জ্বালানি-গ্যাস দিগন্তে বাপেক্সের নতুন আশা by বদরূল ইমাম

সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা দুটির সীমানা ছাপিয়ে মাটির নিচে বিরাট গ্যাস মজুদ ধারণক্ষম একটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। দুটি জেলার নামে এটির নাম দেওয়া হয়েছে সুনেত্রা।


মাটির ওপর থেকে দৃশ্যমান নয়, বরং বাপেক্সের সাইসমিক জরিপের মাধ্যমে যখন ভূগর্ভে এই কাঠামোটি শনাক্ত করা হয়, তখন উল্লসিত হওয়ার দুটি কারণ ছিল: ১. ইতিপূর্বে বাপেক্সের আবিষ্কৃত সব গ্যাসক্ষেত্রই ছোট বা মাঝারি আকারের, সুনেত্রার বিরাট আকার বাপেক্সকে বিরাট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। ২. সম্ভাব্য এই বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রের অর্ধেকটাই ব্লক ১২-এর অন্তর্ভুক্ত, যা অতীতে বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকাকালীন তারা এটি শনাক্ত করতে পারেনি; পরবর্তীকালে বাপেক্স তার সাইসমিক জরিপের মাধ্যমে এটি ম্যাপ করে।
সুনেত্রা একটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা কেমন এবং এ নিয়ে বাপেক্সের পরিকল্পনা কী—প্রশ্ন করলাম বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুকের কাছে। তিনি জানালেন, ‘সুনেত্রাকে আমরা একটি প্রথম সারির সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করছি। আজ পর্যন্ত সুরমা বেসিনের পূর্ব প্রান্ত বরাবর বহুসংখ্যক বৃহৎ ও মাঝারি আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, অথচ একই বেসিনের পশ্চিম প্রান্তে এর আগে কোনো কাঠামোর অবস্থান না জানার ফলে আবিষৃ্কত হয়নি। আমরা জরুরি ভিত্তিতে সুনেত্রায় অনুসন্ধান কূপ খনন করতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত কাজ শেষ করে আগামী বছর কূপ খনন সম্পন্ন করব। আমরা মনে করছি, সুনেত্রা একটি টিসিএফ মাত্রার গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে প্রমাণিত হবে।’
বাপেক্স বাংলাদেশের জাতীয় তেল কোম্পানি। বাপেক্সের জন্মকালে এটি মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস বা ভারতের ওএনজিসির মতো সাধারণ প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু চার দশকে পেট্রোনাস বা ওএনজিসি তাদের কর্মদক্ষতার সুবাদে দেশের ভেতর তো বটেই, আন্তর্জাতিক সীমানায় কর্মকাণ্ডের খ্যাতি বিস্তার করতে সমর্থ হয়। বাপেক্স আশির দশকে দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলে গ্যাস আবিষ্কারের সফলতা অর্জন করলেও নব্বইয়ের দশকে সরকারি অবহেলা, কোনো কোনো মহলের চক্রান্তে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল হতে থাকে এবং এর দক্ষ জনশক্তির বড় অংশ অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু দেশীয় সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শক মহলের চাপের মুখে বাপেক্স পুনরুজ্জীবিত হওয়ার উদ্যোগ খুঁজে পায়। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার যে অভাব ছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে উঠতে শুরু করে। সম্প্রতি বাপেক্সের অবকাঠামো ও কর্মকাণ্ডের পরিসরে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রতীয়মান হয় যে বাপেক্স এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বাপেক্সকে নিয়ে আপনাদের বর্তমান ও নিকট-ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী রকম—প্রশ্নটি রাখলাম পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরের কাছে। তিনি জানালেন, ‘অতীতে বাপেক্সের সমস্যাটি ছিল সরকারি অবহেলা এবং কোনো এক সময় স্বার্থান্বেষী মহলের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, যাতে করে একটি দুর্বল ও অকার্যকর বাপেক্সের কারণে দেশটি পুরোপুরি বিদেশি তেল কোম্পানির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। বিগত দিনে বাপেক্সকে না সজ্জিত করা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, রসদ ও দক্ষ জনশক্তি দিয়ে, না দেওয়া হয়েছে অনুসন্ধান বা উন্নয়ন কূপ খননে পর্যাপ্ত টাকা। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি আমরা ২০০ কোটি টাকা দিয়ে একটি আধুনিক গভীর কূপ খননক্ষম রিগ ক্রয় করেছি এবং ইতিমধ্যেই তা ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননে নিয়োজিত আছে। আরও দুটি নতুন খনন রিগ আগামী বছর চলে আসবে। এ মুহূর্তে চারটি খনন রিগ একসঙ্গে খননকাজে নিয়োজিত রয়েছে। কেবল তা-ই নয়, আগামী দুই বছরে বাপেক্স পাঁচটি অনুসন্ধান কূপ খননের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অতীতে এ রকম জোর কার্যক্রম হওয়ার রেকর্ড নেই বাপেক্সের।’
ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে গিয়ে বাপেক্সের নতুন আধুনিক রিগের খনন কার্যক্রম পরিচালনাকারী কর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্যোগী মনোভাব লক্ষ করা গেল। শত সমস্যার দেশে গ্যাস অনুসন্ধানকাজে লোকালয় থেকে দূরে পাহাড়ি বা জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশের নির্জনতা ভেঙে বাপেক্সের কর্মকোলাহল যেন নতুন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। দুই মাসের মধ্যে এখানে খননকাজ শেষ করে গ্যাস উৎপাদন লাইনে দিয়েই নতুন রিগটি চলে যাবে কুমিল্লার শ্রীকাইল খনন পয়েন্টে। সেখানে বাপেক্সের নতুন সাইসমিক জরিপ সুনির্দিষ্টভাবে গ্যাসস্তর চিহ্নিত করেছে এবং তা খননের অপেক্ষায় রয়েছে। শ্রীকাইলে খনন শেষ করে নতুন রিগটি চলে যাবে সুনামগঞ্জের সুনেত্রা খনন পয়েন্টে। সুনেত্রা বাপেক্সের বর্তমান পরিকল্পিত খনন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এখানে ২০১১ সালে খনন শুরু ও শেষ করে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের আশা করা হচ্ছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে চলে এলাম নোয়াখালীর সুন্দালপুর খনন পয়েন্টে। ‘আমরা দুদিন আগে এখানে কূপ খনন শুরু করেছি এবং আশা করছি, দুই মাসের মধ্যে ঈপ্সিত গভীরতায় পৌঁছে গ্যাসস্তরের সন্ধান পাব।’ জানালেন সুন্দালপুর খনন কার্যক্রমের ইনচার্জ। সুন্দালপুর এর আগে বাপেক্সের (পূর্বসূরি) আবিষ্কার করা বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সম্প্রতি বাপেক্সের সাইসমিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত। লক্ষ করলাম, খনন রিগের সঙ্গে আনা সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত অনলাইন মাড লগিং (রেকর্ডিং) ইউনিটটি, যা কিনা খনন কার্যক্রমের প্রতি মুহূর্তের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইনে দেবে এবং তা ঢাকায় বসে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক খনন কার্যক্রমকে কম্পিউটারের মাধ্যমে তদারক করতে ও নির্দেশনা দিতে পারবেন।
বাপেক্সের সাম্প্রতিক আধুনিকায়নের অপর একটি অংশ হলো ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন (৩-ডি সাইসমিক) জরিপ। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষে সিলেটে মাঠভিত্তিক কার্যক্রম এই প্রথমবারের মতো বাপেক্সকে আন্তর্জাতিক সাইসমিক কাজের মানদণ্ডে পৌঁঁছে দিয়েছে। বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বর্তমান পেট্রোবাংলার পিএসসি পরিচালক মোহাম্মদ এমাদউদ্দিন জানালেন, ‘এটি সন্তোষজনক যে বাপেক্স এখন ৩-ডি সাইসমিক কাজ করতে স্যাটেলাইটভিত্তিক ট্র্যাকিং সিসটেম ব্যবহার করছে, যা কিনা এ কাজে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। আমরা আশা করছি, বাপেক্সের সাইসমিক দলটি বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে একের পর এক কাজ করে গ্যাস মজুদের প্রকৃত চিত্র আরও নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করবেন।’
বাপেক্সের বর্তমান ও নিকট-ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা ইঙ্গিত দেয় যে গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বাপেক্স এখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে খনন করা অনুসন্ধান কূপ সুন্দালপুর এ বছর শেষ করে ২০১১ সালে পরবর্তী অনুসন্ধান কূপগুলো হবে যথাক্রমে শ্রীকাইল, সুনেত্রা ও কাপাসিয়া। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর জানালেন, ‘প্রতিবছর বাপেক্স দুই থেকে তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাপেক্স তার অবকাঠামোগুলোতে উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানের কাজের যে ধারা আমরা লক্ষ করছি, তা চালিয়ে যেতে পারলে বাপেক্স শিগগিরই একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারবে। এ জন্য সরকারি যে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, তার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি।’
বাংলাদেশে বর্তমান গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন দুই হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট—অর্থাৎ ঘাটতি প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বাপেক্সের সূত্রমতে, ২০১২-১৩ সালে এ চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সে সময় চাহিদা মেটাতে হলে বর্তমানের অতিরিক্ত ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশ্ন হলো, দুই বছর সময়ে দেশে এই অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে কি? পেট্রোবাংলার মতে, বাপেক্সের বর্তমানে চালু (সুন্দালপুর) এবং আগামী বছরের পরিকল্পিত অনুসন্ধান কূপগুলো (শ্রীকাইল, সুনেত্রা, কাপাসিয়া) থেকে নতুন আবিষ্কৃত গ্যাস (সম্ভাব্য), আগের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের পরিকল্পিত উন্নয়ন কূপগুলো (ফেঞ্চুগঞ্জ, সেমুতাং, বেগমগঞ্জ ইত্যাদি) থেকে প্রাপ্ত গ্যাস, পেট্রোবাংলার অপর গ্যাস উৎপাদক অঙ্গসংগঠন কর্তৃক তিতাস ও রশীদপুর গ্যাসক্ষেত্রে নতুন উন্নয়ন কূপগুলো থেকে উৎপাদিত গ্যাস, বিদেশি তেল কোম্পানি সান্তোস কর্তৃক সমুদ্রবক্ষে সাঙ্গুর নতুন কূপ, নতুন গ্যাসক্ষেত্র ম্যাগনামা (সম্ভাব্য) থেকে প্রাপ্ত গ্যাস এবং বিদেশি কোম্পানি শেভরন কর্তৃক বিবিয়ানা থেকে অতিরিক্ত উৎপাদন মিলিয়ে ২০১২-২০১৩ সালে দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে সমতা আনা সম্ভব হবে।
তবে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, বর্তমানে হাতে নেওয়া অনুসন্ধান কূপগুলোতে নতুন গ্যাস আবিষ্কার। আগামী দিনের গ্যাস-সংকট প্রকটতর হবে, না ক্ষীণতর হবে, নাকি তা পুরোপুরি মিটে যাবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে অনুসন্ধান কূপগুলোর সফলতা বা ব্যর্থতার ওপর। দেশে বর্তমান গ্যাস-সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ বিগত পাঁচ বছর বা এরও বেশি সময় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে স্থবিরতা। এটি আশার কথা যে বর্তমানে বাপেক্স জোর অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এ মুহূর্তে বাপেক্স এবং অন্যান্য তেল-গ্যাস কোম্পানির অনুসন্ধান ও খনন প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিক সর্বাত্মক সহযোগিতা পাবে—এটিই দেশবাসী আশা করে।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.