চিরকুট-পাতালপুরীর মন্ত্র by শাহাদুজ্জামান
কপার ধাতুটির নাম জানি অনেকেই কিন্তু ধাতুটি কী কাজে লাগে, জানি না হয়তো। জানি না আমাদের শহরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে আছে যে বৈদ্যুতিক তার, আমাদের ঘরে যে নানা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম—এর সবকিছুর ভেতরেই গোপনে রয়েছে কপারের কারুকাজ।
আরও জানি না বিশ্বসংসারকে সেই কপারের জোগান দিতে কিছু মানুষকে প্রতিদিন নেমে যেতে হয় পৃথিবীর পেটের ভেতরে, মাটির অনেক অনেক গভীরে, জানি না পৃথিবীকে আলোকিত করার আয়োজনে কাউকে কাউকে নেমে যেতে হয় পাতালের অন্ধকারে। আমরা এসব জানলাম, যখন তেমনই এক কর্মযজ্ঞে পাতালপুরীর অন্ধকারে বন্দী হয়ে গেলেন চিলির কতিপয় শ্রমিক। চিলিকে একসময় পৃথিবী চিনত নেরুদার কবিতা দিয়ে। বহুকাল পর চিলি পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল নামহীন সেসব খনিশ্রমিকের বদৌলতে।
মাটির দুই হাজার ৪১ ফুট নিচের খনিতে চিলির শ্রমিকেরা কপার সংগ্রহেই ব্যস্ত ছিলেন। কাজের ফাঁকে সেই খনিরই এক কোনায় সবাই বসেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। তখনই এক বিশাল ধস নেমে আটকে যায় খনি থেকে তাঁদের বেরোনোর পথ। পৃথিবীর অনেক অনেক গভীরে এক মৃত্যুকূপে আটকে যান ৩৩ জন মানুষ। তাঁদের চারদিকে অন্ধকার, পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধ যাবতীয় যোগাযোগ, তাঁদের সংগ্রহে কিছু বিস্কুট আর টুনা মাছের টিন। এমন গুমোট, অবিশ্বাস্য অনিশ্চয়তায় কী করতে পারে মানুষ? বহুকাল আগে নোবেল বিজয়ী লেখক উইলিয়াম গোল্ডিং লর্ড অব দি ফ্লাইজ নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে এক বিরান মরুভূমিতে আটকে পড়ে কয়েকজন ব্রিটিশ স্কুল-বালক। পৃথিবীর সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে সেই বালকেরা ক্রমেই হয়ে ওঠে একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাসী, হয়ে ওঠে বর্বর, হয়ে ওঠে পরস্পরের খুনি। কিন্তু চিলির খনিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের ভেতর আমরা দেখি বিপরীত চিত্র। মাটির নিচের ওই মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে তাঁরা বরং হয়ে ওঠেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর। নিজেদের মধ্যে শ্রম বিভাজন করে নেন তাঁরা, অতি সতর্কতায় ভাগ করে নেন সংগ্রহে থাকা সীমিত খাবার, সুস্থ থাকতে শরীরচর্চা করেন নিয়মিত, গল্প শুনিয়ে একে অন্যকে চাঙা রাখেন। আর এই চরম নাজুক মুহূর্তে বোধগম্য কারণেই তাঁরা স্মরণ করেন ঈশ্বরকে। পাতালের অন্ধকারে নিয়মিত প্রার্থনায় বসেন তাঁরা। আর প্রত্যেকেই চোখের নিচে ফুটিয়ে রাখেন আশার সিন্ধুতীর। সীমাহীন ওই দুর্যোগের মুহূর্তে সহযোগিতা আর সহমর্মিতায় পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরা। তারপর একে একে ১৭ দিন পর পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় তাঁদের।
কিন্তু পাতালপুরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পর এবার অনিশ্চয়তার সূত্রপাত ঘটে মর্ত্যলোকে। মাটির এত গভীর তলদেশ থেকে মানুষকে উদ্ধারের কোনো ইতিহাস পৃথিবীতে নেই। তবে কি জ্যান্তই সমাধিস্থ হবেন এই মানুষগুলো? তবে কি প্রকৃতির কাছে পরাজয় বরণ করতে হবে মানুষকে? খনিতে আটকে পড়া এই শ্রমিক দল যেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তির যাবতীয় সাফল্যের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। চিলি দরিদ্র দেশ, এই অভূতপূর্ব অবস্থা সামাল দেওয়ার সাধ্য তার কোথায়? কিন্তু সে দেশের প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ার পিনেরা নিজে গিয়ে দাঁড়ান ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এবার শুরু হয় মর্ত্যলোকের পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতার পালা। চিলির গির্জায় গির্জায় শুরু হয় প্রার্থনা। প্রতীয়মান হয়, বুঝিবা কেবল অলৌকিকভাবেই বেঁচে উঠতে পারেন এঁরা। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে এসে যোগ দিল বিজ্ঞানও। এগিয়ে আসেন নাসার বিজ্ঞানী, জার্মানির প্রকৌশলী। তাঁদের সহযোগিতায় চিলির নৌস্থপতিরা মিলে তৈরি করেন পৃথিবীর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম লিফট। তারপর সেই অভূতপূর্ব লিফটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাতালপুরীতে। এবং ঘটনার ৬৯ দিন পর সেই অতল থেকে এক এক করে উঠিয়ে আনা হয় ৩৩ জন শ্রমিককে। যেন পৃথিবীর গর্ভ থেকে প্রত্যেকেই নতুন করে ভূমিষ্ঠ হলেন আবার। টেলিভিশনের সামনে বসে সারা পৃথিবীর মানুষ দেখে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য। নামহীন একদল খনিশ্রমিক দুই মাসেরও বেশি সময় পাতালবাসের বিনিময়ে হয়ে ওঠেন পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ কেউ বলেছেন, চিলির খনি দুর্ঘটনাটি যে ব্যাপক গণমাধ্যম প্রচারণা পেয়েছে, তার সঙ্গে কেবল তুলনা চলে মানুষের প্রথম চাঁদে অবতরণের সেই প্রচারণার।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়তই খনিতে আটকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে শ্রমিকদের। পত্রিকার কোনো এক প্রান্তে সে বিষয়ের ছোট্ট খবরে হয়তো চোখই পড়ে না আমাদের। কিন্তু মৃত্যু নয়, বেঁচে ওঠার মাধ্যমেই চিলির খনির শ্রমিকদের খবরটি হয়ে ওঠে অভিনব। তাঁরা পরিণত হন সংবাদের শিরোনামে। চিলির খনির এই রোমাঞ্চকর ঘটনাটি নিয়ে ইতিমধ্যেই বই লেখা, চলচ্চিত্র নির্মাণের তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নানা প্রকাশনা সংস্থা, টিভি, ফিল্ম প্রতিষ্ঠান হামলে পড়েছে আটকে পড়া ৩৩ জন শ্রমিকের কাছে, তাঁদের এই ৬৯ দিনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনতে। এ জন্য প্রত্যেককে মোটা অঙ্কের অর্থও প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও শ্রমিকেরা নিয়েছেন এক অভিনব পদক্ষেপ। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের গল্প যদি বিক্রি করতেই হয়, তবে তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, তা বিক্রি করবেন যৌথভাবে এবং এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নেবেন তাঁরা। যৌথতা ও সহমর্মিতাই বেঁচে থাকার, বেঁচে ওঠার মূলমন্ত্র, চিলির শ্রমিকেরা পাতালপুরী থেকে এই মন্ত্রই যেন বয়ে এনেছেন পৃথিবীর কাছে। সেই মন্ত্র আমরা গ্রহণ করেছি কি?
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
মাটির দুই হাজার ৪১ ফুট নিচের খনিতে চিলির শ্রমিকেরা কপার সংগ্রহেই ব্যস্ত ছিলেন। কাজের ফাঁকে সেই খনিরই এক কোনায় সবাই বসেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। তখনই এক বিশাল ধস নেমে আটকে যায় খনি থেকে তাঁদের বেরোনোর পথ। পৃথিবীর অনেক অনেক গভীরে এক মৃত্যুকূপে আটকে যান ৩৩ জন মানুষ। তাঁদের চারদিকে অন্ধকার, পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধ যাবতীয় যোগাযোগ, তাঁদের সংগ্রহে কিছু বিস্কুট আর টুনা মাছের টিন। এমন গুমোট, অবিশ্বাস্য অনিশ্চয়তায় কী করতে পারে মানুষ? বহুকাল আগে নোবেল বিজয়ী লেখক উইলিয়াম গোল্ডিং লর্ড অব দি ফ্লাইজ নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে এক বিরান মরুভূমিতে আটকে পড়ে কয়েকজন ব্রিটিশ স্কুল-বালক। পৃথিবীর সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে সেই বালকেরা ক্রমেই হয়ে ওঠে একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাসী, হয়ে ওঠে বর্বর, হয়ে ওঠে পরস্পরের খুনি। কিন্তু চিলির খনিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের ভেতর আমরা দেখি বিপরীত চিত্র। মাটির নিচের ওই মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে তাঁরা বরং হয়ে ওঠেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর। নিজেদের মধ্যে শ্রম বিভাজন করে নেন তাঁরা, অতি সতর্কতায় ভাগ করে নেন সংগ্রহে থাকা সীমিত খাবার, সুস্থ থাকতে শরীরচর্চা করেন নিয়মিত, গল্প শুনিয়ে একে অন্যকে চাঙা রাখেন। আর এই চরম নাজুক মুহূর্তে বোধগম্য কারণেই তাঁরা স্মরণ করেন ঈশ্বরকে। পাতালের অন্ধকারে নিয়মিত প্রার্থনায় বসেন তাঁরা। আর প্রত্যেকেই চোখের নিচে ফুটিয়ে রাখেন আশার সিন্ধুতীর। সীমাহীন ওই দুর্যোগের মুহূর্তে সহযোগিতা আর সহমর্মিতায় পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরা। তারপর একে একে ১৭ দিন পর পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় তাঁদের।
কিন্তু পাতালপুরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পর এবার অনিশ্চয়তার সূত্রপাত ঘটে মর্ত্যলোকে। মাটির এত গভীর তলদেশ থেকে মানুষকে উদ্ধারের কোনো ইতিহাস পৃথিবীতে নেই। তবে কি জ্যান্তই সমাধিস্থ হবেন এই মানুষগুলো? তবে কি প্রকৃতির কাছে পরাজয় বরণ করতে হবে মানুষকে? খনিতে আটকে পড়া এই শ্রমিক দল যেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তির যাবতীয় সাফল্যের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। চিলি দরিদ্র দেশ, এই অভূতপূর্ব অবস্থা সামাল দেওয়ার সাধ্য তার কোথায়? কিন্তু সে দেশের প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ার পিনেরা নিজে গিয়ে দাঁড়ান ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এবার শুরু হয় মর্ত্যলোকের পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতার পালা। চিলির গির্জায় গির্জায় শুরু হয় প্রার্থনা। প্রতীয়মান হয়, বুঝিবা কেবল অলৌকিকভাবেই বেঁচে উঠতে পারেন এঁরা। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে এসে যোগ দিল বিজ্ঞানও। এগিয়ে আসেন নাসার বিজ্ঞানী, জার্মানির প্রকৌশলী। তাঁদের সহযোগিতায় চিলির নৌস্থপতিরা মিলে তৈরি করেন পৃথিবীর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম লিফট। তারপর সেই অভূতপূর্ব লিফটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাতালপুরীতে। এবং ঘটনার ৬৯ দিন পর সেই অতল থেকে এক এক করে উঠিয়ে আনা হয় ৩৩ জন শ্রমিককে। যেন পৃথিবীর গর্ভ থেকে প্রত্যেকেই নতুন করে ভূমিষ্ঠ হলেন আবার। টেলিভিশনের সামনে বসে সারা পৃথিবীর মানুষ দেখে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য। নামহীন একদল খনিশ্রমিক দুই মাসেরও বেশি সময় পাতালবাসের বিনিময়ে হয়ে ওঠেন পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ কেউ বলেছেন, চিলির খনি দুর্ঘটনাটি যে ব্যাপক গণমাধ্যম প্রচারণা পেয়েছে, তার সঙ্গে কেবল তুলনা চলে মানুষের প্রথম চাঁদে অবতরণের সেই প্রচারণার।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়তই খনিতে আটকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে শ্রমিকদের। পত্রিকার কোনো এক প্রান্তে সে বিষয়ের ছোট্ট খবরে হয়তো চোখই পড়ে না আমাদের। কিন্তু মৃত্যু নয়, বেঁচে ওঠার মাধ্যমেই চিলির খনির শ্রমিকদের খবরটি হয়ে ওঠে অভিনব। তাঁরা পরিণত হন সংবাদের শিরোনামে। চিলির খনির এই রোমাঞ্চকর ঘটনাটি নিয়ে ইতিমধ্যেই বই লেখা, চলচ্চিত্র নির্মাণের তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নানা প্রকাশনা সংস্থা, টিভি, ফিল্ম প্রতিষ্ঠান হামলে পড়েছে আটকে পড়া ৩৩ জন শ্রমিকের কাছে, তাঁদের এই ৬৯ দিনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনতে। এ জন্য প্রত্যেককে মোটা অঙ্কের অর্থও প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও শ্রমিকেরা নিয়েছেন এক অভিনব পদক্ষেপ। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের গল্প যদি বিক্রি করতেই হয়, তবে তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, তা বিক্রি করবেন যৌথভাবে এবং এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নেবেন তাঁরা। যৌথতা ও সহমর্মিতাই বেঁচে থাকার, বেঁচে ওঠার মূলমন্ত্র, চিলির শ্রমিকেরা পাতালপুরী থেকে এই মন্ত্রই যেন বয়ে এনেছেন পৃথিবীর কাছে। সেই মন্ত্র আমরা গ্রহণ করেছি কি?
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments