শ্রমিক নির্যাতন রোধে ইসলামের বিধান by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো- সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। চরম পন্থা পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নামই ভারসাম্য। এককথায়, কোনো ক্ষেত্রেই সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। মানুষের বিবেক ও প্রকৃতির সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই। বরং বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সর্বদা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।


কখনোই সীমা লঙ্ঘন করে না। বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। যারা বিবেককে কাজে লাগায় না, তারা সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করছে। আসলে তারা অজ্ঞ। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনসহ যুদ্ধক্ষেত্র, ইবাদত-বন্দেগি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। তাই সেই সমাজ ছিল শান্তিময়।
বর্তমান সময়ে আমাদের হাতের নাগালে সব আছে, কিন্তু শান্তি নেই। আমরা এক অস্থির সময় পার করছি। সমাজে বিভিন্ন অপরাধের পাশাপাশি শ্রমিক নির্যাতন ও গৃহকর্মী নির্যাতন নিত্যকার ঘটনা। এসব বন্ধে দরকার ন্যায়বিচার ও ইসলামী অনুশাসন। কারণ, ইসলাম এসব বিষয়ে অত্যন্ত কার্যকর পথ, পন্থা ও আদর্শ রেখে গেছে।
ইসলাম পরিশ্রম করে সৎভাবে উপার্জনের শিক্ষা দেয়। ইসলাম বেকার থাকা পছন্দ করে না। আল্লাহতায়ালা সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। সব ধরনের অসম নীতির বিরুদ্ধে ইসলাম সর্বদা সোচ্চার। ইসলামের মূলনীতিতে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান ও বৈষম্য নেই। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তারা (মজুর, শ্রমিক ও অধীন বেতনভোগী কর্মচারীরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করেছেন। অতএব, যার কোনো ভাইকে তার অধীন করে দেওয়া হয়েছে, সে যেন তাকে তা-ই আহার করতে দেয়, যা সে নিজে আহার করে। যেন সেই পরিধেয় পরিধান করতে দেয়, যা সে নিজে পরিধান করে থাকে। আর তাকে যেন এমন কাজ করতে বাধ্য না করে, যা করলে সে পর্যুদস্ত হবে। আর যদি এমন কাজ করতে তাকে বাধ্য করে, তাহলে যেন সে তাকে সহযোগিতা করে।'_বুখারি শরিফ
মালিক-শ্রমিকের মধ্যে এমন সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক রচিত হলে শ্রমিকদের সব অসন্তোষ চিরতরে বন্ধ হবে। কথায় কথায় কল-কারখানা বন্ধ, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের দরকার পড়বে না। ইসলাম মনে করে, পার্থিব জগতে কোনো উন্নতি শ্রম ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। তাই ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যাদা অত্যন্ত তাৎপর্যময়। ইসলামী বিধানমতে, মালিকের কর্তব্য হচ্ছে, শ্রমিক নিয়োগের আগে অবশ্যই তার মজুরি নির্ধারণ করে নেওয়া ও কাজ শেষ করামাত্রই শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক প্রদান করা। শ্রমিকরা দিনান্তে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শুধু পরিবারের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে। এই মজুরিই তাদের অবলম্বন। এমতাবস্থায় তারা যদি যথাযথ মজুরি না পায়, তাহলে তাদের নানাবিধ দুর্দশায় পড়তে হয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমরা শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।'
বর্তমানে গৃহকর্মী নির্যাতন মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। মধ্যযুগীয় কায়দায় গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধেও ইসলামের বিধান রয়েছে। আমাদের সমাজের অনেকেই গৃহকর্মীদের দাস-দাসী মনে করে। মনে রাখতে হবে, গৃহকর্মীরা দাস-দাসী নয়। ইসলাম চিরতরে দাসপ্রথার বিলোপ সাধন করেছে। গৃহকর্মীরা আমাদের মতোই স্বাধীন। সব মানবিক অধিকারে সমান অংশীদার। ইসলাম বলেছে, 'তোমরা নিজেরা যা খাবে-পরবে; কাজের লোকদেরও তাই খেতে-পরতে দেবে।' তাদের হক ও প্রাপ্যের ব্যাপারে অবহেলাকে জুলুম বলা হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে স্বীয় চাকর-চাকরানীকে প্রহার করবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার পরিণাম দেওয়া হবে।' অন্য হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমাদের থালা-বাটি তোমাদের চাকর-চাকরানীর হাতে ভেঙে গেলে তাদের মারধর করবে না। কেননা তোমাদের আয়ুষ্কাল যেমন অনির্ধারিত, থালা-বাটিরও তদ্রূপ।' ইসলামের এই বিধান ও নিয়মনীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে সমাজ থেকে গৃহকর্মী নির্যাতন চিরতরে বিদায় নেবে- ইনশাআল্লাহ।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.