সেলাই করা খোলা মুখ-আপনি বড়ই ভাগ্যবান মোজাফ্ফর আহমদ স্যার by মোফাজ্জল করিম
সম্প্রতি প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ স্যার কী ভাগ্যটাই না নিয়ে এসেছিলেন। সারা জীবন মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা পেয়েছেন। কেউ কোনো দিন একটা কটু কথাও উচ্চারণ করেনি তাঁর সম্পর্কে, যদিও সারা জীবন অকুতোভয় জাতির বিবেকের ভূমিকাটি তিনি ঠিকই পালন করে গেছেন।
একজন স্পষ্টবাদী সাহসী বুদ্ধিজীবী হিসেবে যে ক্ষেত্রটি তিনি প্রস্তুত করেছিলেন নিজের জন্য, তা বোধ হয় দীর্ঘদিন শূন্যই পড়ে থাকবে।
প্রশ্ন হলো, শুরুতেই এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটিকে আমি ভাগ্যবান বললাম কেন। বললাম এ জন্য যে বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি সর্বজনশ্রদ্ধেয়, কৃতবিদ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও দুর্লভ মেধার অধিকারী মানুষের এখন বড়ই দুঃসময় যাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের অর্জন দ্বারা বাংলাদেশের মুখ যতই উজ্জ্বল করুন না কেন, এক শ্রেণীর মানুষ যেন কসম খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁদের চরিত্র হনন করতে। তাঁদের সাফল্যে তাঁদের মধ্যে সম্পূর্ণ বোধাতীত কারণে এক ধরনের জ্বলুনি-পুড়ুনি সৃষ্টি হয় এবং তারই বহিঃপ্রকাশ তাঁরা ঘটান যত্রতত্র। তাঁদের অর্জনকে কী করে খাটো করে দেখানো যায়, কী করে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে এভারেস্টের চূড়া থেকে কেবল 'বেইস ক্যাম্পে'ই নয়, কাঠমাণ্ডু শহরের পশুপতিনাথের সামনের পচা নর্দমায় ফেলে মুখে ছাইভস্ম লেপে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টায় পরশ্রীকাতর লোকগুলো নিজেদের রাতের ঘুম ও দিনের আরাম হারাম করে তরবারি চালাচ্ছেন প্রাণপণে। তাঁরা আবার আমাদের সমাজের কেষ্ট-বিষ্টু, তাঁদের হুংকারে দশ দিগন্ত প্রকম্পিত। তাঁদের কথায় দিন হয় রাত, রাত হয় দিন। তাঁদের অনেকের কথাই আবার 'আইন'।
সাম্প্র্রতিককালে এই যে মানি লোকের, গুণী লোকের মুখে চুনকালি লাগানোর সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত অবারিত অপচেষ্টা, এটা দেখে মনে হয়, যেসব বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই অনগ্রসর দরিদ্র দেশটির সুসন্তানদের তাঁদের দুর্লভ কৃতিত্বের জন্য স্বীকৃতি দিল তাদের এই বলে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে : ওহে বিশ্বসভার সদস্যরা, তোমরা ভুল মানুষকে বাছাই করেছ। আরে, ওর কোনো যোগ্যতা আছে নাকি? ওকে তোমরা আর কতটুকু চেন? ও আমাদের ঘরের লোক, ওকে তোমাদের চেয়ে আমরা এক শ গুণ বেশি চিনি। ও তো একটা এক নম্বরের দুই নম্বরি লোক। আর স্বীকৃতি যদি দিতেই হয়, তবে তোমরা তোমাদের চোখের মাথা খেয়েছ নাকি, আমাদের অমুককে কি তোমাদের চোখে পড়ে না? যতসব 'রাবিশ'!
ব্যস, ঘরে-বাইরে উঠতে-বসতে শুরু হয়ে গেল একজন পূজনীয় ব্যক্তির ওপর কটু-কাটব্যের শিলাবৃষ্টি। আর অন্যের চরিত্র-হননের এই ভয়ংকর খেলায় একবার মেতে উঠলে বোধ হয় হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে দা দিয়ে পানিতে কোপ দিলে সে কোপ যে নিজের হাঁটুতে এসে পড়তে পারে তা আর মনে থাকে না। নইলে গুরুমহাশয় যখন তাঁর শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে দুর্নীতি কাকে বলে উদাহরণসহ বোঝাতে চাইলেন, আমরা কেন শুনব তিনি আসলে বলেছেন : 'ঠাকুরঘরে কে রে?' অমনি আমরা সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম : আমি (নাকি আমরা?) কলা খাই না। প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের কাছে নাকি শিক্ষক মহোদয়ের পুরো বক্তব্যটি রেকর্ড করা আছে। ওই প্রতিবেদন পাঠ করে আমাদের পাড়ার কাউলা আর জাউলা চিক্কুর দিয়ে উঠল : খাইছে আমারে। এইটা তো দেহি মনের মইধ্যে পুলিশ পুলিশ অবস্থা। সে যাই হোক, ঘটনাটি না জেনে, না শুনে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে সংসদীয় ধোলাই দেওয়ায় লাভ এটাই হলো, আমজনতা 'যা বুঝনের বুইঝ্যা গেল।' হায়!
