রহীতাদের অন্যান্য আয়ের উৎস ছিল। শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ঋণগৃহীতার অবস্থা একই রকম আছে। কিন্তু অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে তাদের ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে। শতকরা ৪০-৪২ ভাগের অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
ক্ষুদ্রঋণ মডেলের সুদের হার নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক বেশি শোনা যায়। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণের নির্দিষ্ট কোনো হার নেই। বৃহৎ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্যে নিয়োজিত। এই সুদের হার বর্তমানে সংস্থা ও ক্ষেত্র ভেদে গড়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি সুদের হার আদায় করতেও দেখা যায়। ক্ষুদ্রঋণ মডেলে সুদের হারের পাশাপাশি এর আদায় পদ্ধতি অনেক বেশি নিপীড়নমূলক। এই ক্ষুদ্রঋণ মডেলে ধরে নেওয়া হয়, যারা এই ঋণ নেয়, তারা এটি বিনিয়োগ করে এই মাত্রায় আয় করবে যে তা সুদের হারের চেয়ে অতিরিক্ত হবে এবং তারা প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে সক্ষম হবে।
যেহেতু প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করাই ক্ষুদ্রঋণ মডেলের নিয়ম, সে জন্য যেকোনো রকম অসুস্থতা, ক্ষুদ্রঋণের টাকায় কেনা রিকশা বা ভ্যান অচল হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনীতির মন্দা, বাজারের বৈরিতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি—যেকোনো একটি ঘটনা ঘটলেই পুরো মডেলটি ভেঙে পড়ে। একবার কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলেই সেটা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যে কারণে তাকে অন্য ঋণ নিয়ে পুরোনো কিস্তি শোধ করতে হয়। এ রকম ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অনেকেই এখন বিপর্যস্ত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রচলিত ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে হারে সুদ আদায় হয়, দেশের গরিবদের ওপর ক্ষুদ্রঋণের সুদের চাপ তার চেয়ে বেশি। সচ্ছল ব্যক্তিরা প্রচলিত ব্যাংকঋণ শোধ করার জন্য যতটা নমনীয় ব্যবস্থা পেতে পারেন, গরিবদের জন্য ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি অনমনীয়।
যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সমাজবিজ্ঞানী লামিয়া করিমের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য গরু, মুরগি, ঘরের টিন, আসবাব ছাড়াও মেয়েদের নাকছাবিও বিক্রি করতে হয়েছে। এ ধরনের নানা ঘটনার সাক্ষী গবেষক ও সাংবাদিক। এসবের অল্পই প্রকাশিত হয়।
সরকার সম্প্রতি ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের জাল যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তাতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তাতে যথেষ্ট সংশয় আছে। ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ সংস্থাগুলোর প্রভাব এত বেশি, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষেও এসব সংস্থা নিয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান এবং সেগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ক্ষুদ্রঋণের জালে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ কীভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকারের কোনো অনুসন্ধান কিংবা সমীক্ষা নেই। অবস্থানগত দায়দায়িত্বের কারণেই সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্ষুদ্রঋণ মডেল প্রদর্শিত এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য মধ্য নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংক ও বহুজাতিক মূলধারার ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্রঋণের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। ১৯৯৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ইউএসএআইডি, ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং সিটিব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ খাতে বরাদ্দ দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৮ সালে ইউএনসিটিএডি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি এত দিনের অব্যবহূত এক বিশাল সম্ভাব্য বাজারের সন্ধান দিয়েছে।
২০০৫ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণে যুক্ত হয় এবং বলিভিয়ার বানকোসল ও কেনিয়া কেরেপ পৃথিবীর বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যাংকগুলোর চেয়েও অধিক মুনাফাযোগ্যতা দেখাতে সক্ষম হয়। মেক্সিকোর কমপার্তামস ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্য শুরু করার পর এখন বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। লন্ডনের ফিন্যানশিয়াল টাইমস-এর সূত্রমতে, ইউএসএআইডি-ও ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এর মুনাফার হার এখন প্রায় শতভাগ।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই মেরুকরণ একটি প্রবণতা। ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্যের মধ্যে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই একচেটিয়াকরণ ও কেন্দ্রীভবনই ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সংক্ষেপে কথাগুলো থেকে বিষয়টি স্পষ্ট, লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল খুবই সফল এবং এর বিস্তার অব্যাহত। মূলধারার ব্যাংকিংয়ে ক্ষুদ্রঋণ একটি শক্তিশালী অংশ। ক্ষুদ্রঋণের মধ্য দিয়ে যে বিপুল মূলধন সংবর্ধিত হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে, তা বৃহৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বহুজাতিক পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সফল মাধ্যম। বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোন, বীজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রমাণ আছে। কিন্তু যে মূল দাবি নিয়ে ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু, সেই দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্যের কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ কোনো সমীক্ষায়ই পাওয়া যায়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি শাখা মুনাফা অর্জন করে, শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ শাখা শতভাগ ঋণ আদায় করে। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে, এমন শাখার শতকরা হার মাত্র দুই ভাগের সামান্য ওপরে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত সমীক্ষার মাধ্যমে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও অন্যরা যে ফলাফল পেয়েছেন, তাতে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করে কিস্তি শোধ করতে অক্ষম। এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ উচ্চতর সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ করেছে এবং শতকরা ১০ ভাগ ছাগল বা অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করে কিস্তি শোধ করতে বাধ্য হয়েছে।
একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষুদ্রঋণ মডেলের অন্যতম দাবি হলেও এই সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, গৃহীত ঋণের ওপর শতকরা মাত্র ১০ ভাগ নারী ঋণগ্রহীতার নিয়ন্ত্রণ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ নারীকেই ঋণের টাকা তুলে দিতে হয় স্বামী, ভাই বা অন্য কোনো পুরুষ সদস্যের হাতে। ক্ষুদ্রঋণ এখন অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের বিকল্পও বটে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন গ্রামের ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় আমি নিজে দেখেছি, শতকরা মাত্র পাঁচ থেকে নয় ভাগ ঋণগ্রহীতা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পেরেছে। উল্লেখ্য, এই ঋণগ্রহীতাদের অন্যান্য আয়ের উৎস ছিল। শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ঋণগৃহীতার অবস্থা একই রকম আছে। কিন্তু অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে তাদের ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে। শতকরা ৪০-৪২ ভাগের অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
ক্ষুদ্রঋণ মডেলের সুদের হার নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক বেশি শোনা যায়। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণের নির্দিষ্ট কোনো হার নেই। বৃহৎ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্রঋণ-বাণিজ্যে নিয়োজিত। এই সুদের হার বর্তমানে সংস্থা ও ক্ষেত্র ভেদে গড়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি সুদের হার আদায় করতেও দেখা যায়। ক্ষুদ্রঋণ মডেলে সুদের হারের পাশাপাশি এর আদায় পদ্ধতি অনেক বেশি নিপীড়নমূলক। এই ক্ষুদ্রঋণ মডেলে ধরে নেওয়া হয়, যারা এই ঋণ নেয়, তারা এটি বিনিয়োগ করে এই মাত্রায় আয় করবে যে তা সুদের হারের চেয়ে অতিরিক্ত হবে এবং তারা প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে সক্ষম হবে।
যেহেতু প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করাই ক্ষুদ্রঋণ মডেলের নিয়ম, সে জন্য যেকোনো রকম অসুস্থতা, ক্ষুদ্রঋণের টাকায় কেনা রিকশা বা ভ্যান অচল হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনীতির মন্দা, বাজারের বৈরিতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি—যেকোনো একটি ঘটনা ঘটলেই পুরো মডেলটি ভেঙে পড়ে। একবার কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলেই সেটা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যে কারণে তাকে অন্য ঋণ নিয়ে পুরোনো কিস্তি শোধ করতে হয়। এ রকম ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অনেকেই এখন বিপর্যস্ত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রচলিত ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে হারে সুদ আদায় হয়, দেশের গরিবদের ওপর ক্ষুদ্রঋণের সুদের চাপ তার চেয়ে বেশি। সচ্ছল ব্যক্তিরা প্রচলিত ব্যাংকঋণ শোধ করার জন্য যতটা নমনীয় ব্যবস্থা পেতে পারেন, গরিবদের জন্য ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি অনমনীয়।
যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সমাজবিজ্ঞানী লামিয়া করিমের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য গরু, মুরগি, ঘরের টিন, আসবাব ছাড়াও মেয়েদের নাকছাবিও বিক্রি করতে হয়েছে। এ ধরনের নানা ঘটনার সাক্ষী গবেষক ও সাংবাদিক। এসবের অল্পই প্রকাশিত হয়।
সরকার সম্প্রতি ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের জাল যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তাতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তাতে যথেষ্ট সংশয় আছে। ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ সংস্থাগুলোর প্রভাব এত বেশি, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষেও এসব সংস্থা নিয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান এবং সেগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ক্ষুদ্রঋণের জালে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ কীভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকারের কোনো অনুসন্ধান কিংবা সমীক্ষা নেই। অবস্থানগত দায়দায়িত্বের কারণেই সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments