বাড়ি বানানোর নামে গণবিধ্বংসী মৃত্যুফাঁদ বানানো থামান-আত্মঘাতী মানসিকতা

কাঁঠালবাগানের হেলে পড়া বাড়িটি আমাদের সার্বিক দায়িত্বহীনতার চলতি নজির। ভবনমালিক, নির্মাতা ও ডেভেলপারদের দায়িত্বহীনতা এবং সাধারণ মানুষের বিপন্নতার প্রতীক হয়ে ভবনটি পরিহাস করছে যে আমরা কতটা আত্মঘাতী। বাড়ি বানানোর নামে এই ঢাকায় মৃত্যুপুরী বানানো হচ্ছে। নাজুক ভবন ও দুর্বল অবকাঠামোর এই ঢাকা নিজেই এখন হয়ে উঠছে এক গণবিধ্বংসী ফাঁদ।


সাততলা একটি ভবন উঠল, কিন্তু নকশা মেনে চলা হলো না। জমির মালিক আর ডেভেলপাররা গরজ করলেন না, রাজউকও খবর নিল না। রাজউকের ভূমিকা হয়েছে যাত্রাপালার বিবেকের মতো; তারা নীতিকথা বলে কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় অপারগ হয়ে থাকে। অথচ চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। শোনানোর কঠোর কোনো চেষ্টাও সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের তরফে দেখা যাচ্ছে না। এ রকম কত ভবন বিল-ডোবা-পুকুর ভরাট করে উঠেছে, কত ভবনের নকশা নিরাপদ নয়, কত ভবনের নির্মাণে ফাঁকি বা ত্রুটি রাখা হয়েছে, তার কোনো হিসাব কি কারও কাছে আছে? তা না থাকলেও এসবের পরিণামে অজস্র মৃত্যুর হিসাব আমাদের রাখতেই হচ্ছে। কিছুদিন আগে রাজধানীর বেগুনবাড়িতে পাঁচতলা ভবন উপড়ে ২৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। ঢাকার আবাসন কর্তৃপক্ষ যতটা দায়িত্বহীন, ভবননির্মাতারা যতটা প্রতারণাশ্রয়ী, মৃত্যুগুলো ততটাই মর্মান্তিক।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভবনটির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে পারিবারিক বসবাস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নিয়তিকে ধন্যবাদ যে ছোট বিপদ দিয়ে সেই বড় বিপদটি থেকে রেহাই পাওয়া গেল। নইলে কাঁঠালবাগানের ঘটনার পরিণতিও বেগুনবাড়ির মতো মর্মান্তিক হতো। এসব কিছু না হলেও, ঘটনার রাতে আশপাশের বাড়িগুলোর শতাধিক দরিদ্র পরিবারকে অসহায় অবস্থায় বাইরে রাত কাটাতে হয়েছে। দায়িত্বহীনতা যদি একজনেরও হয়, তার খেসারত এভাবে দিচ্ছে অজস্র মানুষ। কখনো কখনো জীবনের মূল্যে কর্তৃপক্ষের ভুলের মাশুলও শোধ করতে হচ্ছে। ভাবা যায়, বড় আকারের ভূমিকম্প হলে এই ঢাকা শহরের অজস্র নাজুক ভবন এবং সেখানে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের কী হবে? আর কত ভবন ধসে পড়লে এই আত্মঘাতী বাস্তবতা বদলানোয় জাতীয় উদ্যোগ আসবে?
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহনীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর ওপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশ ভবনের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশ ভবনের থাম ও কলাম দুর্বল। কেবল সরকার বা ডেভেলপার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যক্তিরাই নন, অবাণিজ্যিক ভবননির্মাতারাও টেকসই নকশার ভিত্তিতে, সঠিক কাঁচামাল ব্যবহার করে ভবন বানাচ্ছেন না। যেখানে সামান্য বেশি অর্থ খরচ করলে একটি ভবন ভূমিকম্পসহনীয় হতে পারে, সেখানে অর্থের কার্পণ্যের মূল্য শুধতে হচ্ছে জীবনের মূল্যে। এই আত্মঘাতী আয়োজন বন্ধ করা হোক, মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হোক।

No comments

Powered by Blogger.