শ্রদ্ধেয় মানুষের চরিত্রের এই 'সিরিয়াল-কিলিংয়ের'কালে আমার পরম শ্রদ্ধেয় পরিবেশবাদী শিক্ষাগুরু (সরাসরি নন যদিও) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শিরোপরি খৰাঘাত নেমে এসে বেইজ্জত হওয়ার আগে বা-ইজ্জত এই পঙ্কিলময় পরিবেশ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। ... এ জন্যই শুরুতে বলেছিলাম, তিনি এদিক দিয়ে ভাগ্যবান। নইলে কে জানে ড. ইউনূস, অধ্যাপক আবু সায়ীদের পর এই মহৎপ্রাণ মানুষটির নামটি হয়তো চলে আসত। তাঁর অপরাধ? অপরাধ, তিনি বড় অপ্রিয় সত্য কথা চাঁচা-ছোলাভাবে বলেন, কাউকে খুশি করার জন্য বা কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলেন না।
স্যারের কাছাকাছি থেকে একবার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেটা ১৯৭০-এর দশকের শেষাধর্ে্ব। তিনি তখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় উপদেষ্টা। অর্থাৎ মন্ত্রী। একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ওই সময়ে সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত নিবন্ধক। স্যার একদিন আমাকে ফোন করে তাঁতশিল্প সংক্রান্ত একটা বিষয়ের ওপর রিপোর্ট চাইলেন। আমি ওই দিনই রিপোর্টটি একজন অফিসারের মারফত পাঠিয়ে দিলাম তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের কাছে। ওটা পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনই ফোন করলেন তিনি। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। ফোনে আলোচনা করে তিনি বললেন, মোফাজ্জল করিম, আপনার রিপোর্টে আপনি টাঙ্গাইল জেলার তাঁতসমৃদ্ধ পাতরাইল এলাকার কথা উল্লেখ করেছেন। চলুন না, আমরা এলাকাটি একটু ঘুরে আসি। তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কাজকর্ম সরেজমিনে গিয়ে দেখে তারপর দেখা যাবে কী করতে পারি আমরা। ওই দিনই বেলা ২টার দিকে পাতরাইল রওনা হলাম তাঁর সঙ্গে। শুধু তিনি আর আমি। নো পুলিশ, নো বডিগার্ড, নো স্টাফ। সেদিন তাঁর মধ্যে যে আন্তরিকতা, অনুসন্ধিৎসা ও দেশপ্রেম দেখেছিলাম তা কোনো দিন ভুলিনি। ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সবুজ ঘাসের জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে নিলেন স্যার। তিনি খুবই ধার্মিক লোক ছিলেন, তবে ধর্ম নিয়ে কোনো রকম ভড়ং বা বাড়াবাড়ি ছিল না তাঁর মধ্যে, কোনো রকম গোঁড়ামিও ছিল না।
তিনি চলে গেছেন। অনেকের মতো আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি তাঁর মতো একজন জাতীয় অভিভাবককে হারিয়ে। তবে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, কোনো রকম মানহানিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়নি এই দুষ্কালে।
২
ড. ইউনূসের অর্জন-অনার্জন ও এতদসংক্রান্ত সাম্প্রতিককালের তর্জন-গর্জন সম্বন্ধে কোনো কিছু বলার মতো যোগ্যতা বা অভিপ্রায় আমার নেই। সে কথা অকপটে স্বীকার করে আমার ইদানীংকালের একটি বোধোদয়ের উল্লেখ করতে চাই। তার আগে বাল্যশিক্ষায় পড়া একটা নীতিকথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে মনে করি। আমরা শিখেছিলাম, ওপরের দিকে (কথাটি ছিল বোধ হয় 'আকাশের দিকে'। আমি আকাশ না লিখে ওপর লিখলাম। কারণ সুযোগসন্ধানী বিদূষকের তো অভাব নেই। কেউ হয়তো বলে বসবেন ও, আপনি তাহলে অমুককে আকাশের মতো মনে করেন। ... ও মন খুলে লিখতে গেলেও যে কত রকম হ্যাপা!) 'থুতু ফেলিও না, ফেলিলে উহা ফিরিয়া আসিয়া নিজের মুখমণ্ডলেই পতিত হইবে।' ইদানীং দেখছি এ কাজটি এত বেশি করা হচ্ছে যে নীতিবাক্য লঙ্ঘনকারীদের মুখমণ্ডল তাঁদের নিজেদের নিষ্ঠীবনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
বলছিলাম আমার এক ধরনের বোধোদয়ের কথা। ওটা আর কিছু না, ওই নোবেল প্রাইজ নিয়েই। প্রফেসর ইউনূসের নোবেল পাওয়া যে কোনো ব্যাপারই নয়, তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে কেন যে এত অশান্তি সৃষ্টি করা হলো, এটা যে সম্পূর্ণ অপাত্রে দান হয়েছে- এসব কথা শুনতে শুনতে আমি রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেছি : নোবেল প্রাইজ সম্বন্ধে আমাদের আবাল্য লালিত ধারণা তা হলে ভুল। ওটা এমন কোনো বিরাট ব্যাপার নয়, ওটা নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। চাইলে যে কেউ এ পুরস্কার পেতে পারেন। আমি, তুমি, সে। আজ, কাল, পরশু। এমনকি রোজ!
এ রকম ধারণা সৃষ্টি যদি বছরদশেক আগে হতো তাহলে ইংল্যান্ডে আরেক বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে আমি খামকা 'ভুল' প্রস্তাব দিতাম না। ওই দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের সুবাদে প্রিন্স অব ওয়েলস যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারকয়েক দেখা হয়েছিল। প্রথমবার সেটা বোধ হয় ২০০৪ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উক্তি : ও, আপনি বাংলাদেশের হাইকমিশনার? তা আমার বন্ধু প্রফেসর ইউনূসের কী খবর? (হাউ ইজ মাই গুড ফ্রেন্ড প্রফেসর ইউনূস?) এরপর পরবর্তী বছর দুয়েক আরো চার-পাঁচবার সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর সঙ্গে এবং প্রতিবারই তিনি প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তাঁর মুখে যেন কানু বিনে আর গীত নেই।
প্রিন্স চার্লস ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু জনসেবামূলক কাজ করে থাকেন। এর সবটারই লক্ষ্য সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের কল্যাণ সাধন। একবার তিনি কথায় কথায় আমাকে জানালেন, প্রফেসর ইউনূসের মডেল অনুসরণ করে তিনিও সামান্য কিছু কাজ করছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস গেল বেড়ে; আমি বেমক্কা বলে বসলাম, অথচ দেখুন, আপনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং আরো অনেক গুণগ্রাহী খ্যাতিমান ব্যক্তির সমর্থন থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি প্রফেসর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন না, যদিও আমি শুনেছি গত কয়েক বছর যাবৎ তাঁর নাম নোবেলের জন্য প্রস্তাবিত হয়ে আসছে। প্রিন্স চার্লস একে তো জাতে ব্রিটিশ, তারপর আবার ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ। আমার কথা শুনে কৌশলে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেলেন। মুখে শুধু বললেন, দ্যাটস ভেরি আনফরচুনেট (এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক)।
অবশেষে না পেরে ২০০৫ সালের জুলাইয়ের ২০ তারিখ আমি একটা চিঠিই লিখে বসলাম তাঁকে বিসমিল্লাহ বলে। সেই নাতিদীর্ঘ-নাতিহ্রস্ব পত্রে আমার প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলাম এবং এও উল্লেখ করলাম, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে, এমনকি অনেক উন্নত দেশেও দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের এই মডেল সাফল্যের সঙ্গে অনুসরণ করা হচ্ছে। যুবরাজের দপ্তর থেকে যথাসময়ে একটি ধনাত্মক জবাব পাওয়া গেল পত্রটির। এরপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রফেসর ইউনূস নোবেল পেলেন এবং ১৪ কোটি বাংলাদেশির মস্তক অভ্রংলেহী উচ্চতায় উন্নীত হলো। অবশ্য প্রিন্স চার্লসকে আমি চিঠি লেখাতেই যে তিনি পুরস্কারটি পেলেন, অন্যথায় পেতেন না, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই; এমনটি মনে করাও পাপ।
তবে হ্যাঁ, বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করা ওই ঘটনায় সেদিন সারা দেশ এবং দেশের কোটি কোটি মানুষ আনন্দে-গর্বে মেতে উঠেছিল, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অত সুখ আমাদের কপালে সইবে কেন? আমাদের অনেকেই উঠেপড়ে লাগলেন ছিদ্র খুঁজে বের করতে। বাংলা ভাষায় এদের জন্যই অভিধানে একটি কঠিন ও দন্তভঙ্গুর শব্দ সংযোজিত হয়ে আছে। শব্দটি হচ্ছে পরশ্ছিদ্রান্বেষণকারী। এর জ্ঞাতি ভাই পরশ্রীকাতরতা (আরেক ভাই পরস্ত্রীকাতরতা)। বাংলাদেশে এদের দাপট বিশাল।
লন্ডনে থাকতে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রফেসর ইউনূসকে তাঁদের দেশে আমন্ত্রণ জানানোর আন্তরিক অভিলাষ ব্যক্ত করতেন। তাঁদের অনুরোধে আমি ইউনূস সাহেবের কাছে চিঠি লিখলে প্রায়ই জবাব আসত : আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আগামী দুই বছর আমার পূর্বনির্ধারিত বিদেশ সফরের কর্মসূচির নির্ঘণ্টের ঠাসবুনুনির জন্য আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারছি না বলে দুঃখিত।
এহেন প্রফেসর ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, স্বীকৃতি ও অবস্থানকে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে নানা ফোরামে কাজে না লাগিয়ে আমরা কি না চললাম উল্টো পথে। দেশে একটা কথা আছে : নিজের ভালো কানাও বোঝে, বোঝে না শুধু পাগল আর আহা...।
৩
আর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ? তাঁর 'পাগলামি' (!) দেখেও অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল। কেন বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর দশজন যেমন লাইসেন্স-পারমিট, বাস-লঞ্চ-টিভি চ্যানেলের মালিকানা, রাজনীতি-রাজদুর্নীতি ইত্যাদিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে আঙুল ফুলে কলাগাছ-বটগাছ হচ্ছে, সেপথে না গিয়ে দেশ থেকে অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোকিত করার এই 'হর্স ডিজিজে' (ঘোড়ারোগ) ধরল কেন? জানো না, আলো মানে আগুন, আর তুমি সেই আগুন নিয়ে খেলা করছ? তা ছাড়া দেশের বনজঙ্গল, খানা-খন্দ, ঝোপঝাড়, আদাড়বাদাড় থেকে না হয় আঁধার দূর করলে, কিন্তু মাস্টার সাহেব, কিছু মানুষের মনের অন্ধকার দূর করবে কিভাবে? খালি বড় বড় কথা বলো, দাঁড়াও, একবার পেয়ে নিই তোমাকে, এমন প্যাঁদানি দেব না তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। হাউ মাচ প্যাডি, হাউ মাচ রাইস?
যা হোক, শেষ পর্যন্ত মাননীয় স্পিকার-ডেপুটি স্পিকারের বিজ্ঞজনোচিত হস্তক্ষেপে অধ্যাপক সায়ীদ এবং সেই সঙ্গে জাতি- এ যাত্রা আরেকটি কলঙ্কের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। তা না হলে বিশ্ববাসী শুধু দুয়োই দিত না, বলত বাঙালি জাতির সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এরা তাদের দুর্লভ প্রাপ্তিগুলোকে কত সহজেই না তাচ্ছিল্যভরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে মাননীয় স্পিকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ ও সংসদের কার্যবিরবণী থেকে আপত্তিকর বক্তব্যগুলো ছেঁটে ফেলায় অধ্যাপক সায়ীদ সাহেব নিশ্চয়ই পরিতোষ লাভ করেছেন। কিন্তু কথায় আছে, ঘা শুকায়, আঘাত শুকায় না। ভরসা এটুকু যে সায়ীদ সাহেবের মতো মানুষেরা জানেন কী করে পাঁকের ভেতর পাঁকাল মাছ হয়ে থাকতে হয়।
রীতিমতো দুশ্চিন্তায় আছি আমি মুসা ইব্রাহিম-মুহিত-নিশাত-নাজরিনদের নিয়ে। যে এভারেস্ট বিজয় সব দেশের, সব কালের মানুষের একটা বিশাল স্বপ্নের ব্যাপার, সেই এভারেস্টের চূড়া থেকে তাদেরও না ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায় কেউ কেউ। তবে এদের বেলায় কাজটি খুব সহজ হবে না। তারা আমাদের মতো ননির পুতুল নয়, তারা এ প্রজন্মের বাংলাদেশি পোলা/আগুনের গোলা। আমাদের মাইয়ারাও যে আগুনের গোলা তা তো সারা দুনিয়া দেখল। তাদের ছুঁতে গেলে হাত পুড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।
৪
প্রমথ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম, এক ভিল রমণী জঙ্গলে খড়কুটো, ফল-ফলারি কুড়াতে কুড়াতে পেয়ে গেল একটি মুক্তা। ওটা বদরি ফল (কুল) নয় দেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি বিশ্বাস করতে চাই না ইউনূস-সায়ীদ-মোজাফ্ফরদের ভাগ্য ওই ধরনের কোনো 'ফিলিস্টিনদের' দ্বারাই নির্ধারিত হতে থাকবে। যে দেশে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আলোকিত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যায়; যে দেশে সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ সমাজপতিদের আকাল চিরকালের, সেই দেশের যারা বয়সে নবীন, একটি হতদরিদ্র দেশকে কাঁধে করে জীবনে যাদের পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ, সেই আশি শতাংশ নাগরিক কি তাহলে শুধু কালো টাকার মালিক মাসলম্যানদেরই তাদের 'রোল মডেল' হিসেবে মাথায় তুলে রাখবে যুগ যুগ ধরে? হারিকেন জ্বেলে খুঁজে বের করা সৎ মানুষেরা কি গেঁয়ো যোগী বলে এক মুঠো ভিখ্ও পাবে না এ দেশে?
বিধাতা এই দুষ্কালে এ জাতিকে রক্ষা করুন।
১১.০৬.২০১২
প্রশ্ন হলো, শুরুতেই এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটিকে আমি ভাগ্যবান বললাম কেন। বললাম এ জন্য যে বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি সর্বজনশ্রদ্ধেয়, কৃতবিদ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও দুর্লভ মেধার অধিকারী মানুষের এখন বড়ই দুঃসময় যাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের অর্জন দ্বারা বাংলাদেশের মুখ যতই উজ্জ্বল করুন না কেন, এক শ্রেণীর মানুষ যেন কসম খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁদের চরিত্র হনন করতে। তাঁদের সাফল্যে তাঁদের মধ্যে সম্পূর্ণ বোধাতীত কারণে এক ধরনের জ্বলুনি-পুড়ুনি সৃষ্টি হয় এবং তারই বহিঃপ্রকাশ তাঁরা ঘটান যত্রতত্র। তাঁদের অর্জনকে কী করে খাটো করে দেখানো যায়, কী করে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে এভারেস্টের চূড়া থেকে কেবল 'বেইস ক্যাম্পে'ই নয়, কাঠমাণ্ডু শহরের পশুপতিনাথের সামনের পচা নর্দমায় ফেলে মুখে ছাইভস্ম লেপে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টায় পরশ্রীকাতর লোকগুলো নিজেদের রাতের ঘুম ও দিনের আরাম হারাম করে তরবারি চালাচ্ছেন প্রাণপণে। তাঁরা আবার আমাদের সমাজের কেষ্ট-বিষ্টু, তাঁদের হুংকারে দশ দিগন্ত প্রকম্পিত। তাঁদের কথায় দিন হয় রাত, রাত হয় দিন। তাঁদের অনেকের কথাই আবার 'আইন'।
সাম্প্র্রতিককালে এই যে মানি লোকের, গুণী লোকের মুখে চুনকালি লাগানোর সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত অবারিত অপচেষ্টা, এটা দেখে মনে হয়, যেসব বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই অনগ্রসর দরিদ্র দেশটির সুসন্তানদের তাঁদের দুর্লভ কৃতিত্বের জন্য স্বীকৃতি দিল তাদের এই বলে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে : ওহে বিশ্বসভার সদস্যরা, তোমরা ভুল মানুষকে বাছাই করেছ। আরে, ওর কোনো যোগ্যতা আছে নাকি? ওকে তোমরা আর কতটুকু চেন? ও আমাদের ঘরের লোক, ওকে তোমাদের চেয়ে আমরা এক শ গুণ বেশি চিনি। ও তো একটা এক নম্বরের দুই নম্বরি লোক। আর স্বীকৃতি যদি দিতেই হয়, তবে তোমরা তোমাদের চোখের মাথা খেয়েছ নাকি, আমাদের অমুককে কি তোমাদের চোখে পড়ে না? যতসব 'রাবিশ'!
ব্যস, ঘরে-বাইরে উঠতে-বসতে শুরু হয়ে গেল একজন পূজনীয় ব্যক্তির ওপর কটু-কাটব্যের শিলাবৃষ্টি। আর অন্যের চরিত্র-হননের এই ভয়ংকর খেলায় একবার মেতে উঠলে বোধ হয় হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে দা দিয়ে পানিতে কোপ দিলে সে কোপ যে নিজের হাঁটুতে এসে পড়তে পারে তা আর মনে থাকে না। নইলে গুরুমহাশয় যখন তাঁর শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে দুর্নীতি কাকে বলে উদাহরণসহ বোঝাতে চাইলেন, আমরা কেন শুনব তিনি আসলে বলেছেন : 'ঠাকুরঘরে কে রে?' অমনি আমরা সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম : আমি (নাকি আমরা?) কলা খাই না। প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের কাছে নাকি শিক্ষক মহোদয়ের পুরো বক্তব্যটি রেকর্ড করা আছে। ওই প্রতিবেদন পাঠ করে আমাদের পাড়ার কাউলা আর জাউলা চিক্কুর দিয়ে উঠল : খাইছে আমারে। এইটা তো দেহি মনের মইধ্যে পুলিশ পুলিশ অবস্থা। সে যাই হোক, ঘটনাটি না জেনে, না শুনে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে সংসদীয় ধোলাই দেওয়ায় লাভ এটাই হলো, আমজনতা 'যা বুঝনের বুইঝ্যা গেল।' হায়!
