গদ্যকার্টুন-রবির আলো, আইওয়াতেও by আনিসুল হক

ইউনেসকো ছোট্ট আমেরিকান শহর আইওয়াকে সিটি অব লিটারেচার বা সাহিত্যের শহর বলে ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে আইওয়াবাসীর গর্বের সীমা নেই। যেখানেই যাও, যদি ওরা জানতে পারে তুমি আন্তর্জাতিক লেখক, ইন্টারন্যাশনাল রাইটার, বেশ খাতির পাবে।


এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখালেখির কর্মশালা নামে চার বছরের একটা কোর্স আছে, এরা এমএফএ ডিগ্রি দেয়, তাতে এক হাজারজন দরখাস্ত করেন, মাত্র ৩০ জনকে প্রতিবছর নেওয়া হয় ছাত্র হিসেবে। এ রকম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখালেখির কোর্স আছে, প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার পাস করা লেখক বের হন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। তাঁদের কজন লেখক হন, কে জানে। তবে শুনতে পেলাম, এই শহরে যিনি একবার আসেন, তিনি আর এ শহরটা ছাড়তে চান না, পিএইচডি করে এই শহরেই অটোরিকশা চালান। আমাদের গাড়ি যাঁরা চালান, তাঁরা হয় পাস করা লেখক, নয়তো পাস করা শিল্পী। আর আমাদের হোটেলে যাঁরা কাজ করেন, এমনকি পরিচারিকার কাজ, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার হোটেলের রুম পরিষ্কার করতে এসেছিলেন এক তরুণী। পরে আমি তাঁকে দেখি চলচ্চিত্র বিভাগে ক্লাস করছেন। এখানে শ্রমের মর্যাদা আছে এবং শ্রমের কোনো ইতর-বিশেষ নেই সেই অর্থে।
একদিন ওদের সৃজনশীল লেখালেখির ক্লাসে আমাদের দেশের সাহিত্য সম্পর্কে বলতে হলো আমাকে। বিদেশে এসে বাংলাদেশ সম্পর্কে নিন্দা করার পাত্র নই আমি। বললাম, সিয়ার্স টাওয়ারের নাম শুনেছ? কে বানিয়েছে জানো? কোন দেশের প্রকৌশলী? সেই একই দেশ থেকে, সেই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি এসেছি। আইওয়াতে একবার বন্যা হয়েছিল, সেবার যারা আইওয়াতে ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চা পাঠিয়েছিল। তো এসব প্রসঙ্গ উঠতেই জানা গেল, রবীন্দ্রনাথ আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ১৯১১ সালে, তাঁর একটা ভাস্কর্যও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু দিন রাখা ছিল। আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথের ১০০ বছর পরে আরেকজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছেন...।
আন্তর্জাতিক লেখক কর্মসূচির পরিচালক ক্রিস্টোফার মেরিল রসিকতাটা ধরতে পেরে বললেন, রবীন্দ্রনাথ এখানে আসার দুই বছর পরেই নোবেল পেয়েছিলেন...। আমি হাসি সামলে বললাম, মিরাকল স্টিল হ্যাপেনস...।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালের দিকে আমেরিকায় এসেছিলেন, ইলিনয় রাজ্যে পদধূলি দিয়েছিলেন, এটা তাঁর জীবনীতে পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো আইওয়াতেও তিনি এসে থাকবেন, তবে তার বিবরণ কোথাও পাচ্ছি না। ইলিনয়ের শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত এজরা পাউন্ডের পোয়েট্রি পত্রিকায় প্রথম বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির ছয়টা কবিতা। সেটাই তাঁকে নোবেল এনে দেয় ১৯১৩ সালে।
কিন্তু তিনি যে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ১৯১৬ সালে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তিন বছর পরে, তার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি হোটেলে উঠেছিলেন। সাংবাদিকেরা বড় ভিড় করেছিলেন। তাঁর ইংরেজ সেক্রেটারি পিয়ারসন সবাইকে বিদেয় করে দিয়েছিলেন। এক সাংবাদিক নাছোড়, তিনি ফোনে বললেন, ‘হ্যালো, আপনি কি ট্যাগোর?’
‘আমি তাঁর সেক্রেটারি।’
‘আমি ব্রিটিশ ভাইস কনসাল। সল্ট লেক সিটিতে আছি। আমি ট্যাগোরের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘হোটেলে চলে আসুন।’
সেই সাংবাদিক চলে এলেন ব্রিটিশ কনসালের ছদ্মপরিচয়ে। রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘ইয়োর লর্ডশিপ, আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি এই কথা জিজ্ঞেস করতে যে...’
তাঁর সচিব পিয়ারসন হস্তক্ষেপ করলেন, ‘ক্ষমা করবেন, ব্রিটিশ কনসাল কখনো একজন নাইটকে ইয়োর লর্ডশিপ বলে সম্বোধন করবেন না, আপনাকে আমি কি সাহায্য করতে পারি?’
সাহায্য তিনি করেছিলেন। ওই সাংবাদিককে বের করে দিয়েছিলেন।
এই কাহিনি পড়লাম ড. সুধীন্দ্র বসু রচিত আমেরিকায় ১৫ বছর নামের বইয়ে।
রবীন্দ্রনাথ হোটেলের ডাইনিং রুমে খেতে যেতে চাননি। তাঁর জন্য খাবার ঘরে আনানো হয়েছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষ অস্থির হয়ে গিয়েছিল, কবির শরীর খারাপ নাকি?
তখন সুধীন্দ্র বসু কবির ঘরে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, রবিবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওদের বলে দাও, আমরা দু-দুজন ডক্টর এই ঘরে আছি (রবীন্দ্রনাথ তত দিনে ডক্টরেট ডিগ্রি সম্মানসূচকভাবে লাভ করে ফেলেছেন), অসুখ হলে আমরা কি আমাদের চিকিৎসা করতে পারব না।’ (দেখা যাচ্ছে মিরপুরের ওই এমপি সাহেব রবিবাবুর মতোই ভেবেছিলেন, ড. কামাল হোসেন নাকি ডাক্তার, কিসের ডাক্তার, কোনো রোগীই তো জীবনে দেখল না।)
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কবির সম্মানে এক আনুষ্ঠানিক ভোজসভার আয়োজন করেছিল। সে কথা শুনে কবির অক্কা পাওয়ার জোগাড়। না না, আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি যাব না। ফলে সেটা বাতিল করতে হয়েছিল।
আমেরিকানদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মত সুধীন্দ্র বসুর কাছে এই বলে ব্যক্ত করেছিলেন: তোমার আমেরিকানরা বড় ভাসা ভাসা জীবন যাপন করে। তারা গভীরভাবে ভাবতে জানে না।
রবীন্দ্রনাথ আইওয়াতে জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর নাইটহুড প্রাপ্তি বা ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করাটাকে রবীন্দ্রনাথ দেখতেন কৌতুকের সঙ্গে। ব্যাপারটা তিনি নিয়েছিলেন হালকাভাবে। কিন্তু আমেরিকায় যাঁরা ছিলেন তাঁর ভক্ত, তাঁদের মনেও এই প্রশ্ন জেগেছিল যে রবীন্দ্রনাথ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তাঁর সবকিছুই ছুটে চলেছে অসীমের পানে, আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সত্য সুন্দরের দিকে, তাহলে তিনি বিদেশি নাইটহুডের মতো পার্থিব তকমা কেন গায়ে সেঁটেছেন? অবশ্য ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ সেই তকমা ছুড়েও ফেলে দিয়েছিলেন।
আমাদের লেখকদের দলে একজন আছেন আর্জেন্টিনার, তাঁর নাম পলা। তাঁকে প্রথম দিনেই আমি বলেছিলাম, ‘পলা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে চেনো, ওই যে আমাদের রবীন্দ্রনাথকে যিনি বড় ভালোবেসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যাঁর নাম দিয়েছিলেন বিজয়া?’ পলা বলেন, ‘কী বলে, ভিক্টোরিয়াকে চিনব না? তিনি তো খুবই বিখ্যাত।’ এর পর থেকে পলা আমাকে দেখলে সহাস্যমুখে এগিয়ে আসেন। আমি জানি, এ হাসিটা আমি পাই রবিবাবুর কল্যাণে।
আমেরিকার এই মধ্য পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে রবিবাবু এসেছিলেন হেমন্তকালে। এ সময়টায় ঝরে পড়ার আগে গাছে গাছে পাতা রঙিন হয়ে ওঠে। হলুদ, কমলা, লাল, খয়েরি—কত বিচিত্র রঙের পাতা গাছজুড়ে, কী যে সুন্দর লাগে গাছগুলোকে! একজন বাঙালি আমাকে জানালেন, ও ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে...গানটা নাকি এখানেই লেখা...এখানকার হেমন্ত দেখে।
আমিও আমার জানালা দিয়ে আইওয়া নদীর দিকে তাকাই। আমার জানালার কাছের গাছের পাতা কিছুদিন আগেও ছিল সবুজ, এখন একেবারে তীব্র হলুদ...ওই যে নদীর ওপারে গাছের পাতায় কত রং। পাতা ঝরছে। নিজের মনেই গেয়ে উঠি: ঝরা পাতা গো আমি তোমারই দলে...
ইউটিউবে রবীন্দ্রসংগীত বাজাই। প্রবাসী বাংলাদেশির দেওয়া ভাত ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করি। প্রথম আলোর ওয়েবপেজ খুলে প্রথম আলো পড়ি।
আমার ঘরটা বাঙালির ঘর হয়ে ওঠে।
আইওয়া সিটি, যুক্তরাষ্ট্র, ৩ নভেম্বর ২০১০
 আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.