রবীন্দ্রজন্ম সার্ধ শতবার্ষিকী-জয় হোক জীবনের, সত্যের, সুন্দরের

আজ পঁচিশে বৈশাখ। প্রতি বছরই এদিনটি আসে, চলেও যায়; কিন্তু আমাদের নতুন করে দিয়ে যায় আত্মপরিচয়ের তাগিদ। আত্মশক্তির উদ্বোধনের আহ্বান, মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসার বারতা। এদিনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের শুভদিন, জাতি হিসেবে আমাদের শুভ সংকল্পগুলো নবায়নেরও দিন।


কালের যাত্রায় এবারের পঁচিশে বৈশাখ অবশ্য এসেছে এক অতিরিক্ত তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে_ আজ তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। এ সংখ্যাটির নিজস্ব কোনো মহিমা নেই; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনপঞ্জিকার সঙ্গে এর সংযুক্তি একে দিয়েছে বিরল এক মাহাত্ম্য। তিনি মর্ত্যলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন প্রায় সত্তর বছর হলো; কিন্তু এখনও নিত্যদিন তাঁকে আমরা সঙ্গী হিসেবে পাই। তাঁর উপস্থিতি আমাদের চেতনাজুড়ে, তাঁর আবাস আমাদের মর্মমূলে। তিনি আমাদের ভাষাকে পরিশুদ্ধ করেছেন, কল্পনাকে আকাশচারী করেছেন; মানুষের কল্যাণে সত্যধর্মের অন্বেষণে ব্রতীও করেছেন। তিনি অচলায়তন ভাঙার প্রত্যয় দিয়েছেন, রুদ্ধস্রোত জীবনকে মুক্তধারায় ভাসিয়ে নিতে প্রণোদনা দিয়েছেন; ভালো হওয়া, ভালোবাসা এবং ভালো করার উৎসাহ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, তা একই সঙ্গে এ ভূখণ্ডের ও বিশ্বের; একালের ও সর্বকালের। এই বাংলাদেশ উদ্যোগী, পরিশ্রমী এবং ভবিষ্যৎ অন্বেষী একটি দেশ; সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং শত সংকটের বিবরে পড়ে থাকা কোনো দেশ নয়। এ বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একুশ শতকের বাংলাদেশ, যার প্রধান সম্পদ এর তারুণ্য এবং প্রাণশক্তি। তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে এই বাংলাদেশ গড়ার শপথ আমাদের নতুন করে নিতে হবে এবং এই শপথের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এক বিশাল, উদ্ভাবনী ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা।
নিজের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ দেশ ও কাল নিয়ে ভাবতেন, আর আশা করতেন, পরের জন্মদিনটিতে যেতে যেতে ব্যক্তি ও জাতির অর্জনের অসংখ্য মাইলফলক অতিক্রান্ত হতে তিনি দেখবেন। কখনও সেই প্রত্যাশা হতো অনাবিল, কখনও তাতে পড়ত কোনো শঙ্কার ছায়া। আর অবধারিতভাবেই এই শঙ্কার জোগান দিত তাঁর সময়ের রাজনীতি, উগ্র জাতীয়তাবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতার কদর্য প্রকাশ। ১৩৪৫ সনের জন্মদিনে তিনি লিখেছিলেন,
শুনি তাই_
মানুষ-জন্তুর হুহুংকার দিকে দিকে উঠে বাজি।
এই মানুষ-জন্তু, এই 'অপদেবতা' এই 'দানব' আজও হুঙ্কার দিচ্ছে, আজও 'পণ্ডিতের মূঢ়তা', 'ধনীর দৈন্য' সভ্যতাকে নিয়ত পীড়া দিচ্ছে_ হয়তো অনেক বেশি তীব্রতায়। আজও 'মাংসগন্ধে মুগ্ধ' শ্মশানচারীরা 'বীভৎস চীৎকারে ... রাত্রিদিন করে ফেরাফেরি_/নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।'
না, রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশী সময় আর নেই। সেই ঔপনিবেশিকতা এবং তার অন্তে আড়াই দশকের আরেক ঔপনিবেশিকতা শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসেরও চার দশক শেষ হলো; কিন্তু মানুষ-জন্তুর পদচারণা, তার অট্টহাস্য কি এতটুকু কমল, নাকি আরও বাড়ল? রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁর জন্মদিনের শুভক্ষণে বিচলিত বোধ করেন অশুভের পক্ষ বিস্তারে, 'একান্ত আত্মার দৃষ্টি-হারাদের' বীভৎস চিৎকারে, তাহলে তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে আমরাও তো একই, অথবা আরও বেশি, শঙ্কা অনুভব করতে পারি আমাদের সময়ের নানা বিচলনে, সংকটে? এই যে ছুরি হাতে ছুটছে উগ্রবাদী আততায়ী, এই যে কালো ছায়া বিস্তার করে চলেছে কৃষ্ণপক্ষের যত পূজারি, এই যে সভ্যতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সুনীতি-ন্যায়ধর্মের মূল উপড়ে ফেলতে নেমেছে শতসহস্র দানব_ তারা তো আমাদের সব অর্জন নিশ্চিহ্ন করে দেবে এক অমোঘ রাহুগ্রাসে। তাহলে কবির জন্মদিনে আমাদের জন্য কি থাকবে শুধু হা-হুতাশ? ভয়? বিমূঢ়তা?
না। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে বিপদের চিহ্নগুলো যদি দেখান, তার মোকাবেলার পথগুলোও নির্দিষ্ট করে দেন। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ, আমাদের নির্ভয় আশ্রয়। 'জন্মদিন' কবিতাতেই তিনি জানান,
মানুষের দেবতারে
ব্যঙ্গ করে যে অপদেবতা বর্বর মুখবিকারে
তারে হাস্যে হেনে যাব, ব'লে যাব_ এ প্রহসনের
মধ্য-অঙ্কে অকস্মাৎ হবে লোপ দুষ্ট স্বপনের ...
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আবেগঘন ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে 'মনের আকাশের ধ্রুবতারা' ও 'উজ্জ্বল বাতিঘর' হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবিনাশী প্রেরণার কথা স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শে বাংলাদেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, একটি গণতান্ত্রিক ও গণমুখী সরকারের পক্ষেই এই সংকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। রবীন্দ্রচর্চায় শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে, তা যেন দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে বাঁধা না পড়ে তা নিশ্চিত করাও জরুরি।
আমরা এক দুষ্ট-স্বপনে আছি, আছি এক প্রহসনের মধ্যাহ্নে। কিন্তু জাগার আয়োজন জোরদার হলে সেই স্বপন ভেঙে মিলিয়ে যাবে। উত্থান হবে আমাদের আত্মশক্তির। নতুন এক সংকল্পে, নতুন এক সময়ের উদ্বোধনে নামব আমরা।
আত্মশক্তির, জাগরণের, বিজয়ের শাশ্বত জীবনের এই মহাকবিকে অভিবাদন। জয় হোক তাঁর জন্মদিনের জীবনমন্ত্রের।
 

No comments

Powered by Blogger.