শ্রদ্ধেয় মানুষের চরিত্রের এই 'সিরিয়াল-কিলিংয়ের'কালে আমার পরম শ্রদ্ধেয় পরিবেশবাদী শিক্ষাগুরু (সরাসরি নন যদিও) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শিরোপরি খৰাঘাত নেমে এসে বেইজ্জত হওয়ার আগে বা-ইজ্জত এই পঙ্কিলময় পরিবেশ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। ... এ জন্যই শুরুতে বলেছিলাম, তিনি এদিক দিয়ে ভাগ্যবান। নইলে কে জানে ড. ইউনূস, অধ্যাপক আবু সায়ীদের পর এই মহৎপ্রাণ মানুষটির নামটি হয়তো চলে আসত। তাঁর অপরাধ? অপরাধ, তিনি বড় অপ্রিয় সত্য কথা চাঁচা-ছোলাভাবে বলেন, কাউকে খুশি করার জন্য বা কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলেন না।
স্যারের কাছাকাছি থেকে একবার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেটা ১৯৭০-এর দশকের শেষাধর্ে্ব। তিনি তখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় উপদেষ্টা। অর্থাৎ মন্ত্রী। একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ওই সময়ে সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত নিবন্ধক। স্যার একদিন আমাকে ফোন করে তাঁতশিল্প সংক্রান্ত একটা বিষয়ের ওপর রিপোর্ট চাইলেন। আমি ওই দিনই রিপোর্টটি একজন অফিসারের মারফত পাঠিয়ে দিলাম তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের কাছে। ওটা পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনই ফোন করলেন তিনি। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। ফোনে আলোচনা করে তিনি বললেন, মোফাজ্জল করিম, আপনার রিপোর্টে আপনি টাঙ্গাইল জেলার তাঁতসমৃদ্ধ পাতরাইল এলাকার কথা উল্লেখ করেছেন। চলুন না, আমরা এলাকাটি একটু ঘুরে আসি। তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কাজকর্ম সরেজমিনে গিয়ে দেখে তারপর দেখা যাবে কী করতে পারি আমরা। ওই দিনই বেলা ২টার দিকে পাতরাইল রওনা হলাম তাঁর সঙ্গে। শুধু তিনি আর আমি। নো পুলিশ, নো বডিগার্ড, নো স্টাফ। সেদিন তাঁর মধ্যে যে আন্তরিকতা, অনুসন্ধিৎসা ও দেশপ্রেম দেখেছিলাম তা কোনো দিন ভুলিনি। ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সবুজ ঘাসের জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে নিলেন স্যার। তিনি খুবই ধার্মিক লোক ছিলেন, তবে ধর্ম নিয়ে কোনো রকম ভড়ং বা বাড়াবাড়ি ছিল না তাঁর মধ্যে, কোনো রকম গোঁড়ামিও ছিল না।
তিনি চলে গেছেন। অনেকের মতো আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি তাঁর মতো একজন জাতীয় অভিভাবককে হারিয়ে। তবে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, কোনো রকম মানহানিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়নি এই দুষ্কালে।
২
ড. ইউনূসের অর্জন-অনার্জন ও এতদসংক্রান্ত সাম্প্রতিককালের তর্জন-গর্জন সম্বন্ধে কোনো কিছু বলার মতো যোগ্যতা বা অভিপ্রায় আমার নেই। সে কথা অকপটে স্বীকার করে আমার ইদানীংকালের একটি বোধোদয়ের উল্লেখ করতে চাই। তার আগে বাল্যশিক্ষায় পড়া একটা নীতিকথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে মনে করি। আমরা শিখেছিলাম, ওপরের দিকে (কথাটি ছিল বোধ হয় 'আকাশের দিকে'। আমি আকাশ না লিখে ওপর লিখলাম। কারণ সুযোগসন্ধানী বিদূষকের তো অভাব নেই। কেউ হয়তো বলে বসবেন ও, আপনি তাহলে অমুককে আকাশের মতো মনে করেন। ... ও মন খুলে লিখতে গেলেও যে কত রকম হ্যাপা!) 'থুতু ফেলিও না, ফেলিলে উহা ফিরিয়া আসিয়া নিজের মুখমণ্ডলেই পতিত হইবে।' ইদানীং দেখছি এ কাজটি এত বেশি করা হচ্ছে যে নীতিবাক্য লঙ্ঘনকারীদের মুখমণ্ডল তাঁদের নিজেদের নিষ্ঠীবনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
বলছিলাম আমার এক ধরনের বোধোদয়ের কথা। ওটা আর কিছু না, ওই নোবেল প্রাইজ নিয়েই। প্রফেসর ইউনূসের নোবেল পাওয়া যে কোনো ব্যাপারই নয়, তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে কেন যে এত অশান্তি সৃষ্টি করা হলো, এটা যে সম্পূর্ণ অপাত্রে দান হয়েছে- এসব কথা শুনতে শুনতে আমি রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেছি : নোবেল প্রাইজ সম্বন্ধে আমাদের আবাল্য লালিত ধারণা তা হলে ভুল। ওটা এমন কোনো বিরাট ব্যাপার নয়, ওটা নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। চাইলে যে কেউ এ পুরস্কার পেতে পারেন। আমি, তুমি, সে। আজ, কাল, পরশু। এমনকি রোজ!
এ রকম ধারণা সৃষ্টি যদি বছরদশেক আগে হতো তাহলে ইংল্যান্ডে আরেক বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে আমি খামকা 'ভুল' প্রস্তাব দিতাম না। ওই দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের সুবাদে প্রিন্স অব ওয়েলস যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারকয়েক দেখা হয়েছিল। প্রথমবার সেটা বোধ হয় ২০০৪ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উক্তি : ও, আপনি বাংলাদেশের হাইকমিশনার? তা আমার বন্ধু প্রফেসর ইউনূসের কী খবর? (হাউ ইজ মাই গুড ফ্রেন্ড প্রফেসর ইউনূস?) এরপর পরবর্তী বছর দুয়েক আরো চার-পাঁচবার সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর সঙ্গে এবং প্রতিবারই তিনি প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তাঁর মুখে যেন কানু বিনে আর গীত নেই।
প্রিন্স চার্লস ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু জনসেবামূলক কাজ করে থাকেন। এর সবটারই লক্ষ্য সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের কল্যাণ সাধন। একবার তিনি কথায় কথায় আমাকে জানালেন, প্রফেসর ইউনূসের মডেল অনুসরণ করে তিনিও সামান্য কিছু কাজ করছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস গেল বেড়ে; আমি বেমক্কা বলে বসলাম, অথচ দেখুন, আপনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং আরো অনেক গুণগ্রাহী খ্যাতিমান ব্যক্তির সমর্থন থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি প্রফেসর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন না, যদিও আমি শুনেছি গত কয়েক বছর যাবৎ তাঁর নাম নোবেলের জন্য প্রস্তাবিত হয়ে আসছে। প্রিন্স চার্লস একে তো জাতে ব্রিটিশ, তারপর আবার ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ। আমার কথা শুনে কৌশলে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেলেন। মুখে শুধু বললেন, দ্যাটস ভেরি আনফরচুনেট (এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক)।
অবশেষে না পেরে ২০০৫ সালের জুলাইয়ের ২০ তারিখ আমি একটা চিঠিই লিখে বসলাম তাঁকে বিসমিল্লাহ বলে। সেই নাতিদীর্ঘ-নাতিহ্রস্ব পত্রে আমার প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলাম এবং এও উল্লেখ করলাম, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে, এমনকি অনেক উন্নত দেশেও দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের এই মডেল সাফল্যের সঙ্গে অনুসরণ করা হচ্ছে। যুবরাজের দপ্তর থেকে যথাসময়ে একটি ধনাত্মক জবাব পাওয়া গেল পত্রটির। এরপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রফেসর ইউনূস নোবেল পেলেন এবং ১৪ কোটি বাংলাদেশির মস্তক অভ্রংলেহী উচ্চতায় উন্নীত হলো। অবশ্য প্রিন্স চার্লসকে আমি চিঠি লেখাতেই যে তিনি পুরস্কারটি পেলেন, অন্যথায় পেতেন না, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই; এমনটি মনে করাও পাপ।
তবে হ্যাঁ, বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করা ওই ঘটনায় সেদিন সারা দেশ এবং দেশের কোটি কোটি মানুষ আনন্দে-গর্বে মেতে উঠেছিল, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অত সুখ আমাদের কপালে সইবে কেন? আমাদের অনেকেই উঠেপড়ে লাগলেন ছিদ্র খুঁজে বের করতে। বাংলা ভাষায় এদের জন্যই অভিধানে একটি কঠিন ও দন্তভঙ্গুর শব্দ সংযোজিত হয়ে আছে। শব্দটি হচ্ছে পরশ্ছিদ্রান্বেষণকারী। এর জ্ঞাতি ভাই পরশ্রীকাতরতা (আরেক ভাই পরস্ত্রীকাতরতা)। বাংলাদেশে এদের দাপট বিশাল।
লন্ডনে থাকতে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রফেসর ইউনূসকে তাঁদের দেশে আমন্ত্রণ জানানোর আন্তরিক অভিলাষ ব্যক্ত করতেন। তাঁদের অনুরোধে আমি ইউনূস সাহেবের কাছে চিঠি লিখলে প্রায়ই জবাব আসত : আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আগামী দুই বছর আমার পূর্বনির্ধারিত বিদেশ সফরের কর্মসূচির নির্ঘণ্টের ঠাসবুনুনির জন্য আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারছি না বলে দুঃখিত।
