চারদিক-ডলুছড়ার শান্ত পল্লি by আকমল হোসেন
পাহাড়ি, লালচে মাটির পথ। একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠে গেছে। টিলার ওপরে উঠে পথ এদিকে-ওদিকে ছুটেছে। পথের দুই পাশে মাটির দেয়াল তোলা ছোটবড় ঘর। যতই সামনে এগিয়ে যাই, কেমন শান্ত আর কোলাহলহীন পরিবেশ। মানুষ আছে, অকারণ হইচই নেই। এটি একটি আদিবাসী গ্রাম।
টিপরা বা ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর লোকজন এই গ্রামটিতে বাস করে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রাচীন এই গ্রামটির নাম ডলুছড়া ত্রিপুরা পল্লি।
সঙ্গে ত্রিপুরা যুবক সনজিত দেব বর্মণ। গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কয়েকটি শিশু একটি দোকানের সামনে ক্যারম খেলছে। অন্য শিশুরাও নিজেদের মতো ছোটাছুটি করছে। সেদিন স্কুল বন্ধ, তাই সারা দিন ছুটি। গ্রামটির ভেতর বাড়িগুলো পরিপাটি। ডলুছড়ায় (ডলুবাড়ি) অনেক দিন পর চোখে পড়ল ছনের চাল। প্রাকৃতিক শীতাতপ ব্যবস্থা। আজকাল দুর্লভ ও দামি হওয়ায় ছন দিয়ে ছাউনি দেওয়ার সুযোগ কম।
সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, ডলুছড়ায় ৭৫টি ত্রিপুরা পরিবার আছে। তাদের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে লেবু চাষ। প্রায় ১২ মাসই কমবেশি লেবু ফলে। লেবু বিক্রি করেই জীবিকা চলে। তবে মৌসুমি ফল আনারস ও কাঁঠালও আয়ের একটি উৎস তাদের। ডলুছড়া গ্রামের সমতলে ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি থাকায় আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যা অর্জনের কাজটি সেরে নিতে সহজ হয়েছে। তবে উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজ বেশ দূরে। ডলুছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল সদরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। এতটা পথ পাড়ি দেওয়া অনেক আদিবাসী শিশুর পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, এই গ্রামের ১০-১২ জন কলেজে ও ৩০ জনের মতো হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। আসা-যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ সমস্যা; বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে বেশ কঠিনই।
সমস্যা আরও একটা আছে। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের একটি ভাষা আছে। সেই ভাষার নাম ‘ককবরক’। ত্রিপুরা আদিবাসী তরুণী মল্লিকা দেব বর্মণ বললেন, ‘ককবরকে কথা বলি, কিন্তু অক্ষর চিনি না। লিখতে পারি না। তবে জানার আগ্রহ আছে।’ এই জানার আগ্রহ আরও অনেকেরই। কিন্তু সেই সুযোগটি তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁরা জানেনও না কীভাবে নিজেদের ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন। মল্লিকা দেব বর্মণ একটি ব্র্যাক স্কুলে শিশুদের পড়ান। সেই স্কুলেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। নিজেদের ভাষা নিয়ে এ অবস্থা ডলুছড়ার লেখাপড়া জানা না-জানা প্রায় সবার। নিজেদের ভাষাটি এভাবে হয়তো একদিন তাঁরা হারিয়ে ফেলবেন। এই তরুণ-তরুণীরা জানালেন, ‘গড়িয়া’ নামে তাঁদের একটি নিজস্ব পূজা আছে। শুধু বাঁশ দিয়ে বাংলা বছরের শুরুতে এই পূজা হয়ে থাকে। এই পূজায় মূর্তি নির্মাণ থেকে শুরু করে সব কাজ সম্পন্ন করা হয় বাঁশের তৈরি উপকরণ দিয়ে।