ধর্ম-মাদক প্রতিরোধে ধর্মীয় অনুশাসন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধঘোষিত হলেও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যুবসমাজ মাদকের মরণনেশায় মেতে উঠেছে। যারা নেশা করে, তাদের অধিকাংশই জানে যে নেশা কোনোরকম উপকারী বা ভালো কাজ নয় এবং তা মানুষের জীবনীশক্তি বিনষ্ট করে—এসব কিছু জেনেশুনেও মাদকাসক্তরা নেশার অন্ধকার-জগতের মধ্যে থাকতে চায়।


মাদকাসক্ত তরুণ প্রজন্ম ধর্ম-কর্ম সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হতাশাকে সঙ্গী করে জীবনের চলার পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে এবং বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে সামাজিকতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে: ‘যেসব পানীয়তে নেশা সৃষ্টি হয়, তা সবই হারাম। আর যেসব বস্তু অধিক পরিমাণে ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি করে, এর সামান্য পরিমাণও হারাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মাদকের নেশার ছোবল এমনই ভয়ানক যে তা ব্যক্তিকে পরিবার, সমাজ, দেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে না, তার জীবনকে ধ্বংস করে। মাদক কেবল সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রেরই ক্ষতিসাধন করে না, তা সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে। সমাজ জীবনে প্রবেশ করা মাদকদ্রব্যের মধ্যে পরিমাণে অল্প হোক আর বেশি হোক, পান করা হোক বা অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করা হোক, নেশা ও চিত্তভ্রমকারী হলেই তা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে মাদক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, ‘ওহে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্যনির্ণায়ক তির হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি। সুতরাং, তোমরা এসব বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৯০)
মাদক হলো এমন একধরনের অবৈধ ও বর্জনীয় বস্তু, যা গ্রহণ বা সেবন করলে আসক্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটতে পারে। ধীরে ধীরে তা নেশাগ্রস্তকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। মাদকাসক্তির সঙ্গে সন্ত্রাস এবং অন্যান্য অপরাধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মাদকের ক্ষতি শুধু যে নিচ্ছে তাকেই বিপন্ন করে এমনটি নয়, অনাগত সন্তানের ওপরও ঝুঁকি থাকে। বাবা-মা যদি মাদক গ্রহণ করেন তবে তার সন্তানের প্রায় পাঁচ গুণ জন্মত্রুটি থাকতে পারে এবং দৈহিক ও মানসিক বিকাশে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তাই মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে মানুষের অন্তরে মাদকের ক্ষতির অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মাদক ও নেশা থেকে দূরে থাকো, কেননা এটা সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল। আর কোনো নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি ঈমানদার হতে পারে না।’ (মুসলিম)
যেহেতু মাদকাসক্তি একটি জঘন্য সামাজিক ব্যাধি, তাই জনগণের সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর প্রতিকার করা সম্ভব। যার যার ঘরে বাবা-মা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাড়া-মহল্লা বা এলাকায় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘৃণা প্রকাশের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদকদ্রব্যের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে; এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় বিধিবিধান-সম্পর্কিত শিক্ষামূলক ক্লাস নিতে হবে। মাদকদ্রব্য উৎপাদন, চোরাচালান, ব্যবহার, বিক্রয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও কঠোর বিধান কার্যকর নিশ্চিত করা দরকার। সমাজ জীবনে এহেন ঘৃণ্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মসজিদের ইমাম-খতিবের ভাষণে মাদকের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে মাদকের অবৈধ উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও চোরাচালান রোধসহ সকল স্তরে মুসল্লিদের কঠোর অবস্থ্থান নিতে হবে। শুধু মদ্যপায়ী ও বিক্রেতা নয়, বরং মদ ও মাদকদ্রব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত দশজনের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত দিয়েছেন। তারা হলো: ১. মদ পানকারী, ২. মাদক প্রস্তুতকারক, ৩. মাদক প্রস্তুতের উপদেষ্টা, ৪. মাদক বহনকারী, ৫. যার কাছে মাদক বহন করা হয়, ৬. যে মাদক পান করায়, ৭. মাদকবিক্রেতা, ৮. মাদকের মূল্য গ্রহণকারী, ৯. মাদক ক্রয়-বিক্রয়কারী, ১০. যার জন্য মাদক ক্রয় করা হয়। (তিরমিযি)
সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিসহ সকল শ্রেণীর ধর্মপ্রাণ লোক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মাদকদ্রব্যের প্রসার রোধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে দেশ থেকে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ইসলামের বিধিবিধান অবহিত হয়ে তা যথাযথভাবে অনুশীলন করলে সর্বগ্রাসী মাদকদ্রব্য বর্জন ও প্রতিকার সম্ভব। যে ব্যক্তি মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে, সে কখনো জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাবে না। তিন শ্রেণীর লোকের জন্য আল্লাহ তাআলা বেহেশত হারাম করেছেন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীভুক্ত হচ্ছে নিত্য মদপানকারী। (নাসাঈ, আহমাদ) মহানবী (সা.)-এর ইসলামি মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই মাদকের সর্বনাশা অভিশাপ থেকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তরুণদের রক্ষা করতে পারে।
অতএব, ধর্মভীরু বাবা-মা ও অভিভাবকদের সর্বনাশী মাদকের কুফল ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সন্তানদের সচেতন করা দরকার। তাহলেই মাদকাসক্ত সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের সমস্যা অনেক কমে যাবে। বাবা-মা ও অভিভাবকেরা নিজ নিজ সন্তানদের সামনে ধর্মীয় রীতিনীতি, ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার সুন্দর আদর্শ তুলে ধরুন, কারণ তারাই একদিন সমাজ-সংসার তথা দেশের কর্ণধার হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত, তাঁদের সন্তান যাতে করে কোনো অসৎ সংস্রবে পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। নিজ থেকে নেশা ছাড়া সম্ভব না হলে তাদের ধর্মীয় অনুশাসনে উদ্বুদ্ধকরণে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র প্রদত্ত সহযোগিতা গ্রহণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.