এহেন প্রফেসর ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, স্বীকৃতি ও অবস্থানকে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে নানা ফোরামে কাজে না লাগিয়ে আমরা কি না চললাম উল্টো পথে। দেশে একটা কথা আছে : নিজের ভালো কানাও বোঝে, বোঝে না শুধু পাগল আর আহা...।
৩
আর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ? তাঁর 'পাগলামি' (!) দেখেও অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল। কেন বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর দশজন যেমন লাইসেন্স-পারমিট, বাস-লঞ্চ-টিভি চ্যানেলের মালিকানা, রাজনীতি-রাজদুর্নীতি ইত্যাদিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে আঙুল ফুলে কলাগাছ-বটগাছ হচ্ছে, সেপথে না গিয়ে দেশ থেকে অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোকিত করার এই 'হর্স ডিজিজে' (ঘোড়ারোগ) ধরল কেন? জানো না, আলো মানে আগুন, আর তুমি সেই আগুন নিয়ে খেলা করছ? তা ছাড়া দেশের বনজঙ্গল, খানা-খন্দ, ঝোপঝাড়, আদাড়বাদাড় থেকে না হয় আঁধার দূর করলে, কিন্তু মাস্টার সাহেব, কিছু মানুষের মনের অন্ধকার দূর করবে কিভাবে? খালি বড় বড় কথা বলো, দাঁড়াও, একবার পেয়ে নিই তোমাকে, এমন প্যাঁদানি দেব না তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। হাউ মাচ প্যাডি, হাউ মাচ রাইস?
যা হোক, শেষ পর্যন্ত মাননীয় স্পিকার-ডেপুটি স্পিকারের বিজ্ঞজনোচিত হস্তক্ষেপে অধ্যাপক সায়ীদ এবং সেই সঙ্গে জাতি- এ যাত্রা আরেকটি কলঙ্কের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। তা না হলে বিশ্ববাসী শুধু দুয়োই দিত না, বলত বাঙালি জাতির সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এরা তাদের দুর্লভ প্রাপ্তিগুলোকে কত সহজেই না তাচ্ছিল্যভরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে মাননীয় স্পিকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ ও সংসদের কার্যবিরবণী থেকে আপত্তিকর বক্তব্যগুলো ছেঁটে ফেলায় অধ্যাপক সায়ীদ সাহেব নিশ্চয়ই পরিতোষ লাভ করেছেন। কিন্তু কথায় আছে, ঘা শুকায়, আঘাত শুকায় না। ভরসা এটুকু যে সায়ীদ সাহেবের মতো মানুষেরা জানেন কী করে পাঁকের ভেতর পাঁকাল মাছ হয়ে থাকতে হয়।
রীতিমতো দুশ্চিন্তায় আছি আমি মুসা ইব্রাহিম-মুহিত-নিশাত-নাজরিনদের নিয়ে। যে এভারেস্ট বিজয় সব দেশের, সব কালের মানুষের একটা বিশাল স্বপ্নের ব্যাপার, সেই এভারেস্টের চূড়া থেকে তাদেরও না ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায় কেউ কেউ। তবে এদের বেলায় কাজটি খুব সহজ হবে না। তারা আমাদের মতো ননির পুতুল নয়, তারা এ প্রজন্মের বাংলাদেশি পোলা/আগুনের গোলা। আমাদের মাইয়ারাও যে আগুনের গোলা তা তো সারা দুনিয়া দেখল। তাদের ছুঁতে গেলে হাত পুড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।
৪
প্রমথ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম, এক ভিল রমণী জঙ্গলে খড়কুটো, ফল-ফলারি কুড়াতে কুড়াতে পেয়ে গেল একটি মুক্তা। ওটা বদরি ফল (কুল) নয় দেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি বিশ্বাস করতে চাই না ইউনূস-সায়ীদ-মোজাফ্ফরদের ভাগ্য ওই ধরনের কোনো 'ফিলিস্টিনদের' দ্বারাই নির্ধারিত হতে থাকবে। যে দেশে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আলোকিত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যায়; যে দেশে সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ সমাজপতিদের আকাল চিরকালের, সেই দেশের যারা বয়সে নবীন, একটি হতদরিদ্র দেশকে কাঁধে করে জীবনে যাদের পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ, সেই আশি শতাংশ নাগরিক কি তাহলে শুধু কালো টাকার মালিক মাসলম্যানদেরই তাদের 'রোল মডেল' হিসেবে মাথায় তুলে রাখবে যুগ যুগ ধরে? হারিকেন জ্বেলে খুঁজে বের করা সৎ মানুষেরা কি গেঁয়ো যোগী বলে এক মুঠো ভিখ্ও পাবে না এ দেশে?
বিধাতা এই দুষ্কালে এ জাতিকে রক্ষা করুন।
১১.০৬.২০১২
No comments