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলল ‘ত্রিপুরা হস্তশিল্পকেন্দ্র’ নামে একটি দোকানের। দোকানে কেউ নেই। মনে হলো, কেউ না থাকলেও নিরাপদেই আছে দোকানটি। সনজিত দেব বর্মণ নিজেই দোকানটি খুলে দেখালেন। ত্রিপুরাদের নিজেদের তৈরি তাঁতের বস্ত্র রাখা আছে এখানে। নানা রকমের গামছা, ঝোলা ইত্যাদি দোকানের দড়িতে ঝুলছে। এই দোকানের কাপড় নিজেরাই নিজেদের তাঁতে তৈরি করেন। তার বড় ক্রেতাও নিজেরাই। ডলুছড়ার ডলুবাড়ির পুরো গ্রামটিতে কেমন বিন্যস্ত এক জীবনপদ্ধতি। কোথাও উচ্চস্বর নেই, যন্ত্র-দুনিয়ার কোলাহল নেই। সবাই সবার মতো চলছে, ঘর-সংসারের কাজ করছে। কেউ বা লেবুবাগানে, কেউ বাড়ি ফিরছে, কেউ অবসর সময় বসে কাটাচ্ছে। সনজিত দেব বর্মণ ডলুবাড়িতে একটি তাঁত কারখানার কথা জানালেন। সেটি দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে একটি ব্যানার। তাতে লেখা ‘আমাদের তাঁত ঘর’ এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নারী উদ্যোগ। তবে তখন তাঁতগুলো খালি পড়ে আছে। শুধু একজন বৃদ্ধ নারী আপন মনে একটি কোমর-তাঁতে কাপড় বুনে চলেছেন।
তাঁর নাম রেশমবতী বর্মা। বয়স ৬২ বছর। জানালেন, তিনি ‘রিচা’ (কোমরে পরার বস্ত্র) তৈরি করছেন। রেশমবতী বর্মা বললেন, ‘সংসারে আমার কেউ নাই। একলা মানুষ। ছেলেমেয়ে নাই। স্বামী নাই পাঁচ বছর।’ আরও জানালেন, মাসে চারটার মতো চাদর তৈরি করতে পারেন। এ ছাড়া জুমে লেবুবাগানে কাজ করেন। এতে যা মেলে, তা দিয়ে নিজে নিজেই চলেন। এই বয়সে একলা আপন পায়ে দাঁড়িয়ে চলার এক নীরব সংগ্রাম চলছে রেশমবতী বর্মার। খোলা দুনিয়ার মেরেকেটে বা হাত পেতে খাওয়ার লোভ-লালসা তাঁর ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
ডলুবাড়ি থেকে নেমে ডলুছড়ার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পাকা পথে আসতেই দেখা সর্বানন্দ দেব বর্মার সঙ্গে। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। তিনি ডলুছড়ার ‘গ্রাম চৌধুরী’—গ্রামপ্রধান। গ্রামে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনিই মিটমাট করেন। তিনি জানালেন, এই ডলুছড়ার পত্তন হয়েছে প্রায় ৭০০ বছর হলো। আগে রাস্তা ছিল না। পুরোটাই জঙ্গল ছিল। বাঘ-ভালুক ছিল প্রতিবেশী। এখন এসব নেই। কিন্তু এখন যেটা আছে, শান্তি। গ্রাম চৌধুরী বললেন, ‘শান্তিতে আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ শান্তির যে কোনো বিকল্প নেই, তাঁর সরল-শান্ত চেহারাটি সেই সত্যকেই যেন প্রকাশ করছে।
সঙ্গে ত্রিপুরা যুবক সনজিত দেব বর্মণ। গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কয়েকটি শিশু একটি দোকানের সামনে ক্যারম খেলছে। অন্য শিশুরাও নিজেদের মতো ছোটাছুটি করছে। সেদিন স্কুল বন্ধ, তাই সারা দিন ছুটি। গ্রামটির ভেতর বাড়িগুলো পরিপাটি। ডলুছড়ায় (ডলুবাড়ি) অনেক দিন পর চোখে পড়ল ছনের চাল। প্রাকৃতিক শীতাতপ ব্যবস্থা। আজকাল দুর্লভ ও দামি হওয়ায় ছন দিয়ে ছাউনি দেওয়ার সুযোগ কম।
সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, ডলুছড়ায় ৭৫টি ত্রিপুরা পরিবার আছে। তাদের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে লেবু চাষ। প্রায় ১২ মাসই কমবেশি লেবু ফলে। লেবু বিক্রি করেই জীবিকা চলে। তবে মৌসুমি ফল আনারস ও কাঁঠালও আয়ের একটি উৎস তাদের। ডলুছড়া গ্রামের সমতলে ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি থাকায় আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যা অর্জনের কাজটি সেরে নিতে সহজ হয়েছে। তবে উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজ বেশ দূরে। ডলুছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল সদরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। এতটা পথ পাড়ি দেওয়া অনেক আদিবাসী শিশুর পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সনজিত দেব বর্মণ জানালেন, এই গ্রামের ১০-১২ জন কলেজে ও ৩০ জনের মতো হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। আসা-যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ সমস্যা; বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে বেশ কঠিনই।
সমস্যা আরও একটা আছে। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের একটি ভাষা আছে। সেই ভাষার নাম ‘ককবরক’। ত্রিপুরা আদিবাসী তরুণী মল্লিকা দেব বর্মণ বললেন, ‘ককবরকে কথা বলি, কিন্তু অক্ষর চিনি না। লিখতে পারি না। তবে জানার আগ্রহ আছে।’ এই জানার আগ্রহ আরও অনেকেরই। কিন্তু সেই সুযোগটি তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁরা জানেনও না কীভাবে নিজেদের ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন। মল্লিকা দেব বর্মণ একটি ব্র্যাক স্কুলে শিশুদের পড়ান। সেই স্কুলেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। নিজেদের ভাষা নিয়ে এ অবস্থা ডলুছড়ার লেখাপড়া জানা না-জানা প্রায় সবার। নিজেদের ভাষাটি এভাবে হয়তো একদিন তাঁরা হারিয়ে ফেলবেন। এই তরুণ-তরুণীরা জানালেন, ‘গড়িয়া’ নামে তাঁদের একটি নিজস্ব পূজা আছে। শুধু বাঁশ দিয়ে বাংলা বছরের শুরুতে এই পূজা হয়ে থাকে। এই পূজায় মূর্তি নির্মাণ থেকে শুরু করে সব কাজ সম্পন্ন করা হয় বাঁশের তৈরি উপকরণ দিয়ে।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলল ‘ত্রিপুরা হস্তশিল্পকেন্দ্র’ নামে একটি দোকানের। দোকানে কেউ নেই। মনে হলো, কেউ না থাকলেও নিরাপদেই আছে দোকানটি। সনজিত দেব বর্মণ নিজেই দোকানটি খুলে দেখালেন। ত্রিপুরাদের নিজেদের তৈরি তাঁতের বস্ত্র রাখা আছে এখানে। নানা রকমের গামছা, ঝোলা ইত্যাদি দোকানের দড়িতে ঝুলছে। এই দোকানের কাপড় নিজেরাই নিজেদের তাঁতে তৈরি করেন। তার বড় ক্রেতাও নিজেরাই। ডলুছড়ার ডলুবাড়ির পুরো গ্রামটিতে কেমন বিন্যস্ত এক জীবনপদ্ধতি। কোথাও উচ্চস্বর নেই, যন্ত্র-দুনিয়ার কোলাহল নেই। সবাই সবার মতো চলছে, ঘর-সংসারের কাজ করছে। কেউ বা লেবুবাগানে, কেউ বাড়ি ফিরছে, কেউ অবসর সময় বসে কাটাচ্ছে। সনজিত দেব বর্মণ ডলুবাড়িতে একটি তাঁত কারখানার কথা জানালেন। সেটি দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে একটি ব্যানার। তাতে লেখা ‘আমাদের তাঁত ঘর’ এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নারী উদ্যোগ। তবে তখন তাঁতগুলো খালি পড়ে আছে। শুধু একজন বৃদ্ধ নারী আপন মনে একটি কোমর-তাঁতে কাপড় বুনে চলেছেন।
তাঁর নাম রেশমবতী বর্মা। বয়স ৬২ বছর। জানালেন, তিনি ‘রিচা’ (কোমরে পরার বস্ত্র) তৈরি করছেন। রেশমবতী বর্মা বললেন, ‘সংসারে আমার কেউ নাই। একলা মানুষ। ছেলেমেয়ে নাই। স্বামী নাই পাঁচ বছর।’ আরও জানালেন, মাসে চারটার মতো চাদর তৈরি করতে পারেন। এ ছাড়া জুমে লেবুবাগানে কাজ করেন। এতে যা মেলে, তা দিয়ে নিজে নিজেই চলেন। এই বয়সে একলা আপন পায়ে দাঁড়িয়ে চলার এক নীরব সংগ্রাম চলছে রেশমবতী বর্মার। খোলা দুনিয়ার মেরেকেটে বা হাত পেতে খাওয়ার লোভ-লালসা তাঁর ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
ডলুবাড়ি থেকে নেমে ডলুছড়ার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পাকা পথে আসতেই দেখা সর্বানন্দ দেব বর্মার সঙ্গে। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। তিনি ডলুছড়ার ‘গ্রাম চৌধুরী’—গ্রামপ্রধান। গ্রামে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনিই মিটমাট করেন। তিনি জানালেন, এই ডলুছড়ার পত্তন হয়েছে প্রায় ৭০০ বছর হলো। আগে রাস্তা ছিল না। পুরোটাই জঙ্গল ছিল। বাঘ-ভালুক ছিল প্রতিবেশী। এখন এসব নেই। কিন্তু এখন যেটা আছে, শান্তি। গ্রাম চৌধুরী বললেন, ‘শান্তিতে আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ শান্তির যে কোনো বিকল্প নেই, তাঁর সরল-শান্ত চেহারাটি সেই সত্যকেই যেন প্রকাশ করছে।
No comments